জ্বলদর্চি

আলো/অজিত দেবনাথ

আলো


অজিত দেবনাথ 


শহরের প্রান্তে পুরোনো কালীমন্দিরটা যেন এক বিস্মৃত ইতিহাসের মতো দাঁড়িয়ে আছে। লোকে বলে, একসময় এখানে ঘন বন ছিল-সেখানে রাতের বেলা বাতাসে কাঁপত শিউলি ফুলের গন্ধ, ঝিঁঝি পোকাদের সুরে ভেসে আসত অচেনা মন্ত্রের আওয়াজ। সেই মন্দিরের পাশেই ছিল নীলিমাদের ভাঙা বাড়ি। বহু বছর আগের এক কালীপুজোর রাতে সেখানে আগুন লেগেছিল। অগ্নিদগ্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা সংসার। নীলিমার মা, কালীমূর্তিকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারান। লোকে বলে, সেই থেকে প্রতি কালীপুজোর রাত বারোটায় তাঁর ছায়া এসে মন্দিরের প্রদীপে তেল ঢালে, আর মন্ত্র পড়ে—“জগজ্জননী মা, আলো দাও।”
এ বছর মন্দিরের সংস্কারকাজ চলছে। পুরোহিত বদল হয়েছে। নতুন পুরোহিত রমেন তরুণ, যুক্তিবাদী, শহরের কলেজে পড়া ছেলে। গ্রামবাসীদের কুসংস্কারে তার তীব্র অরুচি। “মা কালী কোনো ছায়ার প্রয়োজন রাখেন না।”  সে বলত, “মূর্তির শক্তি মানুষের ভক্তিতে, ভূতের গল্পে নয়।” তবু মন্দির সংস্কারের সময় কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটছিল। মাঝ রাতে কেউ যেন মন্দিরের চাতালে পায়চারি করে। শুকনো প্রদীপ হঠাৎ জ্বলে ওঠে, ঘণ্টা-ধ্বনিও শোনা যায়। রমেন এসব দেখে বিরক্ত হত। সে বলে ওঠে, “চোরেদের কাজ।”  তার পর সে আবার শুয়ে পড়ত নিজের ঘরে।
🍂

পূজার দিন এল। চারদিক আলোয় ভরে উঠল। পাড়ার ছেলেরা আতসবাজি জ্বালাতে ব্যস্ত, মহিলারা প্রসাদ তৈরিতে মনোনিবেশ করেছে , আর মন্দিরে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে ধূপ-ধুনোর।রমেন স্নান সেরে মন্দিরে বসে পাঠ শুরু করল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন অদ্ভুতভাবে গা ছমছমে  করে উঠল। ঘড়িতে তখন ঠিক বারোটা। বাইরে হঠাৎ এক ঝটকা হাওয়া বইল। প্রদীপ নিভে গেল, মন্ত্রপাঠ থেমে গেল মাঝপথে।
রমেন মোমবাতি জ্বালাতে গিয়ে শুনল একটা মৃদু কণ্ঠস্বর, যেন দূর থেকে কেউ ফিসফিস করছে,
“জগজ্জননী মা, আলো দাও…”
রমেনের সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠল।সে ঘুরে তাকাল ।দেখল মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধা, গায়ে মলিন শাড়ি, কপালে ছাই, চোখে শান্ত দীপ্তি। তাঁর ঠোঁটে নরম হাসি, হাতে  প্রদীপ। তিনি ধীরে ধীরে প্রদীপ জ্বালালেন, আর মুহূর্তেই অন্ধকার উধাও। চারপাশে আলো জ্বলে উঠল, বাতাসে গন্ধ ছড়াল চন্দন ও ফুলের।
রমেন কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। বৃদ্ধা মৃদু স্বরে বললেন, “মাকে আলো দিতে কেউ এলে, মা মুখ ফিরিয়ে নেন না। এই আলোটা রক্ষা করো।”
তিনি প্রদীপটা রমেনের হাতে দিয়ে ধীরে ধীরে দরজার দিকে হাঁটতে লাগলেন। দরজার বাইরে আলো কিছুটা ছড়িয়ে পড়লে  । রাত পেরিয়ে  ভোর। গ্রামবাসীরা এল পূজার প্রসাদ নিতে। তারা বিস্ময়ে দেখল, রাতভর যে প্রদীপটি জ্বলছিল, তাতে তেল বিন্দুমাত্র  ফুরোয়নি। অথচ আগের দিন তেল ছিল সামান্যই। রমেন চুপ করে রইল। কেউ বলল, “দেখেছ, কাল রাতে  মা নিজেই এসেছিলেন!”
কেউ বলল, “নীলিমার মায়ের আত্মা বোধহয় মন্দিরের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। ।”
রমেন কোনো উত্তর দিল না। শুধু প্রদীপটার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। আগুনের ছোট্ট শিখার ভেতরে সে যেন দেখতে পেল এক জোড়া চোখ-যে চোখে ছিল এক মায়ের স্নেহ, আর কালীমায়ের করুণা মিলেমিশে একাকার।
সেদিন থেকে রমেন বদলে গেছে। প্রতি বছর কালীপুজোর রাতে সে নিজেই প্রদীপ জ্বালিয়ে বলে,
“জগজ্জননী মা, আলো দাও।”
আর বাতাসের ভেতর দিয়ে ভেসে আসে এক মায়ের মায়াবী কণ্ঠস্বর, “আলো তো তোমার ভেতরেই আছে, বাছা।”

Post a Comment

0 Comments