জ্বলদর্চি

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও অন্ধকার (The Darkness of Sigmund Freud, The Austrian Neurologist)

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও অন্ধকার (The Darkness of Sigmund Freud, The Austrian Neurologist



প্র ভা ত  মি শ্র

ফ্রয়েডীয় অন্ধকার

১. ফ্রয়েড আবহমান

if often he was wrong and, at times, absurd,
to us he is no more a person
now but a whole climate of opinion
under whom we conduct our different lives...

লিখেছিলেন কবি অডেন। উপলক্ষ : ফ্রয়েডের মৃত্যু।

মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বের(Psychoanalysis theory) প্রাণপুরুষ ছিলেন সিগমুণ্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯)। বিশ্বের বৌদ্ধিক জগতে এনেছিলেন বিপ্লব। তাঁর ভাবনাচিন্তা বদলে দিয়েছিল মনােজগতের স্বরূপ সন্ধানের দিক, আন্তর্ব্যক্তিক সম্বন্ধের চরিত্র। বদলে দিয়েছিল মানুষের আচরণ-সম্পর্কিত যাবতীয় প্রচলিত ধারণা। তাঁর জীবনদৃষ্টি অনেকের কাছে গ্রহণযােগ্য হয়নি। কিন্তু তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করাও অনেকের কাছে সম্ভব হয়নি আজও। ফ্রয়েডের প্রেতাত্মা আজও আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগতের অন্ধকারে ঘােরাফেরা করে।

২. নিশ্চেতন

সাধারণভাবে মনে করা হয়, মানুষের ব্যক্তিসত্তা তার মনের সচেতন প্রদেশ-ই গড়ে তােলে। ফ্রয়েড বললেন, মানুষের ব্যক্তিসত্তার বেশিটাই গড়ে তােলে তার মনের নিশ্চেতন অন্ধকার জগৎ। মানুষ ভুল বলে, স্বপ্ন দ্যাখে, ভুলে যায়, সাফল্যের জন্য অবিরাম চেষ্টা করে, একই আচরণ বাববার করে, কবিতা লেখে, গল্প লেখে, ছবি আঁকে -এসব দেখে মানুষকে রহস্যময় মনে হয়। এসবের পেছনে থাকে মনের অন্ধকার জগতের হাতছানি। আমরা তা দেখতে পাই না। মানুষের অস্বাভাবিক আচরণগুলিকে রহস্যময় মনে করি।

ফ্রয়েড চিকিৎসক ছিলেন। বলা ভালাে, মনোরোগের চিকিৎসক। বেশী উৎসাহী ছিলেন মূর্ছা ও উদ্বায়ু রোগের চিকিৎসায়। সেই সময়ের বিখ্যাত মনােচিকিৎসক শারকভ, ব্রয়ারদের মত বুঝে গিয়েছিলেন এইসব রোগের মূল উৎস অবদমিত জীবন-অভিজ্ঞতার স্মৃতি --যার সংস্কার মনের অতল অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছে --নিশ্চেতনে ডুবে আছে। 

নিশ্চেতন স্তর ছাড়া মনের আরও দুটি স্তর আছে-- সচেতন স্তর, প্রাকচেতন স্তর। মনের যে স্তর সর্বদাই আমাদের সাক্ষাৎ জ্ঞানের বিষয়, তা সচেতন স্তর। যে স্তর সাক্ষাৎভাবে জ্ঞানীয় স্তরে থাকে না, কিন্তু যে কোন সময় জ্ঞানের বিষয় হয়ে যেতে পারে, তা প্রাকচেতন স্তর। আর যে স্তরের জ্ঞানই আমাদের থাকে না, তা-ই নিশ্চেতন স্তর। এই নিশ্চেতন, ফ্রয়েডীয় তত্ত্বে বেশিরকম গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রয়েডের মতে নিশ্চেতনই ব্যক্তি জীবনের নিয়ামক। এই নিশ্চেতন অন্ধকারেই মানুষের যাবতীয় অবদমিত ইচ্ছা—কামনা বাসনা সঞ্চিত থাকে, কচ্চিৎ সচেতন স্তরে ভেসে উঠতে চায়, কিন্তু নিশ্চেতনের প্রবল অবদমনশক্তি তাদের আবার টেনে নিয়ে যায় অতল অন্ধকারে।

ফ্রয়েডের মতে আমাদের সব কামনাবাসনা মূলত যৌন-এষণা। সামাজিক নিয়মে এগুলির স্বাভাবিক পরিতৃপ্তি হয় না। এগুলি নিশ্চেতনে আশ্রিত হয়। বিভিন্ন মনােবিকার, যা ব্যক্তিত্বকে গড়ে তােলে, আর স্নায়ুরােগ এবং স্বপ্নের মধ্যেই এই অপরিতৃপ্ত কামনা বাসনা আত্মপ্রকাশ করে।

৩. ইদ-ইগো -- সুপার ইগো( Id- Ego - Super ego)

যৌন-এষণার মৌল অনুসন্ধান করতে গিয়ে ফ্রয়েড ব্যক্তি মনের একটি কাঠামাে আবিষ্কার করেন। এই কাঠামাের তিনটি স্তম্ভ ইদ বা আদি-অহং, ইগাে বা অহং ও সুপার-ইগাে বা অধি-অহং।

আদি-অহং এর উপাদান হ’ল সহজাত প্রবৃত্তি ও যাবতীয় আদিম কামনাবাসনার তাড়না। শিশুর মধ্যেই সহজাত ভাবে আদি-অহং কার্যকরী হয়ে ওঠে। শিশু যখন থেকে পরিবেশ সচেতন হয়, তখন থেকে তার মধ্যে অহং প্রতিষ্ঠা পায়। শিশু যতই বড় হতে থাকে ততই তার মধ্যে মাথা তােলে অধি-অহং। অধি-অহং ব্যক্তির মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ সঞ্চারিত করে। এই নৈতিক মূল্যবােধ সে পিতামাতা বা অন্য অভিভাবকের মধ্যে থাকা সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ থেকে অর্জন করে।

মানুষের আদিম ও সহজাত সমূহ প্রবৃত্তি নিয়ে গঠিত হয় আদি-অহং। মানুষের জন্ম হয় জীবনােম্মুখ সহজাত প্রবৃত্তি  (eros)ও মরণোম্মুখ সহজাত প্রবৃত্তি(death instnct) নিয়ে। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, যৌন-এষণা, অবিরাম সাফল্য-কামনা এগুলি হ'ল জীবনমুখী সহজাত প্রবৃত্তি। এই সহজাত জীবনমুখী প্রবৃত্তি বা জীবন শক্তিকে ফ্রয়েড বলেছেন 'লিবিডো'(libido)। সাধারণত লিবিডো বলতে যৌন এষণা বােঝা হয়। কিন্তু ফ্রয়েডের মতে সবরকমের ভালােবাসা, সন্তান-বাৎসল্য, বন্ধুপ্রীতি লিবিডাের অন্তর্ভুক্ত। 

ফ্রয়েড জড়বাদী ও বিবর্তনবাদী ডারউইন তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। জড়ের মধ্যে একধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে প্রাণের উদ্ভব। এই প্রাণ মানুষের প্রাণ মাঝে মাঝেই জড়ত্বের দিকে ফিরে যেতে চায়, যা প্রকাশিত হয় মানুষের মৃত্যু-বাসনার দ্বারা। তাই কোন কোন মানুষ কখনাে কখনাে আত্মঘাতী হয়, কিংবা আত্মহত্যা করতে চায়। মানুষের স্বাভাবিক জীবনশক্তির বিকাশ ব্যাহত হলে --কিংবা জীবনবিকাশে তার একান্ত হতাশা এলে, সে আত্মঘাতী হয়, কিংবা আত্মহত্যার ইচ্ছা পােষণ করে। অর্থাৎ সে জড়ে অন্তর্লীন হতে চায়। জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন' কবিতার নায়ক এভাবেই আত্মঘাতী হয়েছিল।

ফ্রয়েড মনে করতেন মানুষের ব্যক্তিত্ব বা ব্যক্তিজীবন মৌলিকভাবে আদি-অহং-এর অধিকারে থাকে। আদি-বাসনাগুলির পরিতৃপ্তির জন্য বাস্তব জগতের সংস্পর্শ  প্রয়ােজন। এই কারণে শিশুর সঙ্গে ক্রমে ক্রমে বাস্তব ও সামাজিক জগতের সম্বন্ধ গড়ে ওঠে। আর এর থেকেই তার ব্যক্তিসত্তায় জন্ম নেয় অহং। বস্তুজাগতিক নীতিই অহং-এর পরিচালক। অহং-ই বস্তুজাগতিক নীতির পথ ধরে আদি-অহং এর কামনা-বাসনার তাড়না কমাতে কাজ করে যায়। অহং-ই আদি অহং-এর তাড়নাকে বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করে।

ফ্রয়েডের মতে যার মধ্যে সুস্থ সবল অহং থাকে, তার মধ্যেই থাকে প্রবল ব্যক্তিত্ব। তার মধ্যে জগতে ভালােবাসা ও কাজ করার যথেষ্ট সামর্থ্য থাকে। অধি-অহং, যা মানুষের ব্যক্তিজীবনের নৈতিক শাসক, তা অহং-এর ওপর খবরদারি করে। 'এটা করাে ওটা করাে না' অহংকে বলে। অধি-অহং কারাে মধ্যে প্রবল হয়ে উঠলে, তার দ্বারা ব্যক্তিত্বের বিকাশ কিছুটা ব্যাহত হয়। অধি-অহং হল বিবেক। এই বিবেকের কিছু ভালো ভূমিকা আছে ব্যক্তিমানুষের জীবনে। কিন্তু অধি-অহং বা বিবেক আদি-অহং এর মত বাস্তবতাবর্জিত। তাই একে অতিরিক্ত সবল হতে দিলে বাস্তব জগতে ব্যক্তি মানুষের সামগ্রিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়।

৪.যৌন এষণা

ফ্রয়েড তাঁর দীর্ঘ চিকিৎসক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুলেছিলেন যে স্বপ্ন, যাবতীয় মনােবিকার, স্নায়ুরোগ, অস্বাভাবিক জীবনযাপন – এইসবই মানুষের মধ্যে অবদমিত ইচ্ছা-- কামনা বাসনার প্রকাশ। যে ইচ্ছার মধ্যে প্রধান হল যৌন-এষণা। এই অবদমন শুরু হয়ে যায় মানুষের জীবনের শৈশব থেকে। মানুষের যৌনজীবন শুরু হয় শৈশবে। শৈশবকালীন যৌন-এষণাই নির্মাণ করে নিশ্চেতন অন্ধকার জগৎ। ক্রোধ, ইচ্ছা, ঘৃণা, লােভ প্রধানত এইগুলিই নিশ্চেতনের আধেয় হয়ে উঠতে থাকে। এইগুলি অবদমন করতে করতেই শৈশব অতিক্রম করে মানুষ। ফ্রয়েড শৈশবকালীন যৌন-এষণার বিভিন্ন পর্যায় বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। মায়ের স্তন্যচোষণ এবং নিজের অঙ্গুলিচোষণ থেকে শুরু করে জননেন্দ্রিয় সম্বন্ধে সচেতন হওয়া ও বয়ঃসন্ধিকালের পথ ধরেই শৈশব থেকে মানুষের যৌনজীবনের বিকাশ ও সমৃদ্ধি হতে থাকে। শৈশবকালীন এই যৌনজীবন প্রকাশিত হয় আরাে দুটি বিষয়ের দ্বারা-- ইডিপাস-এষণা ও ইলেকট্রো-এষণা। ফ্রয়েড অবশ্য ইডিপাস-এষণার কথাই বেশি বলেছেন। কারণ তাঁর শৈশবকালীন যৌন-এষণায় তিনি কেবল বালকদের প্রসঙ্গই এনেছেন। মায়ের প্রতি বালকের স্বাভাবিক আকর্ষণ (ফ্রয়েডের মতে যৌন আকর্ষণ) এবং বাবার প্রতি ঈর্ষা ও বিদ্বেষ হল ইডিপাস-এষণা। আর বালিকার বাবার প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ ও মায়ের প্রতি ঈর্ষাদ্বেষ হল ইলেকট্রো-এষণা। বাস্তবিক এই বাস্তব উপলব্ধি ফ্রয়েডকে শৈশবকালীন যৌন-এষণার দিকটি উন্মােচিত করতে বিশেষ সাহায্য করেছে।

৫.স্বপ্ন

ফ্রয়েড মনােরােগীদের চিকিৎসা করতে করতেই মনােজগতের দর্শন রচনা করেছিলেন। তাঁর চিকিৎসাপদ্ধতিই দার্শনিক পদ্ধতি। তাঁর এই পদ্ধতি মনঃসমীক্ষণ বা সাইকোঅ্যানালিসিস নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে রােগীর সাথে চিকিৎসকের দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা হয়। রােগীর কাছ থেকে চিকিৎসক তার পূর্বজীবনের স্মৃতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আত্মবিশ্লেষণ, স্বপ্ন-অভিজ্ঞতা ইত্যাদি সংগ্রহ করেন। এইসব সমীক্ষা বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করাই মনঃসমীক্ষণ। মনঃসমীক্ষক হিসেবে ফ্রয়েডের বারে বারে এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে মানুষের জীবনের অবদমিত কামনা বাসনাগুলি স্মৃতি হিসেবে তার শিশুকাল থেকেই নিশ্চেতন স্তরে থেকে যায়। নিশ্চেতন স্তরের অবদমিত কামনা বাসনা যখন সচেতন স্তরে বিকৃতভাবে অনুপ্রবেশ করে তখনই মানুষ স্বপ্ন দ্যাখে। এই কারণে ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতিতে স্বপ্নসমীক্ষণের বড় একটি ভূমিকা ছিল।

৬. মৃত্যু বাসনা

ফ্রয়েড মনে করতেন, মানুষের মনে দুটি মৌলিক তাড়না সংগােপনে থাকে : যৌনতাড়না (লিবিডাে) এবং আগ্রাসনী তাড়না (অ্যাগ্রেশন)। যৌন তাড়নার অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে মৃত্যুপ্রবণতা। এই মৃত্যুপ্রবণতা যখন ধ্বংসাত্মক শক্তিতে পরিণত হয়, তখন তা কোন মানুষকে মর্ষকামী করে তােলে, আবার কোন মানুষকে ধর্ষকামী করে তােলে। মর্ষকামী আত্মনিপীড়নের দ্বারা যৌন তৃপ্তি লাভ করে, প্রেমিকের দ্বারা নিগৃহীত হয়ে সুখ-লাভ করে। আর ধর্ষকামী প্রেমিক প্রেমিকাকে / প্রেমিকা প্রেমিককে নিপীড়ন করে তৃপ্তি লাভ করে।

শৈশবেই যৌনতাড়নার সূত্রপাত। এই বিতর্কিত সিদ্ধান্তে বিশ্বাসী ফ্রয়েড মনে করতেন শিশুমাত্রই আত্মকামী। এই আত্মকামিতার নাম নারসিসিজম। একটু বয়স বাড়লে তার এই নার্সিসিজম কেবল তার দেহকে ভালােবাসে। আরো বয়স বাড়লে তার মধ্যে জন্ম নেয় সমকামিতা। তারপর যখন সে পরিণত যুবক, সে হয়ে ওঠে বিষমকামী।

৭. উদ্বেগ ও উদ্গতি

ফ্রয়েডের মনােজগৎবীক্ষায় যেমন স্বপ্নের একটা বড় ভূমিকা আছে, তেমনই ভূমিকা আছে উদ্বেগের। উদ্বেগও অনেক উদ্বায়ু রোগের কারণ। যাবতীয় উদ্বেগের কারণ যৌন-এষণাযুক্ত মনের স্বতঃস্ফূর্ত ও যথাযথ বিকাশ না হওয়া। এই উদ্বেগের তিন রূপ : বস্তুজাগতিক উদ্বেগ, স্নায়বিক উদ্বেগ ও নৈতিক উদ্বেগ। বাস্তব জগতের সঙ্গে সংঘাত থেকে উৎপন্ন হয় বস্তুজাগতিক উদ্বেগ। আদি অহং-এর আহ্বানে মানুষ এমন কিছু করে বসে, যখন সে ভাবে যে, সে পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে শাস্তি পাবে, তখনই উৎপন্ন হয় স্নায়বিক উদ্বেগের। আর মানুষ যখন তার সমাজের—তার কালের প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতি, মূল্যবােধ লঙ্ঘন করে কিছু ভাবে, কিছু করে, তখন অধি-অহং-এর প্রভাবে সে নৈতিক উদ্বেগের শিকার হয়। এসব উদ্বেগের প্রতিরােধে আত্মরক্ষার কৃৎকৌশলও মনের নির্জ্ঞান স্তরে কাজ করে যায়। এই কৃৎকৌশলগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম মৌলিক হলাে অবদমন (রিপ্রেশন)। অবদমন বা রিপ্রেশনকেই ফ্রয়েড মনঃসমীক্ষণের ভিত্তিপ্রস্তর মনে করতেন। অবদমনের পরে অন্যপ্রধান কৃৎকৌশল হল অভিক্রান্তি (ট্রানসফারেন্স)। কোন সন্তানহীনা নারী পশুপাখী পুষে আনন্দ পান। এর মূলে রয়েছে অবদমিত মাতৃত্বকামনা। এই অভিক্রান্তির রূপান্তর হ’ল উদ্গতি (সাবলাইমেশন)। সন্তানহীনা মায়ের অনাথ আশ্রম চালানাে বা নার্সের কাজ নেওয়া উদ্গতির বহিঃপ্রকাশ। ফ্রয়েড মনে করতেন, যে কোনপ্রকার সৃজনশীল শিল্প সাহিত্য সৃষ্টির, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সেবা এসবই মানুষের মধ্যে সৃষ্ট উদ্গতি বহিঃপ্রকাশ। মানব সভ্যতার অগ্রগতির স্মারক হয়ে থাকে সৃজনশীল শিল্প সাহিত্য বা বিজ্ঞান। এইসব সৃজনশীল কাজের পেছনে থাকে মানুষের বােধের জগতে আবির্ভূত হওয়া উদ্গতি। এই উদগতিরূপ মানসিক কৃৎকৌশলেই আদিম প্রবৃত্তিমূলক তাড়নাগুলি গঠনমূলক ও সৃজনশীল কাজে রূপান্তরিত হয়। সুতরাং ব্যক্তিজীবনে উদ্বেগ অনেকসময় দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঠিকই, কিন্তু উদ্বেগ প্রতিরােধে উদগতি বা সাবলাইমেশনের মত মানসিক কৃতকৌশল মানুষের মধ্যে থাকে বলেই মানবসভ্যতার বিকাশ ও সমৃদ্ধি সম্ভব হয়।

মনােজাগতিক অধিবিদ্যার অনুসন্ধানে ফ্রয়েডকে সবদিক থেকে সাহায্য করেছিল তার মনঃসমীক্ষণমূলক চিকিৎসা। বিভিন্ন মনঃসমীক্ষণের ফল থেকেই তিনি নৈতিকতা, ধর্ম, এমন কি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের উৎপত্তি ও ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর মতে ব্যক্তিমানুষের এই দিকগুলির ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক মূল রয়েছে তার শৈশবে বা বাল্যকালে। শৈশবে পিতার প্রতিবন্ধকতা এবং নিজের চাহিদা যখন শিশুর নিশ্চেতন মনে পুঞ্জীভূত হতে থাকে, তখন ধীরে ধীরে তার মানসিক জগতে জন্ম নেয় আরও একটি সত্তা --মনোজগতের কাঠামােয় যার নাম অধি-অহং (সুপারইগাে)। এই অধি অহং নৈতিক শাসক হ'য়ে শিশুকে তার কামনাবাসনা ত্যাগের পরামর্শ দেয়, ফলে এইসকল প্রবৃত্তি নিশ্চেতন মনেই অবদমিত হয়ে যায়। ফ্রয়েডের মতে এই অবদমন সমাজ রক্ষার জন্য অপরিহার্য। এইসকল প্রবৃত্তির উদ্গতি (সাবলাইমেশন) থেকেই মানব সভ্যতা পেয়েছে সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রশিল্প, ধর্মীয় চেতনা, এমনকি বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিও। কিন্তু মানুষের সমাজে এই সৃজনশীল শিল্প সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চা, ধর্মবােধ যতই বাড়তে থাকে, ততই ব্যক্তিমানুষের মধ্যে বাড়ে হতাশা, অশান্তি --বাড়তে থাকে স্নায়ু ঘটিত রোগ। ফ্রয়েড মনে করতেন, এইসকল হতাশা, উদ্বেগ ও স্নায়ুবিকার থেকে ব্যক্তিমানুষ মুক্তি পেতে পারে, যদি তার মধ্যে থাকা অবদমিত কামনাবাসনা বাস্তব জগতে পরিতৃপ্তির সুযােগ পায় । ব্যক্তিগত বাস্তবজগৎকে ভুলে সৃজনশীল শিল্পসাহিত্যকর্মে, বিজ্ঞানচর্চায়, দেশসেবায় ডুবে থাকার শক্তি অবদমন থেকে আসে ঠিকই, কিন্তু অবদমনজনিত হতাশা ও উদ্বেগ থেকে প্রেরিত যে কাজে মানুষ সৃজনশীল হয়, সেই কাজেও তার যাবতীয় অবদমিত কামনা বাসনার পরিতৃপ্তি হয় না, সেই কাজ থেকেও সে হতাশা ও উদ্বেগের শিকার হয়। এই হতাশা ও উদ্বেগ আবার অবদমিত হতে থাকে। তবে ফ্রয়েড বিশ্বাস করতেন, এইসব অবদমন --কামনাবাসনা, হতাশ-উদ্বেগের এইসব অবদমন একদিন ব্যক্তিমানুষের মনে পৃথিবীকে বদলানাের শক্তি দিতে পারে, মানুষের কামনা বাসনার ওপর সমাজপৃথিবীর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে আনতে পারে।

৮. ফ্রয়েড ও উত্তরকাল

ফ্রয়েডের মনােদর্শন তুলনাহীন ভাবে ব্যক্তি মনের অতল স্পর্শ করেছিল। অভাবনীয় বিকাশ ঘটিয়েছিল বৈজ্ঞানিক জড়বাদের। ব্যক্তিমন একটি অখণ্ড ও বিশুদ্ধ সত্তা --প্রচলিত এই ভাববাদী সিদ্ধান্তে আঘাত হেনেছিল। কোপার্নিকাসের মতবাদ প্রমাণ করেছিল, পৃথিবী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র নয়, ডারউইনের মতবাদ জানিয়েছিল এই জগতে মানুষই জীবজগতের প্রভু নয়, ফ্রয়েডের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করল যে সচেতন মন বা আত্মস্থ ব্যক্তিসত্তা --দেহমনের শাসক নয়।

দর্শনের ইতিহাসে ফ্রয়েড তত্ত্ব সমাদর পেয়েছে, অনাদরও পেয়েছে। প্রথমে অনাদরের কথা বলি। ভিয়েনার বিশিষ্ট বিজ্ঞানদর্শনবিদ কার্ল পপার ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বকে ছদ্মবিজ্ঞান বলেছেন। বলেছেন, মনঃসমীক্ষণমূলক চিকিৎসায় রোগীকে একান্তে গােপনে বসিয়ে চিকিৎসকের বিশ্বাসানুগত করে যে পদ্ধতি প্রয়ােগ করা হয়, তা অবৈজ্ঞানিক। বরং এই পদ্ধতির দ্বারা চিকিৎসাশাস্ত্রে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে সরিয়ে রাখারই ব্যবস্থা করা হয়। এর থেকে বৈজ্ঞানিকভাবে কোনও সত্যের প্রতিষ্ঠা হয় না। ফ্রয়েডতত্ত্বের মূল ভিত্তি যে নিশ্চেতন মন - তার স্বরূপ অস্তিত্ব বিষয়ে ফ্রয়েড এবং ফ্রয়েডপন্থীদের ব্যাখ্যাকেও পপার ও অন্য অনেক বিজ্ঞানদার্শনিক মেনে নিতে পারেননি। তাঁদের মতে নিশ্চেতন মন বিষয়ে ফ্রয়েডের যাবতীয় সিদ্ধান্তই নির্বিচারবাদী।

আদরও পেয়েছেন ফ্রয়েড। এখনও পাচ্ছেন। ভাষ্যবিদ্যার (হারমেনিউটিকস) প্রধান প্রবক্তা জর্মন দার্শনিক হানস-গেয়র্গ গ্যাদামার মনে করেন, ফ্রয়েডই দার্শনিকদের সুস্পষ্টভাবে এবং বস্তুবাদী দৃষ্টিতে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ভাষার উপরিস্তরের অন্তরালে থাকা অন্তর্জগতের অর্থসন্ধান শিখিয়েছেন। দেখিয়েছেন যে শব্দার্থ নিরূপণে ব্যক্তিকতা অতিক্রম করাই দর্শনের কাজ। গ্যাদামার, হ্যাবারমাস, রিকোর প্রমুখ সাম্প্রতিক কালের দার্শনিকগণ ফ্রয়েড ভাষাবিদ্যা বিকাশের প্রাণপুরুষ বলে মান্য করেছেন। সমাজতন্ত্রী জর্মন-আমেরিকান দার্শনিক হার্বাট মারকিউস দর্শনের ইতিহাসে ফ্রয়েডের বিশিষ্ট অবদান স্বীকার করেন। তিনি মনে করেন, অবদমন, নিশ্চেতন এই ধারণাগুলি ধনতান্ত্রিক আমলানির্ভর ব্যবস্থায় জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা ও বিচ্ছিন্নতাকেই চিত্রিত করে। অস্তিবাদী ফরাসী দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্র তাঁর প্রভাসতাত্ত্বিক অস্তিবাদকে অস্তিবাদসম্মত মনঃসমীক্ষণ বলতেন। সার্ত্রের মতে ফ্রয়েডের গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল এই যে, তিনি ব্যক্তিমন বা অহং বিষয়ে এমন এক চিন্তাসূত্র দিলেন, যে সূত্র ধরে একথা জোরের সঙ্গে বলা যায় যে, ব্যক্তিমানুষ ঐতিহাসিক ও সামাজিক সত্তা – ব্যক্তিমানুষ কোন পূর্বতসিদ্ধ সার ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়।

সাধারণভাবে নারীচেতনাবাদীগণ ফ্রয়েড-এর মত ভালাে চোখে গ্রহণ করেন না। কারণ ফ্রয়েড তাঁর  যৌন-এষণানির্ভর মনােদর্শনচিন্তায় নারীকে কেবল উপায় হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তবু কোনও কোনও নারীচেতনাবাদীর কাছেও ফ্রয়েড আদৃত হয়েছেন। তাঁদের মতে ফ্রয়েডই সর্বপ্রথম দার্শনিক ভাবনার জগতে লিঙ্গ-ঘটিত অবদমনের বিষয়টি উন্মোচিত করেছিলেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় স্ত্রীলিঙ্গকেও যুগ যুগ ধরে অবদমনের শিকার হয়ে আসতে হয়েছে। এই অবদমন থেকে মুক্তিলাভের জন্যই পৃথিবীতে নারী স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা প্রয়ােজন। ফ্রান্সের বিশিষ্ট উত্তর-আধুনিক দার্শনিক জ্যাক্যুয়ে লাকান এবং জ্যা কুয়ে দেরিদা ফ্রয়েড মনােদর্শনকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। এঁদের মনে হয়েছে এরকম যে, নিশ্চেতন মনকে যথার্থ গুরুত্ব দিয়ে ফ্রয়েড যে কেবল সচেতন মন বা অহং-এর আত্মপ্রতারণার মুখােশ খুলে দিয়েছেন তা নয়, তথাকথিত বিশুদ্ধ যুক্তি বা সত্তার বা ধী-কেন্দ্রিক দর্শনের যে আত্মপ্রতারণা, তার আবরণও উন্মোচন করেছেন। যদিও একসময় লাকান আন্তর্জাতিক মনঃসমীক্ষণ সমিতি পরিত্যাগ করেছিলেন, তবু বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে তিনিই ছিলেন ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণতত্ত্বের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা। লাকান খুব জোরের সঙ্গে মানব সভ্যতায় ব্যক্তিমানুষের নিশ্চেতন মনের ভূমিকা স্বীকার করতেন। তিনি মনে করতেন ভাষার মতই নিশ্চেতনও ব্যক্তিমনের অতলে নিঃশব্দে গড়ে ওঠে। দেরিদা তাঁর বিনির্মাণ তত্ত্ব প্রচলিত ভাষাকাঠামাে ভেঙে 
অন্তর্লীন (ট্রেস/আর্কে রাইটিং) সন্ধান করতে চেয়েছেন, তা ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণতত্ত্বের আশ্রিত অবদমিত কামনা বাসনা চিহ্নেরই অনুরূপ। তা দেরিদাকে আমরা পেয়ে যাই একজন একনিষ্ঠ ফ্রয়েড-অনুরাগী হিশেবে, ফ্রয়েডতত্ত্বের ওপর তিনি লিখেছিলেন বেশ বড় একটি প্রবন্ধ 'ফ্রয়েড অ্যাণ্ড দ্য সিন অফ রাইটিং'-- তাঁর 'রাইটিং অ্যাণ্ড ডিফারেন্স’ গ্রন্থে (১৯৮৪) তা সংকলিত হয়ে আছে।
-------------------------------------------------
মতামত জানাতে পারেন।  
jaladarchi@yahoo.in  

Post a Comment

0 Comments