জ্বলদর্চি

ইন্দোনেশিয়ার লোকগল্প (পরােপকার)/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লােকগল্প (ইন্দোনেশিয়া)
চিন্ময় দাশ

পরােপকার 

(এক আশ্চর্য সুন্দর দেশ ইন্দোনেশিয়া। আষ্টে-পৃষ্ঠে সমুদ্রের চাদর দিয়ে মােড়া। যেদিকে তাকাও শুধু জল আর জল। মাঝে মাঝে ছােট-বড় অগুনতি দ্বীপ। দ্বীপগুলি সবই আবার নারকেল গাছের সবুজ ছাউনি দিয়ে ঢাকা। আকাশে ডানা মেলে উড়ে যায় যে পাখিরা, তারা দেশটাকে দেখে কাপড়ের মত। যেন সবুজের বুটি দেওয়া নীল কাপড়। তা, সেই নারকেল গাছ নিয়ে, নাতি-নাতনিদের ভারি সুন্দর একটি গল্প বলেন সেখানের বুড়াে-বুড়িরা।)

 সে দেশে ছিল এক বুড়ােমানুষ।

   বুড়াে বললেও, ঠিকঠাক বােঝানাে যায় না, মানুষটা কতটা বুড়াে। সারা দেশে এতটা বুড়াে আর কেউ ছিল না। বুড়ােদের মধ্যেও বুড়াে ছিল মানুষটা। সাধে কি আর লােকেরা বলাবলি করত - 'হাজার বছর বয়স হবে মানুষটার'!

   যতটা তার বয়স, ততটাই সে ভালো মানুষ। একেবারেই সহজ আর সরল মানুষটা। থাকেও একেবারে সাধারণভাবে।

   থাকবার মধ্যে তাে একটা ডেরা। এই এতবড় দুনিয়া। কতলােকের কত কিছুই তাে আছে। কেবল তারই কিছু নাই। সমুদ্রের একেবারে গায়ে-গা-লাগানাে এক বিশাল পাহাড়। তারই একটা গুহায় থাকে সে। ডেরা বলতে সেই গুহাটুকুই। গুহাটুকু ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছু নাই তার। বনের ফল আর ঝরণার জল-- এতেই কাটিয়ে দিল সে সারাটা জীবন।

   তবে একেবারে কিছু ছিল না মানুষটার, তা কিন্তু নয়। দুটো জিনিষ ছিল তার। লােকটার ছিল গভীর জ্ঞান, আর দেশজোড়া সুনাম। সারা দেশজুড়ে নাম আর খ্যাতি ছিল বুড়ােমানুযটির। কত গভীর যে তার জ্ঞান! কেউ কুল-কিনারা করতে পারে না কোনদিন। দেশ উজিয়ে মানুষ আসে বুড়ােটার কাছে। পরামর্শ নেয় তার, উপদেশ চায় তার কাছে।

   এমনকি, কখনও কখনও রাজবাড়ির রথ এসেও দাঁড়ায় বুড়াের গুহার সামনে । কোনদিন রাজার মন্ত্রী আসে। কোনদিন বা রাজা নিজে এসে নামে রথ থেকে। সঙ্কটের কথা বলে বুড়ােকে। তারপর নিরসনের হদিশ নিয়ে, ফিরে যায় রাজধানিতে। রাজাই হােক, বা সাধারণ প্রজারা, কোন কিছুতেই বেজার নাই তার। যেন মানুষের উপকার করবে বলেই সে জন্মেছে। উপকার করবে বলেই বেঁচে আছে এতগুলাে বছর।

   একদিন এক যুবক এসে হাজির হল সমুদ্রের ধারে। খুঁজে খুঁজে গুহাটার সামনে এসে দাঁড়াল সে। গড় হয়ে প্রণাম করল বুড়াকে-- প্রণাম হই, বাবা। বুড়াে হাত তুলে কেবল বলল-- ভালো থেকো। 
যুবকটি হাসল সে কথা শুনে-- নিজের ভালোর জন্য আমি আসিনি, বাবা। 
সবাই আসে নিজের ভাল চাইতে। এ-ছেলেটা বলে কী! বুড়াে অবাক হয়ে বলল-- তবে কী জন্য এসেছ?"

   ছেলেটা বলল-- দেশ জোড়া তােমার নাম। অনেক জ্ঞান তােমার। জানাে অনেক কিছুই। আমাকে বলে দাও, কী করলে আমি অন্যের ভালো করতে পারব? সারা জীবন ধরে আমি অন্য লােকেদের ভালো করতে চাই।

   বুড়াে অবাক হয়ে বলল – কারণ কী, এমনটা চাইবার?

  -- একটাই তাে জীবন আমার। সেটা নিজের জন্যই কেন খরচ করে যাব? ছেলেটা হাসি মুখে জবাব দিল।

  বুড়ােমানুষটা যেমন অবাক হল, তেমনি খুশিও হোল সেকথা শুনে। মনে ভাবল, আমার তাে যাবার দিন হয়ে এসেছে। কবে ডাক এসে যাবে, তার নাই ঠিক। এতদিনে একজন মানুষের মত মানুষ-এর দেখা পেলাম।

   বুড়াে বলল-- ভারি ভাল লাগল তােমার কথা শুনে। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। 
  যুবক বলল-- হােক না কঠিন। তুমি আমাকে বলে দাও, কী করতে হবে। যা বলবে তুমি, আমি তাই করব।

  হাসি হাসি মুখ করে বুড়ো বলতে লাগল-- কোন কাজে কখনও অধীর হবে না।
  -- হবো না।”
  -- নিজের ভাল মনেও আনবে না কোন দিন।
  -- আনব না।
  -- কৌতুহলকে দমন করে চলবে চিরকাল।
-- করব।
  কথা সেরে, গুহার ভিতরে ঢুকে পড়ল বুড়ােটা। জমাট বাঁধা অন্ধকার সেটার ভিতরে। বেরিয়ে এল যখন, হাতে একটা ছােট্ট বাক্স। ছেলেটার হাতে সেটা দিয়ে বলল-- আমার জীবনের একমাত্র ধন উজ বাক্সটি। যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে আমার। তাই তােমার হাতেই দিয়ে গেলাম। এটার গুণে, আজ থেকে চিরকাল অন্যের উপকারই তােমার একমাত্র কাজ হবে। 
  ছেলেটা তো ভারি খুশি। চোখে মুখে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল তার। বুড়ােমানুষটি বলল-- তবে বাছা, এটা একটা যাদুবাক্স। নিজের ঘরে পৌঁছবার আগে, কোন কারণেই এর ডালা খুলবে না তুমি। খুললে কিন্তু বিপদ হবে তােমার। 
   -- ঠিক আছে। তাই হবে, বাবা! বলে, আবার একবার বুড়ােকে গড় করে, বিদায় নিল ছেলেটি।

   কিন্তু বাক্সটা হাতে নিয়ে পথে নামতেই, একটু একটু করে কৌতুহল জমতে লাগল তার মনের ভিতর। কী আছে এই বাক্সটাতে। ঘরে পৌঁছে খুললে বিপদ হবে না, তবে পথে খুললেই বা বিপদ হবে কেন?

   সবে গুহাটার আড়াল হয়েছে, আর থাকতে পারলনা সে। বুড়ােকে কথা দিয়ে এসেছে এইমাত্র, কৌতুহল চেপে রাখবে। সে কথা মনেই রইল না তার। খুলেই ফেলল বাক্সটার ডালা। আর, সাথে সাথে কী অবাক কাণ্ড! ডালাটাই যা খুলল সে। ভেতরে কী আছে, সেটা আর দেখাই হল না তার। হবে কী করে? কোথায় যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল সেই তরতাজা যুবক। চোখের নিমেষে সেখানে গজিয়ে উঠেছে বড়সড় এক নারকেল গাছ। যেন সেই উঁচু থেকে গাছটা অপরাধির চোখে চেয়ে চেয়ে দেখছে বুড়ােমানুষের গুহাটার দিকে। বুড়াের কথা না শুনে বিপদ হয়েছে যুবকটির। ভারি বিপদ। নিজের জীবন হারিয়ে, একটা নারকেল গাছ হয়ে গিয়েছে সে। 
   কিন্তু বুড়াের আশীর্বাদ তাে পেয়েছে সে আগেই। সেটা মিথ্যা হবার নয়। তাই, অন্যের উপকার করবার স্বপ্ন কিন্তু তার হারিয়ে যায়নি। তাই তাে সেই কোন আদ্যিযুগ থেকে আজও মানুষের সেবা করে চলেছে সে। নারকেল গাছের কাজই হল লােকের সেবা করে যাওয়া। ফলে-জলে-পাতায় নারকেল গাছ আজও জড়িয়ে আছে মানুষের জীবনের সাথে। ভারি উপকারী গাছ। 
   নিজের গুহা থেকে নারকেল গাছটা দেখতে পেয়েছে সেই বুড়ােটিও। মুখে একটা হালকা হাসি ফুটে উঠল তার। থুত্থুরিয়ে এসে, তুলে নিয়ে গেল ছোট্ট যাদুবাক্সটাকে। তুলে রেখে দিল অন্ধকার গুহাটার ভিতরে। হয়তাে আবার কোনদিন এরকমই কোন এক মানুষ এসে হাজির হবে, কে বলতে পারে।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments