জ্বলদর্চি

রবীন্দ্রকাব্যে প্রকৃতি ও পরিবেশ: একটি সংক্ষিপ্ত অনুসন্ধান/ ড: তপতী দাশগুপ্ত

রবীন্দ্রকাব্যে প্রকৃতি ও পরিবেশ: একটি সংক্ষিপ্ত অনুসন্ধান  

ড: তপতী দাশগুপ্ত

সারাংশ
রবীন্দ্রকাব্যে ছন্দ ও গানের এক অপরূপ মেলবন্ধন আমরা খুঁজে পাই প্রকৃতি ও পরিবেশের অন্তস্থলে। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে ভালবেসেছিলেন তাঁর জীবন দিয়ে – প্রকৃতির মধ্যেই তিনি অনুসন্ধান করেছিলেন একাধারে জীবনদেবতার নিবিড় অস্তিত্বকে, অন্যদিকে সৌন্দর্য–পিপাসু কবি প্রকৃতির বিভিন্ন ঋতুর মধ্যে অনুধাবন করেছিলেন প্রকৃতি ও পরিবেশের এক গভীর মহিমা, এক অনাবিল সৌন্দর্যদর্শন। বর্তমান প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে কি ভাবে কবি তাঁর অসামান্য প্রবন্ধরাজি (ডায়েরি) ‘ছিন্নপত্রের’ পাতার সঙ্গে তাঁর লেখা কিছু কবিতা, কিছু গানের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছেন। ‘ছিন্নপত্র’ মূলত: শিলাইদহ ভ্রমণকারী জমিদারী তত্ত্বতালাস সূত্রে লেখা কিছু পরিবেশধর্মী লেখা। বোটে ভ্রমণকারী রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে, চিনেছিলেন পরিবেশকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে। এরই সাথে তাঁর অজান্তেই বোধকরি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে তাঁর কিছু গান, কিছু কবিতা। বর্তমান প্রবন্ধে মূলত: বর্ষা ও শরতের কিছু অংশকে বেছে নেওয়া হয়েছে এই সুরবন্ধনের লাবণ্যকে পরিস্ফুট করতে। এছাড়াও বোটে ভ্রমণকারী কবি দেখেছিলেন গ্রাম বাংলার মানুষের অসীম দারিদ্র্য, গ্লানি, অশিক্ষা এবং সর্বোপরি অসহায়তা, যা রূপ পেয়েছে তাঁর বিভিন্ন ছোটগল্প ও কবিতায়। পরিশেষে দেখানো হয়েছে রবীন্দ্রভাবনার সাথে সামঞ্জস্য আছে এমন কিছু বাংলা সাহিত্যের কাব্য সৃষ্টি – এই অনুসন্ধানমূলক এবং বিশ্লেষণমূলক পরিসরে লেখিকা নিজস্ব ভাবনার কিছু খোরাক রেখেছেন। 

এক
আমরা প্রথমে ‘ছিন্নপত্রের’ বর্ষার একটি অনবদ্য লেখা দিয়ে শুরু করছি, যার সাথে গাঁথবার চেষ্টা করব আমরা তাঁর একটি অসামান্য কবিতা ও গান।
“শিলাইদহ,
২রা আষাঢ় ১২৯৯
“কাল আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বর্ষার নব রাজ্যাভিষেক বেশ রীতিমত আড়ম্বরের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে।....... মেঘদূত লেখার পর থেকে আষাঢ়ের প্রথম দিনটা একটা বিশেষ চিহ্নিত দিন হয়ে গেছে–নিদেন আমার পক্ষে। ........ হাজার বৎসর পূর্বে কালিদাস সেই যে আষাঢ়ের প্রথম দিনকে অভ্যর্থনা করেছিলেন – আমার জীবনেও প্রতি বৎসর সেই আষাঢ়ের প্রথম দিন তার সমস্ত আকাশ-জোড়া ঐশ্বর্য নিয়ে উদয় হয় – সেই প্রাচীন উজ্জ্বয়িনীর প্রাচীন কবির – সেই বহু-বহুকালের শত শত সুখদু:খবিরহমিলনময় নরনারীদের আষাঢ়স্য প্রথম দিবসঃ!”১
        এই একই ভাবময়তা, একই প্রাচীন ছন্দের অনুরণণ আমরা প্রতিভাত হতে দেখি কবির ‘মানসী’ কাব্যের ‘মেঘদূত’ কবিতার কিছু অবিস্মরণীয় পংক্তিরাজিতে:
    “কবিবর, কবে কোন বিস্তৃত বরষে 
    কোন্ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
    লিখেছিলে মেঘদূত। মেঘমন্দ্র শ্লোক
    রাখিয়াছে আপন আঁধার স্তরে স্তরে
    সঘনসংগীত মাঝে পুঞ্জীভূত করে”
    ......
    “সেদিন সে উজ্জয়িনী প্রাসাদশিখরে
    কী না জানি ঘনঘটা; বিদ্যুৎ-উৎসব,
    উদ্দাম পবনবেগ, গুরুগুরু রব।
    গম্ভীর নির্মোঘ সেই মেঘসংঘর্ষের 
    জাগায়ে তুলিয়াছিল সহস্রবর্ষের
    অন্তরগুঢ় বাষ্পাকুল বিচ্ছেদক্রন্দন
    একদিনে। ছিন্ন করি কালের বন্ধন
    সেই দিন ঝরে পড়েছিল অবিরল
    চিরদিবসের যেন রুদ্ধ অশ্রুজল
    আর্দ্র করি তোমার উদার শ্লোকরাশি”
    .....
    “কোথায় অবন্তীপুরী, নির্বিন্ধ্যা তটিনী
    কোথা শিপ্রানদীতীরে হেরে উজ্জয়িনী 
    স্বমহিমাচ্ছায়া সেথা নিশি দ্বিপ্রহরে 
    প্রণয়চাঞ্চল্য ভুলি ভবনশিখরে
    সুপ্ত পারাবত; শুধু বিরহবিকারে
    রমণী বাহির হয় প্রেম-অভিসারে 
    সূচিভেদ্য অন্ধকারে রাজপথমাঝে
    ক্বচিৎবিদ্যুতালোকে।”২
        ‘ছিন্নপত্রের’ গাঁথামালা এক অসামান্য মাধুরীমাখা সৌন্দর্য পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি পর্যায়ের বহুশ্রুত এই গানটিতে: 
    “বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ় এল আমার মনে,
    কোন্ সে কবির ছন্দ বাজে ঝরো ঝরো বরিষণে ||
    যে মিলনের মালাগুলি ধূলায় মিশে হল ধূলি
    গন্ধ তারি ভেসে আসে আজি সজল সমীরণে ||
    সেদিন এমনি মেঘের ঘটা রেবানদীর তীরে,
    এমনি বারি ঝরেছিল শ্যামলশৈলশিরে।
    মালবিকা অনিমিখে চেয়েছিল পথের দিকে,
    সেই চাহনি এল ভেসে কালো মেঘের ছায়ার সনে ||”৩     
প্রকৃতি ও পরিবেশের কী অপরূপ সমন্বয় আমরা খুঁজে পাই গদ্যে, পদ্যে ও গানে। তারই মাঝখানে রমণীয় হয়ে উঠেছে বর্ষার সেই প্রাচীন অথচ চির-নবীন রূপটি। একই বিরহ-মিলনের দোলা, একই বর্ষার অবিরাম বর্ষণ, জীবনের ছন্দে ছন্দে, সুরে সুরে একই বর্ষার নিবির অনুভূতি মধ্যে কবি যেন কখন একাত্ম হয়ে গেছেন।
আবার আমরা ফিরে আসি ‘ছিন্নপত্রের’ ছত্রে বর্ষার আরেকটি সঘন সজল রূপমাধুরীতে।
                                “শিলাইদহ,
৪ঠা জুলাই, ১৮৯৩
“আজ সকালবেলায় অল্প অল্প রৌদ্রের আভাস দিচ্চে। কাল বিকেল থেকে বৃষ্টি ধরে গেছে কিন্তু আকাশের ধারে ধারে স্তরে স্তরে এত মেঘ জমে আছে যে বড় আশা নেই।....... এবারে এত জলও আকাশে ছিল! আমাদের চরের মধ্যে নদীর জল প্রবেশ করেছে। চাষারা নৌকো বোঝাই করে কাঁচা ধান কেটে নিয়ে আসচে – আমার বোটের পাশ দিয়ে তাদের নৌকো যাচ্চে.................. বৃষ্টি যেমনি পড়বার তেমনি পড়চে, নদী যেমন বাড়বার তেমনি বাড়চে, বিশ্বসংসারে এ সম্বন্ধে কারো কাছে কোন দরবার পাবার যো নেই।”৪ 
    এই গদ্যাংশের সঙ্গে আমরা মিল খুঁজে পাই ‘সোনার তরী’ কাব্যের প্রথম কবিতা ‘সোনার তরী’র ছন্দ লহরীতে, যেখানে কবি ‘সোনার ধান’ কেটে নিয়ে যাবার দৃশ্যটি তুলে ধরেছেন ছন্দ সুষমায়।
        “গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা
        কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
        রাশি রাশি ভারা ভারা ধান-কাটা হল সারা,
        ভরা নদী ক্ষুরধারা খরপরশা –
        কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা”
        ......
        ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী 
        আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
        শ্রাবণ গগন ঘিরে ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
        শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি –
        যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।|”৫
ধানের ক্ষেতের এক লাবণ্যভরা প্রতিচ্ছায়া প্রতিফলিত হয়েছে বহুজন প্রিয় ‘ক্ষণিকা’ কাব্যের এই কবিতাটিতে: 
“হৃদয় আমার নাচেরে রে আজিকে ময়ূরের মত নাচে রে” 
.......
গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি গরজে গগনে, গরজে গগনে।
ধেয়ে চলে আসে বাদলের ধারা,
নবীন ধান্য দুলে দুলে সারা,
কুলায় কাঁপিছে কাতর কপোত, দাদুরি ডাকিছে সঘনে।
গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি গরজে গগনে গগনে।”৬
অথবা, শরৎ আকাশের রোদ বৃষ্টির খেলায়, ধানের ক্ষেতের নবীন শোভা প্রকাশ পেয়েছে এই গানে: 
        “আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির
            খেলা রে ভাই, লুকোচুরির খেলা 
        নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা
            মেঘের খেলা রে ভাই লুকোচুরির খেলা।”৭

দুই    
রবীন্দ্রনাথের শরৎ প্রকৃতিও কখন যেন ধরা দিয়েছে ‘ছিন্নপত্রের রূপলাবণ্য মাখা লেখনীতে, যেখানে বর্ষা শেষের অনাবিল রূপ ও শরতারম্ভের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য মিলে মিশে এক হয়ে গেছে। প্রকৃতি ও পরিবেশের এই নিবিড় রূপটি কবি উপলব্ধি করেছেন শিলাইদহে ভ্রমণকারী বোটে বসে।
                                  “শিলাইদহ,
১লা অক্টোবর, ১৮৯১
“বেলায় উঠে দেখলুম চমৎকার রোদ্দুর উঠেছে এবং শরতের পরিপূর্ণ নদীর জল তল্ তল্ থৈ থৈ করচে। নদীর জল এবং তীর প্রায় সমতল – ধানের ক্ষেত সুন্দর সবুজ এবং গ্রামের গাছপালাগুলি বর্ষাবসানে সতেজ এবং নিবিড় হয়ে উঠেছে। এমন সুন্দর লাগল সে আর কি বলব।”৮
    এই মনোভাবটি পরিলক্ষিত হয় শরতের কিছু গানে, তার মধ্যে এই গানটি বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য।
    “অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া –
    দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া”
    কোন্ সাগরের পার হতে আনে কোন্ সুদূরের ধন –
        ভেসে যতে চায় মন,
    ফেলে যেতে চায় এই কিনারায় সব চাওয়া সব পাওয়া
    পিছনে ঝরিছে ঝরো ঝরো জল, গুরু গুরু দেওয়া ডাকে, 
    মুখে এসে পড়ে অরুণকিরণ ছিন্ন মেঘের ফাঁকে।
    ওগো কাণ্ডারী, কে গো তুমি, কার হাসিকান্নার ধন
        ভেবে মরে মোর মন –
    কী সুরে আজ বাঁধিবে যন্ত্র, কী মন্ত্র হবে গাওয়া।”৯ 
    শরতের আরেকটি মায়াময় রূপ প্রতিভাত হয়েছে ‘ছিন্নপত্রের’ এই ছত্রগুলিতে, যেখানে কবি বিভোর হয়ে গেছেন শরৎ প্রকৃতির অনাবিল আবেশে, অফুরন্ত মাধুরীতে।        
   
      
   “শিলাইদহ,
৩রা ভাদ্র, ১৮৯২
“এমন সুন্দর শরতের সকালবেলা। চোখের উপর যে কি সুধাবর্ষণ করচে সে আর কি বলব! তেমনি সুন্দর বাতাস দিচ্চে এবং পাখী ডাক্‌চে। এই ভরা নদীর ধারে বর্ষার জলে প্রফুল্ল নবীন পৃথিবীর উপর শরতের সোনালি আলো দেখে মনে হয় যেন আমাদের এই নবযৌবনা ধরণীসুন্দরীর সঙ্গে কোন্ এক জ্যোর্তিময় দেবতার ভালবাসা চল্‌চে – তাই এই আলো এবং এই বাতাস, এই অর্ধ উদাস, অর্ধ সুখের ভাব, গাছের পাতা এবং ধানের ক্ষেতের মধ্যে এই অবিশ্রাম স্পন্দন, জলের মধ্যে এমন অগাধ পরিপূর্ণতা, স্থলের মধ্যে এমন শ্যামশ্রী, আকাশে এমন নির্মল নীলিমা।”১০ 
        সৌন্দর্য সচেতন কবি রবীন্দ্রনাথের শরতের এই অপার্থিব রূপটি ছবির মত তুলে ধরেছেন, নিপুণ হাতে এঁকেছেন এই গানে:
    “আজি শরততপনে প্রভাত স্বপনে কী জানি পরাণ কী যে চায়।
ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কী যে চায় গো,
    আজি মধুর বাতাসে হৃদয় আকাশে রহে না আবাসে মন হায় –
    কোন্ কুসুমের আশে কোন্ ফুলবনে সুনীল আকাশে মন ধায় গো”
...............................১১
তিন    
প্রকৃতির ও পরিবেশের এমন অপূর্ব সামঞ্জস্য রবীন্দ্রনাথের গদ্যে, পদ্যে ও গানে বার বার ঝংকৃত হয়েছে। এই প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভিত্তি করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘গল্পগুচ্ছের’ বহু ছোট গল্পের খোরাক পেয়েছেন। বোট থেকে দেখা, নদীর পাড়ে পাড়ের ছোট ছোট গ্রামগুলির দৃশ্য তাঁর বার বার চোখে পড়েছে। ছোট ছোট কিছু ঘটনা, কিছু গ্রামীণ কলহ ও তাঁর মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করেছে। অন্যদিকে তিনি গ্রাম বাংলাকে চিনেছিলেন নতুন রূপে – গ্রাম বাংলার দারিদ্র্য, অসহায়তা, অশিক্ষা, মূঢ়তা তাঁকে বার বার ধাক্কা দিয়েছে। অন্যদিকে, এই বোটের জলে ভেসে ভেসে কিছু রাগ-রাগিনী ভিত্তিক সুন্দর সঙ্গীত সৃষ্টিও তিনি করেছেন। ‘গল্পগুচ্ছের’ একটি প্রখ্যাত গল্প ‘পোষ্টমাষ্টারের’ একটি সাক্ষাৎ উপক্রমণিকা আমরা পেয়ে যাই ‘ছিন্নপত্রের’ এই অংশে। 
“সাজাদপুর
২৯শে জুন, ১৮৯২
“কালকের চিঠিতে লিখেছিলুম আজ অপরাহ্ন সাতটার সময় কবি কালিদাসের সঙ্গে একটা এন্‌গেজমেণ্ট করা যাবে। বাতিটি জ্বালিয়ে টেবিলের কাছে কেদারাটি টেনে বইখানি হাতে যখন বেশ প্রস্তুত হয়ে বসেছি হেনকালে কবি কালিদাসের পরিবর্তে এখানকার পোষ্টমাষ্টার এসে উপস্থিত। মৃত কবির চেয়ে একজন জীবিত পোষ্টমাষ্টারের দাবী অনেক বেশি।....... এই লোকটির সঙ্গে আমার একটু বিশেষ যোগ আছে। যখন আমাদের এই কুঠিবাড়ির একতলাতেই পোষ্ট অপিস ছিল এবং আমি এঁকে প্রতিদিন দেখতে পেতুম তখনি আমি একদিন দুপুরবেলায় এই দোতালায় বসে সেই পোষ্টমাষ্টারের গল্পটি লিখেছিলুম এবং সেই গল্প যখন হিতবাদীতে বেরল তখন আমাদের পোষ্টমাষ্টারবাবু তার উল্লেখ করে বিস্তর লজ্জামিশ্রিত হাস্য বিস্তার করেছিলেন।”১২ ........।” এই লেখাটি মনে করিয়ে দেয় আমাদের গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম উলাপুরের পোষ্টমাষ্টার আর ছোট্ট মেয়ে রতনের সেই মর্মস্পর্শী অবিস্মরণীয় আখ্যানটি।১৩
    এরকম আরও বহু ছোটগল্পের পটভূমিকা কবি খুঁজে পেয়েছিলেন পদ্মার চরে চরে, গ্রাম বাংলার স্তরে স্তরে। কেবল প্রকৃতির সুরসুধা নয়, এই প্রকৃতি ও পরিবেশের মধ্যেই তিনি অনুধাবন করেছিলেন ‘চিত্রা’ কাব্যের একটি অসাধারণ কবিতার মুখবন্ধ। গ্রামবাংলার মানুষের রূঢ় বাস্তব সত্যকে তিনি রূপ দিয়েছেন: ‘ছিন্নপত্রের’ গাঁথা মালায় ও কিছু অসাধারণ পংক্তিতে। 
“শিলাইদহ,
১০ই মে, ১৮৯৩
“আমার এই দরিদ্র চাষীপ্রজাগুলোকে দেখ্‌লে আমার ভারি মায়া করে, এরা যেন বিধাতার শিশুসন্তানের মত নিরুপায়। তিনি এদের মুখে নিজের হাতে কিছু তুলে না দিলে এদের আর গতি নেই। পৃথিবীর স্তন যখন শুকিয়ে যায়, তখন এরা কেবল কাঁদতে জানে কোনমতে একটুখানি ক্ষুধা ভাঙলেই আবার তখনি সমস্ত ভুলে যায়।”১৪
        একই ভাবব্যঞ্জনা আমরা খুঁজে পাই ‘চিত্রা’ কাব্যের ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায়:
    “এই সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা; এই সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা; ডাকিয়া বলিতে হবে
‘মূহূর্তে তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে,
যার ভয়ে ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে 
যখনি জাগিবে তুমি, তখনি সে পলাইবে ধেয়ে;
পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সন্ত্রাশে যাবে মিশি।
দেবতা বিমুখ তারে, কেহ নাহি সহায় তাহার,
মুখে করে আস্ফালন, জানে সে হীনতা।
আপনার মনে মনে।”১৫
        কবি এই পরিবেশের মধ্যে অবলোকন করেছেন ঋতুর অনাবিল সৌন্দর্য মহিমা, অনুভব করেছেন গ্রাম বাংলার মানুষের দু:খ ও যন্ত্রণাকে, আবার এই সৌন্দর্যপিপাসু কবিই রাগরাগিণীর সুরছন্দকে ভাষা দিয়েছেন অপূর্ব গানে:
পতিসর
১০ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৮
“এই চৌকিটাতে বসে আকাশ থেকে সোনালি রোদ্দুরটুকু চোখ দিয়ে চাখ্‌তে চাখ্‌তে এবং জলের উপরকার শৈবালের সরস কোমলতার উপর মনটাকে বুলিয়ে চল্‌তে চল্‌তে যতটুকু অনায়াস আলস্যভরে আপনি মাথার উপর এসে পড়ে তার বেশি চেষ্টা করা আপাতত আমার সাধ্যাতীত। আজ সমস্ত সকাল নিতান্ত সাদাসিধা রামকেলীতে যে গোটা দুই তিন ছত্র বারবার আবৃত্তি করেছিলুম সেটুকু মনে আছে – নমুনাস্বরূপ উদ্ধৃত করে দিলুম: 
    “ওগো তুমি নবনবরূপে এস প্রাণে
            (আমার নিত্যনব)
    এস গন্ধেবরণেগানে।
    আমি যেদিকে নিরখি তুমি এস হে –
    আমার মুগ্ধমুদিত নয়ানে।”১৬
একই রূপের প্রতিবিম্ব ‘গীতাঞ্জলি’র গানে, ‘পূজা’ পর্যায়ের পংক্তিতে: 
    “তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে,
    এসো গন্ধ বরণে এসো গানে”
    এসো অঙ্গে পুলকময় পরশে,
    এসো চিত্তে সুধাময় হরষে,
    এসো মুগ্ধ – মুদিত দু নয়ানে।|”১৭

চার    
প্রকৃতি ও পরিবেশ ধর্মী কিছু অসাধারণ লেখা পরিলক্ষিত হয় পরবর্তী কালের এক স্বনামধন্য সাহিত্যিক, যেমন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও একজন কবি, যেমন জীবনানন্দ দাসের মধ্যে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার বৈচিত্র্য অনেক। তার মধ্যে প্রকৃতি ও পরিবেশের এক অপার্থিব সৌন্দর্য ধরা পড়েছে কিছু উপন্যাসের ছত্র রাজিতে, যেমন, ‘পথের পাঁচালী’, ‘আরণ্যক’, ‘ইছামতী’ তে। 
    আমাদের গ্রাম বাংলা যে সত্যিই রূপসী বাংলা তা অপূর্ব সৌন্দর্যভাবে প্রতিবিম্বিত হয়েছে প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘পথের পাঁচালী’, ‘ইছামতী’ প্রমুখ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে এবং স্বনামধন্য কবি জীবনানন্দ দাসের ‘রূপসী বাংলা’ কবিতাগুচ্ছের বহু ছত্রে। একজন গদ্য শিল্পী, আরেকজন অমর পদ্য শিল্পী – দুজনেই তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রাম বাংলাকে দেখেছিলেন; দুজনের লেখনীর আঙ্গিকে এক অপরূপ সাদৃশ্য আমরা খুঁজে পাই। আমরা এখানে ‘পথের পাঁচালী’ অংশ বিশেষ তুলে ধরলাম একটি দৃষ্টান্ত রূপে, যেখানে রবীন্দ্রকাব্যের সুরটিও আমরা খুঁজে পাই।   
    বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালীর’ ছোট্ট নায়ক অপু তার বাবা হরিহরের সঙ্গে যশড়া-বিষ্ণুপুরের নিশ্চিন্দিপুরের গ্রামের রাস্তায় অপরাহ্ন বেলায় বেড়াতে বেড়িয়েছে এবং বাবার হাত ধরে প্রকৃতিকে চিনতে শিখিয়েছে- তার একটি উদ্ধৃতি এখানে দেওয়া হলঃ- ‘মাঠের ঝোপঝাপগুলো উলুখড়, বনকলমী, সোদাল ও কুলগাছে ভরা। কলমীলতা সারা ঝোপগুলোর মাথা বড় বড় সবুজ পাতা বিছাইয়া ঢাকিয়া দিয়াছে- ভিতরে স্নিগ্ধ ছায়া, ছোট গোয়ালে নাটাকাঁটা ও নীল বন- অপরাজিতা ফুল সূর্যের আলোর দিকে মুখ উঁচু করিয়া ফুটিয়া আছে, পড়ন্ত বেলার ছায়ায় স্নিগ্ধ বনভূমির শ্যামলতা; পাখীর ডাক, চারিধারে প্রকৃতির মুক্ত হাতে ছাড়ানো ঐশ্বর্য, রাজার মত ভাণ্ডার বিলাইয়া দান, কোথাও এতটুকু দারিদ্র্যের আশ্রয় খুঁজিবার চেষ্টা নাই, মধ্যবিত্তের কার্পণ্য নাই। বেলাশেষের ইন্দ্রজালের মাঠ, নদী, বন মায়াময়।”১৮
কিশোর বেলার অপু আবারও কোনসময় তাদের জীর্ণ ঘরের জানালায় বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করে: “জানালায় বসিয়া শুধু চোখে পড়ে সবুজ সমুদ্রের ঢেউএর মত ভাঁটশেওড়া গাছের মাথাগুলো, এগাছে ওগাছে দোদুল্যমান কত রকমের লতা, প্রাচীন বাঁশঝাড়ের শীর্ষ বয়সের ভারে যেখানে সোঁদালি, বন-চাল্‌তা গাছের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে, তাহার নীচের কালো মাটির বুকে খঞ্জন পাখীর নাচ! বড় গাছপালার তলায় হলুদ, বনকচু, কচুওলের ঘন সবুজ জঙ্গল ঠেলাঠেলি করিয়া সূর্যের আলোর দিকে মুখ ফিরাইতে প্রাণপণ করিতেছে ......................... আর্দ্র সুগন্ধ মাখানো পৃথিবীটা তাহার সকল সৌন্দর্যরহস্য, বিপুলতা লইয়া ধীরে ধীরে আড়ালে মিলাইয়া চলিয়াছে।”১৯   
বিভূতিভূষণের অপু আর রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ গল্পের বোহেমিয়ান কিশোর তারাপদ কখন যেন মিলে মিশে এক হয়ে গেছে সাহিত্যের দর্পণে। “তারাপদ নৌকার ছাদের উপরে পালের ছায়ায় গিয়া আশ্রয় লইল। পর্যায়ক্রমে ঢালু সবুজ মাঠ, প্লাবিত পাটের খেত, গাঢ় শ্যামল আমনধানের আন্দোলন, ঘাট হইতে গ্রামাভিমুখী সংকীর্ণ পথ, ঘন বন বেষ্টিত ছায়াময় গ্রাম তাহার চোখের উপর আসিয়া পড়িতে লাগিল। এই জল স্থল আকাশ, এই চারিদিকে সচলতা সজীবতা মুখরতা, এই ঊর্ধ-অধোদেশের ব্যাপ্তি এবং বৈচিত্র্য এবং নির্লিপ্ত সূদূরতা, এই সুবৃহৎ চিরস্থায়ী নির্নিমেষ বাক্যবিহীন বিশ্বজগৎ তরুণ বালকের পরমাত্মীয় ছিল; অথচ সেই এই চঞ্চল বালকটিকে এক মূহুর্তের জন্যও স্নেহবাহু দ্বারা ধরিয়া রাখিতে চেষ্টা করিত না। নদীতীরে বাছুর লেজ তুলিয়া ছুটিতেছে, গ্রাম্য টাট্টুঘোড়া সম্মুখের দুই দড়ি-বাঁধা পালাইয়া লাফ দিয়া ঘাস খাইয়া বেড়াইতেছে, মাছরাঙা জেলেদের জাল বাঁধিবার বংশদণ্ডের উপর হইতে ঝপ্ করিয়া সবেগে জলের মধ্যে ঝাঁপাইয়া মাছ ধরিতেছে, জেলেরা জলের মধ্যে পড়িয়া মাতামাতি করিতেছে, মেয়েরা উচ্চকণ্ঠে সহাস্য গল্প করিতে করিতে আবক্ষ জলে বসনাঞ্চল প্রসারিত করিয়া দুই হস্তে তাহা মার্জন করিয়া লইতেছে, কোমর বাঁধা মেছুলিয়া চুপড়ি লইয়া জেলেদের নিকট হইতে মাছ কিনিতেছে, এ সমস্তই সে চিরনূতন অশ্রান্ত কৌতুহলের সহিত বসিয়া বসিয়া দেখে, কিছুতেই তাহার দৃষ্টির পিপাসা নিবৃত্ত হয় না।”২০
    বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন উপন্যাসে চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে প্রকৃতির পরিবেশে, সৌন্দর্য-মাখানো গহন অরণ্যের পরতে পরতে, কখনও বা নদীর ধারে গ্রাম-বসতির বুকের মাঝারে। তাই ‘আরণ্যকের’ মঞ্চী, কুন্তা, ভানুমতী, রাজুপাঁড়ে, গনু মাহাতো, গনোরী তিওয়ারী, এত প্রাণবন্ত, এত বাস্তব হয়ে উঠেছে লেখকের লেখনীতে। অন্যদিকে ভবানী বাঁড়ুজ্যে, তিলোত্তমা, নীলনয়না, স্বরবালা, তাদের ছেলে খোকাকে ঘিরে ইছামতীর নদীর ধারে গড়ে উঠেছে এক অশ্রু-মধুরকাহিনী। যশোর জেলার ছোট্ট গ্রামের অনাবিল রূপটি ধরা পড়েছে “মাদার গাছের লাল ফুলে, বুনো তিৎপল্লা লতার শোভায় বা উঁচু পাড়ের প্রাচীন  বট-অশ্বত্থের ছায়াভরা উলুটি-বাচড়া-বৈঁচির ঝোপে, বাঁশ ঝাড় গাঙশালিখের গর্তে, সুকুমার লতাবিতানের মধ্যে।”২১ 
    এই যে বাংলা প্রকৃতির বিশদ চিত্র এবং বিচিত্র বর্ণনা, এই বৈচিত্র্য আমরা পাই জীবনানন্দ দাসের ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ কবিতায়, যেখানে কবি বলেছেন:
        “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
        খুঁজিতে যাইনা আর; অন্ধকারে জেগে ওঠে ডুমুরের গাছ
        চেয়ে দেখি ছায়ার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে
        ভোরের দয়েলপাখি-চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
        জাম-বট-কাঁঠালের হিজলের অশত্থের করে আছে চুপ;
        ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;
        মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
        এমনই হিজল বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার
        অপরূপ রূপ দেখেছিলো;”২২
অথবা        ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায়
        “আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে-এই বাংলায়
        হয়তো মানুষ নয় -হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
        হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
        কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল- ছায়ায়;
        ..... আবার আসিব আমি বাংলার নদীর মাঠ খেত ভালোবেসে
        জলঙ্গীর ঢেউএ ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙ্গায়
        হয়তো দেখিব চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে
        হয়তো শুনিব এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে।”২৩
জীবনানন্দ দাসের কাব্যমালার প্রতিচ্ছবি পরিস্ফুট হতে দেখি আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই অংশগুলিতে:
        “গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ আমর মন ভুলায়রে
    ওরে কার পানে মন হাত বাড়িয়ে লুটিয়ে যায় ধুলায়রে ||
    ও যে আমার ঘরের বাহির করে, পায়ে পায়ে পায়ে ধরে–
    ওযে কেড়ে আমায় নিয়ে যায় রে, যায় রে কোন্ চুলায় রে।
    ও যে কোন্ বাঁকে কী ধন দেখাবে, কোন্‌খানে কী দায় ঠেকাবে –
    কোথায় গিয়ে শেষ মেলে যে ভেবেই না কুলায় রে ||”২৪

অথবা
    “এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়।
    শালের বনে খ্যাপা হাওয়া, এই তো আমার মনকে মাতায়
    রাঙা মাটির রাস্তা বেয়ে হাটের পথিক চলে ধেয়ে,
    ছোটো মেয়ে ধূলায় বসে খেলার ডালি একলা সাজায়
    সামনে চেয়ে এই যা দেখি চোখে আমার বীণা বাজায়
    আমার এ যে বাঁশের বাঁশি, মাঠের সুরে আমার সাধন
    আমার মনকে বেঁধেছে রে এই ধরণীর মাটির বাঁধন।
    .........................................................................”২৫
 
উপসংহার
     কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে ছিলেন কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, দার্শনিক, রাজনীতিজ্ঞ ও সৌন্দর্যসন্ধানী। তাঁর অসামান্য প্রতিভাকে সামান্য লেখনীর কয়েক ছত্রের মধ্যে পরিস্ফুট করা এক দুরূহ কাজ। বর্তমান প্রবন্ধে কবির প্রকৃতিপ্রেমী এবং মানবপ্রেমী হৃদয়ের একটি প্রতিচ্ছায়াকে প্রতিভাত করার এক সামান্য প্রচেষ্টা করা হয়েছে। প্রকৃতি, পরিবেশ, সৌন্দর্যবোধ ও মানবতাবোধের সমন্বয়টি তুলে ধরার এক অঙ্গীকার নেওয়া হয়েছে এই প্রবন্ধে। সেইসঙ্গে সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও কবি জীবনানন্দ দাসের কিছু সাহিত্য-রচনার সঙ্গে কবিগুরুর রচনা সামগ্রীয় সাদৃশ্য অনুসন্ধান করার এক প্রয়াস করা হয়েছে। 
    বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জীবনানন্দ দাস দুজনেই তাঁদের নান্দনিক সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে রূপসী বাংলার অনাবিল সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছেন এক গভীর জীবনবোধ এবং অনুভূতির সাহায্যে। দুজনের লেখাতেই আমরা পাই গ্রাম বাংলার স্নিগ্ধ-শ্যামল রূপটি-সোঁদা গন্ধে ভরা মাটির ছোঁওয়া। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালীতে’ ছোট্ট অপু আর তার দুগ্‌গা দিদি সারাদিন মেঠো পথে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে জোগাড় করে কোঁচড় ভরা কাঁচা আম, মেটে আলু, বনকল্‌মী, ডুমুর, পাতালকোঁড়-তাদের দরিদ্র গৃহস্থালীর সংস্থান করেন মা সর্বজয়া এইসব দিয়েই। অপু-দুর্গা ঘুরে ঘুরে রেলের রাস্তা খোঁজে, বনের মাঝে সামান্য উপকরণে বনভোজনের জোগাড় করে, কখনও বা অপু শকুনির ডিম খুঁজে পেয়ে আহ্লাদিত হয়। জীবনানন্দ দাস বাংলার রূপ দেখে এতই বিহ্বল যে বার বার ফিরে আসতে চান এই বাংলায়-হয়তো ভোরের কাক হয়ে, শঙ্খচিল হয়ে, হাঁস হয়ে কল্‌মীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে জলঙ্গীর আঘ্রান নিতে চান প্রাণ ভরে। তিনি মনে করেন কখনও বা লক্ষ্মীপেঁচার ডাকে, ধবল বকের ভিড়ে তাঁকে হয়তো বা খুঁজে পাবে আগামী দিনের মানুষ। দুই সাহিত্যিকই খঞ্জনা পাখীর নাচে, দয়েল পাখীর গানে নিজেদের হৃদয় মেলে দিতে পেরেছেন। দুই সাহিত্যিকই বাঁশবন, কাঁঠাল, হিজল, বনকলমী, বনকচুর সবুজ ছায়ায় ভরা গ্রামবাংলার সাধারণ গৃহস্থালীকে ভালবেসেছেন। তাই, পথের পাঁচালীতে শত দারিদ্র্যের মধ্যেও অপু-দুর্গা বেড়ে উঠেছিল বনচাল্‌তা, বনকলমী আর সোদালের গন্ধ ভরা প্রকৃতির সঙ্গে সুর মিলিয়ে; রূপসী বাংলার কবি খইএর ধান ছড়ানো উঠানে, কিশোরীর লাল পায়ের ঘুঙুরের ছন্দে বা ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে গভীর আনন্দের স্বাদ পেয়েছিলেন।
    বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও জীবনানন্দ দাস রূপসী বাংলাকে ভালোবেসেছিলেন অন্তর দিয়ে-তাই বোধকরি তার এত খুঁটিনাটি বর্ণনাকে তাঁরা লিপিবদ্ধ করেছেন সুনিপুণ লেখনীতে। বাংলা প্রকৃতির পরতে পরতে যে এত সৌন্দর্য, এত নিবিড়তা, এত মায়া-তা একমাত্র বিভূতিভূষণ ও জীবনানন্দর লেখনীতেই লালিত্য পেয়েছে, নন্দনীয় হয়ে উঠেছে। কবি রবীন্দ্রনাথও তেমন করেই ভালবেসেছিলেন এই বাংলার মাঠ, ঘাট, নদী, ফুল-পল্লবকে। আমরা তার বিশদ বর্ণনা পেয়েছি উপরোক্ত অংশে তাঁর বিভিন্ন কাব্য কবিতায়। বাংলার মানুষের ব্যথা, যন্ত্রণা, অসহায়তাও বাঙময় হয়ে উঠেছে তাঁর কাব্য-কবিতায়, ছোটগল্পে। এঁরা সবাই ছিলেন জীবন-মুখী কবি সাহিত্যিক, তাই রূপসী বাংলাকে, হতশ্রী বাংলাকে তাঁরা ভালবেসেছিলেন তার দোষ-গুণ, রূপ-গন্ধ নিয়েই।২৬ মূলত: রবীন্দ্রকাব্যের প্রকৃতি ও পরিবেশের এই ভাবব্যঞ্জনা নিয়ে এই অনুসন্ধান মূলক প্রবন্ধটি উপস্থাপনা করা হয়েছে। 

সূত্র নির্দেশিকা
১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৩১৯, ছিন্নপত্র, আদি ব্রাহ্ম-সমাজ প্রেস, পৃ: ৯৮
২। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০০২, সঞ্চয়িতা, পুনশ্চ সংস্করণ, মানসী, ‘মেঘদূত’ পৃ: ৪৮-৫১
৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০০২, গীতবিতান, পুনশ্চ সংস্করণ, পৃ: ৩১৮
৪। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩১৯, ছিন্নপত্র, আদি ব্রাহ্ম-সমাজ প্রেস, পৃ: ১৪৮
৫। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০০২, সঞ্চয়িতা, পুনশ্চ সংস্করণ, সোনার তরী, ‘সোনার তরী’, পৃ: ৫৪
৬। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০০২, সঞ্চয়িতা, পুনশ্চ সংস্করণ, ‘ক্ষণিকা’–পৃ: ২৬৬ 
৭। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০০২, গীতবিতান, পুনশ্চ সংস্করণ, ‘ক্ষণিকা’ পৃ: ৩৩৭
৮। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩১৯, ছিন্নপত্র, আদি ব্রাহ্ম-সমাজ প্রেস, পৃ: ৭০
৯। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০০২, গীতবিতান, পুনশ্চ সংস্করণ, পৃ: ৩৩৭
১০। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩১৯, ছিন্নপত্র, আদি ব্রাহ্ম-সমাজ প্রেস, পৃ: ৩৩৬
১১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০০২, গীতবিতান, পুনশ্চ সংস্করণ, পৃ: ৩৩৬
১২। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩১৯, ছিন্নপত্র, আদি ব্রাহ্ম-সমাজ প্রেস, পৃ: ১০৮
১৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০০২, গল্পগুচ্ছ পুনশ্চ সংস্করণ, ‘পোষ্টমাষ্টার’, পৃ: ১০-১৩
১৪। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩১৯, ছিন্নপত্র, আদি ব্রাহ্ম-সমাজ প্রেস, পৃ: ১৩৭
১৫। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০০২, সঞ্চয়িতা, চিত্রা, ‘এবার ফিরাও মোরে’, পুনশ্চ সংস্করণ, পৃ: ১৩০
১৬। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩১৯, ছিন্নপত্র, আদি ব্রাহ্ম-সমাজ প্রেস, পৃ: ২০১
১৭। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০০২, গীতবিতান, পুনশ্চ সংস্করণ, পৃ: ৫৪
১৮। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৩৮২, ‘পথের পাঁচালী’, শনিরঞ্জন প্রেস, কলিকাতা, পৃ: ৩৩-৩৪
১৯। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৩৮২, ‘পথের পাঁচালী’, শনিরঞ্জন প্রেস, কলিকাতা, পৃ: ১০৯
২০। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০০২, গল্পগুচ্ছ, পুনশ্চ সংস্করণ, ‘অতিথি’, পৃ: ১৮৯
২১। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৩৮৮, শ্রীধর প্রিণ্টিং ওয়ার্কস কলিকাতা, ইছামতী, পৃ: ১
২২। জীবনানন্দ দাস, ১৯৬৩, দেশবাণী মুদ্রনিকা, কলকাতা, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’, পৃ: ৪৬
২৩। জীবনানন্দ দাস, ১৯৬৩, দেশবাণী মুদ্রনিকা, কলকাতা, ‘আবার আসিব ফিরে’, পৃ: ৪৭
২৪। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০০২, গীতবিতান ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’, পৃ: ৩৮৩
২৫। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০০২, গীতবিতান ‘এই তো ভালো লেগেছিল’, পৃ: ৩৮৩
২৬। তপতী দাশগুপ্ত, ২০১৭, শারদ উৎসব-আবাহন, ডি.ভি.সি, মায়াপুর, খড়গপুর, ‘রূপসী বাংলার প্রেক্ষাপটে: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও জীবনানন্দ দাস’ পৃ: ২-৩  

লেখিকা পরিচিতি: 
ড. তপতী দাশগুপ্ত    প্রাক্তন পরামর্শ বিশেষজ্ঞ, আর্কিটেকচার ও রিজিওন্যাল প্ল্যানিং বিভাগ, আই. আই. টি. খড়গপুর। প্রাক্তন গেস্ট্ ফ্যাকাল্টী, ইতিহাস  বিভাগ, মেদিনীপুর কলেজ (পি.জি., স্ব-শাসিত), মেদিনীপুর।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments