জ্বলদর্চি

বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক -১৩/ অসীম ভুঁইয়া

Bengali grammar and debate
বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক
পর্ব ১৩

অসীম ভুঁইয়া

উপসর্গের স্বর্গবাস

আজকের আলোচনার বিষয় উপসর্গ।
কয়েকটি শব্দ নেওয়া যাক। প্রখ্যাত, প্রবাস, প্রবেশ, বিহার, প্রহার, পরিহার, কুকাজ, কুনজর, কুকথা, বিগত, প্রকৰ্ষ, অনুচর।
 
  আগে প্রথম তিনটি শব্দ বিশ্লেষণ করছি। 

প্রখ্যাত - প্র - প্ + র্ + অ( বর্ণগুচ্ছ) + খ্যা( ধাতু) + ক্ত ( প্রত্যয়)। একইভাবে প্রবাস ও প্রবেশ শব্দ দুটি বিশ্লেষণ করা যায়।      
 
   তিনটি ক্ষেত্রেই "প্ৰ" বর্ণগুছটি ধাতুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন অর্থবিশিষ্ট ভিন্ন ভিন্ন শব্দ তৈরি করেছে। এই  "প্র" বর্ণগুচ্ছটিই উপসর্গ।উপসর্গ সবসময়ই ধাতুর আগে বসে।
  
  এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় দেখে নিতে হবে, একটি বর্ণগুচ্ছ তিনটি ভিন্ন ধাতুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন শব্দ তৈরি করেছে, যাদের অর্থও আলাদা।  এখানে "প্র" এর  নিজস্ব অর্থ গুরুত্বপূর্ণ নয়, আর নিজস্ব অর্থ থাকলেও প্রতিটি শব্দে তা পরিবর্তিত হয়েছে।
 
   পরের তিনটি শব্দ বিহার, প্রহার, পরিহার। 
এই তিনটি শব্দে একটি ধাতু( হৃ) রয়েছে, কিন্তু বর্ণগুচ্ছ বা উপসর্গ আলাদা। এবং তিনটি শব্দ ভিন্ন অর্থবিশিষ্ট। অর্থাৎ একই ধাতু  ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গের সঙ্গে যুক্ত হলে ভিন্ন অর্থের ভিন্ন শব্দ তৈরি করতে পারে।
   আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়,  "হৃ" ধাতুর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হরণ করা। কিন্তু এখানে কোনো শব্দই সে অর্থ বয়ে বেড়াচ্ছে না। বিহার- ভ্রমণ করা। প্রহার - মারামারি করা, পরিহার- ত্যাগ করা।
 
   পরের তিনটি শব্দ:
 কুকাজ, কুনজর, কুকথা।
এই তিনটি শব্দে "কু" বর্ণগুচ্ছটি ধাতু নয়। শব্দের   সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, অর্থাৎ উপসর্গ ধাতু ও শব্দ উভয়ের সঙ্গেই যুক্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়, কু এর অর্থ মন্দ বা খারাপ। এই "কু" সহযোগে যে শব্দগুলি তৈরি হয়েছে তাদের প্রতিটিতেই কু এর অর্থ পরিষ্কার। অর্থাৎ এখানে উপসর্গটি নিজস্ব অর্থেই বিরাজমান। শব্দ পরিবর্তনে "কু", নিজস্ব অর্থ পরিবর্তন করেনি। 

    বাকি তিনটি শব্দ: বিগত, প্ৰকর্ষ, অনুচর। এই তিনটি শব্দের ক্ষেত্রে বি, প্র, অনু, এই  বর্ণগুচ্ছগুলি ধাতুজাত শব্দের অর্থ পুরোপুরি পরিবর্তন না করে বরং মাত্রাগত পরিবর্তন করেছে। যেমন বি: বিশেষ। গত: অতীত। বিগত: বিশেষভাবে অতীত। প্র: প্রকৃষ্ট, কর্ষ: আকর্ষণ, পুরো অর্থ: প্রকৃষ্ট রূপে আকর্ষণ। অনু- পরে/ অনুসরণকারী। চর - খবর সংগ্রাহক। অনুচর - খবর সংগ্রাহকের অনুসরণকারী। অর্থাৎ এখানে পুরো অর্থ পরিবর্তিত না হয়ে অর্থের মাত্রাগত গভীরতা বা উৎকর্ষতা প্রকাশ পেয়েছে। 
    
   আমরা চার ধরনের বর্ণগুচ্ছের সঙ্গে পরিচিত হলাম। যারা কোনো শব্দ বা ধাতুর আগে বসে শব্দের অর্থ পরিবর্তন করে, নতুন শব্দ তৈরি করে বা শব্দের মাত্রাগত হেরফের করে। এই বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছকেই উপসর্গ বলে। 
   
   অর্থাৎ যে বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছ শব্দের আগে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ তৈরি করে বা শব্দের মাত্রাগত অর্থের হেরফের করে তাকেই উপসর্গ বলে।  

   উপসর্গের বৈশিষ্ট্য:
 ১, উপসর্গ ধাতু বা শব্দের আগে যুক্ত হয়। 
২, শব্দের অর্থ পরিবর্তন 
করে বা নতুন শব্দ তৈরি করে। কখনো শব্দের অর্থের মাত্রাগত পরিবর্তন করে। 
৩, উপসর্গের নিজস্ব অর্থ থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। তবে অর্থের সম্ভাবনা  থাকেই।
৪,  উপসর্গযোগে ধাতুর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে।
 ৫, একই উপসর্গ ভিন্ন ভিন্ন ধাতু বা শব্দের আগে যুক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন শব্দ গঠন করে। 
৬, নিজস্ব অর্থবিশিষ্ট উপসর্গগুলি ভিন্ন ভিন্ন শব্দে যুক্ত হয়েও নিজস্ব অর্থ  পুরোপুরি বজায় রাখতে পারে।
৭, একই ধাতু বা শব্দের আগে ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গ যুক্ত হয়ে নতুন অর্থবিশিষ্ট শব্দ তৈরি হয়।

 উপসর্গের শ্রেণিবিভাগ:
   বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত উপসর্গগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। 
সংস্কৃত উপসর্গ, 
বাংলা উপসর্গ ও 
বিদেশি উপসর্গ।

   সংস্কৃত উপসর্গ:
 সংস্কৃত উপসর্গ বলতে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত সংস্কৃত উপসর্গের কথাই বলা হচ্ছে।
 অবশ্য সমস্ত সংস্কৃত উপসর্গই বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়। এদের সংখ্যা ২০ টি।
প্র পরা অপ্ সম্ নি অব্ অনু নির্ দুর্ বি অধি সু উদ্ পরি প্রতি অভি অতি অপি উপ আ।  

    যে সমস্ত উপসর্গ সংস্কৃত থেকে জাত, তাকে সংস্কৃত উপসর্গ বলে।
সংস্কৃত উপসর্গের  প্রচলিত প্রয়োগ দেখানোর আগে দেখে নেওয়া যাক, কীভাবে একটি নয়, একাধিক উপসর্গ একটি ধাতু বা শব্দের আগে বসে নতুন শব্দ তৈরি করে। 
যেমন-  উপসর্গ - বি, অব। ধাতু- হৃ,  প্রত্যয়- অ। নতুন শব্দ- ব্যবহার।
  
   সংস্কৃত উপসর্গের কিছু প্রচলিত প্রয়োগ:
 প্র -  প্রগতি প্রকৃত প্রকাশ প্রচুর প্রতিভা প্রতিভা প্রস্থান  প্রকল্প প্রকার প্রতারণা প্রজন্ম প্রজাপতি প্রভৃতি।
পরা - পরায়ন পরাজয় পরান্ন পরাধীন পরাভব।
অপ্ - অপকর্ষ অপকার অপদেবতা অপমান 
সম্ - সংকীর্ণ সংকুচিত সংকোচন সংকলন  সমৃদ্ধি সংকেত সংবাদ সংবিধান সম্পর্ক সম্মান।
নি - নিমজ্জিত নিভৃত নির্জন অব্ - অবক্ষয় অবগত অবগত অবগতি অবগুণ্ঠন অবান্তর
 অনু - অনুকরণ অনুকরণ অনুসন্ধান অনুকম্পা 
নির্- নিরীক্ষণ নিরন্ন নিরপরাধ নিরুৎসাহ নিরুত্তর নিরঞ্জন নিরন্তর নিরূপণ নির্ঝর নির্ণয় নির্যাতন নির্যাস।
দুর্ - দুর্ভাগ্য দুর্বল দুরবস্থা।
বি-  বিচ্ছিন্ন বিচিত্র বিচিন্তা। অধি- অধিকর্তা অধিকৃত অধিগ্রহণ।
সু -সুস্পষ্ট সুজন সুজলা সুদর্শন সুসজ্জিত সুদীর্ঘ।
উদ্ - উল্লাস উদগ্রীব উদ্বিগ্ন উদ্ভিদ উৎপাদন। 
পরি - পরিচর্যা পরিচারক পরিবেদন পরিতৃপ্তি পরিনাম পরিত্যাগ পরিভাষা।
 প্রতি -প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া প্রতিফল প্রতিরোধ  প্রতিশ্রুতি প্রতিদিন। 
অভি - অভিপ্রায় অভিমত অভ্যুত্থান অভিযাত্রী অভিষেক অভিনয়।

অতি- অতিকথন অতিকায়   অতিক্রান্ত অতিবাহিত অতিভুজ।  
অপি- অপিনিহিতি। আধুনিক বাংলা ভাষায় এর আর প্রয়োগ নেই। 
উপ- উপকণ্ঠ উপকূল উপনীত উপস্থিত উপকথা উপগ্রহ উপবন। 
আ -আগামী আমরণ আসমুদ্র আকণ্ঠ আকৈশোর আজন্ম। 

   সংস্কৃত উপসর্গের মধ্যে অতি ও প্রতি: এ দুটিরই শুধু স্বাধীন প্রয়োগ আছে।
প্রথাগত ব্যাকরণে উপসর্গ-স্থানীয় অব্যয় নামে এক ধরনের শব্দকে উপসর্গের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। শব্দগুলি যেহেতু ধাতু বা শব্দের আগে বসে উপসর্গের মতো আচরণ করে, তাই এদের  উপসর্গের সঙ্গেই আলোচনা করা হয়। তবে অব্যয়ের ধারণা যেহেতু বিগত  তাই আমরা এদের অব্যয় তো বলবই না, উপসর্গও বলব কিনা সন্দেহ ! কারণ এরা মূলত সন্ধিবদ্ধ শব্দের অংশ হিসেবেই নতুন সন্ধিবদ্ধ শব্দ তৈরি করে। তবুও দেখে নেওয়া যাক এই শব্দগুলি: 
অন্তঃ -  অন্তর্গত অন্তঃপুর অন্তর্বর্তী।
আবিঃ -আবির্ভাব আবিষ্কার আবিষ্কৃত। 
এভাবে, প্রাদু্ঃ বহিঃ পুরঃ তিরঃ অলমঃ সাক্ষাৎ পূর্ব পশ্চাৎ সহ।

 বাংলা উপসর্গ:

   খাঁটি বাংলা ভাষা থেকে গৃহীত যে উপসর্গগুলি শব্দের আগে যুক্ত হয়, তাকে বাংলা উপসর্গ বলে।

   উল্লেখ্য, সংস্কৃত উপসর্গগুলি ধাতু ও শব্দ উভয়েরই আগে বসে। 
কিন্তু খাঁটি বাংলা উপসর্গগুলি শুধু শব্দেরই আগে বসে।
 
   বাংলা উপসর্গের তালিকা: 
অ: অজানা অচেনা অগুনতি।
অঘা: ওঘামারা অঘারাম।
 আধুনিক বাংলায় স্বল্প প্রয়োগ। 
অজ: অজপাড়াগাঁ।
 বাংলায় এই একটি প্রয়োগই এখনও দেখা যায় ।
অনা:  অনাসৃষ্টি। 
আ: আলুনি আচালা আগাছা।
আড় : আড়নয়ন আড়পাগলা
 আড়ক্ষ্যাপা 
আন : আনকোরা আনচান।
ঊন: ঊনপাঁজুরে। 
কু: কুনজর কুকথা কুকাজ।
নি' নিখোঁজ নিখুঁত।
না: নাখোশ নাছোড় নাবালক নারাজ।
 পাতি: পাতিলেবু পাতিহাঁস।  বি: বিজোড় বিদেশ বিকেল
 বিকল্প।
বে: বেজন্মা বেজাত বেহায়া। ভর: ভরদুপুর ভরপেট।
ভরা: ভরাডুবি ভরানৌকা।
এছাড়াও রাম, স, সা, শা, সু, হা প্রভৃতি।

   এই উপসর্গগুলির কয়েকটি  হয়তো আদ্যপ্রত্যয়।
পাতি, ভর প্রভৃতিকে অনেকেই উপসর্গ না বলে আদ্য প্রত্যয়ই  বলতে চেয়েছেন। "ভর" তো আবার শব্দের আগে ও পরে দু'জায়গাতেই বসতে পারে। যেমন: ভরসন্ধ্যা, জীবনভর। যা উপসর্গের নিয়মবিরুদ্ধ।
বিদেশি উপসর্গ:
যে সমস্ত উপসর্গ সাধারণত ইংরেজি ও ফারসি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে, তাদের‌ই‌‌ বিদেশি উপসর্গ বলে। এগুলো সাধারণত ধাতুর  আগে নয়, শব্দের‌ই আগে বসে।

   ফারসি উপসর্গ আম -  আমদরবার আমপারা।
 কার- কারখানা কারসাজি। 
 আম ও কার উপসর্গ সম্পর্কে পবিত্র সরকারের বিশ্লেষণ:
"এ শব্দগুলি মূলেই ফারসি, কাজেই বাংলায় কার উপসর্গ দিয়ে কোনো নতুন শব্দ হয়েছে কিনা সন্দেহ!" 
খাস- খাসজমি।
গর্- গরমিল গররাজি।
দর্- দরদালান দরকাঁচা
না- নাখোশ নাপছন্দ
নিম- নিমরাজি নিমখুন
ফি- ফিবছর ফিসন
ব- বনাম বকলম 
বর্- বরবাদ বরদাস্ত।
বদ্- বদরক্ত বদলোক।
বে- বেআইনি বেগতিক।
হর্- হরদম হররোজ।
খোশ্ - খোশখবর  খোশমেজাজ। 

  ইংরেজি উপসর্গ: 
ফুল-  ফুলহাতা ফুলবাবু।

হাফ- হাফপ্যান্ট হাফহাতা। 
হেড-  হেডঅফিস হেডপন্ডিত।
 সাব- সাবডিভিশন সাবএডিটর।

  মিনি- মিনিট্রাক মিনিবাস মিনিহোটেল মিনিস্কার্ট।

    ইংরেজি উপসর্গের বেশিরভাগই স্বতন্ত্র শব্দ, তাই এই উপসর্গযোগে তৈরি শব্দগুলি "সমাস না  উপসর্গযোগে তৈরি শব্দ এ প্রশ্ন থেকেই যায়।" সূত্র -  পবিত্র সরকার। 

   উল্লেখ্য, সংস্কৃত উপসর্গগুলির মধ্যে শুধু "প্রতি" " অতি" র‌ই স্বাধীন প্রয়োগ রয়েছে। 
যেমন- তোমার প্রতি আমার ধারণা খুব ভালো।
 অতি সাবধানে যেও। 

   উপসর্গ কখনো সন্ধিবদ্ধপদ হিসেবেও নতুন শব্দ গঠন করে। যেমন:  
দুর্গম = দুঃ + গম।
 দুরবস্থা =  দুঃ + অবস্থা।

   সংস্কৃত উপসর্গ ধাতু ও শব্দ উভয়ের আগেই বসতে পারে।
 কিন্তু বাংলা ও বিদেশি উপসর্গ সম্ভবত শুধু শব্দের আগেই বসে। উপসর্গের নিজস্ব অর্থ যাই থাকুক, শব্দ বা ধাতুর আগে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করলে বেশিরভাগ সময়ই অর্থ পরিবর্তিত হয়ে যায়।

   খুব সংক্ষেপেই আলোচনাটা সারলাম। হস্ চিহ্ন যুক্ত কিছু সমস্যা থেকেই গেল। আর উদাহরণের কিছু বৈচিত্র্যেও রাশ টানতে হল।

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments