জ্বলদর্চি

সুদর্শন দাস অধিকারী (ঠুংরি সম্রাট, পাঁশকুড়া)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৮৭
সুদর্শন দাস অধিকারী (ঠুংরি সম্রাট, পাঁশকুড়া) 

ভাস্করব্রত পতি

১৯১৫ সালে পাঁশকুড়ার কালিদান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সুদর্শন দাস অধিকারী। যদিও আজ এখানে কেউ তাঁর নাম শোনেনি। চেনেনও না। আজ ও তাঁর নাম বললে অনেকেই অবাক হয়ে যান। অথচ পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সীমান্তবর্তী কালিদান গ্রামের এই মানুষটিই একসময় হিন্দি চলচ্চিত্রের অসংখ্য গানে অন্যতম বাদ্যকার হয়ে উঠেছিলেন। 

অত্যন্ত দরিদ্র বৈষ্ণব পরিবারের থেকে বড় হয়েছেন। কিন্তু রক্তে ছিল সঙ্গীত প্রেম। পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তাঁকে 'ঠুংরি সম্রাট' উপাধি দিয়েছিলেন। যা মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উঠে আসা এক শিল্পীর জীবনের অন্যতম মাইলস্টোন। 

তখন গ্রামে গঞ্জে বসত গ্রামীণ যাত্রার আসর। সেসময় লোকজনের কাছে এই যাত্রা ছিল মনোরঞ্জনের অন্যতম মাধ্যম। খুব ছোটবেলা থেকেই গ্রামের সেই যাত্রার আসরে তবলার বোল শুনে শুনে নিজেকে পরিশীলিত করতে থাকেন। তবলার তাল শুনে শুনেই তবলা বাজানো শিখেন ফেলেন। এমনই প্রতিভা ছিল তাঁর। 

১৯৬২ সালে চিন ভারত যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দেশাত্মবোধের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করতে এবং জাগিয়ে রাখতে সাতটি তবলার সমাহারে দুর্দান্ত তবলা লহরার ক্যাসেট বানিয়ে তা উৎসর্গ করেছিলেন সেনাবাহিনীর জওয়ানদের। এ কৃতিত্ব রোমাঞ্চিত করে মেদিনীপুরবাসীদের। 

কালিদান গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। চরম দারিদ্রতার কারণে জন্মভূমি ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে হাতে নিয়ে ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি দিলেন বিদেশ বিভুঁই। লক্ষ্য কপালের লেখার পরিবর্তন করা। পৌঁছে যান দেশের রাজধানীতে। অপরিচিত জায়গা। অপরিচিত ভাষা। 

অবশেষে কাজ খুঁজতে খুঁজতে দিল্লির অলিগলিতে ঘুরতে ঘুরতে ঢুকে পড়েন এক অনামা বাঈজীর পরিবারে। গান নাচের পরিবেশ। সেই পরিবারের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের রক্ষনাবেক্ষনের কাজে যুক্ত হলেন সুদর্শন দাস অধিকারী। বাঈজীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ থাকতো। ফলে সেইসব অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের ওস্তাদদের আগমন ঘটত। তাঁদের বাদ্যযন্ত্রের বোল এবং মূর্ছনা শুনে শুনেই অসম্ভব প্রতিভাধর এই মানুষটি ধীরে ধীরে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর কাজ করায়ত্ত করে ফেলেন। 

ছোট্ট সুদর্শনের নরম হাতে তবলা, শ্রীখোল, পাখোয়াজ, ঢোল ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র হয়ে উঠলো জলের মতো সহজ সরল। একজন যথার্থ কুশলী এবং পারদর্শী শিল্পী হয়ে উঠলেন অচিরেই। ধীরে ধীরে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়লে চারিদিকে। 

সুদর্শন দাস অধিকারীর বাদ্যনৈপুণ্য খু্ঁজে পাওয়া যায় 'ঝনক ঝনক পায়েল বাজে' সিনেমায়। ১৯৫৫ সালে ভি শান্তারাম এই হিন্দি ছায়াছবিটি বানিয়েছিলেন। এই ছবির বিভিন্ন গানে সুদর্শন দাস অধিকারী বাজিয়েছিলেন শ্রীখোল লহরা। এতে অভিনয় করেন ভি শান্তারামের স্ত্রী সন্ধ্যা, গোপী কৃষ্ণ, মদন পুরী প্রমুখ। সেসময় সুপারহিট এই সিনেমাটি পেয়েছিল All India Certificate of Merit for Best Feature Film, National Film Award for Best Feature Film in Hindi এবং Filmfare Best Movie Award।  এরকম একটি চলচ্চিত্রে তাঁর ভূমিকা গর্ব করার মতোই। এছাড়াও পরবর্তীতে ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল অভিনীত 'নৃত্যের তালে তালে' (১৯৫৯) ছায়াছবিতে তিনি ছিলেন অন্যতম সঙ্গীত নির্দেশক।
🍂

Post a Comment

1 Comments

  1. ভারি আনন্দ পেলাম এই বিরল প্রতিভার খোল /তবলা বাদক সম্রাটের বিষয়ে জানতে পেরে

    ReplyDelete