জ্বলদর্চি

অনিতা অগ্নিহোত্রী


অ নি তা  অ গ্নি হো ত্রী


বজ্র

দুর্নীতির গঙ্গাজল মাখা কটি ভাত, তার সঙ্গে শিলে পেষা সুসিদ্ধ আত্মসম্মান
এর জন্য বেঁচে থাকা, এর জন্য উদয়াস্ত হাঁটুতে চিবুক
প্রতিদিন পিছমোড়া হাত দুটি থালার কিনারে ঘষে ঘষে
অবশেষে ভাবা, থাক, মুক্তি নয়, বন্ধনেও কত মায়া জাগে—
এই ভাবে যদি আমি কবিতা-জীবনে বাঁধা পড়ে ভাবতাম বেঁচে আছি,
জেগে আছি শৈবাল, চলমান জলের কিনারে, তাহলে নিজেকে ধ্বংস, নষ্ট করে দিতাম
আগেই। ক্ষতবিক্ষত হাত, দগ্ধ ঠোঁট, নত হয়ে চুম্বন করেছে আকাশের
নীরবতা। দৃষ্টিহীন চোখ জেনে গেছে
মুক্তির বিকল্প নেই। রক্তধমনীতে স্বাধীনতা নৃত্যপর।
পায়ে পায়ে ক্ষুধার্ত গিরিখাত পার হয়ে
আমি যাই বাসনার খোঁজে।

(মাটির ঢেলাটি গেল জল আনতে, ফিরলো না আর।
পাতাটি আগুন নিতে গিয়ে পুড়ে ছাই।— আদিবাসী লোককথা)

চণ্ডালের কাছে যাও। শ্মশানের ধূলিমাখা পায়ে । মাটির মালসায় পাবে
অদাহ্য নাভি, অদগ্ধ কশেরুকা।
বজ্র হবে।

সংসার-সীমান্ত-বাসী, শ্রেণিহীন, তোমাকে প্রণাম।
জলের কাছে

জলের কাছে এসে আমার পথ ফুরায়। ঘাটের সিঁড়ির উপর মেয়েরা যে জলকলস রেখে গেছে, 
তাদের বলা গল্পে আমার সন্ধ্যা নামে
সকালে ডাকার কথা, কেন ভাতের গন্ধে রঙিন মোরগ ফালা ফালা করে দেয় সূর্য অস্তবেলা। 
চারদিকে জলকষ্ট, তবু মেয়েদের স্নানপর্ব শেষই হয় না যেন।
হয়তো যে শাড়ীগুলি গাছেদের ডালে রেখে গেছে, সেগুলিই তাদের শরীর।
জলের ভিতর কোনও নারী অবয়ব নেই, উঠে আসবে না কেউ।
ধুরন্ধর জল চায় সমুদ্রের কাছে যেতে। দিঘির তলায় কোনও গোপন সুড়ঙ্গ ছিল ত্রেতা  যুগে। 
সেই পথ রুদ্ধ, জলঝাঁঝি আর নিভন্ত শৈবালে। 
দু'একটি শঙ্খ, জল মাকড়সার ছিন্ন মাথা রয়ে গেছে,
জল ভাবে সমুদ্র হঠাৎ একদিন ধেয়ে আসবে। জলের অবোধ আশা কষ্ট দেয়, তাকে বলে বোঝাতে পারি না।
জলের কাছে এসে পথ ফুরায়।
আমার পৃথিবী কমে ছোট হয়ে আসে এক জলচর পাখির মতন, কাছিমের ডিমের আকার।
জলজ অন্ধকারে নেমে যেতে যেতে হঠাৎ 
আঙুলে ঠেকে শাঁখা পরা অশরীরী হাত। কাংস্য শব্দে বুঝি ওই কলসেরা জলেই চলেছে।


দুপুর

একটা দুপুর থেকে অন্যটাকে আলাদা করতে গিয়ে হাতে লেগে যায় মরচে রং পাতার প্রজাপতি পাখার নখে গেঁথে যায় সূর্যের তীক্ষ্ণ ফলা আর জলের আয়না চোখে আলো ফেলে চুপ করে বসে থাকে শেওলা জড়ানো ডুবে মরার গল্পে ন বউ তুমি তাকে জানতে তার কান্না শোনোনি গোঙানো কুকুরের মত ভর দ্বিপ্রহরে আজকাল একটা করে দুপুর ঘুঁটের মত অন্যটার গায়ে লেগে জমে গেছে যেন বিরহিনীর ভাতঘুম যে আসবে না ফিরে তার কাটা মুণ্ডু জলতলে বসে আছে গ্রেফতারের অপেক্ষায় কিন্তু না বড়বাবু কই তাঁর বদলির পর এ তল্লাটে বিলকুল সন্নাটা লম্বা হলুদ বাদামী এক দুপুরের চলমান অজগর গিলে নিচ্ছে সমস্ত যাতনা বিকেলের বউডুবি মাঠে যদি রাত্রি
আসে তাই ভাল তাই সত্য হোক হিরণ্ময়।


লিঞ্চিং

একদিন শীতঘুম থেকে সাপ উঠে এল, চারদিকে পাতা ওড়া ছড়ানো বিকেল
রোদ বেঁকে পড়ে আছে বাঁশঝাড়ে, রক্ত জমে পুরাতন বাঁশের পাতায়
শীতপৃথিবীর মায়া সাপের স্মৃতিতে, আর তার মনে নেই বসন্ত কেমন
রৌদ্রের উত্তাপ কত খর হতে পারে, বরষার হর্ষভরা নৃত্যপরতার কোনও ছবি
সতর্ক, অচিন গন্ধ, পাতার হাঁটার শব্দ বুকে নিয়ে সাপ যেই বেরোল বিহ্বল
তখনই হাজার জোড়া পায়ে এল লেঠেল মানুষ, অপরিচিতের জন্য যাহাদের
ভ্রমহীন দ্বেষ, যারা রক্ত গন্ধে জীবনের আস্বাদ পায়, যারা কোনও শিকার না করে
ঘরে ফিরবে না। বাঁশঝাড়ে তাজা রক্ত, থ্যাঁৎলানো সাপের মাথায় সন্ধ্যারোদ
প্রপাত

প্রপাতের কাছে। জলের গেরুয়া শব্দ। মাথার রন্ধ্রের মধ্যে জলের চিৎকার
পাক খায়, সালওয়া জুড়ুমে যার গ্রাম ছারখার সেই গোণ্ড যুবা
জল হয়ে লাফিয়ে পড়েছে, পাথরের ধাপে ধাপে ফেনা হয়ে থুতু দিচ্ছে
আমাদের গূঢ় মন্ত্রণাকে; আত্মসমর্পক ইনস্যাস, তাজা কার্তুজ
সকলেই পূর্বপরিচয় লুকিয়েছে, করমর্দনের ছবি ছাপা হলে মুক্তি পাবে বলে
চাষিবাসি দিনমজুরের এই ছলনায় টাকা আছে, উর্দির লুণ্ঠন শেষ হয়
বধূদের যৌন যন্ত্রণার  অবশেষ। সমস্ত পাহাড় নদী অরণ্য প্রান্তর
যার পাঁজরের মধ্যে, সেই গোণ্ড গ্রামপতি পূর্বজনমের অলিখিত
মুক্তিগাথা গেয়ে চলে চলে, আমাদের ভ্রম হয়, প্রপাতের গৈরিক চিৎকার।

----------

Post a Comment

4 Comments

  1. চণ্ডালের কাছে যাও। শ্মশানের ধূলিমাখা পায়ে । মাটির মালসায় পাবে
    অদাহ্য নাভি, অদগ্ধ কশেরুকা।
    বজ্র হবে।
    অসাধারণ ভাষার মাধুর্য, অনবদ্য লেখনি। সব কবিতার অ, অলঙ্করণ অনন্য অসাধারণ লাগলো কবি। ভালো থাকুন ।

    ReplyDelete
  2. অপূর্ব কাব্যশৈলী

    ReplyDelete
  3. অমিতরূপ চক্রবর্তীJuly 13, 2020 at 8:25 PM

    ভাল লাগল ।

    ReplyDelete