জ্বলদর্চি

ইতিহাস ঘেঁটে কিছু কৃষক বিদ্রোহ/গৌতম বাড়ই

 

বর্তমান কৃষিবিল-কে নিয়ে সারা ভারত জুড়ে অবরোধ ও ধর্মঘট হল। সেই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল এই ভারতবর্ষে, বিশেষ করে পরাধীন ভারতবর্ষের কিছু ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন তথা বিদ্রোহের কথা।চলুন ইতিহাসকে একটু ছুঁয়ে দেখি আমরা।

ঐতিহাসিক নীলবিদ্রোহ  

ফরাসি বণিক লুই বোনার্ড ছিলেন ভারতের প্রথম নীলকর বণিক। কার্ল ব্লুম নামে একজন ইংরেজ বণিক ভারতে প্রথম নীলশিল্প গড়ে তোলেন।

১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে সনদ আইনে নীল চাষে একচেটিয়া কোম্পানির অধিকার লুপ্ত হয়। নীলকর সাহেবের নিজেদের জমিতে নীল চাষ করলে তাকে বলা হত নীল আবাদী এবং চাষীকে আগাম টাকা দিয়ে চাষের জমিতে নীল চাষ করার জন্য চুক্তি করলে তাকে বলা হত রায়তি, দাদনী বা বে-এলাকা চাষ। 

১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক প্রকাশিত হয়। রেভারেন্ড জেমস লঙ এর উদ্যোগে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। নীলকররা জেমস লঙের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন এবং বিচারে তার এক মাসের কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা হয়।জমিদার কালী প্রসন্ন সিংহ নিজে সেই টাকা জমা দেন।

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ৫ম আইন দ্বারা নীলকরদের অত্যাচার দমনের চেষ্টা করেন। বাংলার ছোটলাট হলিডে সাহেব, সরকারি ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল লতিফ, বারাসাত জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মঙ্গোলস নীলকরদের বিরুদ্ধে চাষীদের পক্ষ নেন। 1859 সালে শেষ দিকে কৃষ্ণনগরের কাছে চৌগাছা গ্রামে বিষ্ণু চরণ ও দিগম্বর বিশ্বাস কৃষক দের সংগঠিত করেন। নীল বিদ্রোহের কারণ নির্ণয় করেন সেই সময়ের গভর্নর জন পিটার গ্রান্ট। 

নীলবিদ্রোহ দমনের জন্য একাদশ আইন পাস হয়। নীল বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন পাবনার মহেশ বন্দোপাধ্যায়, মালদহের ফৈরাজী নেতা রফিক মন্ডল, আসাননগরের মেঘাই সর্দার, খুলনার কাদের মোল্লা, সুন্দর বনের রহিম মোল্লা, বাঁশবেড়িয়ার বৈদ্যনাথ সর্দার ও বিশ্বনাথ সর্দার প্রমুখ।

নড়াইলের জমিদার রামরতন রায় কে বাংলার      নানাসাহেব বলা হত।নদীয়ার বিষ্ণুচরণ ও 
 ও দিগম্বর বিশ্বাস কে বলা হত বাংলার "ওয়াট টাইলার"। বিশ্বনাথ সর্দার বিশে ডাকাত নামে পরিচিত হয়। ১৮৬০ সালে সরকার নীল কমিশন গঠন করে। ১৮৬৯ সালে ৮ম আইন দ্বারা নীল চুক্তি আইন রোধ করা হয়। হিন্দু প্যাট্রিওট পত্রিকার সম্পাদক হরিশ চন্দ্র মুখার্জি নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী নিয়মিত প্রকাশ করতেন। নীল বিদ্রোহ নিয়ে লেখা বিখ্যাত ইংরেজি বই "দা ব্লু মিউটনি"। এই হল মোটামুটি নীলচাষ নিয়ে এক সংক্ষেপে ইতিহাসের আলেখ্য।


পাবনা বিদ্রোহ 

পূর্ব ভারতের বাংলাতে (অধুনা বাংলাদেশ) জমিদারদের বিরুদ্ধে পাবনা কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়। সরকার শেষ পর্যন্ত অস্ত্রের দ্বারা এই বিদ্রোহ দমন করে ও একটি কমিশন বসানো হয় কৃষকদের দুরাবস্থা জানার জন্য। এই বিদ্রোহের প্রধান নেতারা ছিলেন ঈশান চন্দ্র রায়, শম্ভু পাল, কে মোল্লা প্রমুখ। এই বিদ্রোহের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হন জমিদার দ্বিজেন্দ্র নাথ ঠাকুর, জোড়াসাঁকোর সেই বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ির। ঠাকুরবাড়ির বাদবাকি-টা সবার জানা। ১৮৭৪ সালে এই বিদ্রোহের কথা নিয়ে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র লেখেন 'বাংলার কৃষক বিদ্রোহ'। 
দাক্ষিণাত্য বিদ্রোহ 

দাক্ষিনাত্যে বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে ভূমি রাজস্ব আদায়ের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় গ্রামের প্যাটেল (patel) বা মোড়লদের। দাক্ষিণাত্যে কৃষকরা সাউকার বা মহাজনদের বিরূদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। ১৮৭৪ সালে মহারাষ্ট্রের পুণা জেলার কার্দে  গ্রামে এই বিদ্রোহের সূচনা হয়। কার্দে গ্রামে কালুরাম নামে জনৈক মহাজন, ঋণের দায়ে পড়া বাবা সাহেব দেশমুখ নাম এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির জমিজমা ঘরবাড়ি আদালতের আদেশে দখল করে নিলে কৃষকরা একত্রিত হয়ে মহাজনদের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কট শুরু করে। ১৮৭৫ সালে ১২-ই মে পুনা জেলার সুপা গ্রামে উন্মত্ত জনতা মহাজন দের ঘরবাড়ি, দোকান, লুট করে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাহায্যে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়, এবং প্রায় ৬০০০ কৃষককে বিভিন্ন মেয়াদী কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৮৭৬ সালে এই বিদ্রোহের জন্য কমিশন নিয়োগ করা হয়।

পাঞ্জাবের কৃষক অসন্তোষ

পাঞ্জাবের মহাজনদের জমি অধিগ্রহনের জন্য কৃষকরা আন্দোলন শুরু করে। সরকার ১৯০২ সালে পাঞ্জাব জমি হস্তান্তর আইন পাস করেন। এই আইনে কৃষকদের থেকে মহাজনদের হাতে জমি হস্তান্তর নিষিদ্ধ হয় ও কুড়ি বছরের বেশি সময় ও জমির মর্টগেজ নিষিদ্ধ হয়।

মোপালা বিদ্রোহ

 কেরলের মালাবার অঞ্চলে মুসলমান মোপালা কৃষকরা হিন্দু জমিদার ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে মোপালা বিদ্রোহ শুরু করে। ১৯২১ সালে পুলিশেরা তীরুরঙ্গদি মসজিদে অস্ত্র খোঁজার নামে তল্লাশি চালালে, থানা, জমিদার ও মহাজনদের বাড়ি আক্রমণ করে। মোপালারা বিভিন্ন স্থানে রিপাবলিক গঠন করে। 
মোপালা বিদ্রোহের নেতা ছিলেন কানহামমত 
গাজী, কলথিনগল মোহাম্মদ, আলী মুসলিওর প্রমুখ। ব্রিটিশরা ২৩৩৭ জন বিদরিহিকে হত্যা করে, ১৬৫০ জন কে আহত করে, প্রায় ৪৫০০০ জনকে বন্দী করে।

বারদৌলী সত্যাগ্রহ

গুজরাটের বারদৌলী জেলায় ২২ শতাংশ ভূমি রাজস্ব বৃদ্দি হলে ১৯২৭ সালে সর্দার বল্লভভাই  প্যাটেল নবম রেভিনিউ ক্যাম্পেইন শুরু করে। ব্রিটিশরা সেই আন্দোলনের দমন করতে চাইলেও ব্যর্থ হন। সরকার একটি অনুসন্ধান কমিটি নিয়োগ করেন। এই কমিটির সুপারিশে রাজস্ব কমানো হয়। এই সত্যাগ্রহ অনুসন্ধানের জন্য সরকার ম্যাক্সওয়েল 
ব্লুমফিল্ড কে নিয়োগ করেন। 


বিজলীয়া আন্দোলন

১৯০৫ সালে এই আন্দোলন শুরু হয় রাজস্থানের
মেওয়াড়ে। সাধু সীতারাম দাস ১৯১৩ সালে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯১৫ সালে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ভূপ সিং ও তাকে সাহায্য করেন মানিক লাল ভার্মা। ১৯১৬ সালে উদয় পুরের রাজার বিরুদ্ধে তারা নবম রেভিনিউ আন্দোলন শুরু করেন। 

কোনো প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে জনসমষ্টি যখন বিরোধী হয়ে ওঠে তখন সেই অবস্থা কে বিদ্রোহ বলা হয়। সাধারণত ভারতীয় কৃষক বিদ্রোহের কারণ হিসাবে এই কাজ টি বেশ জোরালো ছিলো। কেননা বহুদিন ধরে উপনিবেশিকদের অত্যাচারে ভারতীয় কৃষক সমাজ জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। সেই কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দেশীয় কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে পড়ে, সাথে সাথে দেখা দেয় কৃষক বিদ্রোহ। এই রকম কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে  আলোচনা করা হলো।

বর্তমান সময়ে কৃষক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ ঐ ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো মনে পড়ল।তবে বৈদেশিক শাসনে আমরা আজ আর নেই,আশা করছি আমাদের স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক সরকার এর একটা সুষ্ঠ সমাধান করবেন।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন

Post a Comment

1 Comments

  1. দুর্দান্ত একটা লেখা পড়লাম।।

    ReplyDelete