নাস্তিকের ধর্মাধর্ম- পর্ব-- ২৪/সন্দীপ কাঞ্জিলাল
নাস্তিকের ধর্মাধর্ম- পর্ব-- ২৪
সন্দীপ কাঞ্জিলাল
মানুষ ও ধর্ম
বলা বাহুল্য, অশিক্ষা মানুষের জন্মলব্ধ ধর্মবিশ্বাসকে শক্তিশালী করে। যে দেশে অশিক্ষা বেশি, সাধারণত সে দেশে ধর্মের প্রাবল্যও বেশি। কারণ মহাবিশ্ব, পৃথিবী, মানুষের বিবর্তন, এবং সমাজ ব্যবস্থার জাগতিক ভিত্তি সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞানের অভাব বশত অধিকাংশ মানুষ প্রাচীন টোটেম, ধর্মজাদু, প্রাকৃতিক ও পৌরাণিক দেবদেবী, এমনকি মিথ বা কাল্পনিক অতিকথা ভিত্তিক ধর্মবিশ্বাসের শিকার হয়।
অনেক সময় এমন কি রামায়ণ জাতীয় শিশুপাঠ্য পুরাণ কাহিনীর নায়ক এবং তার ভক্ত জন্তুকে পুজো করে। তাদের নামে যত্রতত্র মন্দির গড়ে তোলে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মস্থান ধ্বংস করে সেখানে পৌরাণিক অতিকথার নায়কের নামে মন্দির স্থাপনের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার বন্যা বইয়ে দেয়। কিন্তু সকলেই জানেন, ধর্মবিশ্বাস শুধুমাত্র অশিক্ষিত মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। যে কোনো ধরনের শিক্ষাই নয়, প্রকৃত বৈজ্ঞানিক শিক্ষাই পারে মানুষকে মুক্তচিন্তায় সমৃদ্ধ করে তুলতে। এই বৈজ্ঞানিক শিক্ষার মধ্যে প্রথমেই অবশ্য প্রকৃতিবিজ্ঞানকে ধরতে হবে। কারণ একমাত্র তার মধ্য দিয়েই মহাবিশ্বের স্বরূপ ও বিবর্তন, তথা মানুষের উৎপত্তি ও বিবর্তনের জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানও অপরিহার্য। কারণ তার মধ্য দিয়েই জানা সম্ভব যে শ্রেণীভেদ, আর্থসামাজিক অসাম্য, রাজনৈতিক স্বৈরাচার প্রভৃতি দ্বারা কলুষিত সমাজ ব্যবস্থা কোন ঈশ্বর সৃষ্টি করেননি, মানুষই সৃষ্টি করেছে।
একশ্রেণীর মানুষ নিজেদের শ্রেণীস্বার্থে অপর শ্রেণীকে দমন শোষণ করবার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছে। সে কারণে প্রচলিত অসম সমাজ ব্যবস্থাকে ক্রমশ সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার আদর্শে নতুন করে গড়বার কাজও মানুষকেই করতে হবে। এ কাজ ঈশ্বর কিংবা তার কোন অবতার বা প্রতিনিধি করে দেবেন না। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মাধ্যমে এ চৈতন্য মানুষের মধ্যে জন্মালেই সে ধর্মের অলীক দর্শন থেকে মুক্ত হবে।
জ্ঞানবিজ্ঞানের বিস্ময়কর প্রগতি সত্বেও মানুষ মহাবিশ্ব সম্বন্ধে, এমন কি নিজের শরীর সম্বন্ধে, অনেক কিছুই জানতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞান অনন্ত, এবং মানুষের জানা হয়তো কোনদিনই শেষ হবে না। কিন্তু সে জানার পথ শিক্ষার মাধ্যমে কষ্টসাধ্য জ্ঞান আহরণেই সীমাবদ্ধ। চোখ বুজে ধ্যান করে, ঈশ্বরচিন্তা করে, মন্তর আউরে কিংবা ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে মানুষের অন্য যাই উপকার হোক না কেন, এ পন্থায় মহাবিশ্ব, পৃথিবী বা মানব জীবন সম্বন্ধে সহসা পূর্ণজ্ঞান লাভের কোনই সম্ভাবনা নেই। ধর্মচর্চার মাধ্যমে যারা এরকম পূর্ণজ্ঞান লাভের দাবি করেছেন, তারা সকলেই ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছেন। কারণ মহাবিশ্বের কোথায় কি আছে সে সম্বন্ধে তার কোনো সঠিক তথ্যই দিতে পারেন নি, একমাত্র কল্পিত স্বর্গ-নরক ছাড়া। আর মানুষের শরীর এবং চৈতন্য সম্বন্ধেও তারা কিছুই বলতে পারেন নি, একমাত্র কল্পিত ঈশ্বর দর্শন এবং আত্মা-পরমাত্মা-পুনর্জন্মের তত্ত্ব ছাড়া। মরমিয়াবাদ বা মিস্টিসিজম, এবং কিছু মানুষের মহাবিশ্বচৈতন্যের অভিজ্ঞতার কথা আলাদা। কিন্তু এখানে বলে রাখা ভালো যে ব্যক্তিমানুষের কোন বিশেষ মরমিয়া অভিজ্ঞতার সত্যতা অস্বীকার না করলেও তাকে ধর্মের সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করা কঠিন। আর এরকম অভিজ্ঞতার ফলে মহাবিশ্ব এবং মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস, বস্তুজগতের গঠন এবং মানব সমাজের বিন্যাস প্রভৃতি কোন বিষয়েই কোন বাস্তব জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। মহাবিশ্বের বিবর্তন ও গঠন থেকে আরম্ভ করে সূক্ষাতিসূক্ষ বস্তুকণা বা তরঙ্গের গঠন ও আচরণ সম্বন্ধে ক্রমবর্ধমান জ্ঞান একমাত্র বিজ্ঞানই মানুষকে দিয়েছে, এবং দৃশ্য ভবিষ্যতেও দিতে পারবে।
মানুষের বিবর্তন, মানবদেহের গঠন ও প্রকৃতি, মানব সভ্যতার বিকাশ, এবং মানব সমাজের রূপান্তর সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞানও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, এবং ইতিহাস সহ সমাজবিজ্ঞানের মাধ্যমেই লাভ করা সম্ভব। ধর্মের মাধ্যমে নয়। এ কারণেই বহুকাল আগে ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) বলেছিলেন যে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে বিজ্ঞান ধর্মের বিকল্প হয়ে দাঁড়াবে। বিজ্ঞান কোন তাৎক্ষণিক উপলব্ধির মাধ্যমে পূর্ণজ্ঞানের অধিকারী হতে পারে না। কিন্তু বিজ্ঞানের কঠিন, বন্ধুর এবং সুদীর্ঘ পথ ছাড়া ব্যক্তিমানুষের সামনে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের আর কোন পথ খোলা নেই। সিগম্যান্ড ফ্রয়েড যথার্থই বলেছেন: "No, our science is no illusion. But an illusion it would be to suppose that what science cannot give us we can get elsewhere." বারট্রান্ড রাসেলও বিজ্ঞান ও ধর্মের সম্পর্ক বিষয়ে একই ধরনের মত প্রকাশ করেছেন। বিজ্ঞানের পুঞ্জিভূত জ্ঞান একদিন প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ এবং মানুষের মগ্নচৈতন্যে বেঁচে থাকা ধর্মকায়াগুলোকে উত্তরণ করে মানব জীবনে বৈজ্ঞানিক মহাবিশ্বচেতনার জন্ম দেবে। সেদিন বর্তমানের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম এবং ধর্মের অলীক দর্শন বর্জিত সৃষ্টির মতই পড়ে থাকবে মানুষের বিবর্তনের পথের ধারে। মানুষের ব্যক্তিজীবনকে সেদিন নিয়ন্ত্রিত করবে ধর্মের বদলে বৈজ্ঞানিক মহাবিশ্বচৈতন্য।
কিন্তু এ কথা মনে রাখা বিশেষ যে প্রয়োজন যে ব্যক্তিমানুষের চৈতন্য একক ভাবে গড়ে ওঠে না। দেশকাল অনুযায়ী প্রত্যেক সমাজের একটি বিশেষ বিন্যাস থাকে, একটি বিশেষ কাঠামো থাকে। ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠন যে বৃহত্তর সামাজিক বিন্যাস এবং কাঠামো থেকেই উৎপন্ন এবং তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত। বিশেষ ক্ষেত্রে এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে কোন প্রবল ধীশক্তি এবং ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিমানুষ তার সাধারণ সামাজিক পরিবেশকে এবং জন্মলব্ধ ধর্মকে উত্তরণ করে নব চৈতন্যের অধিকারী হতে পারে। এ ভাবেই কখনো কখনো চৈতন্যের আকাশে নতুন তারকা জন্ম হয়। কিন্তু সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিবর্তন এবং অবিরাম রূপান্তরের মাধ্যমে ছাড়া ব্যক্তিমানুষের জীবনে এবং সমষ্টিগত মানব সমাজে ধর্মহীন নব চৈতন্যের উদ্ভব হয় সম্ভব নয়। বস্তুজগৎ ও সমাজ ব্যবস্থার বিবর্তনই পৃথিবীর মানুষের চৈতন্যের বিকাশের ভিত্তি।
বিশেষত সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক প্রভাব এবং ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াই ব্যক্তিমানুষের সামাজিক চৈতন্য ও তার বিবর্তনের ভিত্তি। অতএব ধর্মের ভবিষ্যত বুঝতে হলে আমাদের আলোচনা শুধুমাত্র ব্যক্তিজীবনে ধর্মের ভূমিকাতে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না। সামগ্রিক ভাবে সমাজ জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক সাংগঠনিক ধর্মের উৎপত্তি এবং ভূমিকাও বিশ্লেষন করতে হবে।
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
Comments
Post a Comment