জ্বলদর্চি

গল্প: "শেষ ট্রেনটা চলে গেল" /বাপন দেব লাড়ু

গল্প
"শেষ ট্রেনটা চলে গেল"
বাপন দেব লাড়ু 

কলকাতার এক পুরনো বাগানবাড়ি। শীতের সকাল। বাগানে বসে ধুনুচির ধোঁয়ার মতো ধীরে ধীরে উড়ছে নীরা আর সুমিতের সম্পর্কের শেষটুকু।
"তুমি সবসময় নিজের মতো করে ভাবো," নীরার গলা টান, ঠান্ডার মতো কাঁপা-কাঁপা, কিন্তু জেদে ভরা।
সুমিত চুপ করে থাকে। ঠোঁটের কোণে এক টুকরো সিগারেট, নিঃশব্দে পুড়ে যাচ্ছে। সম্পর্কটা পুড়ছে অনেকদিন হলো। শুধু ধোঁয়াটা এখন দৃশ্যমান।
"আমার কী কেমন লাগে, সেটা কখনও বোঝার চেষ্টা করেছ?" নীরা জিজ্ঞেস করে।
"চেষ্টা করেছি," সুমিত ধীরে বলে, "কিন্তু তুমি তো নিজের মনের দরজাটা খুলতেই দাও না।"
তাদের বিয়ে হয়েছে ছয় বছর। প্রেমে পড়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে। তখন সস্তা ক্যাফেতে কফি ভাগ করে খাওয়া, শ্যামবাজার থেকে হাত ধরে হেঁটে বেড়ানো—সবই ছিল রঙিন।
কিন্তু জীবনের ছকে ঢুকতেই রংগুলো মুছে যেতে শুরু করে। সুমিত চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজেকে হারিয়েছে। নীরা নিজের প্যাশন—পেইন্টিং—ছাড়তে চায়নি, তাই সংসারের নিয়ম-রুটিনে সে বারবার কোণঠাসা।
"তুমি একটা ছবিও শেষ করতে পারো না এখন। নিজের জন্য সময় কোথায়?" সুমিত একদিন বলেছিল।
"কার জন্য সময় নেই, সেটা কি একবার ভেবেছ?" নীরার চোখে তখন জল ছিল।
তাদের ঝগড়া কখনও চিৎকারে, কখনও নিঃশব্দে। কিন্তু প্রতি ঝগড়ার শেষে একটা ছোট্ট মৃত্যু হত—আস্তে আস্তে।
আজ, সেই মৃত্যুটা চূড়ান্ত হতে চলেছে।
সুমিত বলল, "চল, আলাদা হয়ে যাই। অনেক হয়েছে। আমরা দুজনেই ক্লান্ত।"
নীরার চোখ দুটো ফাঁকা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, "এই কথাটা তুমি এত শান্তভাবে বলতে পারো?"
"কারণ এটা অনেক আগেই ঠিক হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে। আমরা কেবল মুখে বলিনি," সুমিত উত্তর দেয়।
নীরা উঠে দাঁড়ায়। জানলার পাশে দাঁড়িয়ে দেখে, ট্রেন যাচ্ছে দূরে কোথাও। শীতে কুয়াশার ভেতরেও ট্রেনের হুইসেল কানে বাজে।
🍂
ad

সে হঠাৎ বলে, "তুমি কি জানো, তুমি আমাকে শেষবার কবে ভালোবেসেছিলে?"
সুমিত কিছু বলতে পারে না। তার মাথার ভেতর তখন কেবল চাকরির টেনশন, লোনের কিস্তি, আর অসংখ্য অপ্রকাশিত ক্লান্তি।
তারা আলাদা হয়ে যায়। নীরা ফিরে যায় নিজের পৈতৃক বাড়িতে শান্তিনিকেতনে। রঙ-তুলির সঙ্গে ফের একটা সম্পর্ক গড়ে তোলে। সুমিত কলকাতায় থাকে, কাজ করে, প্রমোশন পায়—কিন্তু নিজের আয়নায় তাকিয়ে একটা শূন্যতা অনুভব করে প্রতিদিন।
একদিন হঠাৎ খবর আসে—নীরার ছবি এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে জায়গা পেয়েছে। পত্রিকায় খবর হয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল।
সুমিত খবরটা দেখে, হাসে, কাঁদে—ঠিক বোঝা যায় না। সে জানে, এই খবরে আনন্দিত হবার অধিকার আজ আর তার নেই।
ছয় মাস পর, সুমিত শান্তিনিকেতনে যায়। কোনো ফোন না করেই, হঠাৎ।
নীরার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সে ভাবে, দরজা খোলার পর কী বলবে? “ভুল করেছি?” নাকি “তুমি কেমন আছো?” নাকি শুধু “চা দেবে একটু?”
দরজা খোলে।
নীরা চমকে ওঠে, কিন্তু অবাক হয় না। যেন জানত এই দিনটা আসবে।
দুজনেই চুপচাপ।
সুমিত বলে, “শেষ ট্রেনটা হয়তো আমি মিস করে ফেলেছি।”
নীরা হেসে বলে, “শেষ ট্রেন বলে কিছু হয় না। যদি তুমি সত্যি চাও, হাঁটতেও পারো।”
দুজনেই জানে, সব কিছু আগের মতো হবে না। কিন্তু কিছু সম্পর্ক ভেঙে গিয়েও বেঁচে থাকে, অন্য এক রূপে।


"প্রেম শুধুই থাকার নাম নয়—বোঝার, শোনার, সময় দেওয়ার নাম। সম্পর্ক শেষ হয় তখন, যখন দুজনের মধ্যে শুধু 'আমি' বেঁচে থাকে। কিন্তু যদি সত্যিই ভালোবাসো, তবে শেষ ট্রেন মিস করলেও হাঁটতে শেখো—তাহলে গন্তব্য তোমার জন্য অপেক্ষা করে।"

Post a Comment

0 Comments