জ্বলদর্চি

কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিতায় সিনেমাটোগ্রাফি/বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিতায় সিনেমাটোগ্রাফি
( জন্ম ১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৪৪- মৃত্যু ১০ জুন ২০২১) 

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় 

"ট্রামলাইনের ওপার  দেখা যায় কবির বাড়িতে 
পটপট আলো জ্বলে ওঠে।"
 
কবিতার ভেতর এভাবেই দৃশ্যপট বুনে দিয়েছেন কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। এই পৃথিবী নয়, চেনা চারপাশের মধ্যে নয় ট্রামলাইনের ওপারে কবির বাড়ি। একদিন সেখানেই ফিরে যেতে হয় কবিকে। তাঁর সৃষ্টির ভেতর সেই আলোটুকু রেখে যান তিনি। আমাদের ব্যথাতুর চোখ সেইদিকে তাকিয়ে থাকে। দেখতে পায় পটপট আলো জ্বলে উঠছে দিগন্তের ঐ পারে।বস্তুত এই নিয়তির মধ্যেই জেগে থাকে কবির ঠিকানা। চলে গেলেন প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক এবং কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত।দীর্ঘদিন ধরেই কিডনির অসুখে ভুগছিলেন তিনি। চিকিৎসা চলছিল । পাশাপাশি  ডায়ালিসিস। তবু ঘুমের মধ্যে চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। তাঁর  মৃত্যুতে  বাংলা চলচ্চিত্র  ও সাহিত্য জগতে একটি যুগের  অবসান হল । ১৯৪৪ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি পুরুলিয়ার আনাড়া  রেলশহরে তাঁর জন্ম।বাবা তারাকান্ত দাশগুপ্ত ছিলেন রেলের চিকিৎসক। শৈশবের দিনগুলি কেটেছে পুরুলিয়ার পলাশ ও পুটুসের সান্নিধ্যে ফলে পুরুলিয়ার গ্রামবাংলা তাঁর সিনেমায় অন্য রূপ পেয়েছে। ছো ঝুমুরের গতিশীল এবং সর্বাত্মক প্রয়োগ  তাঁর শিল্পে ও নির্মাণে  এমনভাবে ফুটে উঠেছে যা পুরুলিয়ার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে চিনতে সাহায্য করে। মাত্র ১২ বছর বয়সে হাওড়া দীনবন্ধু স্কুলে পড়াশোনার জন্য কলকাতা চলে আসেন তিনি। তবু পুরুলিয়ার সাথে তাঁর অন্তরের টান ছিল।এই টান আমৃত্যু  থেকে গেছে  তাঁর কাজে ও চিন্তায়। মনে প্রাণে তিনি ছিলেন মানভূমের মাটির মানুষ।  

 শুধু পুরুলিয়া নয়, বাংলা এবং বৃহত্তর বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার যে নির্যাস তিনি  উপলব্ধি করেছিলেন তাই ছিল তার সিনেমার প্রেক্ষাপট। চেনা দৃশ্য চেনা নিসর্গ  তাঁর বিভিন্ন সিনেমায় এর সার্থক  প্রতিফলন ঘটেছে। মানুষের জীবনচর্চাই হয়ে উঠেছে তাঁর ভাবনার আশ্রয়। তাঁর শিল্পের মূলবিন্দু। 

১৯৬৮ সালে মাত্র ১০ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি দ্য কন্তিনেন্ত অফ লাভ দিয়ে চলচ্চিত্রে তাঁর  অভিষেক হয়েছিল।  ১৯৭৮ সালে প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের  ছবি দূরত্ব-( দৌরাতওয়া) এর জন্য পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার। এরপর একে একে
নিম অন্নপূর্ণা (১৯৭৯)গৃহযুদ্ধ (১৯৮২) অন্ধ গলি (১৯৮৪) ফেরা (১৯৮৮) বাঘ বাহাদুর (১৯৮৯) 
তাহাদের কথা (১৯৯২) চরাচর (১৯৯৩)লাল দরজা (১৯৯৭) উত্তরা (২০০০) মন্দ মেয়ের উপাখ্যান (২০০২) স্বপ্নের দিন (২০০৪) আমি, ইয়াসিন আর আমার মধুবালা (২০০৭) কালপুরুষ (২০০৮) জানালা (২০০৯) মুক্তি(২০১২)
পত্রলেখা (২০১২)আনোয়ার কা আজিব কিসসা (২০১৩)টোপ (২০১৭)।

  প্রতিটি ছায়াছবিতে নতুন নতুন ভাবনায় প্লাবিত হয়েছে তাঁর নির্দেশনা। উত্তরায় আমরা পুরুলিয়ার মাটি ও মানুষকে ছুঁয়েছি নিবিড়ভাবে। 

"কালো জলে কুচলা তলে ডুবল সনাতন
আজ সারা না, কাল সারা না পাই যে দরসন৷
লদীধারে চাষে বঁধু মিছাই কর আস
ঝিরিহিরি বাঁকা লদি বইছে বারমাস৷"

যে গ্রাম বাংলাকে তিনি স্পর্শ করেছেন আশৈশব খুব স্বাভাবিক ভাবেই তার শিল্পে এর মূর্ত অবয়ব প্রতিফলিত হবেই। হয়েছেও। 

  শুধু চলচ্চিত্র পরিচালনা নয় সাহিত্য জগতেও তিনি ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর কবিতা অন্য এক পৃথিবীর সন্ধান দেয় আমাদের। যা নিয়ে চর্চা আগামীদিনেও অব্যাহত থাকবে। তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, রোবটের গান, ছাতা কাহিনি, গভীর এরিয়েলে, কফিন কিম্বা সুটকেস, হিমজগ, শ্রেষ্ঠ কবিতা, ভোম্বোলের আশ্চর্য কাহিনি ও অন্যান্য কবিতা সহ বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। 
কবিতায় সিনেমার রুদ্ধ দরজা খুলে দিয়েছেন তিনি। পাঠকের মনে হবে ছবি দেখছেন। শব্দে শব্দে গতিশীল ছবি। যা প্রবাহিত হচ্ছে অনুভবে, উপলব্ধিতে।  ছোট ছোট দৃশ্য দিয়ে বোনা হয়েছে কবিতার কোলাজ। যেমন-

১ 
শাড়ির ফলস পাড় উঠে পড়ছে অনেকদূর 
চক্রাকারে বেড়ে উঠেছে ক্রমশ ঢের শান্ত এক তিল
মাঝখানে আছে সময় যা পার হলে বোঝা যাবে সব
মানুষের কোন কোন অঙ্গ  হৃদয়ের মতো বিষন্ন হয়
মাইল মাইল ঘুরে আসার বদলে আমার হলুদ হাত 
শুয়েছিল তোমার হাতের নীচে

অন্যরকম এক কবিতা। এই কবিতার নীচে শুয়ে আছে যত্নলালিত ছবি। যেন ক্যামেরার উজ্জ্বল লেন্স থেকে এক একটি শব্দ বেরিয়ে এসে সাজিয়ে তুলছে কবিতার খাতা। যেন  বিকেল শেষ  হয়ে গেছে। ম্লান আলোর ভেতর উঠে আসছে কয়েকটি লাইন- 

"… শেষ হয়ে আসছিল তখন, বিকেল শেষ হয়ে এলে
আমি ঘুরে দাঁড়ালাম, 
দেখলাম আমার স্নানের জল 
তুলে দিচ্ছে বুড়ি। 
এক প্রসন্ন আশ্রয়ের ছবি ভেসে উঠছে সন্ধ্যের মর্মরিত আলোয়। কবিতা নয় এক সিনেমার দৃশ্যপট দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পাঠক। বন্দুকের গল্প কবিতার দিকে যদি আমরা তাকাই কী দেখব, শব্দ দিয়ে বুনে ফেলা সিনেমাই
হাড় হিম ছোট্ট ফোকরের ভেতর 
সেই বন্দুক শুয়ে থাকে সারা রাত, 
সারা রাত সমস্ত শহর জুড়ে  ফ্যান ঘোরার শব্দ
শুনতে পায় সেই বন্দুক
বন্দুকের ঘুম হয় না।"

ছোট্ট এই ছবির ভেতর উঠে আসছে অস্থির সময়। রক্তলাঞ্ছিত সময়ের রূপ। কয়েকটি লাইন দিয়ে সেই চলমান ছবিটি ধরা আছে কলমের আশ্চর্য লেন্সে। 
ডিম কবিতায় আমরা জীবনের চিরন্তন ছবি দেখতে পাই। 

"কেন না বেঁচে থাকা মানেই
ক্রমাগত  ডিম পাড়ার স্বপ্ন দেখা  ও ডিম পাড়ার জন্য অপেক্ষা করা-
আর কিছু নয়,
যার ভেতর থেকে একদিন মাথা ঠুকতে ঠুকতে  আমরাও বেরিয়ে এসেছি।"

  কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিতায়  বাড়ি, ঘর, চার দেওয়াল, গাছপালা, জল মাটি, পাখি, পাখির ডিম, ছাতা, পাহাড় এসব বারবার এসেছে। জীবন মানে তো শুধু মানুষ নয়। শুধু মানুষ তো নির্জীব। দৃশ্যই পারে মানুষের ভেতরে যে জীবন যে সজীবতা তাকে বাঙময় করে তুলতে। 
"একটা পাতা পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে। মাথার উপর দিয়ে
         এইমাত্র যে পাখি উড়ে গেল
মেঘের ভেতর
সে আমাদের শিখিয়ে গেল কিভাবে ঠোঁট  বন্ধ করে 
কথা বলতে হয় চিরকাল।"

তাঁর সাধনা তো পাখির মতোই।  ঠোঁট বন্ধ করে কথা বলা। শুধু একটি ছবির ভেতর  আশ্চর্য ইশারা রেখে যাওয়া। যা পাঠ করবে অনন্তকালের পাঠক।

আরও পড়ুন 
প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

Post a Comment

3 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো। একদম সহজ সরল ভাষায়। অভিনন্দন।

    ReplyDelete
  2. খুব সুন্দর সহজ ও সাবলীল ভাবে বুদ্ধদেববাবু ও তাঁর কাজ আর ভাবনা তুলে ধরেছেন। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  3. জলদ্বর্চি খুব উচ্চমানের ম্যাগাজিন।প্রতিটি লেখা ‌‌পড়েঋদ্ধ হই

    ReplyDelete