জ্বলদর্চি

অন্নদাতাদের ভবিষ্যতের ভাবনায় কৃষিবিল নিয়ে এত উদ্বিগ্নতা কেন? কী আছে এই বিলে?/শ্রীদর্শী রায়

অন্নদাতাদের ভবিষ্যতের ভাবনায় কৃষিবিল নিয়ে এত উদ্বিগ্নতা কেন? কী আছে এই বিলে?

শ্রীদর্শী রায়

অবশেষে সারা ভারতের কৃষক সংগঠনগুলি ভারত বন্ধের ডাক দিয়েছে। হয় এই কৃষি সর্বনাশা বিল বাতিল কর নতুবা সারা ভারত ব্যাপী ৮-ই ডিসেম্বর একদিনের অবরোধ ও ধর্মঘট হবে এবং দিল্লী অবরোধ কর্মসূচি চলবেই। 

বিরোধীদের বক্তব্য :

একটা অদ্ভুত ফরমেশন বা রূপান্তর ধারাবাহিক ভাবে চলছে গত কয়েক বছর। এসেছে কিছু বদল। এই বদলগুলিতে সাধারণ মানুষের সুরাহার থেকে দুঃখ আর দুর্দশা বেড়েছে আরও। তাই আজ এক অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরী হয়েই আছে দেশজুড়ে। যার মূল অভিমুখ কিন্তু সবকিছুই বে-সরকারীকরণ। ইওরোপ বা আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গীতে এই দেশের প্রশাসন চালাতে গিয়ে, অতি বাণিজ্যকরণ করতে গেলে সমূহ বিপদ সেটা ধারাবাহিক ভাবে আমরা প্রাক্ করোনাকাল পর্যন্ত দেখে আসছি। কলে কারখানায় উৎপাদন সূচক আজ একদম নিচে, বে-রোজগার স্বাধীনতার পরে সর্বাধিক এবং আজ তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প থেকে ব্যাঙ্ক বীমা সরকারি দপ্তর রেল সব আজকে প্রশ্নের মুখে। আমরা শুধু দেখতে পাচ্ছি সংখ্যাগরিষ্ঠের এত অসহনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও সামান্য হাতে-গোণা দু-চারজন শিল্পপতির মুনাফা কয়েক'শ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। 

কেন বিরোধিতা ! কী আছে বিলে ! 

সরকারের দাবি কৃষিপণ্যের বাণিজ্যে উদারীকরণই এই তিনটি বিলের লক্ষ্য। তবে কেন বিরোধী দলগুলি এই তিনটি বিলের বিরোধিতা করছে? ঠিক কী আছে এই বিলগুলিতে? আসুন একটু জেনে নিই -
   
১. কৃষকের উৎপাদন ব্যবসা ও বাণিজ্য (প্রচার ও সুবিধাদি) বিল, ২০২০
বিধান -

প্রথম বিলটি কৃষি বাজার সংক্রান্ত। এই বিলে বলা হয়েছে এমন একটি বাস্তুতন্ত্র তৈরি করা হবে, যেখানে কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা রাজ্যের কৃষি পণ্য বাজার কমিটির আওতায় নিবন্ধিত কৃষিমান্ডিগুলির বাইরে খামারজাত পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের স্বাধীনতা পাবেন।

রাজ্যের ভিতরে ও বাইরে কৃষি উৎপাদনের বাণিজ্যে আর বাধা থাকবে না।

বিপণন ও পরিবহন ব্যয় কমবে, যার ফলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের আরও ভাল দাম পাবেন।

কৃষকদের ই-কমার্সের জন্য একটি সুবিধাজনক পরিকাঠামোও সরবরাহ করবে এই বিল।

বিরোধী দলগুলির আপত্তি -

বিরোধী দলগুলি জানিয়েছে এই ব্যবস্থার ফলে রাজ্যগুলির রাজস্ব সংগ্রহে বড় ক্ষতি হবে। কারণ, কৃষকরা নিবন্ধিত মান্ডিগুলির বাইরে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয শুরু করলে রাজ্য 'মান্ডি ফি' পাবে না।

এছাড়া, তারা প্রশ্ন তুলেছে, যদি সম্পূর্ণ কৃষিবাণিজ্যই মান্ডির বাইরে চলে যায়, সেই ক্ষেত্রে রাজ্যের নিযুক্ত 'কমিশন এজেন্টদের' কী হবে?

সেই সঙ্গে এই বিল শেষ পর্যন্ত এমএসপি-ভিত্তিক অর্থাৎ সরকারের বেঁধে দেওয়া ন্যুনতম সমর্থিত মূল্যের ক্রয় ব্যবস্থার অবসান ঘটাবে।

ই-এনএএম অর্থাৎ সরকারি কৃষিপণ্য বিক্রয়ের অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মতো বৈদ্যুতিন বাণিজ্য সংস্থাগুলি কৃষি মান্ডিগুলির পরিকাঠামোই ব্যবহার করে। ব্যবসা বাণিজ্যের অভাবে যদি মান্ডিগুলিই ধ্বংস হয়ে যায় সেই প্ল্যাটফর্মগুলির ভবিষ্যৎ কী হবে, সেই নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা।

২. কৃষকদের (ক্ষমতায়ন এবং সুরক্ষা) মূল্য আশ্বাস এবং খামার পরিষেবার চুক্তির বিল, ২০২০

বিধান -

এই বিলটি চুক্তিভিত্তিক চাষ সংক্রান্ত। এতে বলা হয়েছে, কৃষকরা ভবিষ্যতের কৃষি পণ্য বিক্রির জন্য কৃষিবাণিজ্য সংস্থা, প্রক্রিয়াকারক সংস্থা, হোলসেলার, পাইকারি ব্যবসাদার, রফতানিকারক বা বড়মাপের খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে প্রাক-সম্মত মূল্যে চুক্তি করতে পারবেন।

এই চুক্তির মাধ্যমে পাঁচ হেক্টরের কম জমির মালিক, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকরা লাভবান হবেন (ভারতের মোট কৃষকদের ৮৩ শতাংশই প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র কৃষক)।

এতে করে অপ্রত্যাশিত বাজারের ঝুঁকি কৃষকদের কাঁধ থেকে তাদের স্পনসর সংস্থাগুলির কাঁধে স্থানান্তরিত হবে।

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে কৃষকদের আরও ভাল তথ্য পেতে সক্ষম করবে।

বিপণনের ব্যয় কমিয়ে কৃষকদের আয় বাড়াবে।

মধ্যস্থতাকারীদের এড়িয়ে কৃষকরা সরাসরি বিপণনে জড়িত থেকে সম্পূর্ণ দাম নিজেরাই পেতে পারবেন।

প্রতিকারের সময়সীমা বেঁধে বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তির একটা কার্যকরী প্রক্রিয়া তৈরি করা হবে।
বিরোধী দলগুলির আপত্তি -

চুক্তি চাষের ব্যবস্থাপনায় কৃষকদের ক্ষতিই হবে। কারণ তারা চুক্তির অন্য পক্ষের মতো দরাদরি করার বিষয়ে দক্ষ নন,  তাই তাদের প্রয়োজনটা আদায়  করতে পারবেন না।

টুকরো টুকরো করে বহু সংখ্যক ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি করতে সম্ভবত স্পনসররা পছন্দ করবে না।

বড় বেসরকারী সংস্থাগুলিই হোক কিংবা রফতানিকারী, পাইকারি ব্যবসায়ী বা প্রক্রিয়াকাররা, বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ছোট কৃষকদের থেকে তারা অবশ্যই বেশি সুবিধা পাবে।


৩. অত্যাবশ্যক পণ্য (সংশোধনী) বিল, ২০২০

বিধান -

এই বিলটি পণ্য সম্পর্কিত। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে খাদ্যশস্য, ডালশস্য, তৈলবীজ, পেঁয়াজ এবং আলু জাতীয় পণ্য সরিয়ে নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে এই বিলে। যুদ্ধের মতো কোনও 'অস্বাভাবিক পরিস্থিতি' বাদে এই জাতীয় পণ্যগুলি মজুতের সীমা আরোপ করা হবে না।

এই বিধান বেসরকারী বিনিয়োগকারীদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা দূর করবে। ফলে বেসরকারী ক্ষেত্র / বিদেশী বিনিয়োগকারীরা কৃষিক্ষেত্রে আকৃষ্ট হবে।  

এতে করে, কোল্ড স্টোরেজের মতো কৃষি পরিকাঠামো এবং খাদ্য সরবরাহের শৃঙ্খলকে আধুনিকীকরণের জন্য বিনিয়োগ আসবে।

দামে স্থিতিশীলতা এনে কৃষক এবং গ্রাহক উভয়ই সহায়তা করা হবে।

প্রতিযোগিতামূলক বাজারের পরিবেশ তৈরি করে কৃষিপণ্যের অপচয় বন্ধ করা হবে।

বিরোধী দলগুলির আপত্তি 

বিরোধীদের বক্তব্য 'অস্বাভাবিক পরিস্থিতি'র যে উদাহরণ সরকার দিয়েছে সেই রকম চরম পরিস্থিতি সম্ভবত কখনই তৈরি হবে না।

বড় সংস্থাগুলি পণ্য মজুদ করার স্বাধীনতা অর্জন করার অর্থ তারা কৃষকদের উপর শর্ত আরোপ করার সুযোগ পাবে। যার ফলে চাষীরা কৃষিপণ্যের কম মূল্য পেতে পারেন।

এই বিধান পেঁয়াজের রফতানি উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহের পরিবেশ তৈরি করেছে।

এবারে ভেবে দেখুন ভারতবর্ষের মতন বহু ভাষাভাষী বিপুল জন সংখ্যার  কৃষি প্রধান দেশে এই বিলের যৌক্তিকতা কতটা? মোগল আমল থেকে ব্রিটিশ আমল হয়ে স্বাধীনতা উত্তর  ভারতবর্ষে কৃষকরা আজও কতটা শোষিত অবহেলিত আমরা জানি।কৃষকের ভাগের গুড় খেয়ে যায় মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা আজও। জমিদারি প্রথার সেই নৃশংস দিনগুলি বা নীলকরচাষীদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার, সাঁওতাল তথা আদিবাসীদের হুল বিদ্রোহ নিশ্চয় মনে পড়ে।আর ইংরেজ প্রভুদের ঔরসজাত সেই বাবুপ্রথা আর চাটুয়া চাটুকারদের ভুল ইতিহাস বানিয়ে লেখা আমাদের কিছুতেই সন্তুষ্টি এনে দেয় না। তাই প্রশ্ন থেকে যায় কয়েকটি-- এই বিলের মাধ্যমে কি আমরা ঐ ভাগের গুড় বৃহৎ পুঁজিপতিদের খেতে দেখব? না কি কৃষকদের কিছু লাভ হবে আদৌ! 

আমরা সবাই নিশ্চয়ই চাই এই বিক্ষোভ প্রশমিত  হোক। কৃষকের সত্যিকারের জয়যাত্রা শুরু হোক।

সময়ই বলবে শেষ কথা! 

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments