আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৮
শ্যা ম ল জা না
পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীরা এবং তাঁদের মতবাদ ও ছবি(৩য় অংশ)
পল গগ্যাঁ ও সিম্বলিজম্, সিন্থেটিজম্, ক্লোইসোনিজম্, প্রিমিটিভিজম ও পন্ত অ্যাঁভে স্কুল(দ্বিতীয় পর্ব)-
এই সিন্থেটিজমকে সাধন করতে গিয়ে পল গগ্যাঁ ক্লোইসোনিজম্-এর পদ্ধতিকে ক্যানভাসে প্রয়োগ করলেন৷ এই ক্লোইসোনি পদ্ধতি প্রাচীন মেডিভ্যাল আর্ট বা মিনোয়ান আর্ট-এর সময়কাল থেকেই শুরু হয়েছিল(পর্ব-১-এর ছবি-১ দেখুন)৷ প্রথমে একটি ধাতু-পাতের পাত্রের উপরিতলে ড্রইং করা হয় ৷ তারপর শুধুমাত্র ড্রইং অংশটুকু সামান্য খোঁদল করে নেওয়া হয় ৷ এরপর এক ধরনের রঙিন পাথরের গুঁড়ো দিয়ে ওই খোঁদল অংশটুকু ভরাট করা হয় ৷ তারপর তার ওপর আগুনের তাপ(Heat) দিলে, ওই পাথরের গুঁড়ো গলে গিয়ে ধাতু-পাতের ওপর স্থায়ী রঙিন ও চকচকে প্রলেপ তৈরি করে৷এই পদ্ধতির নাম ক্লোইসোনি পদ্ধতি ৷ এই পদ্ধতিতে ছবিতে সূক্ষ্ম কিছু করা যায় না ৷ আলো-ছায়া দিয়ে কোনো ভলিউমও তৈরি করা যায় না ৷ সহজ-সরলভাবে ফ্ল্যাট রঙের প্রলেপ ও ঘন কালো লাইন দিয়ে তার আউটলাইন দেওয়া ছাড়া অন্য কিচ্ছু করা যায় না ৷ এই পদ্ধতিকে বা ক্লোইসোনিজম্-কে অনুসরণ করেই পল গগ্যাঁ ক্যানভাসে সিন্থেটিজমকে সফলভাবে প্রয়োগ করলেন (ছবি-১)।
এর পরেও তাঁর মনে হতে থাকল, যে, তিনি ঠিক যা চাইছেন, তা সবটা হচ্ছে না ৷ ক্যানভাসের ছবিকে যতই সহজ-সরল করি না কেন, ছবিতে কোথাও যেন একটু হলেও সভ্যতার ছাপ থেকে যাচ্ছে ৷ আসলে, তিনি এই আধুনিক সভ্যতাকে মন থেকে ঘৃণা করতেন ৷ এতটাই যে, সভ্যতাকে সর্বঅর্থে বিসর্জন দিয়ে, আধুনিক ফরাসির বসবাস ছেড়ে, প্রশান্ত মহাসাগরের প্রত্যন্তে তাহিতি দ্বীপ-এ তিনি জীবনের শেষ দশ বছর কাটিয়েছিলেন ওই আদিম মানুষদের মতো করেই ৷ এবং ওখান থেকে তিনি আর ফেরেননি ৷ ১৯০৬ সালে ওখানেই মারা গেছেন৷
ওই দশ বছর সময়ে তাঁর আদিম মানুষদের আঁকা ছবির(Primitive Art) প্রতি মনোযোগ গেছিল ৷ কারণ তিনি দেখেছিলেন— আধুনিক চিত্রকলার যে ব্যাকরণ, করণ-কৌশল, রঙের মানে অনুযায়ী প্রয়োগ, ক্যানভাসে রঙের প্রলেপ দেওয়ার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, স্পেস ডিভিশন… ইত্যাদি ইত্যাদি আদিম মানুষেরা বিজ্ঞানসম্মতভাবে একেবারেই জানত না ৷ গগ্যাঁ বিস্মিত হয়েছিলেন! তিনি দেখেছিলেন— অশিক্ষিত পটুত্ব দিয়ে অত্যন্ত সাবলীল ও স্বতঃষ্ফূর্তভাবে তারা ছবি এঁকেছে ৷ মৌলিক রঙে আঁকা সেই সব ছবি অত্যন্ত সহজ-সরল প্রকৃতির ছবি হলেও, তা কোনো অর্থেই হুবহু প্রকৃতির নকল নয় ৷ তারা যেরকম সহজ-সরল, তাদের ছবিও ঠিক সেই রকম ৷ তাতে সেই অর্থে কোনো ভলিউম তৈরির প্রচেষ্টা তো নেইই, উপরন্তু বেশ সাবলীলভাবে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট ৷
তাঁর মনে হল— তিনি ঠিক যেরকম ছবি আঁকতে চাইছিলেন, সেই দীর্ঘ আত্মিক অনুসন্ধান এতদিনে সফল হল ৷ তিনি, আধুনিক শিক্ষায় অর্জিত তাঁর শিক্ষিত পটুত্ব দিয়ে, তাহিতির অশিক্ষিত পটুত্বে আঁকা আদিম চিত্রকলা(Primitive Art)-কে বিনির্মাণ করলেন ৷ একেই বলা হয় প্রিমিটিভইজম ৷ ওই সময়ের থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর প্রায় সব ছবিতেই দেখা গেল তাহিতির আদিম চিত্রকলার মোটিভ ৷ এবং, এই সময়ের অধিকাংশ ছবিই পরবর্তীকালে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে গন্য হয়েছে, এবং তাঁকে অমর করে রেখেছে(ছবি-২)।
দ্য নবিস—
নবি কথাটির অর্থ— ঈশ্বর প্রেরিত পুত্র ৷ যিনি ঈশ্বরের বাণী নিয়ে মর্ত্যলোকে এসেছিলেন ৷ ভবিষ্যৎ বক্তা ৷ আত্মার শক্তিকে যিনি জাগ্রত করেন ৷ হিব্রু ভাষায় এর উল্লেখ আাছে ওল্ড টেস্টামেন্ট-এ, আর আরবিক ভাষায় এর উল্লেখ আছে কোরান-এ ৷
একদল নব্য ধারণার আধুনিক ফরাসি চিত্রকর ১৮৮৮ সালে পোস্ট-ইম্প্রেশনিজম-এর পক্ষে স্বতন্ত্রভাবে একটি আন্দোলন(Movement) গড়ে তুলেছিলেন ৷ তাঁরা চিত্রশিল্পকে যে আধ্যাত্মিক মানসিক অবস্থান থেকে দেখতে চাইছিলেন, তার সাথে এই “নবি” ধারণাটি দারুনভাবে মিলে যাওয়ায় তাঁরা এই আন্দোলনটির নাম দিয়েছিলেন— “দ্য নবিস”(Les Nabis)৷
সেই ইম্প্রেশনিজম-এর পর থেকে অ্যাকাডেমিক আর্ট থেকে অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট, সিম্বলিজম, এবং আধুনিক চিত্রকলা আন্দোলনের প্রথম দিকে আরও যে সব প্রাসঙ্গিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল, এই নবিসরা সব ক্ষেত্রেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন ৷
প্যারিস-এ “অ্যাকাডেমিক জুলিয়ান” নামে একটি একশ বছরের চিত্রশিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ৷ বহু বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী এই প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়েছিলেন ৷ এই প্রতিষ্ঠানেরই কয়েকজন চিত্রশিল্পী(দু-এক জন বাদ দিলে) মিলে পল সেরুসিয়ের-এর নেতৃত্বে “দ্য নবিস” আন্দোলনটি গড়ে তোলেন ৷ এদের মধ্যে যাঁরা উল্লেখযোগ্য, তাঁরা হলেন— পিয়েরে বোনার্ড, মৌরিসে ডেনিস, পল রানসন, এডওয়ার্ড ভুইলার্ড, কর-জেভিয়ার রোউসেল, ফেলিক্স ভ্যালেটন আর, এই পল সেরুসিয়ের ৷ (ক্রমশ)
4 Comments
সুন্দর...
ReplyDeleteApekkha kore thaki lekha porbar jonyo.asadharon....
ReplyDeleteপল গগ্যাঁ-র সম্পর্কে বলতে গিয়ে চিত্রশিল্পের বিবর্তন যে ভাবে বর্ণিত
ReplyDeleteহল তাতে শিল্পীমহল উপকৃত হবে
অবশ্যই। পাশাপাশি উৎসাহী পাঠক
হিসেবে আমরাও ঋদ্ধ হচ্ছি। এই
লেখাটির টান বা আকর্ষণ এতটাই
যে, পরের লেখাটির জন্য উন্মুখ হয়ে
থাকছি।এটা শ্যামল জানার বৈশিষ্ট্য।
লেখাকে সাধারণের করে তোলা।আর সহজবোধ্য করে লেখা।দারুণ!
একটা বিশেষণের বারবার পুনরাবৃত্তি করতেই হয় এই সিরিজের প্রতি কিস্তির শেষে,,,,,,,অসাধারণ ও অত্যন্ত কার্যকরী শ্যামলদার এই অবদান।
ReplyDelete