অজিত দেবনাথ
বৃষ্টি ভেজা রাস্তা ধরে নিখিল সরকার হেঁটে চলে একা। উত্তরবঙ্গের বনভূমির প্রাচীর তখন সবুজে ছয়লাপ।চারদিক সজল, প্রকৃতির চেহারাটা যেন ধুয়ে-মুছে এক নতুন রূপে ধরা দিয়েছে। বাতাসে মাটির গন্ধ— যেন পুরনো কোনো স্মৃতির দরজা খুলে দেয়। গাছপালারা যেন বৃষ্টিকে স্বাগত জানিয়ে মাথা নুয়ে আছে, আর আকাশে জমে থাকা মেঘেরা হঠাৎ-হঠাৎ গর্জে ওঠে বলে, "আমি আছি, আমি আছি।" নিখিলের মাথার উপর খোলা আকাশ। সে চায় ভিজতে, একান্তভাবে, নিঃশব্দে, এই ধুলোছোঁয়া পৃথিবীর অন্তর্গত ভাষার সঙ্গে মিশে যেতে।
বেশ কয়েক বছর হল মা-বাবা মারা যায় । তার জীবনে এখন আর কেউ নেই। যে মানুষগুলো ছিল, তারা এখন কেবল অশান্ত নদীর মতো লেলিহান স্মৃতি—বুকের ভেতর যন্ত্রণার আলপিন হয়ে গেঁথে আছে। এক সময় ভালোবাসা ছিল প্রতীক্ষার অমলিন চাদরের মতো, একরাশ বিশ্বাস ছিল, দ্বিধাহীন স্বপ্নও ছিল—কিন্তু সবই একে একে হারিয়ে গেছে সময়ের জরাজীর্ণ স্রোতে। তবু আজকের এই বর্ষণ যেন ভেতরের জমে থাকা কান্নাকে ধুয়ে দেয়, বুকের ভিতর উঁকি মারে এক অন্য পৃথিবী। গাছের পাতা থেকে জল পড়ছে, যেন প্রকৃতি নিজেই তার ব্যথা প্রকাশ করছে নিঃশব্দে।
নিখিল থেমে দাঁড়ায়, মুঠোভরে আকাশের জল ধরার চেষ্টা করে। তার মনে হয়, এই এক ফোঁটা জলের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে তার জীবনের উত্তর। শহরের কোলাহল, ব্যস্ততা, মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া নিজেকে সে যেন আবার খুঁজে পায় এই নির্জন রাস্তায়। এখানে কেউ নেই তাকে ঠকানোর, কেউ নেই তাকে ভুল বোঝার। শুধু আছে গাছ, পাখি, বাতাস আর বর্ষা—যারা নীরবে বোঝে তার মনের কথা।
একটা ছোট পাখি এসে ঝোপের ডালে বসে। পালক ভিজে গেছে, তবু সে নড়ে, ডানা ঝাপটায়, গা থেকে জল ঝরে । নিখিল তাকিয়ে দেখে, এক আশ্চর্য প্রশান্তি নামে চোখে-মুখে। সে বুঝতে পারে—প্রকৃতির ভাষা যে কোনো মানুষের ভাষার চেয়ে অনেক গভীর, অনেক স্নেহপূর্ণ। একাকীত্বও কখনো কখনো অনুভূতির নিঃসীম উপত্যকা হয়ে ওঠে, যদি প্রকৃতি নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়ায়।
বৃষ্টিভেজা সেই পথে নিখিল হেঁটে চলে। তার মনে এখন আর কোনো দুঃখ নেই, নেই কোনো অভিযোগ। যেন ভিতরে কোথাও এক নতুন আলো জেগে উঠেছে, এক অদ্ভুত উন্মেষ। সে জানে, জীবনে যা হারিয়ে গেছে, তা আর ফিরে আসবে না। কিন্তু এই হাঁটা, এই নিঃসঙ্গতা, এই প্রকৃতি—এগুলিই তাকে ফিরিয়ে দেয় তার নিজের কাছে।
আজ নিখিল কারো কাছে নয়, কারো ছায়ায় নয়—সে একেবারে নিজের মতো করে প্রকৃতির কোলে, একাত্ম, নিঃশব্দ, অথচ পূর্ণ।
🍂
0 Comments