জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-১৩/শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-১৩

শুভদীপ বসু

বিষয় - অলংকার (তৃতীয় অধ্যায়)

৭)অপহ্নুতি অলংকার-উপমেয় কে অস্বীকার করে যদি উপমান কে প্রতিষ্ঠা করা হয় তাহলে অপহ্নতি অলংকার হয়।
এই অলংকারে উপমেয় কে নিষেধ বা অস্বীকার করা হয় দুইভাবে-১)না,নহে,নয় ইত্যাদি অব্যয় প্রয়োগে২) ছল,ছদ্ম,ছলনা ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগে।
'ওনহে গগন, সুনীল সিন্ধু;
 তারার পুঞ্জ নহে ও,ফেনাররাশি।'
-উপমেয় গগন,তারার পুঞ্জ কে নিষেধ করে উপমান সিন্ধু ফেনারাশি কে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
'এ তো মেয়ে মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয়'-এখানে উপমেয়-মেয়ে উপমান-দেবতা,অস্বীকার সূচক শব্দ-নয়।উপমেয় কে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে,এখানে উপমান কে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং নয় শব্দের দ্বারা অস্বীকার কে বোঝানো হয়েছে অর্থাৎ এখানে মেয়েকে অস্বীকার করে দেবতাকে স্বীকার করা হয়েছে ও না শব্দের দ্বারা সে অস্বীকার কে বুঝিয়েছে। তাই এটি অপহ্নতি অলংকার।

৮)নিশ্চয়ই অলংকার-যে অলংকার উপমানকে অস্বীকার করে উপমেয় কে প্রতিষ্ঠা করে তাই নিশ্চয়ই অলংকার। এটি অপহ্নতি অলংকার এর বিপরীত অলংকার।
'এ নহে কুঞ্জ কুন্দ কুসুম রঞ্জিত 
ফেনো হিল্লোল কলকল্লোল দুলিছে'-এখানে উপমেয়-ফেনো হিল্লোল ও উপমান-কুঞ্জ।
এখানে দেখা যাচ্ছে উপমান-কুঞ্জ কে অস্বীকার করে,উপমেয়-ফেন হিল্লোলকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
৯) ব্যতিরেক অলংকার-একে দুই ভাগে ভাগ করা যায় যথা-উৎকর্ষাত্মক ব্যতিরেক ও অপকর্ষাত্মক ব্যতিরেক।
ক)উৎকর্ষাত্মক ব্যতিরেক-যেখানে উপমেয় কে উপমানের থেকে উৎকৃষ্ট রূপে দেখানো হয় সেখানে হয় উৎকর্ষাত্মক ব্যতিরেক অলংকার।
'সপ্ত পুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া'
এখানে উপমেয়-মাটি,উপমান সোনা।উপমান সোনার থেকে উপমেয় মাটিকে বড় করে দেখানো হয়েছে তাই এটি উৎকর্ষত্মক ব্যতিরেক অলংকার।

খ)অপকর্ষাত্মক ব্যতিরেক-যে অলংকারে উপমানের থেকে উপমেয় কে নিকৃষ্ট করে দেখানো হয় তাকে অপকর্ষাত্মব্যতিরেক অলংকার বলে।
'পাপীকে ও তুমি মানিয়েছ হার'-এখানে উপমেয় তুমি,উপমান পাপী অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে উপমান পাপীর থেকে উপমেয় তুমি কে নিকৃষ্ট করে দেখানো হয়েছে তাই এটি অপকর্ষাত্মক ব্যতিরেক অলংকা।
১০)সমাসোক্তি অলংকার-যে অলংকারে উপমেয়ের ওপর উমানের ব্যবহার আরোপিত হয় তাকে সমাসোক্তি অলংকার বলে।
'আসন্ন শীতের বেলা হামাগুড়ি দিয়ে চলে আসে।'-এখানে উপমেয়- শীতের বেলা,উপমান-একজন বৃদ্ধা বা শিশু।কবিতাটি পড়লেই বোঝা যাচ্ছে একজন বৃদ্ধা বা শিশুর মতো শীতের বেলা যেনো হামাগুড়ি দিয়ে আসছে অর্থাৎ বোঝা যায় উপমেয় শীতের বেলার ওপর উপমান-মানুষের ধর্ম আরোপিত হয়েছে বা জড়ের ওপর জীবের ধর্ম আরোপিত হয়েছে।তাই এটি সমাসোক্তি অলংকার।
১১)অতিশয়োক্তিঅলংকার-
অভেদ বোঝাবার জন্য উপমেয়ের উল্লেখ না করে যদি শুধু উপমানের উল্লেখ থাকে অর্থাৎ উপমেয়কে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে যদি উপমান উপমেয়ের স্থান অধিকার করে তখন তাকে অতিশয়োক্তি অলংকার বলে।
   'বৈশাখী দুপুরে দূরে বালুচরে কাঁপিছে ঝিঝির পাখা'
এখানে উপমেয়-ঝিঁঝিঁর পাখা উপমান-রৌদ্র(যার উল্লেখ নেই) অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে উপমেয় রৌদ্র উপমান ঝিঁঝিঁর পাখার দ্বারা সম্পূর্ণরূপে গ্রস্ত উপমেয়ের উল্লেখ এখানে নেই।
১২) বিরোধমূলক অলংকার-বিরোধ মানে ঝগড়া নয় এখানে বিরোধ হলো কবি কল্পনায় চমৎকারিত্ব। যেখানে আপাত বিরোধের আড়ালে একটা গভীর ঐক্য ও সৌন্দর্যের সন্ধান থাকে।বিরোধমূলক অলংকার বলতে বোঝায় দুটি বস্তুর মধ্যে আপাত বিরোধ।
'বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে'
এটি পড়লে বোঝা যায় বড় হতে গেলে আগে ছোট হতে হবে।কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ হলো তুমি বিনম্র ও ভদ্র হবে।সবাইকে শ্রদ্ধা করো।অংশটি পড়লে আপাতদৃষ্টিতে বিরোধ আছে বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে বিরোধ থাকছে না যে কাব্যটি হয়েছে তার মধ্যে চমৎকারিত্বের সৃষ্টি হয়েছে।এই বিরোধমূলক অলংকার কে পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়- ক)বিরোধাভাসখ)বিভাবনা গ)বিশেষক্তি ঘ)অসঙ্গতিঙ)বিষম।
১৩) ব্যাজস্তুতি-যে অলংকারে কোন উক্তি তারা নিন্দার ছলে প্রশংসা বা প্রশংসার ছলে নিন্দা প্রকাশিত হয় সেই অলংকারকে ব্যাজস্তুতি অলংকার বলে।
'অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ, কোন গুন নাই তার কপালে আগুন'
   -এখানে ঈশ্বরি পাটনির সঙ্গে মহামায়ার পরিচয়ে মহামায়া পাটনী কে এই কথা বলেছে।দেবী স্বামীর পরিচয় যা বলেছে তাতে মনে হবে তার স্বামী বৃদ্ধ,নেশা করে,কোন গুনই নেই।তাই তার কপাল পুড়েছে অর্থাৎ সে তার স্বামীর নিন্দা করেছে।কিন্তু এই কথাগুলোর মধ্যে দিয়ে প্রশংসা বর্ণিত হয়েছে।তার স্বামী সব দেবতার থেকে বড় তিনি সব কাজে সিদ্ধিলাভ করেন তার সব গুণ আছে এবং কপালে তার সব সময় আগুন জলে যাতে মদন ভস্মীভূত হয়েছিল।ফলে আমরা আপাতদৃষ্টিতে নিন্দা দেখলেও প্রকৃতপক্ষে এখানে প্রশংসা করা হচ্ছে,তাই এটি ব্যাজস্তুতি অলংকার।

   আবৃত্তিকার কেন অলংকার পড়বে?
১) একটি কবিতাকে বুঝতে অলংকার আবৃত্তিকার কে সাহায্য করবে।
২) কবির কল্পনা কে বুঝতে সাহায্য করবে।
৩) আবৃত্তি করার সময় কোন শব্দে আবৃত্তিকার অতিরিক্ত জোর বা স্ট্রেস দেবেন তা অলংকার বুঝলে আবৃত্তিকারের পক্ষে সুবিধে হয়।
৪) কোন কবিতা আবৃত্তি করার সময় কবিতার মধ্যে যে নাটকীয়তা আছে তা আবৃত্তিকারের কন্ঠে প্রকাশিত হয় এই নাটকীয়তার মাত্রা নির্ধারণের ক্ষেত্রে অলংকার আবৃত্তিকার কে সাহায্য করতে পারে।
৫) অলংকার কাব্যের ভূষণ এটি পাঠক কে কাব্যরস দেয় যা শুনে পাঠকের মন আনন্দিত হয়। আবৃত্তিকার তার সুকণ্ঠ আবৃত্তির মধ্য দিয়ে এই আনন্দের বিস্তার ঘটাতে পারে।
৬) কোন আবৃত্তিকার যখন কাব্যের অলংকার বুঝিয়ে আবৃত্তি করেন তখন তার বাচনভঙ্গি আরো সুন্দর ও সাবলীল হয়।
   তাই একজন আবৃত্তিকার যদি কাব্যের অলংকার সম্পর্কে সম্যক ধারণা পায় তবে তার আবৃত্তি বহু মানুষের হৃদয়ে কবিতার রসকে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করবে।
পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments