রাখাল ছেলে ও জাদু পাথর
সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস
কথক- সম্পদ দাস, গ্ৰাম- ডুমুরিয়া, থানা- নয়াগ্ৰাম, জেলা- ঝাড়গ্ৰাম
অনেকদিন আগে চন্দ্রপুর গ্ৰামে বিজু নামে এক রাখাল ছেলে থাকত তার মায়ের সঙ্গে। সারাদিন সে ছাগল চরাত আর মনের আনন্দে বাঁশি বাজাত। বিজু ছিল খুবই শান্ত ও সরল প্রকৃতির ছেলে। তার বাবা ছিল না। এমনকি তারা গরীবও
ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিজুর মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকত।
একদিন খেতে বসে সে তার মাকে বলে-“জানো মা, এই বর্ষায় জলে চারিদিকে কত নতুন ঘাস হয়েছে। ছাগলগুলো যে কী মজা করে খায় তোমায় কী বলব।”
তখন তার মা বলে-“বেশ বেশ, এখন নিজে খা তো দেখি। সারাক্ষণ খালি কথা আর কথা।”
বিজু বলে-“মা কাল যে গল্পটা বলেছিলে আজও সেটা বলবে তো?”
তার মা বলে-“হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা, বলব বলব। এখন তুই খা তো।”
এইভাবে মহানন্দে মা ও ছেলের দিন কাটছিল।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও বিজু গেছে ছাগল চরাতে। হঠাৎই আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এল।
আকাশে মেঘ দেখে বিজু বলে-“আকাশে মেঘ করেছে,এখনি বৃষ্টি নামবে মনে হয়। আমি আগে ছাগলগুলোকে জোড়ো করি।”
এই বলে বিজু ছাগলগুলোকে ডাকতে থাকে। সে ডাকে-“কালী, বেলা, রামু, পুঁটি, মধু কোথায় গেলি আয় আয়।”
বিজুর ডাকে ছাগলগুলো একে একে তার কাছে চলে আসে, আসে না শুধু কালী।
তখন বিজু বলে-“উফ্, কালী কোথায় গেলি রে? এই তোরা এখানে থাক। আমি কালীকে নিয়ে আসছি।”
এই বলে সে কালী কালী ডাকতে ডাকতে কালীকে খুঁজতে থাকে। জঙ্গলের মধ্যে একটু ডুকতেই দেখতে পায় কালী মনের আনন্দে ঘাস খাচ্ছে।
কালীকে দেখে বিজু বলে-“এই তো কালী। খুব দুষ্টু হয়েছিস তুই। খালি এদিক সেদিক চলে যাওয়া তাই না।”
হঠাৎই বিজুর চোখে পড়ে একটা আলো। যা দেখে বিজু বলে-“ও বাবা! মাটিতে ওটা কী? এরকম পাথর তো আগে কখনো দেখিনি। কী সুন্দর দেখতে।”
এই বলে সে পাথরটি হাতে তুলে নেয়। আর পাথরটি হাতে নিতেই পাথর বলে-“তোমার মনের ইচ্ছার কথা আমায় বলতে পার আমি তা পূরণ করব।”
🍂
এই শুনে বিজু ভয় পেয়ে যায়। চারিদিকে তাকিয়ে সে বলে-“কে, কে, কে?”
তখন পাথর বলে-“আমি গো আমি, তোমার হাতে থাকা পাথর বলছি।”
বিজু বলে-“বাপরে, পাথর কথা বলছে নাকি?”
পাথর আবার বলে-“তুমি কী চাও বলো, আমাকে বলো?”
বিজু বলে-“আমার তো চাওয়ার কিছু নেই।”
তখনই মেঘ ডাকতে থাকে। তখন বিজু বলে-“এ বাবা, মনে হয় বৃষ্টি নামবে। এই কালী চল চল চল। আর পাথর তুমি এখন আমার গামছায় বাঁধা থাকো হ্যাঁ।”
এরপর বিজু পাথরটিকে গামছায় বেঁধে ছাগল নিয়ে বাড়ি চলে যায়।
ওইদিন মোড়ল বিজুর বাড়ি আসে। আর এসে বিজুর মাকে বলে-“এই যে বিজুর মা, বলি তোমাদের ধার বাকিটা এবার শোধ করো। আর কতদিন ফেলে রাখবে শুনি?”
বিজুর মা তখন বলে-“হ্যাঁ মানে, মোড়লমশাই ছেলেটা একটু বড়ো হয়ে যাক, ভালো কাজবাজ করূক তখন ঠিকই মিটিয়ে দেব। আর কিছু সময় দাও মোড়লমশাই।”
মোড়ল বলে-“খুবই মুশকিল ব্যাপার। আচ্ছা ঠিক আছে আর কী করা যাবে।”
এই বলে মোড়ল সেখান থেকে চলে যায়। ঠিক সেইসময় বিজু বাড়ি আসে।
বিজুকে দেখে তার মা বলে-“কী রে, তোর আজ এত দেরি হল?”
তখন বিজু বলে-“আর বলো না মা, কালীটা ঘাস খেতে খেতে জঙ্গলের ভেতরে চলে গিয়েছিল। ওকে আনতে গিয়েই তো এত দেরি হয়ে গেল। আচ্ছা মা, আমাদের কী চাই বলো তো?”
তার মা বলে-“ওমা, কী আবার চাই। কিছু চাই না। তুই এখন খেতে বস আমি সেটাই চাই।”
এরপর সে খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়ে।
পরেরদিন সকালে সে প্রতিদিনের মতো ছাগল চরাতে যায় আর মনের আনন্দে বাঁশি বাজাতে থাকে।
ঠিক তখন তার গামছায় বাঁধা পাথর বলে-“আমাকে এখান থেকে বের করো।”
পাথরের কথা শুনে বিজু বলে-“এ মা, আমি তো তোমার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।”
এই বলে সে গামছা থেকে পাথরটি বের করে।
তখন পাথর বলে-“বলো, বলো এবার তোমার কী চাই?”
বিজু তখন বলে-“আমার কিছু চাই না। শুনলে না মাও তো বলল আমাদের কিছু চাই না।”
পাথর বলে-“আচ্ছা তোমাদের ছোটো কুঁড়েঘরটা যদি আমি আরও বড়ো করে দি?”
তখন বিজু বলে-“না না আমরা দুজন মানুষ এত বড়ো ঘর নিয়ে কী করব?”
পাথর তখন বলে-“আর যদি অনেক সোনাদানা দি, যাতে তোমাকে আর ছাগল চরাতে না হয়।”
বিজু বলে-“তাহলে কালী, বেলা, মনু, পুঁটি, রামু এদেরকে কে খাওয়াবে, কে দেখবে শুনি?”
এদিকে বিজু ও পাথরের সব কথা মোড়লের ছেলে রতন গাছের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে ও শোনে। তারপর দৌঁড়ে গিয়ে খবর দেয় তার বাবাকে।
রতনের সব কথা শুনে মোড়ল বলে-“এ্যাঁ, কী বললি?”
তখন রতন বলে-“হ্যাঁ গো বাবা, একটা জাদু পাথর। জানো সেই পাথর আবার কথা বলে।”
মোড়ল বলে-“পাথর কথা বলছে! উম্ নিশ্চয়ই বিজু কোনো জাদুমন্তর জানে। চল তো দেখি কোথায় ও, চল চল।”
এই বলে মোড়ল ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বিজুর বাড়ি যায়। বিজুর বাড়ি পৌঁছে মোড়ল বিজু ও বিজুর মাকে ডাকতে থাকে। তখন ঘর থেকে বিজু বেরিয়ে আসে।
বিজুকে দেখে মোড়ল বলে-“এই তো বিজু, বার কর এখুনি বার কর।”
বিজু বলে-“কী বের করব জেঠা?”
মোড়ল বলে-“জাদু পাথর। যা দিয়ে তুই গ্ৰামের সবার ক্ষতি করতে চাইছিস।”
বিজু বলে-“ ক্ষতি! না না আমি কারোর ক্ষতি করতে চাই না। তুমি বিশ্বাস করো।”
এদিকে মোড়লের গলার আওয়াজে একে একে করে গ্ৰামের সবাই এসে জোড়ো হয় বিজুর বাড়ির সামনে।
আর তারা সবাই যখন কথা বলছিল তখন মোড়লের ছেলে রতন লুকিয়ে বিজুর ঘর থেকে খুঁজে নিয়ে আসে ওই পাথর।
পাথর নিয়ে এসে রতন বলে-“বাবা বাবা, এই যে দেখ এই সেই জাদু পাথর। এই দেখ পাথর আবার কথাও বলছে। আমার ইচ্ছাপূরণ করার কথা বলছে।”
তখনই পাথর বলে-“তোমার মনের ইচ্ছার কথা আমাকে বলো। আমি তা পূরণ করব।”
রতন বলে-“পাথর পাথর আমাকে এক বাক্স খেলনা দাও।”
ঠিক তখনই তার সামনে এক বাক্স খেলনা চলে আসে। এই দেখে মোড়ল ও গ্ৰামের সবাই অবাক হয়ে যায়।
তখন মোড়ল বলে-“আহা রতন, কী করছিস কী। দে দে ওই পাথর আমায় দে।”
রতন তখন বাবাকে ওই পাথর দিয়ে দেয়।
পাথর মোড়লকে বলে-“তোমার মনের ইচ্ছার কথা আমাকে বলো। আমি তা পূরণ করব।”
মোড়ল তখন বলে-“আমার মানে আমার এক বাক্স সোনা চাই।”
আর ঠিক তখনই মোড়লের সামনে এক বাক্স সোনা চলে আসে। যা দেখে মোড়লের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। সে তখন গ্ৰামের সবাইকে সরিয়ে দিয়ে সোনা আর পাথর নিয়ে বাড়ি চলে যায়।
এদিকে বিজু কাঁদতে কাঁদতে বলে-“ও মোড়ল জেঠা, মোড়ল জেঠা গো, ওই পাথরটা নিয়ে যেও না। ও আমার বন্ধু। জেঠা ও জেঠা।”
সেইসময় বিজুর মা বাড়িতে আসে। এই সব দেখে সে বলে-“কী হয়েছে রে বিজু কী হয়েছে?”
তখন বিজু তার মাকে সব কথা বলে।
সব শুনে তার মা বলে-“কাঁদিস না বাবা কাঁদিস না, আমাদের কিছু চাই না কিছু না।”
এইভাবে এই জাদুর পাথরের কথা ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্ৰামে। গ্ৰামের সবাই পাথর নিয়ে বলাবলি করতে থাকে। আর এইসব কথা কোনোমতে পৌঁছে যায় ডাকাতের কানে। তখন ডাকাত সর্দার মোড়লের বাড়িতে ডাকাতি করার ফন্দি আঁটে।
এদিকে পাথর পেয়ে মোড়ল একেবারে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। সে তার বউ বাচ্চা কারোর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না। বউ গয়নাগাটি পরে থাকলে তা খুলে তাকে দিতে বলে। আর ছেলে কিছু বললে তাকেও বকাবকি করে।
এই ভাবে সবসময় বকাবকি করতে মোড়লের ছেলে রতন বলে-“বাবা, তুমি তো আগে কোনোদিন আমাকে এভাবে বকাবকি করতে না। এখন তাহলে কেন বকছো?”
এই বলে সে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির বাইরে চলে যায়। আর সেখানে বসে খেলা করে।
ঠিক সেইসময় ডাকাতেরা মোড়লের বাড়ি আসে। ডাকাতদের দেখে রতন চেঁচাতে থাকে। তখন ডাকাতেরা রতনকে আঘাত করে। রতনের চিৎকার শুনে তার মা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। এসে দেখে রতন মাটিতে পড়ে আছে।
আর এদিকে ডাকাতেরা মোড়লকে ভয় দেখিয়ে সব সোনাদানা নিয়ে চলে যায়। এরপর মোড়ল ঘরের বাইরে আসে। এসে দেখে রতন মাটিতে পড়ে আছে।
মোড়ল তখন জাদু পাথরকে বলে-“পাথর পাথর আমার ছেলেকে ভালো করে দে। পাথর এই পাথর।”
কিন্তু পাথর কোনো কথা বলে না। এদিকে মোড়ল বউয়ের চিৎকারে গ্ৰামের সবাই সেখানে আসে।
রতনের এই অবস্থা দেখে মোড়ল কাঁদতে থাকে। আর গ্ৰামের সবাইকে বলে-“এই, এই নে তোরা একটু পাথরকে বল না। যদি পাথর তোদের কথা শুনে।”
কিন্তু কেউ ভয়ে সেই পাথর ছুঁতে চায় না।
তখন মোড়লের বউ মোড়লকে বলে-“সব সব তোমার লোভের ফল। ওগো ওগো তুমি এখুনি বিজুকে ডেকে আন। বিজু ও বিজু একবার আয় বাবা। আমার ছেলেটাকে বাঁচা।”
এই বলে মোড়লের বউ কাঁদতে থাকে।
মোড়ল বলে-“হায় হায় হায়, এ আমি কী করলাম। সুখে শান্তিতে ছিলাম কিন্তু এই লোভ এই লোভের জন্য আমার সব গেল, সব গেল।”
এই বলে মোড়লও কাঁদতে থাকে।
ঠিক সেইসময় বিজু সেখানে আসে। বিজুকে দেখে মোড়ল বলে-“ওরে ও বিজু, বিজু দেখ না দেখ না তোর বন্ধুর কী হল দেখ একবার দেখ।”
এই বলে মোড়ল বিজুকে পাথরটি দেয়। বিজুর হাতে পাথরটি যেতেই পাথর কথা বলে। পাথর বলে-“তোমার মনের ইচ্ছার কথা আমাকে বলো। আমি তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করব।”
তখন বিজু বলে-“পাথর, পাথর রতনকে ভালো করে দাও।”
এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই রতন ঠিক হয়ে যায়।
তখন মোড়ল বিজুকে বলে-“আমাকে ক্ষমা কর বিজু। আমি আর লোভ করব না আর লোভ করব না।”
এরপর থেকে রতন ও বিজু একসঙ্গে খেলা করে। বিজু ছাগল চরাতে গেলে রতনও তার সঙ্গে যায়।
এদিকে গামছায় বাঁধা পাথর বিজুকে গামছা থেকে আবার বের করতে বললে বিজু বলে-“না না এখন তোমাকে বের করব না। এখন আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে গল্প করব। তোমার সঙ্গে রাত্রে গল্প করব কেমন।”
তখনই রতন বলে-“বিজু এ বিজু, একটু বাঁশি বাজা না শুনি।”
বিজু বলে-“আচ্ছা, বাজাচ্ছি।”
0 Comments