জ্বলদর্চি

মধুমিতা মহাপাত্র


ম ধু মি তা  ম হা পা ত্র 


মহান দেশসেবক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়

দেশ সেবার মহান ব্রত নিয়ে ভারতমাতার যে কৃতিসন্তানগণ আবির্ভূত হয়েছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম।যিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর জনজীবনের নানাবিধ সমস্যাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে, তার সমাধানে প্রয়াসী হয়েছিলেন। সেবাব্রত এর সূত্র ধরে তাঁর সাময়িক পত্র সম্পাদনায় মনোনিবেশ।শেষ পর্যন্ত সাময়িকপত্র সম্পাদনার জগতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সমর্থ হয়েছিলেন।দেশপ্রেমিক, সাহিত্য রসিক, শিল্পানুরাগী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় আজীবন যে মহান আদর্শকে অনুসরণ করেছিলেন তা বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
বহুপ্রতিভাধর রামানন্দ ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে মে বাঁকুড়া জেলার এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বাঁকুড়া জেলার জেলর শ্রী নাথ চট্টোপাধ্যায় মাতা  হরসুন্দরী দেবী।তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী রামানন্দ প্রথমে টোলে ভর্তি হলেও বাঁকুড়ার একটি বাংলা স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন।তারপর বাঁকুড়ার ইংরেজি স্কুল থেকে ১৯৮৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে এফ. এ ও সিটি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বি.এ এবং ১৮৯০ সালে এম.এ পাশ করেন। সিটি কলেজে অধ্যাপনা দিয়েই কর্মজীবন শুরু করেন। পরে ১৮৮৫ সালে এলাহাবাদে 'কায়স্থ পাঠশালা'য় অধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি দুঃস্থ মানুষজনের সেবার উদ্দেশ্যে গড়ে তোলেন  'দাসাশ্রম'। যেখানে তিনি তাঁর উপার্জনের বেশিরভাগটাই দান করতেন। দাসাশ্রম এর মুখপত্র ছিল 'দাসী' পত্রিকা।যার প্রস্তাবনায় তিনি লিখেছিলেন--"বঙ্গ সাহিত্য সংসারে  মাসিক পত্রিকার অভাব নাই ,এতগুলো মাসিক পত্রিকা থাকিতে আমরা কেন আর একখানি ক্ষুদ্র পত্রিকা প্রকাশ করিতেছি এই প্রশ্ন সকলেই জিজ্ঞাসা করিতে পারেন।.. বঙ্গীয় পুরুষ ও রমণীগণের হৃদয়ে  সেবার ভাব জাগাইয়া দেওয়াই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য।"
ভারতবর্ষের উত্থান-পতন ময় এক দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী তিনি ‌।আর এই ভাঙ্গা-গড়াকে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরার গুরু দায়িত্ব নিয়েছেন প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে। রামানন্দের হাত ধরে এদেশীয় সাময়িক পত্রিকা এক অনন্য মাত্রা পেয়েছিল।তার সৃজনশীল চিন্তাভাবনার স্পর্শে ধন্য হয়েছিল যে সব পত্রিকা সেগুলি হল 'ধর্মবন্ধু' ,'ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার', 'প্রদীপ'' দাসী' 'কায়স্থ সমাচার' 'প্রবাসী' 'মডার্ন রিভিয়ু'।
শিল্প-সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, জাতীয় সমস্যা, প্রভৃতি বিষয়ে ছিল  তাঁর গভীর জ্ঞান । সেই সঙ্গে ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই ছিল সমান দক্ষতা তাই সম্পাদক ও লেখক উভয় ক্ষেত্রেই সফল হতে পেরেছিলেন।দেশবাসীর স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই এর সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য আমৃত্যু প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সাময়িক পত্র হয়ে উঠেছে  তাঁর হাতিয়ার।
সম্পাদনা কার্যে তাঁর কিছু মৌলিক ভাবনা আজও চির স্মরণীয় হয়ে আছে ।যেমন সচিত্র পত্রিকায় প্রকাশ।তিনি প্রথম উৎসাহ দেওয়ার জন্য লেখকদের দক্ষিণা প্রদানের ব্যবস্থা করেন ‌।তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় আরেক নতুনত্ব ছিল  আলোচনা বিভাগ । যেখানে লেখক ও পাঠকের বক্তব্য থাকতো।শুধু সুকুমার সাহিত্য নয় অর্থাৎ গল্প কবিতা সাহিত্য তত্ত্ব বিষয়ক প্রবন্ধই নয়, বৈচিত্র্যময়  জ্ঞান জগতের বহু দিক তাঁর পত্রিকায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠত। ইতিহাস, ভূগোল ,বিজ্ঞান, রাজনীতি অর্থনীতি, নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ভাষা ,নানাবিধ সামাজিক সমস্যা ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতা প্রভৃতি। এককথায় পত্রিকা প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য ছিল লোকশিক্ষা। তাঁর কথায়--" আমি সম্পাদকের কর্মকে শিক্ষক বা অধ্যাপকের কার্য অপেক্ষা কম পবিত্র ও দায়িত্বপূর্ণ বলে মনে করি না"

দীর্ঘ সময়ের এই সম্পাদনা পর্বে জহুরির মতো প্রতিভা রত্নের অন্বেষণ করেছেন প্রতিনিয়ত।অর্থ দান, প্রীতিদান এর মাধ্যমে প্রতিভার উত্তরণের পথকে প্রশস্ত করেছেন, দিয়েছেন যোগ্য সম্মান।কোন বিরূপ সমালোচনা ,তিরস্কার ,দৃঢ় চেতা ,নির্ভীক চরিত্রের এই মানুষটির আদর্শ চু্্যতি ঘটাতে পারেনি। পক্ষপাত প্রদর্শন ত্যাগ করে  বরাবর সত্য ও ন্যায়ের পথে চলেছেন। আর এ জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতেও পিছপা হননি।সস্তায় পাঠক চিত্তকে আকর্ষণ বা রুচিহীন বিজ্ঞাপন এসব থেকে বিরত থেকেছেন বরাবার ।এ প্রসঙ্গে কবিগুরুর কথার অবতারণা করা যেতে পারে--প্রথম যখন রামানন্দ বাবু 'প্রদীপ 'ও পরে 'প্রবাসী' বের করলেন তাঁর কৃতিত্ব ও সাহস দেখে বিস্ময় লাগল। আকারে বড়, ছবিতে অলংকৃত ,রচনায় বিচিত্র এমন জিনিস যে বাংলাদেশের চলতে পারে তা বিশ্বাস হয়নি।

দেশমাতার সঙ্গে মাতৃভাষা বাংলার প্রতি তাঁর দরদ ছিল সীমাহীন। তাই প্রচার ও প্রসারের জন্য উৎসাহ ও ছিল অন্তহীন। সেজন্য বিরূপ মন্তব্য সত্ত্বেও  বিশিষ্ট ভাষাবিদ যোগেশচন্দ্র রায় উদ্ভাবিত নতুন অক্ষর ও লেখা ছাপাতে ও দ্বিধা বোধ ছিল না। ভারতীয় চিত্রকলাকে সর্ব জনসমক্ষে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ও তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য । এ বিষয়ে নন্দলাল বসু ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূয়সী প্রশংসা তে ই তার প্রমাণ মেলে।প্রখ্যাত ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজকে বাঁকুড়া থেকে শান্তিনিকেতনে এনে শিল্প শিক্ষার সুযোগ করে দেন তিনি , রামকিঙ্কর তাঁর এই ঋণ অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন।
শুধু দেশে নয় বিদেশেও তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। রোমা রলা উক্তি তে তার প্রমাণ মেলে--'' রামানন্দ কে দেখলে টলস্টয় এর কথা মনে হয়।'' দেশে বিদেশে অভিনন্দিত এই সেবাব্রতী সাময়িকপত্র সম্পাদনার ইতিহাসে যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন অদূর ভবিষ্যতেও দেশবাসীর কাছে তা অনুসরণযোগ্য হয়ে থাকবে।

১৯৪৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রয়াণ ঘটে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের।
------

Post a Comment

2 Comments

  1. মানবকল্যাণ আর সাহিত্য সেবায় নিবেদিত প্রাণ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা। লেখিকাকে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. সুন্দর লেখা। অনেক কিছু জানলাম।

    ReplyDelete