মানবতাবাদই ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একমাত্র ধর্ম
ম ঙ্গ ল প্র সা দ মা ই তি
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এক বর্ণময় চরিত্রের মানুষ। যে মানুষটিকে নিয়ে আমাদের বাঙালিজাতির গর্বের শেষ নেই, অহঙ্কারের সীমা-পরিসীমা নেই। বজ্রের মতো কঠোর অথচ কুসুমের মতো কোমল হৃদয়ের মানুষটির নিজস্ব ধর্ম কী ছিল তা আমাদের জানতে বড়ো ইচ্ছে করে বৈকি। অনেকে তাঁর সম্বন্ধে অভিযোগ করে থাকেন বিদ্যাসাগর ঘোর নাস্তিক ছিলেন, ঈশ্বরে মোটেই বিশ্বাস করতেন না। সত্যি কি আসলে তাই?
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে বিদ্যাসাগর বুঝি ঠাকুর-দেবতা মানতেন না, তথাকথিত ধর্ম-কর্মে তাঁর মন ছিল না। কিন্তু তাঁর প্রতিদিনকার জীবনযাত্রার দিকটি নিয়ে যদি পর্যালোচনা করি তাহলে বিষয়টা অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক নিষ্ঠাবান হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে। তিনি যে পৈতা ধারণ করেছিলেন সেই পৈতার মর্যাদা তিনি সারাজীবন দিয়ে এসেছেন। ব্রাহ্মদের মতো তিনি পৈতা পরিত্যাগ করেননি কখনো। হিন্দু ধর্মমতে অন্নপ্রাশন, বিবাহ, শ্রাদ্ধ ইত্যাদির যে সামাজিক অনুষ্ঠান তাও তিনি মেনে গেছেন। এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে কোথাও কোনো প্রতিবাদ করেছেন বা, মন থেকে মেনে নেননি এমন উদাহরণও নেই। খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণকারী মাইকেল মধুসূদনকে তিনি ভালোবেসেছেন। তাঁকে বিপদের সময় আর্থিক সাহায্য করেছেন। ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী শিবনাথ শাস্ত্রীকে তিনি স্নেহ করতেন, দেবেন্দ্রনাথের প্রতি ছিল শ্রদ্ধার আসন পাতা। খাঁটি হিন্দু বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ছিলেন তাঁর প্রিয়পাত্র। দেখা যাচ্ছে সব ধর্মের প্রতিই ছিল তাঁর সমান আনুগত্য, ভালোবাসা।
পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজে এসে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করে গেছেন। যা ছিল এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। বিদ্যাসাগরের ধারণাই ছিল না রামকৃষ্ণদেব কোনদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারেন। রামকৃষ্ণদেব এসেছেন। বিদ্যাসাগর চেয়ার ছেড়ে শশব্যস্তে রামকৃষ্ণদেবকে বসার আসন পেতে দিতে গেলেন। রামকৃষ্ণদেব তাতে না বসে মেঝেতে বসে পড়লেন। তাই দেখে বিদ্যাসাগরও মেঝেতে বসলেন। এরপর বিদ্যাগরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন “এতদিন শুধু নালা-নর্দমা ডিঙিয়েছি; ডোবা আর পুকুর পার হয়েছি। এবার সাগরে এলাম।”
রামকৃষ্ণদেবের কথা শুনে বিদ্যাসাগর কৌতুক করার লোভ সংবরণ করতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন- “যখন এসে পড়েছেন। যখন এসে পড়েছেন। তখন তো আর উপায় নেই; খানিকটা নোনা জলই নিয়ে যান। আর জাল যদি ফেলতে চান, বড়োজোর কুচো মাছ, আর নইলে ঝিনুকের খোসা উঠতে পারে; তার বেশি কিছু নেই।”
উত্তরে রামকৃষ্ণদেব বললেন “না গো না, নোনা জলই নেব কেন? এ যে দুধের সাগর, দইয়ের সাগর, মধুর সাগর। তুমি তো অবিদ্যা নও, বিদ্যাসাগর। আমি যখন এসেছি তখন মুক্তো কুড়িয়ে নিয়ে যাব।” এরকম আরও কিছু কথা হয়েছিল। জ্ঞান, বৈরাগ্য, ভক্তি নিয়েও কথা হয়েছিল। আলু পটলের মতো সিদ্ধ পুরুষ বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন রামকৃষ্ণদেব। প্রস্থানকালে রামকৃষ্ণদেব বিদ্যাসাগরকে দক্ষিণেশ্বরে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর কথাও দিয়েছিলেন যাবেন বলে। কিন্তু বিদ্যাসাগর দক্ষিণেশ্বরে শেষ পর্যন্ত যাননি। কেন যাননি সে রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি।
স্বামী বিবেকানন্দ মহেন্দ্রনাথ গুপ্তকে বলেছেন “বিদ্যাসাগর ঈশ্বরকে উপলব্ধি করেছেন।” তাঁর মানসকন্যা ভগিনী নিবেদিতাকে বলেছেন “বিদ্যাসাগরের মানুষের প্রতি এত দয়া, এত মমতা তার কারণ তিনি যথার্থ ধার্মিক ব্যক্তি। শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের পরেই তাঁর গুরু হলেন বিদ্যাসাগর।”
বিদ্যাসাগর যে সব আহার বিহার করতেন তাও ছিল সব ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মতোই। যে সব চিঠি পত্র তাঁর পাই সেই সব চিঠি পত্রের উপরে তিনি লিখতেন “শ্রী শ্রী হরি: শরণম”, “শ্রী শ্রী হরি: সহায়”, ‘শ্রীশ্রী দুর্গা শরণম” ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিদ্যাসাগরের অসামান্য একটি গ্রন্থ হল ‘বোধদয়’। এটি ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়। পাঠ্যপুস্তক হিসাবে প্রকাশিত হলেও সেই সময় এই গ্রন্থটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। জানা যায় বিদ্যাসাগর তাঁর জীবদ্দশায় এই গ্রন্থটির একশোটিরও বেশি মুদ্রিত সংস্করণ দেখে গেছেন। যা একটি বিরল ঘটনা। প্রথমদিকে না হলেও শেষের দিকের সংস্করণে এই বইটির মধ্যে বিদ্যাসাগর ঈশ্বর সম্বন্ধে আলোকপাত করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন “ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ। তাঁহাকে কেহ দেখিতে পায় না, কিন্তু তিনি সর্বদা সর্বত্র বিরাজমান আছেন।” অন্যত্র তিনি লিখছেন “ ঈশ্বর কি অভিপ্রায়ে কোন বস্তুর সৃষ্টি করিয়াছেন আমরা তাহা অবগত নহি। বিশ্বকর্তা ঈশ্বরের সন্নিধানে সকল বস্তুই সমান। ঈশ্বর কেবল প্রাণীদিগকে চেতনা দিয়াছেন। তিনি ভিন্ন আর আর কাহারও চেতনা দেবার ক্ষমতা নাই।” এ কথাগুলি তিনি কি শুধু ছাত্রদের উপদেশ দেবার জন্যই লিখেছিলেন? তা কিন্তু নয়। ঈশ্বরকে নিয়ে গভীরভাবে বিদ্যাসাগর নিজে ভেবেছেন। আর ঈশ্বরের প্রতি গভীর বিশ্বাস ছিল বলেই এমন কথা লিখতে পেরেছেন।তাই বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন একথা মেনে নেওয়া যায় না। আসলে তথাকথিত ধর্ম নিয়ে হৈচৈ, হুল্লোড়, মাতামাতি এটা পছন্দ করতেন না তিনি। অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি বিলে মনে করতেন এখানেই ছিল তাঁর তীব্র আপত্তি। তখন তাদের নাস্তানুবাদ করতেও ছাড়েননি। তিনি মানুষের সেবা করাটাকে সবচেয়ে বড়ো ধর্ম বলে মনে করতেন। মানবতাবাদের মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি, ছিলেন জীবন্ত বিগ্রহ। তাইতো অন্যের দুঃখে তাঁর প্রাণ কাতর হয়ে উঠত। তার সেবা করতে পারলে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করতেন। তাঁর অন্তরে, হৃদয়ের স্থলে সবসময় জ্বলতো একট ধর্মের দীপশিখা। তা তিনি লোকদেখানো বাইরের আলোয় আনতে চাননি। তাইতো তিনি কাশী গিয়ে অনায়াসে সেখানকার ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের বলতে পেরেছেন। “আমি তো কাশী দর্শন করতে আসিনি, আমি এসেছি পিতৃদর্শন করতে। আমার বিশ্বনাথ হলেন আমার বাবা। আর আমার অন্নপূর্ণা হলেন আমার মা। আমি তাঁদেরই মানি।” এই হলেন আমাদের বিদ্যাসাগর, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
0 Comments