জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত/ পর্ব-১৫/সুদর্শন নন্দী

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত     
পর্ব-১৫

সুদর্শন নন্দী 

২৫শে জুন,১৮৮৬। রথযাত্রার দিন ঠাকুর ভক্তদের সঙ্গে ঈশানের বাড়িতে। আচার্য হওয়া নিয়ে কথা হচ্ছে। ঠাকুর বললেন-যে পণ্ডিতের বিবেক নাই, সে পণ্ডিতই নয়।
যদি আদেশ হয়ে থাকে, তাহলে লোকশিক্ষায় দোষ নাই। আদেশ পেয়ে যদি কেউ লোকশিক্ষা দেয়, তাকে কেউ হারাতে পারে না। এবার উপমা সহকারে বোঝালেন তিনি। বললেন-
বাগ্বাদিনীর কাছ থেকে যদি একটি কিরণ আসে, তাহলে এমন শক্তি হয় যে, বড় বড় পণ্ডিতগুলো কেঁচোর মতো হয়ে যায়।
প্রদীপ জ্বাললে  বাদুলে পোকাগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে আপনি আসে — ডাকতে হয় না। তেমনি যে আদেশ পেয়েছে, তার লোক ডাকতে হয় না; অমুক সময়ে লেকচার হবে বলে, খবর পাঠাতে হয় না। তার নিজের এমনি টান যে লোক তার কাছে আপনি আসে। তখন রাজা, বাবু, সকলে দলে দলে আসে। আর বলতে থাকে আপনি কি লবেন? আম, সন্দেশ, টাকা-কড়ি, শাল — এই সব এনেছি; আপনি কি লবেন? আমি যে সকল লোককে বলি, ‘দূর কর — আমার ও-সব ভাল লাগে না, আমি কিছু চাই না।’
এবার চুম্বকের উপমা টেনে বললেন-চুম্বক পাথর কি লোহাকে বলে, তুমি আমার কাছে এস? এস বলতে হয় না,— লোহা আপনি চুম্বক পাথরের টানে ছুটে আসে।
 তবে যে আদেশ পেয়েছে তার জ্ঞানের শেষ নাই। সে জ্ঞান ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে, — ফুরায় না।
আবার একটি উপমা দিয়ে বললেন-ও-দেশে ধান মাপবার সময় একজন মাপে, আর-একজন রাশ ঠেলে দেয়; তেমনি যে আদেশ পায় সে যত লোকশিক্ষা দিতে থাকে, মা তাহার পেছন থেকে জ্ঞানের রাশ ঠেলে ঠেলে দেন। সে-জ্ঞান আর ফুরায় না। 
আবার আচার্যের বিষয় হতে হতে তিন বৈদ্যের উদাহরণ দিলেন ঠাকুর। বললেন-
তিনরকম বৈদ্য আছে। একরকম — তারা নাড়ী দেখে ঔষধ ব্যবস্থা করে চলে যায়। রোগীকে কেবল বলে যায়, ঔষধ খেয়ো হে। এরা অধম থাকের বৈদ্য। সেইরূপ কতকগুলি আচার্য উপদেশ দিয়ে যায়, কিন্তু উপদেশ লোকের ভাল হল কি মন্দ হল তা দেখে না। তার জন্য ভাবে না।
কতকগুলি বৈদ্য আছে, তারা ঔষধ ব্যবস্থা করে রোগীকে ঔষধ খেতে বলে। রোগী যদি খেতে না চায়, তাকে অনেক বুঝায়। এরা মধ্যম থাকের বৈদ্য। সেইরূপ মধ্যম থাকের আচার্যও আছে। তাঁরা উপদেশ দেন, আবার অনেক করে লোকদের বুঝান যাতে তারা উপদেশ অনুসারে চলে। আবার উত্তম থাকের বৈদ্য আছে। মিষ্ট কথাতে রোগী যদি না বুঝে, তারা জোর পর্যন্ত করে। দরকার হয়, রোগীর বুকে হাঁটু দিয়ে রোগীকে ঔষধ গিলিয়ে দেয়। সেইরূপ উত্তম থাকের আচার্য আছে। তাঁরা ঈশ্বরের পথে আনবার জন্য শিষ্যদের উপর জোর পর্যন্ত করেন।
এ উপমা শুনে  পণ্ডিত জিজ্ঞাসা করলেন-মহাশয়, যদি উত্তম থাকের আচার্য থাকেন, তবে কেন আপনি সময় না হলে জ্ঞান হয় না, এ-কথা বললেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তর দিলেন—সত্য বটে। কিন্তু মনে কর, ঔষধ যদি পেটে না যায় — যদি মুখ থেকে গড়িয়ে যায়, তাহলে বৈদ্য কি করবে? উত্তম বৈদ্যও কিছু করতে পারে না।
ঠাকুর  ঐদিন কথাচ্ছলে ঈশানকে উপদেশ দিলেন-পিঁপড়ের মতো সংসারে থাক, এই সংসারে নিত্য অনিত্য মিশিয়ে রয়েছে। বালিতে চিনিতে মিশানো — পিঁপড়ে হয়ে চিনিটুকু নেবে।
জলে-দুধে একসঙ্গে রয়েছে। চিদানন্দরস আর বিষয়রস। হংসের মতো দুধটুকু নিয়ে জলটি ত্যাগ করবে।
আর পানকৌটির মতো। গায়ে জল লাগছে, ঝেড়ে ফেলবে। আর পাঁকাল মাছের মতো। পাঁকে থাকে কিন্তু গা দেখ পরিষ্কার উজ্জ্বল।
গোলমালে মাল আছে — গোল ছেড়ে মালটি নেবে।
আহা, এমন উপযুক্ত উপমা ঠাকুর ছাড়া আর কে দেবেন।
১৮৮৪, ৩০শে জুন। দক্ষিণেশ্বরে বাবুরাম, রাখাল, মাস্টার, হাজরা, লাটু, শশধর রয়েছেন।
ঠাকুর বলছেন-শুধু জ্ঞানী একঘেয়ে, — কেবল বিচার কচ্চে ‘এ নয় এ নয়, — এ-সব স্বপ্নবৎ।’ আমি দুহাত ছেড়ে দিয়েছি, তাই সব লই।
এবার উপমা হিসেবে একটি গল্প বললেন তিনি। একজন ব্যানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। ব্যান তখন সুতা কাটছিল, নানারকমের রেশমের সুতা। ‘ব্যান’ তার ব্যানকে দেখে খুব আনন্দ করতে লাগল; — আর বললে — ‘ব্যান, তুমি এসেছ বলে আমার যে কি আনন্দ হয়েছে, তা বলতে পারি না, — যাই তোমার জন্য কিছু জলখাবার আনিগে।’ ব্যান জলখাবার আনতে গেছে, — এদিকে নানা রঙের রেশমের সুতা দেখে এ-ব্যানের লোভ হয়েছে। সে একতাড়া সুতা বগলে করে লুকিয়ে ফেললে। ব্যান জলখাবার নিয়ে এল; — আর অতি উৎসাহের সাথে — জল খাওয়াতে লাগল। কিন্তু সুতার দিকে দৃষ্টিপাত করে বুঝতে পারলে যে, একতাড়া সুতো ব্যান সরিয়েছেন। তখন সে সুতোটা আদায় করবার একটা ফন্দি ঠাওরালে। সে বলছে, ‘ব্যান, অনেকদিনের পর তোমার সাথে সাক্ষাৎ হল। আজ ভারী আনন্দের দিন। আমার ভারী ইচ্ছা কচ্ছে যে দুজনে নৃত্য করি।’ সে বললে — ‘ভাই, আমারও ভারী আনন্দ হয়েছে।’ তখন দুই ব্যানে নৃত্য করতে লাগল। ব্যান দেখলে যে, ইনি বাহু না তুলে নৃত্য করছেন। তখন তিনি বললেন, ‘এস ব্যান দুহাত তুলে আমরা নাচি, — আজ ভারী আনন্দের দিন।’ কিন্তু তিনি একহাতে বগল টিপে আর-একটি হাত তুলে নাচতে লাগলেন! তখন ব্যান বললেন, ‘ব্যান ওকি! একহাত তুলে নাচা কি, এস দুহাত তুলে নাচি। এই দেখ, আমি দুহাত তুলে নাচছি।’ কিন্তু তিনি বগল টিপে হেসে হেসে একহাত তুলেই নাচতে লাগলেন আর বললেন, ‘যে যেমন জানে ব্যান!’
আমি বগলে হাত দিয়ে টিপি না, — আমি দুহাত ছেড়ে দিয়েছি — আমার ভয় নাই। তাই আমি নিত্য-লীলা দুই লই।”
কি অসাধারণ উপমা এবং ব্যাখ্যা ঠাকুরের।
১৮৮৪, ৩রা আগস্ট। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে মধ্যাহ্ন সেবার পর ভক্তসঙ্গে বসে আছেন। বেলা দুটা। সাকারবাদীদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ঠাকুর বললেন- 
ব্রহ্মজ্ঞানের পরও যারা সাকারবাদী তারা লোকশিক্ষার জন্য ভক্তি নিয়ে থাকে। যেমন কুম্ভ পরিপূর্ণ হল, অন্য পাত্রে জল ঢালাঢালি করছে।
এবার ঝুড়ি-কোদালের উপমা দিয়ে বোঝালেন যে  এরা যে-সব সাধনা করে ভগবানকে লাভ করেছে, সেই সকল কথা লোকশিক্ষার জন্য বলে— তাদের হিতের জন্য। জলপানের জন্য অনেক কষ্টে কূপ খনন করলে — ঝুড়ি-কোদাল লয়ে। কূপ হয়ে গেল, কেউ কেউ কোদাল, আর আর যন্ত্র কূপের ভিতরেই ফেলে দেয় — আর কি দরকার! কিন্তু কেউ কেউ কাঁধে ফেলে রাখে, পরের উপকার হবে বলে।
কেউ আম লুকিয়ে খেয়ে মুখ পুঁছে! কেউ অন্য লোককে দিয়ে খায় — লোকশিক্ষার জন্য আর তাঁকে আস্বাদন করবার জন্য। 
১৮৮৪, ৭ই সেপ্টেম্বর। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে রাম, বাবুরাম, মাস্টার, চুনি, অধর, ভবনাথ, নিরঞ্জন প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে কথা বলছেন।
সাধন শেষের বিষয়ে কথা হচ্ছে। ঠাকুর বললেন-একজন বাউল এসেছিল। তা আমি বললাম, ‘তোমার রসের কাজ সব হয়ে গেছে? — খোলা নেমেছে?’ যত রস জ্বাল দেবে, তত রেফাইন (refine) হবে। প্রথম, আকের রস — তারপর গুড় — তারপর দোলো — তারপর চিনি — তারপর মিছরি, ওলা এই সব। ক্রমে ক্রমে আরও রেফাইন হচ্ছে।
খোলা নামবে কখন? অর্থাৎ সাধন শেষ হবে কবে? — যখন ইন্দ্রিয় জয় হবে — যেমন জোঁকের উপর চুন দিলে জোঁক আপনি খুলে পড়ে যাবে — ইন্দ্রিয় তেমনি শিথিল হয়ে যাবে।                  (ক্রমশঃ)


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments