জ্বলদর্চি

ব্রিটিশ লেখক ভার্জিনিয়া উলফের গল্প: হানাবাড়ি/শ্যামাশ্রী চৌধুরী মজুমদার

ব্রিটিশ লেখক ভার্জিনিয়া উলফের গল্প: হানাবাড়ি
ভাষান্তর: শ্যামাশ্রী চৌধুরী মজুমদার
অলংকরণ: সুমন মজুমদার

দিনের যেকোনো সময় ঘুম ভাঙলেই শোনা যায় দরজা বন্ধ করার আওয়াজ। হাত ধরাধরি করে তারা এঘরে ওঘরে ঘুরে বেড়ায়। জিনিসপত্র এদিক ওদিক সরিয়ে, কখনও আবার খুলে দেখে নিশ্চিত হয় সেই যুগলেরা...যারা কেবল ছায়া।
-"এটা এখানেই রেখেছিলাম, " স্ত্রীলোকটি বলে।
-"কিন্তু এখানেও!" পুরুষটি যোগ দেয়।
-"এটা দোতলায়" স্ত্রীলোকটির মৃদু স্বর।
-"আর বাগানেও" সঙ্গীটি ফিসফিসিয়ে বলে।
-"খুব আস্তে", তারা বলে, " নয়ত ওরা জেগে উঠবে।"
তবে তোমরা আমাদের ঘুম ভাঙাও না। নাহ্ আবারও
-" ওরা কিছু খুঁজে বেড়ায়;  তারা পর্দা সরাচ্ছে", দু'এক পাতা পড়তে পড়তেই কেউ বলতে পারে।
-"এবার তারা এটা খুঁজে পেয়েছে," কেউ নিশ্চিত হয়ে বইয়ের মাঝে পেন্সিল রেখে দেয়। তারপর পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে উঠে খুঁজতে যায়। দেখে কেউ কোথাও নেই। গোটা বাড়িটায় ছড়িয়ে আছে ধু ধু শূন্যতা। দরজাগুলো দাঁড়িয়ে আছে হাঁ করে। কেবল ঘুঘুর গভীর প্রশান্তির বুকবুক ডাক আর খামার থেকে ভেসে আসা গম আছড়ানোর কলের মৃদু গুঞ্জন ছাড়া  কিছুই শোনা যায় না।

  -"আমি কেন এখানে এসেছিলাম?"
-"আমি কী খুঁজতে চাই?" আমার দু'হাত ফাঁকা।
-" তবে কি সম্ভবত এটা ওপরে?"
আপেল গুলো লফ্টেই পড়ে রইল। আবারও নীচে নেমে আসতে হল, বাগানটা ঠিক আগের মতোই আছে শুধু বইটাই হাত ফসকে পড়ে গেছে ঘাসের ভেতরে।
কিন্তু তারা এটাকে ড্রয়িংরুমে খুঁজে পেয়েছিল। কেউ কোনোদিন তাদের দেখতে পায়না। জানলার শার্সিতে ধরা পড়ে আপেল আর গোলাপের ছবি। সব সবুজ পাতারা মুখ দেখে জানলার কাচে। যদি তারা ড্রয়িংরুমের মধ্যে দিয়ে যায় অমনি আপেলটা ঘুরে যায় হলদে পিঠের দিকে। তবুও পরমুহূর্তেই যদি দরজা খুলে যায়, মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে, উদাসীন হয়ে থাকে দেওয়াল জুড়ে, সিলিংএর কড়িকাঠ বেয়ে নামে... কি? আমার দুই হাতই শূন্য। থ্রাশ পাখির ছায়া কার্পেট পার হল। অতলান্তিক নৈঃশব্দ্যের রাজ্যে তরঙ্গ উঠল ঘুঘুর বুকবুক ধ্বনির। 

  -"নিরাপদ, নির্ভয়, নিশ্চিন্ত" গৃহ তন্ত্রীতে মৃদু ঝঙ্কার।
-"ঘরের মধ্যেই রয়েছে লুকোনো সম্পদ..." দ্রুত থেমে গেল স্পন্দন।

  তবে ওটাই কি সেই গুপ্তধন? মুহূর্তের মধ্যেই আলো কমে আসে। তাহলে বাইরের বাগানে কি হবে? কিন্তু সূর্যের একফালি আনমনা আলোয় তরুরাজির আঁধার কেটেছে। এমন শীতল স্নিগ্ধতা আলোয় ঢেকে থাকলে কাচের আড়ালে যেন পুড়ে যাই আমি। মৃত্যুই সেই কাচের দেওয়াল; আমাদের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছিল।
প্রথমে সে ছুঁয়েছিল নারীটিকে। সে প্রায় কয়েকশ বছর আগের কথা।এই বাড়িটা একলা পড়ে ছিল। জানালাগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল চিরকালের মতো; ঘরগুলোতে নেমেছিল নিশ্ছিদ্র আঁধার। পুরুষটি তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল উত্তরে, তারপর পূর্বে। দেখেছিল দক্ষিণ আকাশের ঢালে গড়িয়ে যাওয়া নক্ষত্রদের। একসময় মনে পড়েছিল বাড়ির কথা তারপর উন্মুক্ত বিস্তৃত প্রান্তরে পেয়েছিল সন্ধান।

  "নিরাপদ নির্ভয় নিশ্চিন্ত", বাড়িটির প্রাণ আজ আনন্দে স্পন্দিত।
"সব সম্পদ তোমাদের।"
অলিগলিতে গর্জে ওঠে বাতাস। গাছেরা এদিকে ওদিকে হেলে যায়, নুয়ে আসে। বৃষ্টি মাথায় করে ঝরে চাঁদের আলো প্রবল প্রতাপে। জানলা থেকে ল্যাম্পের আলো সোজাসুজি এসে পড়ে পথে। স্থির মোমবাতি হঠাৎই তীব্রতর হয়ে ওঠে। বাড়ির মধ্যে যত্রতত্র ঘোরাঘুরি করে, হুটহাট জানলা খুলে, পাছে আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত হয় তাই ফিসফিস করে কথা বলে অশরীরী দম্পতিরা আনন্দ পায়।
  -"এখানে আমরা ঘুমোতাম", নারীকন্ঠ বলে ওঠে,
-"আমাদের অজস্র আদর ছড়ানো।",পুরুষটিও যোগ দিল তাতে।
-"ঘুম ভাঙা সকাল..." " গাছের ফাঁকের রূপোলি রেখা..." " দোতলায়..." " বাগানে..." " যখন গরম পড়ত..." " শীতের তুষারপাতের সময়..." 
দূরে শোনা যায় দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ। ক্রমশ তা হৃৎস্পন্দনের মতো মৃদু তরঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। দরজার কাছে এসে তারা দাঁড়িয়ে যায়। বাতাস থমকে গেছে। বৃষ্টি কাচের গা বেয়ে রূপোলি রেখায় নামে। আমাদের চোখে আঁধার ঘনিয়ে আসে। আশেপাশের কোনো পায়ের আওয়াজ পাইনা আর। কোনো মহিলার ছায়াছায়া গাউন চোখে পড়ে না। পুরুষালি হাত আড়াল করে আলো।
  -" দেখো, " পুরুষটির শ্বাস পড়ে "গভীর ঘুমে মগ্ন এখন। ঠোঁটে মিশেছে ভালোবাসা।" 
একটু ঝুঁকে তাদের রূপোরঙা আলো ফেলে আমাদের ওপরে। দীর্ঘ সময় নিয়ে দেখে। গভীর দৃষ্টি নিমগ্ন আমাদেরই মুখে। সময় স্তব্ধ হয়ে আছে। বাতাস ঋজুবেগে প্রবহমান। শিখাটি ঈষৎ নুয়ে আসে। বনজ্যোৎস্না মেঝে আর দেওয়াল পার করে মিশে যায় ঝুঁকে পড়া মুখদুটিতে। সেখানে গভীর ভাবনার আনাগোনা। তারা যে সুসুপ্তির অন্তরালে থাকা নর-নারীর মনের হদিশ জানতে চায়। খোঁজে তাদের গোপন আনন্দ। 
  "নিরাপদ নির্ভয় নিশ্চিন্ত," গৃহের হৃদয়ের গর্বিত অনুরণন।
"সুদীর্ঘ সময়..." পুরুষটির শ্বাস দীর্ঘতর হয়।
"আবারও তুমি আমাকে খুঁজে পেলে।"
"এখানে," নারীটি গুনগুনিয়ে ওঠে, " ঘুমোনো, বাগানে বই পড়া, হাসি, চিলেকোঠায় গড়িয়ে দেওয়া আপেল। এখানেই আমরা ফেলে গিয়েছি আমাদের সর্বস্ব...সেরা সম্পদ।"
  তারা ঝুঁকে পড়েছে, তাদের আলোর পর্দা সরিয়ে দিল আমার চোখের পাতায় এসে। 
"নিরাপদ! নির্ভয়! নিশ্চিন্ত!" বাড়ির স্পন্দন প্রবলভাবে জানান দিল।

  জেগে উঠে আমি চিৎকার করে বললাম, " ওহ্ এই কি তোমাদের গোপন ঐশ্বর্য? প্রাণের আলো।"

লেখক পরিচিতি : ভার্জিনিয়া উলফ: দশ বছরের জন্মদিনে কালির দোয়াত, কলমের স্ট্যান্ড ও লেখালেখির সামগ্রী উপহার পাওয়া মেয়েটি যে কালে কালে হয়ে উঠবেন বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম তা হয়ত নির্ধারিত হয়েছিল ১৮৮২ সালের ২৫ শে জানুয়ারি লন্ডনের দক্ষিণ কেনসিংটনে তাঁর জন্মলগ্নেই। পুরো নাম এ্যাডেলাইন ভার্জিনিয়া স্টিফেন। বিয়ের পর উলফ পদবীটি গ্রহণ করেন। সাহিত্যনুরাগী লিওনার্ড উলফের সঙ্গে ভার্জিনিয়ার বিবাহ হয় ১৯১২ সালে। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'দ্য ভয়েজ আউট'( ১৯১৫ )। ১৯২০ সালে তিনি যোগ দেন লেখকদের সংগঠন ব্লুমসবারি গ্রুপে। 
  তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাস হল 'মিসেস ডালাওয়ে'(১৯২৫), 'টু দ্য লাইটহাউস' (১৯২৭), 'ওরল্যান্ডো, আ বায়োগ্রাফি (১৯২৮)', 'দ্য ওয়েভস' (১৯৩১), 'দ্য ইয়ার্স (১৯৩৭), 'বিটুইন দ্য অ্যাক্টস (১৯৪১)। ছোটগল্পেও অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। কয়েকটি ছোট গল্পের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে যেমন 'মার্ক অন দ্য ওয়াল', 'কিউ গার্ডেন', 'অ্যান আনরিটেন নভেল', 'আ হন্টেড হাউস'। শেষোক্ত গল্পটির অনুবাদ এখানে রয়েছে। গল্পটি ১৯২১ সালে তাঁর ছোটগল্প সংকলন 'মনডে অর টিউইস ডে'তে প্রকাশিত হয়। 
  চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তাঁর লেখার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। 'স্ট্রিম অব কনশাসনেস'  বা চেতনাপ্রবাহকে একটা বর্ণনামূলক কৌশলে পরিণত করার অগ্রদূত ছিলেন তিনি। অথচ এক গভীর অবসাদ কেড়ে নিয়েছিল তাঁর জীবন তৃষ্ণা। ১৯৪১ এর ২৮ শে মার্চ ওভার কোটের পকেটে নুড়ি পাথর ভরে মাত্র ৫৯ বছর বয়সে ডুব দেন ওউজ নদীতে। তবে সময় নদীর বিস্মরণের স্রোত ছুঁতে পারেনি তাঁকে। বরং মগ্ন পাঠকের গভীর মনোযোগের সম্পদ হয়েই আছে তাঁর সৃষ্টিরাজি। ঠিক তাঁর গল্পের শেষটুকুর মতোই 'মননের আলো' হয়ে।

পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments