সূ র্যে ন্দু বি কা শ পা ত্র
মানবেন্দ্র নাথ রায়। জন্ম ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে ৩০ মাইল উত্তর-পূর্বে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার আড়বেলিয়া গ্রামে। যদিও তাঁর বাবার আদি নিবাস ছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমার খেপুত গ্রাম। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস সেই ইতিহাসের বীর সন্তানদের যে নামগুলো আমাদের স্মৃতিতে ভেসে বেড়ায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, ক্ষুদিরাম বসু, মাস্টারদা সূর্যসেন, চিত্তরঞ্জন দাস সহ আরো অনেকে। এইসব নামের আড়ালে প্রায় বিস্মৃতির অতলে চলে যাওয়া নাম হল মানবেন্দ্র নাথ রায়। যাঁর প্রকৃত নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। আমরা জানি কোন ঐতিহাসিক চরিত্র বা ঘটনা বিচার করতে গেলে ওই সময়ের বাস্তব পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থান, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, জ্ঞান জগতের পরিধি সমস্ত কিছুই বিচারে রেখে সামগ্রিকভাবে কোন ব্যক্তি অথবা ঘটনাকে দ্বান্দ্বিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে মূল্যায়ন করতে হয়। এই পদ্ধতি অবলম্বন না করে যদি আমরা কোনো বিষয়কে ভিন্নতর কোনো দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করি তবে তার দ্বারা আমরা ভুল করবো। এর ফলে অযথা কোনো ব্যক্তিকে অথবা বিষয়কে গুরুত্ব বা গুরুত্বহীন করে ফেলে নিজের অজ্ঞতাকেই প্রকাশ করবো। মানবেন্দ্র নাথ রায় যিনি জ্ঞান জগতের এক বিরাট স্তরে নিজেকে উন্নীত করেছিলেন, ১৪ টা ভাষা শুধু জানতেন না সেই ভাষায় প্রায় ২০০বেশি বই লিখেছেন । সোভিয়েত রাশিয়া, মেস্কিকো , চীন, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, সুইজারল্যান্ড মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সমস্ত দেশের রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে নিজে শুধু সংযুক্ত নন্ এক তাৎপর্যপূর্ণ উচ্চতায় আসীন হয়েছিলেন, দ্বিতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের অন্যতম নেতৃত্ব এবং 'কলোনিয়ান থিসিস' এর ওপর তাঁর অবদান যাঁকে কমরেড লেনিন বলেছেন- 'ঔপনিবেশিক বিপ্লবীদের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি ' সেই মানুষটিকে আমরা ভুলতে বসেছি! জীবনের নিয়মে বহু ঘটনা, ব্যক্তিকে, সমাজ জীবনের ঘটে যাওয়া নানান বিষয় আমরা ভুলে যাই । এই ভুলে যাওয়ার মধ্যে লজ্জার তেমন কিছু থাকে না কিন্তু যখন আমাদের জীবনকে গড়ে তোলার প্রশ্ন ওঠে, সমাজকে সুন্দর করার প্রশ্ন ওঠে, অগণিত অসহায় নিপীড়িত মানুষদের মুক্তির প্রশ্ন ওঠে, তখনই আমাদের প্রেরণার প্রয়োজন হয়। আর সেই প্রেরণার কাজ করে অতীত ভারতবর্ষের বিস্ময়কর চরিত্রেরা। যেসব চরিত্র তাঁদের জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সমাজ জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁদের ভূমিকার মধ্য দিয়ে সমাজকে তাঁরা অনেকখানি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে টেনে নিয়ে গেছেন। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, সুভাষচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ এঁদেরই নাম। এঁদেরকে যখন ভুলে যাই তখন ভুল নয়, করে ফেলি অপরাধ। অমার্জনীয় অপরাধ। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই অবিস্মরনীয় নামগুলোর সঙ্গে এক সারিতে না এলেও মানবেন্দ্র নাথ রায় এক অবিশ্বাস্য বিরলদৃষ্ট্য সংগ্রামী নেতা ছিলেন। যাঁর মতো এতো আন্তর্জাতিক ব্যাপ্ততা ও পান্ডিত্বের গভীরতা অন্যদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল আমরা তা অস্বীকার করতে পারব না। এই অনালোচিত মানুষটির জীবন সংগ্রাম নিয়ে এবং সেখান থেকে শিক্ষা নিতে এই আলোচনাটা আমি অবতারণা করছি।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মের ১০ বছর আগে মানবেন্দ্র নাথ রায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন যখন ভারত বর্ষ ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খলে শৃঙ্খলায়িত। যখন ভারতবর্ষের জনসাধারণ অশিক্ষা কুসংস্কার মধ্যযুগীয় ধর্মীয় গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন । এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। এর বাইরে জনজীবনে আরেকটি ক্ষিণোজ্জ্বল ধারা যে ধারার প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ। যাকে অনুসরণ করে কতিপয় ভারতীয়ের মধ্যে দেশপ্রেম, শিক্ষা গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা, প্রতিবাদ করার মানসিকতা গড়ে উঠেছিল। সেই ধারাকে জীবনে গ্রহণ করলেন মানবেন্দ্র নাথ রায়। তখন তিনি সবে কৈশরে পদার্পণ করেছেন। ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র ঋষি বঙ্কিম চন্দ্রের আদর্শে এক বৈপ্লবিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন তার নাম ছিল অনুশীলন সমিতি। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ভারতমাতার শৃঙ্খল মোচনের স্বপ্ন নিয়ে ওই দলের তিনি সদস্য হন। নিজের শরীরকে বলিষ্ঠ কষ্টসহিষ্ণু ও দৃঢ় করে গড়ে তোলা এবং নিজের বিচার বিতর্ককে সুতীক্ষ্ণ, যুক্তির প্রয়োগে দক্ষতার কৌশল শেখার জন্য লাঠিখেলা, কুস্তি, শরীরচর্চার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিপ্লব ও বিপ্লবীদের ইতিহাস সম্বন্ধে প্রচুর পড়াশোনা করতে থাকেন। ১৯০৫ সালে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সম্বর্ধনা দেয়ার কারণে তাঁকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি হরিনাভি স্কুলে আর ফিরে যাননি। পরে ১৯০৬ সালে জাতীয় বিদ্যাপীঠ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যাদবপুরে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন কারণ বোমা তৈরীর ফরমুলা টি তাঁর সর্বাগ্রে জানা চাই। ১৯০৭ সালের তাঁরই নেতৃত্বে বাংলার প্রথম রাজনৈতিক ডাকাতি হলো চিংড়ি পোতা রেল স্টেশনে। তখন তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি বছর। পরবর্তীকালে আরেকটি রেল ডাকাতি করতে গিয়ে তিনি ধরা পড়েন। তাঁকে কুড়ি মাসের জন্য কারারুদ্ধ থাকতে হয়। তার মধ্যে নয় মাস মানবেন্দ্র নাথ রায় নির্জন সেলে কাটান। সেই সময় স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষায় প্রাণিত হয়ে যোগাভ্যাস করে নিজের মনঃসংযোগ করার ক্ষমতা কে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলেন। ১৯১৫ সালে বাঘাযতীন, অতুল ঘোষ, তিনি নিজে প্রচুর অস্ত্র সংগ্রহ করে জার্মানির সাহায্যে ভারতে বিদ্রোহ ঘোষণার এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। জার্মানির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য এম এন রায় কে সী মার্টিন ছদ্মনামে বাটাভিয়া পাঠানো হয়। আপনারা জানেন বুড়িবালাম নদীর তীরে বিপ্লবী বাঘা যতীনের দুঃসাহসিক সংগ্রাম যেখানে মারাভিক নামক জাহাজে অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো হয়েছিল সেই অস্ত্র পাঠানোর ক্ষেত্রে মানবেন্দ্র নাথ রায় জার্মান কন্সাল থিওডোরকে প্রভাবিত করে যুদ্ধাস্ত্র ভর্তি জাহাজ বুড়িবালাম নদীর তীরে পাঠান । ওই যুদ্ধের কথা পাঠ্য বইতে আমরা পড়েছি। ওই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম বাঘাযতীন কে ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্মরণীয় চরিত্র দিলেও এম এন রায়ের ভূমিকার কথা অনুল্লেখ থাকে। বুড়িবালামের পরীখা যুদ্ধে বিপ্লবীদের পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে মানবেন্দ্র নাথ রায় আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। ১৯০৮সালের ১১ই আগস্ট ভারত মাতার অগ্নি কিশোর শহীদ ক্ষুদিরাম হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় ধারণ করে গোটা ভারতবর্ষের ছাত্র-যুবর মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা লড়াই, করবার সাহস, অকুতোভয় মনন জাগিয়ে দিয়েছিলেন। মানবেন্দ্র নাথ রায়ের হৃদয়ে সেই স্পর্শ অনিবার্যভাবেই লেগেছিল । তাই তথাকথিত নির্বিঘ্নে জীবনযাপন নয়। পড়াশোনা অত্যন্ত মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজদের নকরি বৃত্তি নয় । যথার্থ মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপদসংকুল জীবন গ্রহণ করলেন। যে কারণে আমরা শ্রদ্ধায় মাথা অবনত না করে থাকতে পারিনা।
তিনি ফিলিপাইন দেশের মধ্য দিয়ে নানা পথ ঘুরে জাপানের উদ্দেশ্যে রওনা হন।পথে হরি সিং নাম বদল করে মিস্টার হোয়াইট ছদ্মনামে নাগাসাকি শহরে অবতীর্ণ হন। সেখানে রাসবিহারী বসুর সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক পথ সম্পর্কে কোন আশ্বাস দিতে না পারায় চীনের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী সান ইয়াৎ সেনের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁর ব্যক্তিত্বে দ্বারা সান ইয়াৎ সেন কে জয় করেন। সান ইয়াৎ সেন ১৯১৩ সালের নানকিং বিদ্রোহে পরাজয়ের পর গোপনে জাপানে পলাতকের জীবন যাপন করছিলেন। মানবেন্দ্র নাথ রায় তাঁকে প্রস্তাব দিলেন কিছু অস্ত্র যদি ভারতীয় বিপ্লবীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় তাহলে চীনের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতীয় বিপ্লবীদের একটা যোগাযোগ স্থাপিত হবে যা উভয় দেশের মুক্তি আন্দোলনের পরিপূরক হবে। ৫০ লক্ষ ডলার জার্মান রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে সান ইয়াৎ সেন কে আদায় করে দিলেই তিনি সবরকম সহযোগিতা করার আশ্বাস দিলেন। এদিকে জাপান পুলিশ মানবেন্দ্র নাথ রায়ের খবর পেয়ে যায়। তখন তিনি জাপানের পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে গোপনে পিকিং আসেন। ওখানে জার্মান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেন কিন্তু আশানুরূপ ফল লাভ হয়নি। তখন তিনি নিরাপদে আমেরিকা পৌঁছবার মনস্থির করেন। দীর্ঘ দেড় বছর মালয়, ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচীন, ফিলিপাইন, জাপান, কোরিয়া, চীন, জার্মানি ঘুরে অবশেষে ১৯১৬ সালে মানবেন্দ্র নাথ রায় ফাদার মার্টিন ছদ্মনামে সানফ্রান্সিসকোতে পৌঁছান। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। সেখানে তাঁর বিপ্লবী সহকর্মী ডাক্তার যাদুগোপাল মুখার্জির ভ্রাতা ধনবান মুখার্জি থাকতেন। স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটি শহর পালোআল্টোতে আশ্রয় নেন। সেখানেই তাঁর পৈত্রিক নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য থেকে মানবেন্দ্র নাথ রায় এই ছদ্মনামে পরিচয় দিতে থাকেন । ওই সময় 'পাঞ্জাব কেশরী' লালা লাজপত রায় আমেরিকাতে ছিলেন। এম এন রায় তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। এম এন রায়ের ব্যক্তিত্বে লালাজী মুগ্ধ হন। গোটা বিশ্বে তখন মার্কসবাদের চর্চার ঝড় উঠেছে। নিউইয়র্কের পাবলিক লাইব্রেরীতে তিনি মার্কসবাদ নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা শুরু করেন। মার্কসবাদের মধ্যে তিনি নতুন আলোর সন্ধান পান। আমেরিকা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ পক্ষ হওয়ার কারণে সেখানে পলাতক ভারতবাসীর পক্ষে আর নিরাপদ থাকলো না। আমেরিকার ইমিগ্রেশন আইন ভাঙ্গার কারণে এম এন রায় কে অভিযুক্ত করা হয়। তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। নিউ ইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে তাকে নিয়ে এলে তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং বাচনভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁকে জামিনের ব্যবস্থা করে দেন। এম এন রায় আমেরিকায় তাঁর সোশ্যালিস্ট বন্ধুদের কাছে শুনেছিলেন মেস্কিকোতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব চলছে। ওই সময় এলভিন ট্রেন্ট কে তিনি বিয়ে করেন এবং দুজনেই মেস্কিকো পালিয়ে আসেন । মেস্কিকো এসে সোশালিস্ট পার্টিতে যোগদান এবং অচিরে ওই পার্টির সেক্রেটারি পদে আসিন হন । ওই সময় রুশ বিপ্লবের অন্যতম নেতা মাইকেল বরোদিনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। বরোদিনের সঙ্গে মার্কসবাদ নিয়ে নানান আলাপ আলোচনা হয়। বরোদিনের পরামর্শেই তিনি প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে মেস্কিকো তে ' কমিউনিস্ট পার্টি অফ্ মেস্কিকো ' গড়ে তোলেন। তখন তিনি ম্যানুয়াল ব্যান্ডেজ এই ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিলেন। মানবেন্দ্র নাথ রায় মেস্কিকো সোশালিস্ট প্রেসিডেন্ট ডক্টর কারাঞ্জারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বাস ভাজন ছিলেন। তিনি মেস্কিকোতে গোটা লাতিন আমেরিকার সোশালিস্ট সম্মেলন সংগঠিত করেন। মেস্কিকোতে থাকাকালীন তিনি পাশ্চাত্য শিল্পকলা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন । ১৯১৯ সালের মস্কোতে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এর দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ২১ জুলাই থেকে ৭ই আগস্ট পর্যন্ত। ওই সম্মেলনে যোগ দিতে আমন্ত্রিত হন। 'কমিউনিস্ট পার্টি অফ মেস্কিকো'র মুখপাত্র 'গেলার্সে' এম এন রায়ের লেখা পড়ে মার্ক্সের পর মার্কসবাদের অথরিটি মহান চিন্তানায়ক কমরেড লেনিন অভিভূত হয়ে ছিলেন। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে এম এন রায়ের 'কলোনিয়ন থিওরি' কমরেড লেনিনের সঙ্গে মতবাদিক সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে কংগ্রেসে গৃহীত হয়। ১৯২৫ সালে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল এর চারটি প্রধান নীতি নির্ধারক কমিটিতে স্থান পেয়েছিলেন।চারটি সংস্থা হল কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল সভাপতিমণ্ডলী, রাজনৈতিক সেক্রেটারিয়েট, কার্যনির্বাহী কমিটি এবং বিশ্ব কংগ্রেসের সদস্য। তাছাড়া তিনি প্রাচ্য বিষয়ক কমিশনের চেয়ারম্যান ব্রিটিশ ও কৃষি বিষয়ক কমিশনের সভ্য, চিনা কমিশনের যুগ্ম-সম্পাদক, কমিন্টার্ন এর কার্যনির্বাহী কমিটির সম্পাদক মন্ডলীর এবং সংগঠন ব্যুরোর সভ্য ছিলেন । ১৯২৭ সালে চীনে কমিউনিস্ট পার্টির পঞ্চম কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁকে পাঠানো হয়। মার্কসবাদী আন্দোলনের আরেক অথরিটি কমরেড মাও সেতুং এর সঙ্গে এম এন রায়ের বিপ্লবের গতি প্রকৃতি নিয়ে মতবাদিক সংগ্রাম হয়। মাও সেতুং এম এন রায়ের নির্দেশ অমান্য করেন। 1927 সালের জুলাই মাসে এম এন রায় মস্কো ফিরে আসেন । কমিন্টার্ন এর ষষ্ঠ কংগ্রেসের বিখ্যাত 'উপনিবেশ বিমোচন তত্ত্ব' ( থিওরি অফ ডি কলোনাইজেশন) উত্থাপিত করেন । চিনা কমিশনে তাঁদের কার্যকলাপ নিয়ে এম এন রায় ও বরোদিন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। সপ্তম কংগ্রেসের সময় মস্কোয় ছিলেন না। সেই সময় তিনি ছিলেন বার্লিনে। গোটা ইউরোপ জুড়ে তখন ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থান ঘটছে। বৃহত্তর ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিক ফোরাম গোড়ে তোলার প্রস্তাব দেন । এ প্রস্তাব কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গ্রহণ করেনি। তিনি এ বিষয়ে জার্মান কম্যুনিস্ট পার্টির ব্র্যান্ডলার ও থেলহাইমার সঙ্গে তাত্ত্বিক মতবিনিময় করেন এবং তাদের মুখপত্রে প্রবন্ধ লেখেন। দল বিরোধী কার্যক্রমের জন্য তাকে রেনিগেড আখ্যা দেয় এবং পরে কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক পরিত্যক্ত ঘোষিত হন । মানবেন্দ্র নাথ রায়ের প্রবাসী জীবন এখানেই শেষ হয়। সত্যিই এক অত্যাশ্চর্য জীবন ।তাঁর জীবনের ঘটনা পরম্পরায় আমরা বুঝতে পারি কি কঠিন-কঠোর জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেকে এত উন্নত স্তরে নিয়ে গেছিলেন। ভাবতে গেলে গোটা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কিন্তু সেই মানুষটার পরিণতি অত্যন্ত দুঃখের। যে মার্ক্সবাদকে সমাজ মুক্তির বিজ্ঞান হিসেবে তিনি গ্রহণ করলেন। সেই বিজ্ঞানের অনুশাসনকে তিনি অনুসরণ করতে পারলেন না। তাই তাঁকে 'কমিউনিস্ট পার্টি অফ রাশিয়া' বহিষ্কার করলো। মহান স্ট্যালিন তাঁকে রেনিগেড হিসাবে চিহ্নিত করলেন । কেন এই পরিণতি হলো ? এই বিষয়টাই আমাদের ভাবা দরকার । আজকে আমরা যারা ভারতবর্ষের অসহায় মানুষদের দুঃখ যন্ত্রণায় কাতর হই এবং আমরা এই সত্য জেনেছি ভারতবর্ষের মুক্তি, সেই সঙ্গে সঙ্গে গোটা পৃথিবীর মুক্তি সঠিক মার্কসবাদের চর্চার উপর নির্ভর করে আছে। যে মার্কসবাদ হল সমস্ত বিজ্ঞানের বিজ্ঞান । এতো পাণ্ডিত্য, বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে এতো সুগভীর ধারণা, সুন্দর বাগ্মিতা কোন কিছুই তাঁকে কিন্তু রক্ষা করতে পারেনি । আর এখানেই মার্কসবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ তাঁর এই জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন পাণ্ডিত্য মার্কসবাদের একমাত্র বিষয় নয় । তত্ত্ব এবং প্র্যাকটিস, মার্ক্সবাদকে জীবন দর্শন হিসেবে গ্রহণ করা , জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা, মার্কসবাদের মর্মবস্তু উন্নত রুচি সংস্কৃতি অর্থাৎ সর্বহারার রুচি সংস্কৃতি আয়ত্ত করা,এটা যদি কেউ না করতে পারে তাহলে একদিন সে এই পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যেতে পারে । এম এন রায়ের ক্ষেত্রে এ ঘটনাটি ঘটলো। আমরা যারা সমাজকে পরিবর্তন করতে চাই ।সত্যকে গ্রহণ করতে চাই । জেনেছি মার্কসবাদই একমাত্র পথ। তাদের ক্ষেত্রে এম এন রায়ের এই স্খলন থেকে শিক্ষা নেওয়া অত্যন্ত জরুরী।
১৯৩০ সালে তিনি ভারতবর্ষে ফিরে আসেন ব্রিটিশ সরকার কানপুর মামলায় অভিযুক্ত করে ১২ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। ছয় বছর কারাবাস করার পর জহরলাল নেহেরুর সহযোগিতায় তিনি মুক্তিলাভ করেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার কারণে তাঁকে ভারতবর্ষের 'কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া' গ্রহণ করল না।। প্রথমে তিনি কংগ্রেসের সদস্য হোন। কংগ্রেস পরিচালনার নীতির প্রশ্নে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিরোধিতা করেন। কিভাবে চলা উচিত তার খসড়া তৈরি করেন। ধীরে ধীরে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এই জনপ্রিয়তা মহাত্মা গান্ধী ভয় পেতে শুরু করেন। ১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেসের নেতাজী সুভাষ বসু কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁকে তিনি সমর্থন করেন এবং ভারতবর্ষে রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তনের সম্ভাবনার কথা বলেন । কংগ্রেসের পরবর্তী ত্রিপুরী অধিবেশন সুভাষ চন্দ্রের সভাপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সুভাষচন্দ্র মতবাদিক বিরোধ এবং পট্টভি সীতারামাইয়াকে সুভাষ চন্দ্রের বিরুদ্ধে ভোটে নামিয়ে পট্টভি সীতারামাইয়ার পরাজয়কে নিজের পরাজয় হিসেবে স্বীকার করা এবং পরবর্তীকালে পন্থপ্রস্তাবের মধ্য দিয়ে সুভাষ চন্দ্রের স্বাধীন কার্যকলাপের বাধা দেওয়া যা ভারতবর্ষের ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে পরিচিত ওই সময় এম এন রায় কিন্তু নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে সমর্থন করেছিলেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি 'রেডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি' নামে একটি স্বতন্ত্র দল গঠন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ওই দল ভারতীয় জনগণের সমর্থন না পাওয়ায় তিনি 'রেডিক্যাল হিউম্যানিজম' নামে পত্রিকা প্রকাশ করে নানান ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্য প্রবন্ধ আকারে লেখা শুরু করেন। তিনি ' নিউ হিউম্যানিজম' মতবাদ তৈরি করেন যা সম্পূর্ণরূপে মার্কসবাদ বিরোধী। ভারতবর্ষ ১৯৪৭সালে স্বাধীন হয়। তিনি রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। ১৯৫৪ সালে তিনি মারা যান। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান-সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াতে লেনিন কর্তিক অর্থনৈতিক নীতি নিউ ইকোনমিক পলিসি (এন ই পি) তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন ট্রটস্কি। সেই সময় লেনিনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এবং ওই নীতিকে পূর্ণ সমর্থন করেছিলেন। ক্রুশ্চেভ যখন রাশিয়ার বুকে মার্কসবাদকে বিকৃত করে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিন কে কালিমালিপ্ত করার প্রয়াস করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এবং রাশিয়ার বুক থেকে স্ট্যালিন কে মুছে ফেলার চক্রান্ত করে তখন এম এন রায় স্ট্যালিনের পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মানবেন্দ্র নাথ রায়কে স্মরণ করার এখানেই তাৎপর্য যে - কোন মানুষ তিনি যে স্বপ্ন দেখেন, মনে যা ইচ্ছা পোষণ করেন, যে ইস্পিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান কেবলমাত্র স্বপ্ন, কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় অপরিহার্য নয় । জীবনে পরিশ্রম, অধ্যবসায়, পাণ্ডিত্য এইগুলো না হলে চলে না ঠিকই কিন্তু তার চেয়েও যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা হল যথার্থ বৈজ্ঞানিক পথ এবং প্রক্রিয়া ।এই পথ এবং প্রক্রিয়া যদি সঠিক না হয় তাহলে একজন ব্যক্তি বা বহু ব্যক্তি প্রচুর ক্ষমতা অর্জন করলেও সমাজের যথার্থ মুক্তি দিতে তাঁরা পারবেন না। এম এন রায়ের জীবনই হলো তার বেদনাদায়ক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
0 Comments