কালী:সামন্তবাদের বিরুদ্ধে দ্রোহের জয়ঘোষ ও রামপ্রসাদ
শঙ্খজিৎ
কালীপূজা। কালী উপাসনা মূলত মাতৃ-উপাসক অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের হাজার বছরের ঐতিহ্যের নিউএস্ট ফর্ম। গঙ্গাল সভ্যতায় একনংশা দিয়ে শুরু,তারপর বৌদ্ধতারা-বজ্রযোগিনী হয়ে বজ্রযান এবং সহজযানীদের শম্যাঁ বা শ্রমণধম্মের চামুণ্ডা উপাসনা,এর একটু পরেই এল লোকায়ত চণ্ডী। সেই চণ্ডীকে স্মৃতিকারের এক করলেন বিভিন্ন বৈদিক দেবীদের সঙ্গে। এসব বৈদিক দেবী কারা? বাক্,কাত্যায়নী প্রমুখ মানবীরা। তারপর কালী। আগমবাগীশী কালী। এই কালীর অবশ্য প্রথম উল্লেখ মেলে বৈদিকযুগে আগুনের সপ্তজিহ্বা তত্ত্বে। সে কালী আর বিভিন্ন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে লোকজীবনের কালী নির্ঘাত এক নন। কিন্তু স্মৃতিকারেরা তাদেরও একাত্ম করে দিলেন।
এর মাঝে অবশ্য ক্বাদি মতের সাধকরা আজকের কালীঘাট অঞ্চলে ‘ক’ অক্ষরের উপাসনা করতেন। সে নিয়ে অনেক কথাই লেখা যায়। অতিমাত্রিক বিতর্ক ভক্তদের পছন্দ হবে না। ক্যাঁড়ম্যাঁড় করবে। তাই উৎসবের মধ্যে আপাতত থাক সেসব আলোচনা।
আমরা কালী নিয়ে কিছুটা লেখবার চেষ্টা করছিলাম। এত জনপ্রিয় একজন দেবী,তার বস্তুগত অভিযাত্রা কে দ্বন্দ্ববিদ্যার আড়শি দিয়ে না দেখলে হয়? জনপ্রিয়তা এল কবে থেকে? কার দ্বারা?
শ্রমণধম্মের বিবর্তিত ধারা বা শম্যাঁ সংস্কৃতিতে দেবী উপাসনা একেবারেই বীরাচারী ও তামসিক। পশুবলি,মৎস্যবলি,কারণ(মদ) সে পূজার অবিচ্ছেদ্য উপাচার। আর বীরাচারী উপাসনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যা যুক্ত,তা হল মৈথুনাদি ক্রীড়া। এগুলোকে অস্বীকার করে এ আলোচনা চলতে পারে না। কামাখ্যার মায়ং অঞ্চল বাদে মোটামুটি সব জায়গাতেই এসব প্রথা লুপ্ত হয়েছে। কিন্তু কালীর অভিযাত্রার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল কিন্তু আগমবাগীশ মহাশয়ের দ্বারা হয় নি। হয়েছে কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন-এর দ্বারা।
🍂
রামপ্রসাদ সেন। জাতিতে শূদ্র। বৈদ্য নন;আটঘরা কায়স্থদের একটি পদবি সেন। এ রামপ্রসাদ এহেন সেন। কায়স্থরা প্রায় সকলেই পুরাতন বৌদ্ধ। ইতিহাসের একটা পর্যায়ে এসে বৌদ্ধধম্মের সাংস্কৃতিক অধঃপতন হয়। কায়স্থরা সে পর্যায়েই বৌদ্ধদের থেকে বেরিয়ে এসে স্বতন্ত্র হয় এবং বৈদিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের সাথে সমঝোতা করে নেয়। এহেন রামপ্রসাদ কালী-র বন্দনা করছেন আসলে সামন্ততান্ত্রিক বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে ধ্বনি দিতে দিতে। আর তাতেই কালী হয়ে উঠছেন হতশ্রী দরিদ্রের আশ্রয়।
‘'চাই না মা-গো রাজা হতে/রাজা হওয়ার সাধ নাই গো আমার” কিম্বা “ঐ পান বেচে খায় কৃষ্ণপান্তি,/ তারে দিলে জমিদারী।”-র মতো পঙ্/ক্তি গুলি সে চিন্তার প্রকাশ। আবার রামপ্রসাদ লিখছেন,“ ‘কারেও দিলে ধন জন মা!/ হস্তী রথী জয়ী।।/ আর কারো ভাগ্যে মজুর খাটা/ শাকে অন্ন মিলে কই।/কেউ থাকে অট্টালিকায়,/ আমার ইচ্ছা তেম্নি রই।।/ ও মা তারা কি তোর বাপের ঠাকুর,/ আমি কেহ নই/ কারো অঙ্গে শাল-দোশালা ভাতে চিনি দই/ আবার কারো ভাগ্যে শাকে বালি/ ধানেভরাকই।” কাকে লিখছেন রামপ্রসাদ? সমকালীনতায় কালী হয়ে উঠছেন তার দ্রোহপ্রকাশের মাধ্যম।
কৃষিকাজকে সাধক রামপ্রসাদ মিলিয়ে দিলেন তন্ত্রবিদ্যার অঙ্গে। “এমন মানবজমিন রইল পতিত/আবাদ করলে ফলতো সোনা” কিম্বা “দেহ জমির জঙ্গল বেশী,/ সাধ্য কি মা সকল চাষি/ মাগো যৎকিঞ্চিৎ আবাদ হইলে/ আনন্দ সাগরে ভাসি” এ তো নিবৃত্তিমার্গের চাহিদা ছাড়া আর কিছুই নয়।
দেবীসূক্তে যে “অহং রাষ্ট্রী সংগমনী”-র আওয়াজ ছিল। রামপ্রসাদ নির্মাণ করলেন তার বৈকল্পিক ভাষ্য। পাট্টা চেয়ে লিখলেন,“‘শিব-রাজ্যে বসত করি,/ শিব আমার পাট্টা দিয়াছে।” আবার লিখলেন,“এ সংসারে ডরি কারে—/ রাজা যার মা মহেশ্বরী,/ আনন্দে আনন্দময়ীর খাস তালুকে বসত করি।’‘ কালী,কল্পতরু হলেন। কালী হলেন দ্রোহরাষ্ট্রের প্রতীক,বুর্জোয়া সমাজে বিদ্রোহীনী।
এই কালীকেই আমরা চিনেছি,বুঝেছি,অনুধাবন করেছি। বাঙালী নিম্নবিত্তের দুঃখ,দারিদ্র,বিপদ,শঙ্কাকে নাশ করছেন কালী,এই ভাবনার স্ফূরণ হয়েছে। বীরাচারের ধাঁধা ছেড়ে কালী-কেন্দ্রীক সংস্কৃতি বিস্তারলাভ করেছে ভক্তিবাদী সাধনক্রমে। এই বিস্তারলাভের এই আশ্চর্য জাদুদণ্ডটি ছুঁইয়ে দিয়েছেন রামপ্রসাদ। আমাদের কবিরঞ্জন।
তাঁর আবির্ভাবের ৩০০ বছর অতিক্রান্ত। সরকারী/বিরোধী কেউ সে ৩০০ বছর নিয়ে ভাবিত হল না। পালন করল না। সেলিব্রেট করল না। কেন করল না তা সহজেই অনুমেয়। বাংলার শাসনক্ষমতা এখনও যে সামন্ততান্ত্রিকতা-কে পুরোপুরি অতিক্রম করতে পারল না! মাঝে বিকেন্দ্রীভূত পঞ্চায়েত ব্যবস্থার রূপায়ণ হলেও,শাসনক্ষমতার নিম্নতম ডালের রাশ আবার ধরে ফেলেছে নব্যবুর্জোয়া লুম্পেনরা। তাই,রামপ্রসাদ আবার প্রাসঙ্গিক,বারবার প্রাসঙ্গিক।
0 Comments