মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৬৩
জন্মেজয় ওঝা (স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিধায়ক, শিক্ষক, পটাশপুর)
ভাস্করব্রত পতি
বাবা বৈকুন্ঠনাথ ওঝা ছিলেন এলাকার একজন হতদরিদ্র কৃষক। অতি শৈশবেই মা অম্বিকাদেবীর মৃত্যু হয়। অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটতো তাঁদের। গ্রামের নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর পর সারদাবাড় উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়ে পানিয়া সারদাবাড় এম ই স্কুল থেকে পড়াশোনা করেন। তিনি পটাশপুরের প্রাক্তন বিধায়ক জন্মেজয় ওঝা। বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১৯২৮ এর ৮ ই জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন প্রত্যন্ত লালুয়া গ্রামে। ১৯৪৪ এ ধানবাদ একাডেমিতে শিক্ষালাভ করেন। ১৯৪৮ এ পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর কলকাতার আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫২ তে বি কম পাস করেন। সেইসাথে বাল্যগোবিন্দপুর জ্ঞানকর্ম বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতার চাকরি পান।
১৯৪২ এর ২৯ শে সেপ্টেম্বর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে থানা দখল অভিযানে যুক্ত হয়ে পড়েন। তখন তিনি ক্লাস সিক্সের ছাত্র। নিজের বয়ানে উল্লেখ করেছেন সেই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের স্মৃতি -- 'ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কী উত্তেজনা! বিদেশী শাসকদের দেশ থেকে তাড়াবার জন্য নেতারা গ্রামে গ্রামে মিটিং করতেন। মনে পড়ে জীতেন্দ্রনাথ মাল প্রায় আসতেন। তিনি একদিন চকরসুলে একজনের বাড়িতে মিটিং করছেন। লোকেরা দৃঢ় ও একাগ্রচিত্তে তাঁর কথা শুনছেন। তিনি খুব ভাল বক্তা ছিলেন না। তবু তাঁর কথায় সবার মনে কী উদ্দীপনা। থানা দখলের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হতে চাইলাম। জীতেনবাবু রাজী হলেননা। একে বয়স খুব কম। তার উপর আমি বড্ড কৃশ ছিলাম। তিনি বুঝিয়ে বললেন, অনেক দূরে যেতে হবে। তুমি যেতে পারবে না বাপু। আমি তখন ক্লাশ সিক্স পাশ করে সেভেনে উঠেছি। কিন্তু আন্দোলনের তোড়ে স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। বড় ছেলেরা আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। একদিন দেখলাম, এলাকার অনেকে লাঠি নিয়ে সন্ধ্যায় বেরিয়ে গেলেন। পরদিন শুনলাম, থানা ভাঙা হয়েছে। পুলিশেরা আত্মসমর্পণ করেছে। সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে যোগ না দিলেও খবর দেওয়া নেওয়া, চিঠি চালাচালি এসব কাজের মধ্য দিয়ে আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম, ভাবতে আজও রোমাঞ্চ জাগে'।
কংগ্রেস বিরোধী মানসিকতায় বলীয়ান ছিলেন জন্মেজয় ওঝা। ১৯৫৬ তে সেটেলমেন্টের সময় জোতদারদের দ্বারা বঞ্চিত ভাগ চাষীদের পাশে দাঁড়িয়ে বর্গা লেখানোতে নেতৃত্ব দেন। সাধারণ মানুষের লড়াই সংগ্রামের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন তিনি। ১৯৫৯ এ মথুরা পঞ্চায়েতের প্রধান নির্বাচিত হন। একটানা ১৯৯৩ পর্যন্ত ৩৪ বছর গ্রাম প্রধানের পদে থেকে এলাকার নানা উন্নয়নমূলক কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। ১৯৫০ এ নিজের গ্রামে উন্নয়ন মূলক কাজের লক্ষ্যে গঠন করেন লালুয়া প্রগতি সংঘ। আজ ও বেঁচে রয়েছে তাঁর আমলে লাগানো ৯৩ হাজার বিভিন্ন গাছের সারি।
১৯৬৭-৬৮ তে শুরু হল খাদ্য আন্দোলন। সেইসাথে বারচৌকা ও দুবদা বেসিন সংস্কার আন্দোলনে সামিল করলেন নিজেকে। তখন সাংসদ সমর গুহ। কেলেঘাই সুবর্ণরেখার বন্যায় মহকুমা জুড়ে বিপর্যস্ত অবস্থা। পটাশপুর, ভগবানপুরে ত্রাণবিলির নেতৃত্বে জন্মেজয় ওঝা। সেই পর্বেই এরাজ্যে আগমন ঘটে তাইচুং, তাইনান ইত্যাদি উচ্চফলনশীল ধানের চাষ। ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার শুরু হয় তখন থেকেই।
১৯৬৯ এবং ১৯৭২ এ মুগবেড়িয়া কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও পরাজিত হন। আসলে তখন কংগ্রেসের জয়জয়কার। ইন্দিরা গান্ধীর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ছিল। এরপর ১৯৭৭ এ বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠা হয়। পটাশপুর কেন্দ্র থেকে জনতা দলের হয়ে বিধায়ক পদে জেতেন জন্মেজয় ওঝা। এই বিধায়ক নির্বাচিত হওয়া প্রসঙ্গে জন্মেজয় ওঝা লিখেছেন, '১৯৭৭ সাল। জীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট। নির্বাচনী সভায় বিপুল সাড়া। তবে পশ্চিমাঞ্চল দাবী করল কেলেঘাই, বাঘুইতে তিনটা ব্রিজ, মধ্যাঞ্চল দাবী করল বারচৌকা জলনিকাশী, পূর্বাঞ্চল ইটাবেড়িয়া খালনিকাশী। প্রতিশ্রুতি দিতে হল। এম এল এ হয়েই এই তিনটি ব্যাপারে মন দিলাম। বিরোধী দলের এম এল এ। তবু কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে ভালই সম্পর্ক হল। কেলেঘাই, কনকপুর, বাঘুই ব্রীজ ১৯৬২ সালে বিধান রায়ের সময় হওয়ার কথা ছিল। ঐটি ছিল প্রস্তাবিত দীঘা যাওয়ার সোজা রাস্তা। ১৭ বছর অতীত। কোন উচ্চবাচ্য নাই। খোঁজ নিয়ে দেখলাম সব অথৈ জলে। প্রাথমিক তিক্ততা সত্ত্বেও পূর্তমন্ত্রী যতীনবাবুর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করে নতুন করে প্ল্যান এস্টিমেট করে শেষ পর্যন্ত ক্যাবিনেট কমিটির অনুমোদন এনে পর পর তিনটি কেলেঘাই ও কনকপুর ৮২ মধ্যে এবং বাঘুই ব্রীজ আরম্ভ করেছিলাম ঐ সময় মধ্যে'।
বিধায়ক জন্মেজয় ওঝার সম্পর্কে প্রাক্তন মন্ত্রী প্রবোধচন্দ্র সিনহার উপলব্ধি প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, 'বিধানসভায় জন্মেজয় বাবুর ভূমিকা ছিল খুবই প্রশংসনীয়। সদা বিধানসভা কক্ষে উপস্থিত থেকে কর্মসূচীর বিভিন্ন বিষয়ে তীক্ষ্ণ যুক্তি দিয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। এ ছাড়া দলের নেতৃত্বে সে সময় যেসব আন্দোলন হয়েছে তাতেও তাঁর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। মরিচঝাঁপিতে জনতা দলের যে বিধায়কগণ গিয়েছিল, জন্মেজয়বাবু ছিলেন তার অন্যতম সদস্য। এই ঘটনায় পুলিশ বিধায়কদের গ্রেপ্তার করে বসিরহাট থানায় নিয়ে আসে। কিন্তু দলনেতা কাশীকান্ত মৈত্রের ইঙ্গিতে জন্মেজয়বাবু নিজ পরিচয় প্রকাশ না করে কলকাতায় ফিরে আসেন এবং পরদিন বিধায়সভায় এই নিয়ে তোলপাড় করেন'।
এইসময় তিনি জনতা পার্টির জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য নির্বাচিত হন। বাঘুইয়ের পূর্ব্বপাড় বরাবর মুখ আয়মা বড়বড়িয়া থেকে খাকুড়দা বাজার পর্যন্ত ইস্ট এমব্যাঙ্কমেন্ট এবং কোপ্তীপুরের বাঁক সরাবার জন্য স্কীম অনুসারে সমীক্ষা এবং এস্টিমেট করে কাজ শুরু করার উদ্যোগ নেন। এছাড়া বাঘুই মোহনা থেকে পূর্বদিকে লাঙ্গলকাটা ঘাট পর্যন্ত কেলেঘাইর যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা বেঁউদি জাল তোলার চেষ্টা করেছিলেন বিধায়ক হিসেবে এলাকার মানুষের উন্নয়নের স্বার্থে।
গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যদের সাথে জননেতা জন্মেঞ্জয় ওঝা
ফের ১৯৮২ তে নির্বাচনে দাঁড়ালেও পরাজিত হন। কিন্তু এরপরেও নানা সামাজিক কাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন সর্বক্ষণ। ১৯৯৪ তে শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন। ১৯৯০-১৯৯৪ পর্যন্ত ছিলেন জনতা দলের জেলা সভাপতি। এরপর ১৯৯৫-১৯৯৬ পর্যন্ত সোশ্যালিস্ট পার্টির রাজ্য সভাপতি পদে আসীন ছিলেন। ১৯৯৬ থেকে আমৃত্যু তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সমাজবাদী পার্টির রাজ্য সভাপতি এবং ন্যাশনাল কাউন্সিল মেম্বার। জন্মেজয় ওঝা সম্পর্কে প্রাক্তন মন্ত্রী অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সিনহা উল্লেখ করেছেন, 'জন্মেজয় ওঝা শুধু প্রাক্তন বিধায়ক ছিলেন না, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি ছিলেন ছাত্র দরদী প্রথিতযশা শিক্ষক, নৈতিক ও মূল্যবোধের রাজনীতির একনিষ্ঠ সৈনিক এবং বিশিষ্ট সমাজসেবী। জীবনযাত্রা ছিল খুবই সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর। খদ্দরের মোটা ধুতি ও পাঞ্জাবি ছিল তাঁর আজীবনের সঙ্গী। দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র - এই আদর্শগুলি ছিল তাঁর সমগ্র জীবনের অবলম্বন। এ পথ থেকে তিনি কখনও বিচ্যুত হননি। রাজনৈতিক জীবনে তিনি যাত্রা শুরু করেন প্রজা সোস্যালিস্ট পার্টির (পি এস পি) সদস্য হিসেবে। পরবর্তীকালে এই দল জনতা পার্টির সাথে মিশে গেলে স্বাভাবিকভাবে তিনিও জনতা পার্টিতে যুক্ত হন। জনতা পার্টির সদস্য হিসেবেই তিনি পটাশপুর কেন্দ্রের বিধায়ক নির্বাচিত হন। জনতা পার্টির বিপর্যয়েও তিনি দল পরিবর্তন না করে ওই দলে থেকে যান। নিজ আদর্শে অবিচল থেকে নিরলস কাজ করে গেছেন। তৎকালীন কাঁথির সাংসদ বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ অধ্যাপক সমর গুহর তিনি ছিলেন বিশিষ্ট বন্ধু এবং শক্তির স্তম্ভ স্বরূপ'। জেলার বিভিন্ন বন্যা বা ঝড়ের ঘটনা ঘটলেই ত্রাণ নিয়ে মানুষের পাশে পৌঁছে গিয়েছেন অবলীলায়। বেশকিছু গল্পও লিখেছেন তিনি। ২০২২ এর ২ রা মে মেদিনীপুরের মানুষ রতন এই স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষটির জীবনাবসান ঘটে।
তথ্যঋণ -- মৃত্যুঞ্জয়ী জন্মেজয়, সম্পাদনা -- মন্মথনাথ দাস
🍂
0 Comments