জ্বলদর্চি

২২ শে শ্রাবণ / অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য

২২শে শ্রাবণ 

অ মি ত্র সূ দ ন  ভ ট্টা চা র্য  


আমি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে জন্মেছি কিন্তু আজ আমার ৭৭ বছর বয়সে এসে খুব মনে হচ্ছে যে, আমি রবীন্দ্রনাথকে যেন খুব কাছ থেকে দেখেছি। এর অবশ্য অনেকগুলো কারণ আছে। একটা হল আমি শান্তিনিকেতনে গত ৫৫ বছর কাটালাম। যখন আমি প্রথম শান্তিনিকেতনে আসি আমার পিতৃদেবের সঙ্গে সেটা ১৯৬১ সাল। রবীন্দ্রনাথ ১৯৪১ সালে মারা গেছেন আর আমি আসি ১৯৬১ সালে অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে। তখনও পশ্চিমে সূর্যের রঙিন আভার সবটুকু লেগেছিল। শান্তিনিকেতনে গিয়ে দেখলাম সব রবীন্দ্রসান্নিধ্যধন্য মানুষ-- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, জহরলাল নেহেরু, রাধাকৃষ্ণাণ, শান্তিনিকেতনের প্রথম ছাত্র সুধীররঞ্জন দাস, রানু মুখোপাধ্যায়। সেই আশ্রম তপোবনের মতো তার রূপ। সবকিছুর মধ্যে যেন মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের কাছেই এসে পৌঁছেছি। এছাড়া আমার পিতৃদেব ছিলেন রবীন্দ্রসান্নিধ্যধন্য মানুষ। কবির মৃত্যুর ১০ বছর আগে পর্যন্ত তিনি খুব কাছের মানুষ ছিলেন। রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট। আমার বাড়িতে এখনো অনেক চিঠি আছে। সারাজীবনই রবীন্দ্রনাথ পড়েছি। প্রায় প্রতিদিন উত্তরায়ন গেছি। সেখানে পড়াশোনা করেছি। এখনো যে শান্তিনিকেতনে আছি, সেও রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন। এই জন্যই মনে হয় যে, রবীন্দ্রনাথকে খুব কাছ থেকে দেখেছি।

আজ ২২শে শ্রাবণ। মনে হচ্ছে সেই ২২শে শ্রাবণের দিনটি; যাঁরা সেই শোকের অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে আমার পিতৃদেব এবং তাঁর বন্ধু প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত। পিতার মুখে শুনেছি কিভাবে হেঁটে গড়িয়াহাটের মোড় থেকে জোড়াসাঁকো গিয়েছিলেন। কলকাতায় সেদিন ফুল ছিল না। ট্রাম বাস সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী দিনকর কৌশিক-এর মুখেও শুনেছি, যিনি সত্যজিৎ রায়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন আজীবন। আমার 'এক দুর্লভ মানিক' গ্রন্থেও কিছু কথা উল্লেখ আছে। মানিক অর্থাৎ সত্যজিৎ রায় কৌশিকজীকে বলেছিলেন এটাই আমাদের শেষ সুযোগ কবিকে দেখার। তাই ভোরের ট্রেনে এলেন, হাওড়াতে নামলেন। কোনও বাস নেই, গাড়ি নেই সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে জোড়াসাঁকোতে পৌঁছালেন। ভিড়! ভিড়! ভিড়! তাঁদের মুখে শুনেছি সেই গেট ভেঙে যাওয়ার কথা। নন্দলাল বসু রবীন্দ্রনাথের মরদেহ সাজিয়ে নিয়ে এলেন। ওপর থেকে নীচে নামানো হয়েছে। এত ভিড়, সেজন্য গেটের উপর চাপ পড়ছে। শেষ পর্যন্ত সেই গেট ভেঙ্গে পড়লো। সেই সঙ্গে আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। গাড়িতে আর বহন করে নিয়ে  যাওয়ার সুযোগ হল না। মানুষের হাতে হাতে এগিয়ে চলে যেতে থাকলেন রবীন্দ্রনাথ। এক অসম্ভব বিশৃঙ্খলা ঘটেছিল সেদিন। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি সংগ্রহের জন্য কেউ কেউ কবির অঙ্গ থেকে কিছু কিছু জিনিস সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছে। সেটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি। আজ এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে কৌশিকজীর বাড়িতে একটি সুন্দর কাঠের ছোট্ট বাক্সে  তিনি রবীন্দ্রনাথের কেশ গুচ্ছ রেখেছিলেন। তিনি চাইলে হয়তো দিতেন, আমি চাইতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত এটা হারিয়ে গেল কিনা জানি না। তাঁকে এটা দিয়েছিলেন কৃষ্ণ কৃপালনীজী, উপহার হিসেবে। কৌশিকজী ও সত্যজিৎ রায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ ছাত্র।
আজ বাইশে শ্রাবণ। এই দিনে আমি আমার ঘরের আলমারি থেকে বাবাকে লেখা কবিগুরুর চিঠিগুলো বের করি। সেগুলোকে স্পর্শ করি। আমাদের জীবনে অনেক পুজো আছে --সরস্বতী, দুর্গা, কালী --কিন্তু আমার ব্যক্তিগত জীবনে পুজোর দিন দুটো। এক ২৫শে বৈশাখ, অন্যটি ২২শে শ্রাবণ। ২২শে শ্রাবণ আমার কাছে মৃত্যু দিন নয়। কারণ রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই শিখেছি মৃত্যুকে কিভাবে জয় করতে হয়। সেটা তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুতে দেখেছি,  তাঁর পুত্র এবং কন্যার মৃত্যুতেও। আজকে এই মুহূর্তে আমি যে উপন্যাসটি লিখছি 'হৃদয়ে রয়েছ গোপনে' তার একদিকে জীবন  অন্যদিকে মৃত্যু। কবিগুরুর জীবনে কন্যা বেলার মৃত্যু এবং অন্যতর জীবনে রানুর কাছে তাঁর ফিরে আসা, নতুন জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তাই ২২ শ্রাবণ আমরা যদি নতুন দীক্ষায় দীক্ষিত হতে চাই তাহলে আমাদের কাছে ২২শে শ্রাবণ মৃত্যুর দিন নয়, নতুন এক জন্মদিন।



Post a Comment

0 Comments