জ্বলদর্চি

চোদ্দশাক/ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৯৪
চোদ্দশাক

ভাস্করব্রত পতি

'ওলং কেমুকবাস্তকং, সার্ষপং নিম্বং জয়াং।
শালিঞ্চীং হিলমোচিকাঞ্চ পটুকং শেলুকং গুড়চীন্তথা।
ভণ্টাকীং সুনিষন্নকং শিবদিনে খাদন্তি যে মানবাঃ,
প্রেতত্বং ন চ যান্তি কার্ত্তিকদিনে কৃষ্ণে চ ভূতে তিথৌ।'
অর্থাৎ কার্তিক মাসের কালীপূজার আগের দিন বা দীপান্বিতার পূর্বদিন যমচতুর্দশী বা ভূতচতুর্দশী তিথিতে গ্রামের মানুষেরা চোদ্দশাক খায়। শাস্ত্রানুযায়ী ঐদিন চোদ্দশাক খেলে নাকি যম টানতে পারেনা। যমের থেকে রেহাই মেলে। ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে যমের আলয় অনেক দূরে থাকবে। কথায় বলে, চোদ্দশাক খেলে নাকি কার্তিকের টান থেকে রেহাই পাওয়া যায়। কেননা এইমাসে যমের বাড়ির ৮ টি দরজাই খোলা থাকে। মানুষের মুখে এই বিশ্বাস আজও বিরাজমান। 
কেঁউ

ঋগ্বেদের শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণরাই চতুর্দশীব্রতে শাকের ব্যবহার শুরু করেছেন। শাক নামে একটি দ্বীপে ঋগ্বেদের শাকল তথা বাস্কল শাখার জন্ম হয়। তাঁরা শাক আহার ক'রত। তাঁরাই পরবর্তীতে হয়ে ওঠে শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ। তাঁরা আমিষ নয়, নিরামিষ শাকাহারকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। দুর্গার কৃষিকল্প মূর্তির পূজায় তাঁর পরিচিতি শাকিনী নামে। দেবীকে কৃষিলক্ষ্মী জ্ঞানে আরাধনা করলে তিনি হন শাকিনী। তিনি প্রসন্ন হন নৈবেদ্য হিসেবে শাক অর্পণ করলে। আবার মনসার অপর নাম শাকিনী। এক্ষেত্রেও দেবীর পূজার মূল নৈবেদ্য হল শাক।
ওল

দেবী শাকম্ভরী হয়ে যখন দীর্ঘ'দিন তপস্যা করেছিলেন, তখন তিনি শাক খেতেন। তাই তাঁর নাম শাকম্ভরী। আর তাঁকে ঋষিরা অভ্যর্থনা করেছিল শাক দিয়েই। দেবী যেমন শাকে তৃপ্ত হয়ে শাকাহার ক'রে তপস্যা করেছিলেন, তেমনি যে বা যাঁরা কেবলমাত্র শাক দিয়েই দেবীকে চতুর্দশী তিথিতে তৃপ্ত করেন, তিনিই পুণ্যবান। তাই এসময় চোদ্দশাক খাওয়ার রীতি প্রচলিত বলে অনুমান। 
সুষনি

অর্থাৎ চতুর্দশী তিথিতে চোদ্দশাক খেলে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যায়। 'জামাইবারিক' এ আছে 'দোজবরে ভাতারের মাগ / চতুর্দশীর চোদ্দ শাগ্'। এই চোদ্দশাকগুলি হল - ১. গুলঞ্চ বা গুড়ুচি (Tinospora cardifolia) ২. সুষনী বা সুনিসন্নক (Marsilea quadrifolia) ৩. সরিষা (Brassica campestris) ৪. ওল (Amarphophallus campanulatus) ৫. ঘেঁটু বা ভন্টাকী বা ঘন্টাকর্ণ (Clerodendron infortunatum) ৬. হিঞ্চে বা হেলেঞ্চা বা হিলমোচিকা (Enhydra fluctunus) ৭. কেঁউ (Cistus specious) ৮. জয়ন্তী (Sesbania sesban) ৯. কালকাসুন্দে (Cassia sophera) ১০. শাঞ্চে বা শালিও (Alternanthera sessilis) ১১. শেলকি বা শেলঙ্কী (Cordia dichotoma) ১২. বেতো (Chenopodium album) ১৩. পলতা বা পটুক (Trichosanthes dioica) এবং ১৪. নিম (Azadirchta indica)। চরক সুশ্রুতের যুগেও এগুলির দ্রব্যশক্তি আলোচিত হয়েছে। প্রচুর প্রাণপ্রাচুর্য রয়েছে এতে। 
নিম

আসলে এই চোদ্দশাক খাওয়া উচিত পুরো কার্তিক মাস জুড়ে। প্রতিটি শাকের পৃথক পৃথক ওষধি গুণ রয়েছে। এই চোদ্দশাক খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো হলেও সারা মাস জুড়ে খাওয়া সম্ভব হয়না। তাই কেবল ঐ দিনটিতেই মেনে চলা হয়। ভূত চতুর্দশীর দিন চোদ্দশাক তোলার সময় বলতে হয় - 'চোদ্দশাকের মধ্যে আমি ওল পরামাণিক'। অর্থাৎ উত্তম সমাজে অধম ব্যক্তি অধিষ্ঠিত। পরামাণিক বা প্রামানিক হল শ্রেষ্ঠ। 'চোদ্দশাকের মধ্যে ওল পরামাণিক'- এটি একটি জনপ্রিয় বাংলা প্রবাদ।

এগুলির মধ্যে ঋতুপরিবর্তনজনিত সর্দির আক্রমণ থেকে মুক্তি দেয় জয়ন্তী পাতা। দেহের মধ্যে সঞ্চিত পিত্তদোষকে সংশোধন করে পটল বা পলতা পাতা। সুষনি শাক দেহের স্নায়ুতন্ত্রকে বশ করে ঘুমের প্রাধান্য বিস্তার করে। ক্রিমিনাশক হল ঘেঁটু পাতা। কাসকে মর্দিত করে কালকাসুন্দে। তাই একে বলে 'কাসমর্দ'। শেলুকা হল ক্ষুধাবর্ধক ও রুচিকারক। মলমূত্রের সারল্য আনে সরষে শাক। ওল অর্শ রোগের মহৌষধ। তাই একে বলে অর্শোঘ্ন! 'ঘ্ন' অর্থাৎ নাশ করা। লিভারের পক্ষে খুব উপকারী বেতো শাক। আবার বায়ুবিকার দূরীভূত করে গুলঞ্চ। আর চর্মরোগ নষ্টকারী উদ্ভিদ হল নিম। এই চোদ্দশাক একসাথে খেলে আমাদের নানা উপকার হয়। এগুলি এককভাবে নানা উপকার করলেও আসলে এগুলি সম্মিলিতভাবে আরও বহু রোগের নিরসন এবং প্রতিরোধ করতে সক্ষম। 
সত্যজিৎ রায়ের আঁকা সেইসব ভূতের দল

শকৃতি + ঘঞ্জন - অর্থাৎ পাতা, ফুল, ফল, নাল, কন্দ এবং পুরানো পচা মাটিতেও যে গাছ জন্মে (ছত্রাক), সবগুলিই শাক। তাই শাক অর্থে কেবল পাতা নয়। আয়ুর্বেদে 'শাক' শব্দটির বিশ্লেষণ করা হয়েছে এভাবে--
'পত্রং পুষ্পং ফলং নালং কন্দং সংস্বেদজং তথা।
শাকং ষড়বিধমুদ্দিষ্টং গুরুং বিদ্যাদ্ যথোত্তরম্।।'
আমাদের ব্যবহৃত সব্জি খাদ্যগুলিকে মোট ৬ টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমত 'পত্রশাক' হিসেবে নটে, পুঁই, পালং, খসলা, বাঁধাকপি ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত 'পুষ্পশাক' হিসেবে বকফুল, ফুলকপি, কলামোচা ইত্যাদি। তৃতীয়ত কন্দশাক হিসেবে মুখীকচু, মানকচু, ওল, আলু, খামালু, রাঙালু, শাঁকালু ইত্যাদি। চতুর্থত সংস্বেদজশাক হিসেবে মাশরুম, দুর্গাছাতু, খড়ছাতু ইত্যাদি। পঞ্চমত নালশাক হিসেবে শালুক ফুলের ডাঁটা, লাউ, কুমড়ো, সজনে ডাঁটা ইত্যাদি। এবং ষষ্ঠত ফলশাক হিসেবে পেঁপে, কুঁদরি, চিচিঙ্গা, উচ্ছা, বেগুন, বইতাল, করলা ইত্যাদি। 

এগুলি গুরুপাক জাতীয় শাক। অর্থাৎ এগুলি খেলে পাচন হতে সময় লাগে। তবে এগুলির মধ্যে সবচেয়ে লঘুপাক হল পত্রশাক। যদিও বর্ষাকালে বেশি বৃষ্টির দরুন শাকগুলি তেজোগুনসম্পন্ন হয়না। কেননা, বর্ষার প্রকোপ এই গুন কমিয়ে দেয়। বর্ষার স্বভাব হল পরিপাকশক্তি কমিয়ে দেওয়া। বিশিষ্ট বৃক্ষ বিশেষজ্ঞ সৌরেন্দুশেখর বিশ্বাস লিখেছেন, "বর্ষাকালে শাক না খাওয়াই ভাল। এর কারণ দ্বিবিধ। প্রথমত, বর্ষায় মানুষের পরিপাক ক্ষমতা কমে যায়। ফলে শাকাহারে অম্ল ও অজীর্ণ দেখা দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, বর্ষায় জলজ ও জলসিক্ত শাকে ফ্ল্যাজেলেট্ জাতীয় কৃমি লিপ্ত থাকে। যা পরিপাক যন্ত্রের পীড়ার কারণ হতে পারে।" বরং শরতকালের শাকগুলি বেশি তেজোগুনসম্পন্ন হয়। তাই এইসময় থেকেই শাক খাওয়ার পরিমাণ বাড়ে। 

চরক সংহিতায় পাই --
'বর্ষাশীতোচিতাঙ্গনাং সহসৈবার্ক রশ্মিভিঃ।
তপ্তানামাচিতং পিত্তং প্রায়ঃ শরদি কুপ্যতি।'
অর্থাৎ বর্ষাকালের শীতাক্ত দেহ শরতের আগমনে হঠাৎই সূর্যরশ্মির প্রভাবে প্রায়ই পিত্তের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। তাই এই উপাদানগুলি ধর্মীয় বেড়ার অন্তরালে এককভাবে কিংবা সমষ্টিগতভাবে ব্যাবহার করার নিদান দেওয়া হয়েছে। এই চোদ্দশাকের ব্যবহার কিন্তু একদিনের জন্য নয়। আসলে এইদিন থেকে খাওয়া শুরু হয়। 
পটল

এই ভূতচতুর্দশীর দিনই চোদ্দশাক খাওয়ার পাশাপাশি চোদ্দ প্রদীপ জ্বালানোর নিয়মও রয়েছে। যদিও কেন চোদ্দ প্রদীপ জ্বালাতে হয় সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু মেলেনা। আসলে হিন্দুরা পরলোকতত্ত্বে বিশ্বাসী। তাই পরলোকপ্রাপ্ত চোদ্দপুরুষের স্মরণে হয়তো জ্বালানো হয় মাটির প্রদীপ বা মোমবাতি। দুর্গাষষ্ঠীর ফোঁটা মুছে নতুন করে দেওয়ালে দেওয়া হয় চোদ্দ ফোঁটা। তেমনি মহালয়ার দিন চোদ্দপুরুষের তর্পণ করতে হয়। হিন্দু মতে পরলোকগত মানুষেরা বা তাঁদের আত্মারা মহালয়ার অমাবস্যায় যমলোক বা পরলোক ছেড়ে নেমে আসেন মর্তে। তাঁদের বর্তমান বংশধরদের হাতে জল এবং পিণ্ড গ্রহণের জন্য। একেই বলে 'তর্পণ'। ফের তাঁরা যমলোকে ফিরে যান কার্তিক অমাবস্যায়। তখন তাঁরা যাতে ভালোভাবে ফিরতে পারেন সেজন্য আকাশপ্রদীপ জ্বালানো হয় পথ দেখানোর জন্য।
🍂

Post a Comment

0 Comments