রঙ-বেরঙি জীবন
মৌসুমী ভট্টাচার্য্য
হেমন্তকালটা আমার কেন জানি ভারী প্রিয়।বিশেষ করে বিকেলটা।কুয়াশার একটা পাতলা চাদর হাওয়ায় ভাসতে থাকে বিকেল থেকে।ভারতের এই পূর্বপ্রান্তে পাঁচটা না বাজতেই অন্ধকার নেমে আসে।গোধূলি লগ্নে ছাতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে ভারি ভাল লাগে।নীল আকাশ,নির্মেঘ। ছাদের টব গুলিতে শীতের মরসুমি ফুলের চারা লাগাই।স্কুল থেকে ফিরে একটু যে বাগানের তদারকি করব, তার উপায় নেই, অন্ধকার, কুয়াশা, মশা সব বাদ সাধে।পাখি গুলো ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায়, বোধহয় বাড়ি ফিরে।দাঁড়িয়ে থাকেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ভয়ংকর সাইনাস এর সমস্যা, এ সময় বেড়ে যায়।বিকেল থেকে মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়।ঘরে ঢুকেই এক কাপ দার্জিলিং চা তারিয়ে তারিয়ে পান করি আর সন্ধ্যার এই রূপটা এঞ্জয় করি।আজও ছাতে দাঁড়িয়ে আছি, সামনের গলির দিকে চোখ গেল।সেই মহিলাটি, দুই বাচ্চা সাথে নিয়ে যাচ্ছে।গলার নীচ থেকে পেট পর্যন্ত বীভৎস পোড়া দাগ। আশে পাশের কোনো বাড়িতে ঠিকে ঝি-এর কাজ করে।বাচ্চা দুটির একটি বছর সাতেকর মেয়ে, অন্যটি ছেলে, বছর আড়াই তিন হবে। পাশেই কয়েক ঘর নিয়ে ছোটো বস্তি, তাতেই মহিলা থাকে।ঘরে ঢুকেই মেয়েটি বাসন নিয়ে কলতলায় যায়।ছোটো ছোটো হাতে বাসন মাজছে আর মাঝে মাঝে হাত ঘুরিয়ে মশা তাড়াচ্ছে। এতটুকু বয়স থেকে দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করতে নেমে পরেছে। দেখে এতো মায়া লাগলো!এই বয়সী অন্য বাচ্চারা, যারা স্বচ্ছল পরিবারে জন্মেছে,কি আদরেই না থাকে। মা বাবারা বাচ্চার বায়না মেটাতে কি না করে!আকাশের চাঁদই এনে দেবে না কি দিয়ে ধন্য হবে, বুজে উঠতে পারে না।আবার এগুলো নিয়ে আহ্লাদী গলায় মায়েরা বর্ণনা দেয়, যে গা রি রি করে।আমার ছেলে নিয়ে এসব আদিখ্যেতা কোনদিনও করি নি।
মেয়েটি বাসন ধোয়া হয়ে গেলে ঘরে ফিরছে, যতই সাবধানে পা ফেলুক, পিছল কলতলায় আছড়ে পড়েছে বাসন নিয়ে।ব্যথা পেয়েছে, কেঁদে উঠল।ঘর থেকে মা বেরিয়ে এসে দু’ ঘা বসিয়ে দিল। “একটা কাজ ও ঠিকমতো করতে পারিস না”, বোধকরি এ রকম বলে থাকবে।বাসন কুড়িয়ে দুমদাম পা ফেলে ঘরে চলে গেল। মেয়েটিকে তুলল না।ভারি খারাপ লাগল দৃশ্যটা।মেয়ে বলেই কি এত অবহেলা।
একটু পরেই চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালো, আমার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। হাত দিয়ে ডাকলাম।গেটের কাছে আসলো, নাগাল পাচ্ছে না, খুলে দিলাম। চোখের জল শুকোয় নি, কালো, ভারি মিষ্টি মুখ, পান পাতার মত।ভাসা ভাসা চোখ। ডান হাতের কনুইটা ছড়ে গিয়ে দগদগে হয়ে গেছে। বিন্দু বিন্দু রক্ত জমাট হয়ে আছে।আমি তুলোতে ডেটল লাগিয়ে নিয়ে এলাম,“এসো,লাগিয়ে দি,’ মেয়েটি ভীত চোখে হাত পেছনে নিয়ে পেছিয়ে গেল।“এস, ভয় নেই, ঘা হয়ে যাবে, পরে ইঞ্জেকশান লাগবে”। ভারি সন্দিগ্ধ চোখে আমায় দেখে বলল, “ জ্বলবে তো!” “না, জ্বলবে না, পেয়ারা দেব’,বলে কাছে গিয়ে জোর করে ডেটল লাগিয়ে দিলাম। মুখ বিকৃত করে, চোখ বন্ধ করে রইল।আমি পেয়ারা নিয়ে এসে বললাম, ‘চোখ খোল, পেয়ারা খাও। নাম কি তোমার?” চোখ খুলে হাতটা দেখল। না, যতো ভয় পাচ্ছিল, এত জ্বলছে না, লোভী চোখে পেয়ারা দেখছে। ‘নাও’ বলার সাথে সাথে ছোঁ মেরে মেরে তুলে নিল, বলল, ‘যাই, আমার নাম সোনাই”। “ভারি সুন্দর নাম। পারবে একা যেতে,অন্ধকারে?’’ সোনাই মাথা নাড়ল,পারবে।
আমি টিভি খুলে বসলাম। নিজের ছোটবেলা মনে পড়ছে, আমিও বেশ অবহেলায় বড় হয়েছি। ছোটো বয়সেই অনেক দায়িত্ব দেয়া হতো, যা আমার বান্ধবীদের করতে হতো না।একটা নয়, দশ বছরের বালিকার কাছ থেকে অনেক বেশি আশা করা হতো। সোনাইকে দেখে মনে পড়ল, ভুরু কুঁচকে টিভি চ্যানেল ঘোরাচ্ছি, কিছু নেই দেখার মত। সব সিরিয়াল দেখতে পারি না, মানে যা দেখান হয়, মেনে নিতে পারি না, সব। মেয়েরা প্রতিবাদী হবে না, নীরবে অত্যাচারিত হতে থাকবে, সত্য গোপন করে জটিলতা বাড়িয়ে তুলবে, এসব মেনে নিতে কষ্ট হয়।
আমার স্বামী অফিস থেকে ফিরলেন, টিভির আওয়াজ কমিয়ে কিচেনে যাব,এমন সময় শিখা এল। আমি ওকে নিয়ে কিচেনে গেলাম।শিখা আমার প্রাক্তন ছাত্রী, বিধবা,তার জীবন সংঘর্ষে ভরা। ছোট খাটো কাজ করে মেয়েকে পড়াচ্ছে। আমার খুব মায়া লাগে ওর জন্য, ওর জীবন যুদ্ধে একটু সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দি, সাহায্য করি মাঝেমাঝে। বল্লাম,“তোর জন্য কিছু ব্লাউজ বানানোর কাজ আছে, চা এর সাথে কিছু খাবি?” ওর শুকনো মুখ দেখে মনে হল, দুপুরে খায় নি। লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়ল।ওকে দুধ মুড়ি কলা দিলাম।স্কুলের অন্য দিদিমনিদের কাছ থেকে চেয়ে সেলাই কাজ এনে দিই।কম্পুউটারের একটা কোর্স করাচ্ছি,আমিই ফীজ দিই।বাড়ির ভদ্রলোক চা খেতে খেতে টিভি দেখছেন,ভুরু কুঁচকে কোথাও উত্তপ্ত তর্ক চলছে কিনা দেখছেন। আমি শিখাকে গেট অব্দি এগিয়ে দিয়ে খাতা কলম নিয়ে বসলাম,একটা অসম্পূর্ণ গল্প শেষ করে কাল স্কুল যাবার পথে পত্রিকা অফিসে জমা দেব।এই সময় টাই আমার একান্ত।
🍂
পরদিন স্কুল যাবার পথে পত্রিকা অফিসে লেখাটা জমা দিয়ে রিক্শায় উঠব,এমন সময় দেখি,অনিন্দিতা।স্কুলের সহপাঠিনী,কিন্তু যথেষ্ট নিন্দিতা।দেরী হয়ে যাচ্ছে,ওকে বল্লাম,“চল,যেতে যেতে কথা বলি।’’ অনিন্দিতা শপিং-এ বেরিয়েছে,তারপর পার্লারে এ্যাপয়মেন্ট আছে। স্বামী অফিসে,ছেলে মেয়ে হস্টেলে। ভাগ্যবতী সে এখন দু’চারটে পরকীয়া,নিজেকে আকর্ষণীয় করার কৌশল,এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমার মত মাস্টারি করে এনার্জি নষ্ট করে না। যেতে যেতে কথা হল।আহা!গাড়ি ছাড়া কি ওকে মানায়!বড়লোকি চালের ফুটুনির কথা শুনতে শুনতে গেলাম। অংকের হিসেব মিলছে না,ওর ব্যাংক অফিসার স্বামীটি একার রোজগারে এত কিছু কি করে সামলায়….জানতে ইচ্ছে করছিল।সুনীল গাঙ্গুলীর কোন ছোট গল্পে পড়েছিলাম….যেসব মহিলারা সংসারের অর্থনীতি, বা সীরিয়াস বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না,তারা দীর্ঘদিন সুন্দরী থাকে। অনিন্দিতা সেই সৌভাগ্যবতীদের একজন। আমার আর সুন্দরী থাকা হল না,দীর্ঘশ্বাস গোপন করে শুনে গেলাম ওর কথা।
স্কুলে পৌঁছে দেখি কলিগরা উত্তেজিত,ক্লাস টেনের রিণিকে নাকি স্কুল ড্রেসে একটা ছেলের বাইকের পেছনে দেখেছে গীতাদি।গীতাদি স্কুলে এসেই খোঁজ নিয়েছে,রিণি স্কুলে আসে নি। ওর অভিভাবককে খবর দিতেই হবে। উর্মিলা একটা অসংলগ্ন মন্তব্য করে,কুটিল অর্থপূর্ণ হাসি হাসে।ও নিজেও উঠতি বয়সী মেয়ের মা,এমন মন্তব্য করতে বুক কাঁপল না তার।“আরে,এ মেয়ের অনেকদিন হল পাখনা গজিয়েছে।ছেঁটে দিতে হবে’’,গম্ভীর মন্তব্য করল কেউ।“দ্যাখেন গা,কুন্ কান্ড না বান্ধাইয়া বয়।বিধবা মা-ডা খাটতে খাটতে মরল!’’ পিওন বয়স্ক শেফালীদি বলল।টিচিং স্টাফ রুমে জোর জটলা। ভাল রসালো টপিক পাওয়া গেছে,ক্লাসে যেতে পা সরছে না দিদিমনিদের।সুদূর অতীত থেকে কিশোরীবেলার কিছু টুকরো স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।আমরা তখন ক্লাস টেনে।একদিন কোনো উপলক্ষ্যে স্কুল ছুটি হয়ে যায়।আমি আর দু’তিনজন বন্ধু,এক বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিলাম।সিনেমার ছবি দেয়া ‘উল্টোরথ’ ম্যাগাজিন দেখা,সব বলিউড,টলিউডের তারকাদের ছবি,কেচ্ছা,গোগ্রাসে গিলে বাড়ি ফিরেছিলাম।ফেরার পথে আমাদের সহপাঠিনী শাশ্বতীকে তার প্রেমিক আটকায়।‘তুলে নিয়ে যাবে’ বলে ধমকি দেয়।বখে যাওয়া কলেজ ড্রপ আউট গুন্ডা ছিল প্রেমিকটি।সেদিন শাশ্বতীকে নিতে না পারলেও,কয়েকদিন পর শাশ্বতী নিজেই পালায়।আমাদের সেকি উত্তেজনা!শাশ্বতীর পলায়ন পর্ব,মন্দিরে বিবাহ...এসব শুনে তার নতুন সংসার দেখার জন্য কি ব্যাকুলই না হয়েছিলাম!তখন সেটা সম্ভব হয়নি,কিন্তু তার বহু বছর পর কোনো মন্দিরে শাশ্বতীকে দেখে চিনতে পারিনি।পৃথুলা এক নারী,কপালে আধুলির সাইজের সিঁদুরের টিপ,গলায় বহু ভাঁজে বিজবিজে ঘাম,হাঁপরের মত শ্বাস ফেলা এই শাশ্বতীকে আমি চিনিনি।ও-ই এগিয়ে এসে কথা বলে।মন্দিরের ট্রাস্টিতে তার একদা গুন্ডা স্বামী আছে।কন্ট্রাকটরী করে ভালো পয়সা করেছে,যা প্রকাশ পাচ্ছে,বেশভূষায়,কথায়।বাল্য সহপাঠিনীর সাথে বেশী সময় কথা চালাতে পারলাম না।আজ অনিন্দিতার সাথে দেখা হলো,তারই কতো ঘটনা ছিল!অনিন্দিতারা হারিয়ে যায় না।সঠিক জীবনসাথী গেঁথে ফেলার দক্ষতা থাকে তাদের।তারপরেও বেশ কিছু এক্সট্রা স্টেপনী হাতে রাখে স্রেফ মনোরঞ্জনের জন্য।রিণি যে কোন্ দলে পড়বে,ভবিষ্যৎ-ই বলতে পারবে।অফ্ পিরিয়ডে ভাবছি,বিচিত্র সংসার আর কত বিচিত্র চরিত্র। রঙধনুর সাত রঙ্ এর মতই বর্ণাঢ্য সংসার, আর রং বেরঙী চরিত্ররা তাদের অভিনয় করে যাচ্ছে।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
4 Comments
ভালো লাগলো.... হেমন্ত আমারও প্রিয় ঋতু..
ReplyDeleteভারি সুন্দর লেখা, মন কে যেন উচাটন করে তোলে
ReplyDeleteমন ছুঁয়ে গেল, বিচিত্র জীবনের বিচিত্র জীবন কাহিনী।
ReplyDeleteচরিত্র বিচিত্র না হলে আমাদের পরনিন্দা পরচর্চা টা বজায় থাকে কি করে বলুন,রং বদলে সেটা তো চালাতেই হবে।
ReplyDelete