জ্বলদর্চি

মা দুর্গা প্রত্যেক বছর আসেন, তবু আমাদের ডিম ওরা বেচে দেয় পর্ব--৩/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

মা দুর্গা প্রত্যেক বছর আসেন, তবু আমাদের ডিম ওরা বেচে দেয়  পর্ব--( ৩)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল


শারদ উৎসবে বিশ্বব্যাপী হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে পূজিত হন দেবী দুর্গা। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হিন্দুধর্মাবলম্বী দেশ ভারতেই, এমন কিছু মানুষ আছে, দেবী দুর্গার মুখ দেখা যাদের কাছে পাপ। তাই দুর্গাপূজার কয়েকদিন প্রাণপণে তারা চেষ্টা করেন, যাতে দেবী দুর্গার মুখ দেখতে না হয়। কারণ তারা নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর বলে মনে করেন। 

সাঁওতাল মুন্ডা, কোল, অসুর, কুড়মি, মাহালী, কোড়াদের নিয়ে খেরোয়াল জাতি। সেই জাতির রাজা হুদুর দুর্গা কিস্কু বা ঘোড়াসুর সমস্ত পাহাড়-জঙ্গল নদী ও চারণভূমির অধিপতি ছিলেন। আর্যরা বারবার তার রাজ্যকে আক্রমণ করেও, হুদুড় রাজার পরাক্রমের কাছে হেরে যেতে থাকে। তখন তারা এক সুন্দরী নারীকে হুদুড় দুর্গার কাছে পাঠালো। সেই যুবতী ছিল গণিকাপ্রধানা ও আর্যদের 'হানিট্রাপ'। তার সৌন্দর্য ও ছলা কলায় মুগ্ধ হয়ে হুদুড় তাকে বিয়ে করে। নয়দিন উদ্দাম মধুচন্দ্রিমার পরে নববধূ হুদুড়কে মেরে ফেলে। তারা মনে করেন এই হুদুড় দুর্গা হলেন, দেবী দুর্গার বধ্য মহিষাসুর। আর হুদুড় দুর্গাকে হত্যা করার পর, সেই ছলনাময়ী দেহোপজীবিনী পরিচিত হন দেবী দুর্গা নামে। আর্যরা অতঃপর নেতৃত্বহীন ভূমিপুত্রদের সুবিশাল সাম্রাজ্য দখল করে তাদের তাড়িয়ে দেয়। যার ফলে তারা পালিয়ে বেড়াতে থাকে ঝাড়খন্ড উড়িষ্যা বাংলা ছত্তিসগড়ের পাহাড়ে জঙ্গলে। সেই ধাক্কা ও শোক আজও ভূমিপূত্ররা বা মূলনিবাসীরা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই আদিকাল থেকে প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময়, দুর্গা সপ্তমীর দিন থেকে শোকের প্রতীক হিসাবে, 'দাঁশাই' বা 'ভুয়াং' নাচের মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় মধ্য ভারতের অধিবাসীদের শোকার্ত পদযাত্রা। যার দ্বারা মহিষাসুরের হত্যা ও তার ফলে আদিবাসীদের ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়নের করুন ইতিহাস স্মরণ করা হয়। 

এই বিশ্বাস ও বাখ্যায়  হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ মার্কন্ডেয় পুরাণের আখ্যান অনুসরণ করে তারা। এই জনগোষ্ঠী মনে করেন, দেবী দুর্গার হাতে মহিষাসুর বধ আসলে, দেবতাদের ষড়যন্ত্র। তাই অসুরের বংশধররা দুর্গাপূজার চার দিন, মহিষাসুরের জন্য আলাদা পূজার আয়োজন করে। মূর্তিপূজায় অবিশ্বাসী এই সম্প্রদায় দুর্গাপূজার কয়েকদিন শোক দিবস পালন করেন।

দেবতাদের এই ষড়যন্ত্র শুধু ভারতীয় পুরাণে নয় বিদেশের ধর্মশাস্ত্রে দেখা যায়। প্রাচীন মিশরীয়রা দেবতা বিশ্বাসী ছিল। সেখানে দুই হাজারেরও বেশি দেবদেবীর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। মিশরীয় পুরাণ অনুসারে, পুনর্জন্ম মদ শস্য তথা উর্বরতার দেবতা ছিলেন ওসাইরিস। পৃথিবী ও আকাশের সঙ্গমে তার জন্ম। প্রকৃতির সম্মিলিত শক্তির প্রতীক বলা চলে তাকে। তবে তার এই খ্যাতি মেনে নিতে পারেনি তার আপন ভাই সেথ। সেও একজন দেবতা। উৎশৃংখল ও হিংস্র হিসেবে দুর্নাম আছে দেবতা সেথের। চরম বিশৃঙ্খলা ও ঝড়ের দেবতা ছিল সেথ। আপন ভাই ওসিরিসকে হত্যা করে মিশর দখলের পরিকল্পনা ছিল তার।  পরবর্তীকালে তা বিশাল যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যা আমরা দেখতে পাই আমাদের পুরাণে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে লড়াই। 

ইলিয়াড মহাকাব্যের কাহিনীর আগাগোড়াই দেবতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়। ইলিয়াড মহাকাব্যের দেবতারা সক্রিয় ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। আমাদের পুরাণের দেবতারা ছলনা বা ষড়যন্ত্র করে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু ইলিয়াডে দেখা যায়, দেবতারা দুই দলে ভাগ হয়ে ট্রয়ের যুদ্ধে সামিল হচ্ছে। 
আসলে ভারতীয় মহাকাব্যে মানুষের ক্ষমতার তুলনায় দেবতাদের ক্ষমতাকে অনেক বড় করে দেখানো হয়েছে। কিন্তু ইলিয়াড মহাকাব্যে দেবতার ক্ষমতাকে আকাশচুম্বী কোন কিছু ভাবা হয়নি। মানুষের সাথে তাদের প্রধান পার্থক্য, দেবতারা অমর আর মানুষ মরণশীল।

পুরান ইতিহাসে দেবতাদের যত লাভ এবং প্রাপ্তির বর্ণনা আছে সব অসুরদের ঠকিয়ে। যেমন আজকের সমাজে আমরা দেখতে পাই, কিছু লোক ধনীর শিরোপা পাচ্ছে গরীবদের ঠকিয়ে। যে সমস্ত বড়লোকদের শুধু পনীয় জল খেতে প্রতিদিন এক কোটি টাকা লাগে। শুধু তাদের যৌবনে ভাটা আসতে দেবে না বলে। আর সাধারণ মানুষ আর্সেনিক মিশ্রিত জলও পাচ্ছে না। বড়লোকদের গায়ের রঙ কাঁচা সোনা। তারাই তো মর্তের ভগবান। আবার ভগবান নারায়ন শুধু দেবস্বার্থে মোহিনী রুপ ধরে অসুরদের ঠকিয়ে অমৃত চুরি করে দেবতাদের অমরত্ব এনে দিলেন। নেতায় নেতায় যেমন ভাব থাকে, ( যদি সত্যি দেবতাদের কোনো অস্তিত্ব থাকে), তবে ঐ বড়লোকদের সঙ্গে আছে দেবতাদের। মা তাদের ডাকে এই মর্ত্যে আসেন। নয়তো যে দেশে গণতন্ত্রের নামে প্রহসন চলছে, এতো মানুষ বেকার, চারদিকে বানভাসি মানুষের আর্তনাদ, যেখানে সাধারণ মানুষের অস্তিত্ব চরম সংকটে,  সেখানে তিনি আসতেন না। যারা গরীবের ডিমের পয়সা ঝেড়ে বড়লোক হচ্ছে, মা তাদের ডাকে এই মর্ত্যে আসেন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments