জ্বলদর্চি

এক বুড়ো ও বুড়ির গল্প /সংগ্রাহক-পূর্ণিমা দাস/কথক-আল্পনা দাস, গ্রাম-যুগীশোল, থানা-নয়াগ্রাম, জেলা-ঝাড়গ্রাম

এক বুড়ো ও বুড়ির গল্প


সংগ্রাহক-পূর্ণিমা দাস

কথক-আল্পনা দাস, গ্রাম-যুগীশোল, থানা-নয়াগ্রাম, জেলা-ঝাড়গ্রাম


অনেকদিন আগে রামপুর নামে একটি গ্রামের মধ্যে ছোটো একটি কুঁড়েঘরে এক বুড়ো তার বুড়িকে নিয়ে বসবাস করত। রামপুর গ্রামটি ছিল ঘন জঙ্গলে ঘেরা। এই জঙ্গলে নানাধরনের গাছ-পালা, পশু-পাখি বসবাস করত। গ্রামটি ছিল  একেবারে সবুজে ভরা। এই সুন্দর গ্ৰামেই বুড়ো ও বুড়ি থাকত। বুড়ো ও বুড়ির কোনো ছেলেপুলে ছিল না। তারা নিজেরা নিজেদের মতো থাকত। এছাড়া তাদের কোনো আত্মীয় স্বজনও ছিল না। বুড়ো ছিল একটু রাগী ও অলস প্রকৃতির মানুষ। সে কোনো কাজকর্ম করত না। সারাদিন শুয়ে বসে কাটাত। বুড়ি কোনো কাজ করতে বললে বুড়ো বলত-“আমি কোনো কাজ করতে পারব না। আমার বয়স হয়েছে, সেইজন্য আমি আমার বাকি জীবনটা আরাম করে কাটাব।” তখন বুড়ি বলত-“আমারও তো বয়স হয়েছে, তাহলে আমি কী করে কাজ করছি। তোর মতো আমিও তো আরাম করতে পারি। আমার কী আরাম করতে মন করেনি, নাকি রে বুড়ো।” এইসব নানা ছোটো খাটো বিষয় নিয়ে বুড়ো ও বুড়ির মধ্যে সারাদিন ঝগড়া লেগেই থাকত। বুড়ি সারাদিন ঘরের কাজকর্ম করত এবং ঘরের কাজ শেষ করে লোকের বাড়িতে ঝি-গিরি করত।

🍂
ad

 এইভাবে তাদের সংসার চলত। আর এদিকে বুড়ো অলস প্রকৃতির হওয়ায় সে কোনা কাজকর্ম করত না, এমনকি পাড়া-পড়শীরা বুড়োকে কাজ করতে বললে বুড়ো রেগে গিয়ে তাদেরকে বলত-“দূর শালা! আমি কাজ করলাম বা নাই করলাম তাতে তোদের কী? তোরা শালারা কী আমায় খেতে দিস নাকি রে? যা এখান থেকে যা।” এইভাবে বুড়ো নানাভাবে তার পাড়া-পড়শীদের অপমান করত। বুড়ি সারাদিন কাজ করে লোকের বাড়ি থেকে যে খাবার পেত তাই বুড়োর জন্য নিয়ে আসত। আর বুড়ো সেই খাবারগুলো খেয়ে নিশ্চিন্তে দিনযাবন করত। বুড়ি সারাদিন কাজ করেও অর্থেক দিন খালিপেটে থাকত। এছাড়া দিনের পর দিন তারা কলমি শাক সেদ্ধ, কচুশাক সেদ্ধ, গেঁড়ি-গুগলি - এইসব খেত। এইভাবে বুড়ো ও বুড়ির জীবন কাটতে থাকে। একদিন বুড়ো বুড়িকে বলল-"অনেকদিন হল ভালোমন্দ কিছু খাইনি, বুড়ি আজ তুই কিছু ভালোমন্দ রান্না কর, আমার খেতে মন করেছে।” বুড়ি বলল-“আমার পয়সা নেই, আমি কোনো ভালামন্দ রান্না করতে পারবো না। তোর যদি এত খাবার ইচ্ছা তো নিজের পয়সায় খা।” বুড়ো তখন রেগে গিয়ে বুড়িকে বলল-“আমি কেন পয়সা আনব। আমি পারবো না, আমার কাজ করতে ভালো লাগে না। আর এটা আমার ঘর, আমি আমার ঘরে শুয়ে বসে কাটতে পারি, তাতে তোর কী। আর আজ যদি তুই আমাকে ভালোমন্দ কিছু না রান্না করে খাইয়েছিস তো তোকে আমি বাড়ি থেকে বের করে দেব।” বুড়োর মুখে এই কথা শুনে বুড়ি ভয় পেয়ে যায়। কারণ বুড়ি জানে বুড়ো কতটা রাগী। এছাড়া বুড়ো ঘর থেকে বের করে দিলে বুড়ির আর কোথাও যাবার জায়গা নেই। কারণ এই পৃথিবীতে বুড়ো ছাড়া বুড়ির আর কেউ নেই।  আর বুড়ি এইসব কথা ভাবতে ভাবতে বুড়োর জন্যে ভালো ভালো খাবারের খোঁজে বের হয়। কিন্তু সারাদিন ঘুরেও বুড়ি কোনো ব্যবস্থা করতে পারে না। সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ি ফিরে এসে বুড়ি দেখে উঠানের এক কোণে একটি মুরগি বাঁধা আছে। বুড়ি দেখে বুঝতে পারে না, সে ভাবতে থাকে যে মুরগিটা এল কোথা থেকে আর এটিকে কেই বা আনলো। তখন বুড়ো ঘর থেকে বেরিয়ে বুড়িকে বলল-“এই মুরগিটা আমি লোকের বাড়ি থেকে চুরি করে এনেছি।” এই কথা শুনে বুড়ি ভয় পেয়ে যায় এবং বুড়োকে বলে মুরগিটা ফেরত দিয়ে আসতে। কিন্তু বুড়ো বলে এইটা সে আর ফেরত দিবে না। কাল সকালে এই মুরগির মাংস রান্না করে দিলে সে খাবে। এরপর বুড়ি আর কিছু না বলে ঘুমিয়ে পড়ে। আর পরেরদিন সকালে উঠে বুড়োকে মুরগিটা মারতে বলে মাংস রান্নার মশলাপাতি আনতে যায়। লোকের বাড়িতে কাজ করে যেটুকু পয়সা সে জমিয়ে ছিল তাই দিয়ে সে মশলাপাতি আনে। এদিকে বুড়ো মুরগিটাকে মেরে কেটে ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখে। বুড়ি সমস্তকিছু নিয়ে আসার পর সে বুড়িকে তাড়াতাড়ি মুরগির মাংস রান্না করতে বলে স্নান করতে চলে যায়। আর এদিকে বুড়ি মাংস রান্না করতে বসে। মাংস রান্না হতে থাকে। এরপর মাংসগুলো ঠিকমতো রান্না হল কিনা দেখার জন্য বুড়ি এক টুকরো মাংস চেখে দেখে এবং মাংসটি বুড়ির খুব ভালো লাগে। কারণ বুড়োর মতো বুড়িও অনেকদিন ভালো খাবার খায়নি। এইভাবে বুড়ি এক এক করে মাংস খেতে খেতে পুরো মুরগির মাংস খেয়ে ফেলে। সমস্ত মাংস খাওয়ার পর বুড়ি চিন্তায় পড়ে যায়, সে ভাবতে থাকে যে,“লোভে পড়ে তো আমি সব মাংস খেয়ে নিলাম, এবার বুড়ো এসে যদি মাংস না দেখতে পায় তো আমাকে আর জ্যান্ত রাখবে না।” এইসব কথা চিন্তা করতে করতে বুড়ি কোনো উপায় খুঁজে পায় না। কোনো উপায় না পেয়ে বুড়ি শেষপর্যন্ত দা দিয়ে নিজের শরীরের কিছুটা অংশ কেটে ফেলে এবং নিজের মাংস রান্না করে বুড়োর জন্য। আর তার শরীরের কাটা অংশটা ঢাকা দেওয়ার জন্য কিছু না পেয়ে কচুপাতা দিয়ে ঢেকে রাখে, যাতে বুড়ো দেখতে না পায়। বুড়ো স্নান করে এসে দেখে সারা ঘরে রক্ত পড়েছে।  বুড়ো কিছু বুঝতে পারে না। সে ভাবে বুড়ি হয়তো আরও একটা মুরগি নিয়ে এসেছে। এইসব ভাবতে ভাবতে সে ঘরের ভেতরে ঢুকে। তারপর এইসব চিন্তা বাদ দিয়ে বুড়িকে ডাকে তাকে খেতে দেওয়ার জন্য। বুড়ি ভয়ে ভয়ে বুড়োকে খেতে দিতে আসে। বুড়ো দেখে বুড়ি কচুপাতা দিয়ে শরীরের কিছুটা অংশ ঢেকে রেখেছে। তখন বুড়ো বুড়িকে জিজ্ঞাসা করে-“তোর কী হয়েছে রে বুড়ি? কচুপাতা দিয়ে শরীর ঢেকেছিস কেন?" বুড়ি কোনো কথা বলে না। তখন বুড়ো আর কোনো প্রশ্ন না করে খাবার খেতে শুরু করে। মাংসটা মুখে দিয়ে বুড়ো থু থু করে মাংসটা ফেলে দেয় এবং বুড়িকে বলে-“মাংসটা এরকম লাগছে কেন?”  বুড়ি কোনো কথা বলে না। বুড়ো তখন রেগে গিয়ে বুড়িকে বলে-“কী হল, কোনো কথা বলছিস না কেন? তোর মুখে কী পোকা পড়েছে।” বুড়ি তখনও কিছু না বলে কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর বুড়োর সন্দেহ হয় যে বুড়ি কচুপাতা দিয়ে শরীর ঢেকেছে কেন? তখন বুড়ো জোর করে বুড়ির গা থেতে কচুপাতাটা সরিয়ে ফেলে এবং দেখে বুড়ির শরীরের কিছুটা অংশ কাটা। তখন বুড়ো সব বুঝতে পারে যে বুড়ি তার শরীরের মাংস আমার জন্য  রান্না করেছে। তখন বুড়ো বুড়িকে বলে যে, সে এমনটা কেন করলো। বুড়ি তখন সমস্ত ঘটনা খুলে বলে, যে সে লোভে পড়ে সমস্ত মাংস খেয়ে ফেলেছে। আর বুড়ো রেগে যাবে বলে কোনো উপায় না পেয়ে নিজের শরীরের মাংস রান্না করে বুড়োকে খেতে দিয়েছে। বুড়ো সমস্তকিছু শুনে আরও রেগে যায়, আর রাগের মাথায় যে দা দিয়ে বুড়ি নিজের শরীর কেটেছিল, সেই দা দিয়ে বুড়ো বুড়িকে মেরে ফেলে। আর বুড়িকে ছোটো ছোটো করে কেটে জঙ্গলে ফেলে দেয়। এরপর বুড়ো মনে মনে ভাবতে থাকে-“কী রে  বুড়ি, নিজের শরীরের মাংস খাওয়ানোর তোর অনেক শখ না, নে এখন কুকুর-শেয়ালে তোর মাংস খাবে। এবার তো তোর শখ পূর্ণ হল তাই না রে বুড়ি তোর শখ পূর্ণ হল....।" এই বলে বুড়ো হা-হা-হা করে হাসতে থাকে। কিন্তু বুড়ো এটা বুঝতে পারে না যে, সে রাগের মাথায় কী কাজ করে ফেলল। এরপর বুড়ো পাগল হয়ে গ্রামে গ্ৰামে ঘুরে বেড়াতে থাকে।

Post a Comment

0 Comments