জ্বলদর্চি

অ্যাপের নাম বাবাজী-৫/ বাসুদেব গুপ্ত

অ্যাপের নাম বাবাজী 
লেখক বাসুদেব গুপ্ত
৫ম পর্ব  

তোমার হল শুরু, আমার হল সারা, এই গানটা রুপমের খুব প্রিয়। ওর নামে একজন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী আছেন। কিন্তু আমাদের রূপম এই সহজ গানও গেয়ে উঠতে পারে না। আমার হলোতে খাদে যে নেমে যায় আর সা তে ফেরা হয়না। 
তাই রূপম অ্যান্ড গ্রুপের শুরু হলেও, আমার হলো সারা নয়। নটে গাছটিও মুড়োয় নি বরং লক লক করে বেড়ে উঠেছে। এই গল্প সত্যি বলতে এখন শুরু হলো। এখন অনেক কিছু ঘটবে যা এই সাধারণ লেখকের ইন্টেলিজেন্সের বাইরে। এ আই বেড়ে ওঠে সিলিকনের চিপের জগতে। কোনদিন সে কি বুঝতে পারে এই কাদামাটিঘাস ও শস্যক্ষেত্রে বেড়ে ওঠা মানুষের জীবনের অসহায়তা ও তীব্র বেদনা? মনে হয় না। এ আই যে কখন কি করে তা কে জানে। চলুন দেখি কি হচ্ছে রূপমের নতুন জগতে।

হয়েছে অনেক কিছু। রূপম একটি গাড়ী কিনেছে ডাউন পেমেন্ট করে কম্পানির নামে। এস ইউ ভি। সে গাড়ী নাকি সাধারণ গাড়ীর থেকে মজবুত, চলতে পারে যে কোন রাস্তায়। রূপম সারা দিন গাড়িতে চরকি পাক খায়। এছাড়া কলকাতার প্রান্তে ইলেকট্রনিক সিটিতে ভাড়া করেছে ১০০ সিটের ওয়ারক স্পেস। তার সংগে ১০০০ স্কোয়ার ফুটের এডমিন উইং। অর্ণব হয়েছে প্রোগ্রাম ম্যানেজার। রতু বসে গেছে এইচ আরের চেয়ারে আর লোকির কাজ কাস্টমার সাপোর্ট। এসব ব্যাপার নিয়ে বাংলায় খুব একটা লেখা হয় না। বাঙ্গালীরা যেন রসগোল্লা খায়, ডুয়ার্সে বেড়াতে যায় আর জটিল সব প্রেম করে ফেল করে কবিতা লিখে নেটে ভরিয়ে দেয়। আসল জগতে এসব নিয়ে নতুন জেন এত মাথা ঘামায় না। রোজ ব্রেক আপ হয়, ফেসবুকে স্টেটাস বদলায়। কিছুদিন নেট ঘেঁটে করুণ কোটেশন কণ্টকিত পোস্টে ভরে যায় স্টেটাস। তারপর যে কে সেই। সারাদিনেই কাজ চলে। ইমেল ২৪ ঘণ্টা আস্তে থাকে। সবসময় কি হবে কি হবে ভাব। অফিস যাওয়া একটা ক্যালকুলাসের অংশের মত কঠিন। একদিকে মাস্ক ও সোশ্যাল ডিসট্যান্স। অন্যদিকে বাস নেই ট্রেন নেই যে যা খুশিভাড়া হাঁকাটা এপক্যাব এখন জলচল করে দিয়েছে।
যত অশান্তি যত অনিশ্চয়তা তত লোকের বাজী ধরার ইচ্ছে বাড়তেই থাকে। সংগে বাড়তে থাকে বাবাজীর বিজনেস। সবাই বাইক কিনে ফেলে। আর বাবাজীর ১০০ জন কর্মী চালাতে থাকে এ আই এর চাকা। 
শিখা কিন্তু পুরনো কাজ ছাড়ে নি। বুদ্ধিমান। জানে স্টারট আপ বেশির ভাগই হাউইএর মত স্পীডে আকাশে ওঠেতা রপর একদিন হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ে। রূপমকে ও দেখে আর ওর বুকটা কাঁপে। পুরুষ মানুষ। ইগো আর ম্যাচো এই দুই তাদের মাথায় দুই ফুলঝুরির মত সারাক্ষণ জ্বলে। ওটা না থাকলে ঐ আগুন নিভে গেলে ভিজে তুবড়ির মত মুখ করে ঘুরে বেড়াবে আবার সেটা  শিখার মোটেও পছন্দ না। অগত্যা ও এখন কনসালটেন্ট হিসেবে আছে। এতে ও রনিজের কম্পানিরও লাভ। ওরও দুদিকেই লাভ। আজকাল রূপমের আদর করার ইচ্ছেও বেড়ে গেছে। এবং তা কখন মাথা চাড়া দেয় বলা মুস্কিল। 
একটু আগে ঘুম থেকে উঠেছে রূপম। রাত তিনটে পর্যন্ত মিটিং চলেছে ইনভেস্টরদের সংগে। তারা খুব খুশি কম্পানির প্রোগ্রেস দেখে। আরো ইনভেস্ট করার জন্য তৈরী যদি আরো লাভ দেখানো যায়। কতগুলো আইডিয়া এসেছে মিঃ যোশীর থেকে। আজ আবার ফোনে তাই নিয়ে আলোচনা হবে। 
প্রায় এগারোটা।  শিখা কখন তৈরী হয়ে চলে গেছে। অলস পায় উঠে কফি বানায় রূপম। এরাবিকা কফির সুবাসে ঘরটা ভরে যায়। তারপর ফোনটা নিয়ে চেক করে কোন জরুরী মেসেজ আছে কিনা। 
বেশির ভাগ মেসেজ অর্ণবের পাঠানো। কাল কি কি বেট হয়েছে। কতজন বেট ধরেছে, কতজন জিতেছে, টোটাল আর্নিং কত। একদিনে প্রায় ২০ লাখ প্রফিট। মন্দ কি? বেশির ভাগ স্টারট আপ তো লাল থেকে কালোতেই পৌঁছতে পারে না আর দিনে দিনে ডুবে যায় ঋণে।

ফোন বাজে প্রসূনের। 
-কি ঘুম ভাঙলো? ওয়ার্ক আউট করবে না?
মৃদু হাসি আসে ওর। প্রসূন এখন বসেছে মার্গারিটা নিয়ে। সংগে ভেরা। পঁচিশ বছরের ভরা যুবতী। ওয়ার্ক আউট করা চেহারা। রূপমের সময় কই? চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়ে এখনই দৌড়তে হবে। সি ই ও বলে কথা।
-না প্রসূন। টাইম কই? এক্ষুনি আবার এডের লোকজনের সংগে বসতে হবে। এবারের কুস্তি চ্যামপিয়ন রজনী ঘোটালে রাজি হয়েছে বাবাজীর এম্বাসাডার হতে। 
-শরীরটার দিকে নজর দিও। স্মোকিং করো না তো?
-নানা কোনদিন করি নি।
-এলকোহল? একটু ওয়াইন খেতে পারো সন্ধে বেলা। হার্ড লিকার একদম না
-না না সব আমার সহ্য হয় না। আমার লাইম সোডাতেই নেশা হয়ে যায়। 
-খুব ভালো। অবশ্য তোমার তো নেশা একটা আছেই। মিস সান্যাল?
-না না। নেশা হবে কেন।  শিখা আমার ফ্রেন্ড আর টেকনিকাল গুরু। ওর তৈরী এলগরিদমেই তো চলছে।
-খুব ভালো। তবে এবারে একটু চেঞ্জ হোক না এলগরিদমে? ROI নিয়ে এঞ্জেলরা একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। 
-ওরা তো মিটিংএ বললেন বেশ খুশি সব কিছু দেখে।
-সব কি আর তোমাকে বলবে। আর জানো তো এঞ্জেলদের দাঁত লাগিয়ে দিলেই তারা ভ্যাম্পায়ার হতে কতক্ষণ। 
-কিন্তু
-কিন্তু নয়। কিছু ভাবো। তোমার কনসালটেন্টকেও বল। এক সপ্তাহ সময়। এর মধ্যে প্রফিট কি করে ডাবল করা যায় ভেবে বার করো। নইলে নতুন কনসালটেন্ট দেখতে হবে। 
-কি করি বলুন তো। এড বাড়াবো? তাতে কমিশন আরো বাড়বে। আর কোন রাস্তা দেখছি না 
-আমি একটু হিন্ট দিতে পারি?
যা হিন্ট দিল তাতে রূপমের কান মাথা গরম হয়ে গেল। এও কি সম্ভব? তাড়াতাড়ি কথা সেরে বাথরুমে শাওয়ারের নীচে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ।
 শিখাকে ফোন করে বলতে যা ভাবা হয়েছিল তাই বলল
-এটা তো জোচ্চুরি!
 -না না এটা আমাদের একে বারেই ঠিক হবে না 
 শিখা একেবারেই বেঁকে বসে। 
কাল থেকে রূপম অনেকবার বোঝাবার চেষ্টা করেছে এছাড়া আর উপায় নেই। ইনভেস্টর যা বলবে সেটাই করতে হবে। স্টারট আপের এটাই মজা। ঝনঝন করে পয়সা পড়ছে তো পড়ছেই। বড় ঝকঝকে অফিস, প্রেসে রোজই কোথাও না কোথাও নাম বেরোচ্ছ, নতুন গাড়ী, রোজ মেরিয়টের লাঞ্চ। কিন্তু কথা শুনে চলতে হবে। না হলে একনিমিষেই রাস্তায়। 
-আচ্ছা এটা তো একটা ব্যবসা। আমরা কি সমাজসেবা করছি বিল গেটসের মত? চালাচ্ছি তো একটা ক্যাসিনো। এআই। শুনতে কি সাংঘাতিক বৈজ্ঞানিক একটা কথা। পিএচডি ছাড়া কম্পানিগুলো লোক নেয় না। কাজটা কি? না লোকের ডেটা চুরি করে বার করো আর সেগুলো বিক্রি করো যে পয়সা দেবে তাকে না হয় বিভিন্ন দেশের সরকারকে। না দিলে তারা দেশে ব্যবসা করতে দেবে না। সবাই করছে আমরাও করছি।
আলতো করে  শিখার চুল গুলো চোখের ওপর দিয়ে সরিয়ে দেয় রূপম। তারপরে ধীরে ধীরে বিলি কাটে।  শিখার এটা খুব পছন্দ। খুশি হয়ে মেনে নিতেও পারে।
-না গো আমার ব্যাপারটা ভাল লাগছে না। জোর করে টসের আউটকাম পাল্টিয়ে দেওয়া। চুরি তো। 
-চুরি কেন। ব্যাপারটা সোজা। ম্যাচ ফিক্সিংও হয় না? আমরা সেটাকেই আরো এক লেভেল এগিয়ে নিয়ে যাবোএই তো। ধরো বাজী হলো ক টিম আজ তিন গোল দেবে। আমরা ক টিমের বেস্ট প্লেয়ারকে রিক্রুট করলাম, একে বলে স্ট্র্যাটেজিক রিক্রুটমেন্ট। সে দুটো গোল যদি দিয়ে ফেলে তারপর আর গোল দেবে না। বদলে আমরা তাকে একটা পারসেন্টেজ্ দেবো। এরকম তো হয়েই থাকে। আমরা আরো একটা স্টেপ এগোবো। আমরা আমাদের একটা গ্রুপ তৈরী করবো যাদের কাছে সেদিন সকালে হোয়াটসআপ যাবে, অ্যাপের নাম বাবাজী বাজী নং ৭৮৯ বেট ফেললেই টাকা ডবল হয়ে যাবে।
-আর সেই মেসেজ দেখে তারা বাজী ধরবে । হোয়াটসাপ মেসেজ ট্র্যাক করলে?
-কে করবে? এখন সেলফ ডেস্ট্রাকটিং মেসেজ হয়ে গেছে। কোন ট্রেস থাকবে না। 
-এতে আর কত পয়সা পাবো আমরা?
-আরো আছে। আমরা নিজেরাই বাজী ফেলবো। আমরা তো জানি কারা জিতবে। প্রসূন যোশি ব্যবস্থা করে দেবে লক্ষ লক্ষ ফেক একাউন্টের। বুঝলে? আমরা এভাবে একবছরে  ১০ মিলিয়ন পেরিয়ে যাবো। তারপর ইনভেস্টররা আই পি ও করার কথা ভাববে।
বোঝাতে বোঝাতে রূপমের হাত আরো একটা লেভেল পেরিয়ে যায়।  শিখাকে প্রায় চুপ করানোর চেষ্টায় ঠোঁটের ওপর আলতো করে ভাসিয়ে দেয় ওর চঞ্চল আঙ্গুল। তারপর হাল্কা পাপড়ি যেমন করে হাওয়ায় ভেসে যায় তেমনি করে নিজের ঠোটদুটি নামিয়ে আনে।
 শিখার হাত ওকে জড়িয়ে ধরে। যেমন চুম্বকে তড়িতপ্রবাহ গেলে তা মুহূর্তর মধ্যে চুম্বকে পরিণত হয় কিছুক্ষনের জন্য দুটি মানুষও বিদ্যুচ্চুম্বকে পরিণত হয়। 
অনেক মুহূর্ত পেরিয়ে যায় যার কেউ হিসেব রাখে না। তারপর আস্তে করে ঠেলে  শিখা উঠে বসে পড়ে। আর তার খোলা চুল ঝর্ণার মত রূপমকে ঢেকে দেয়।  শিখা জানে রূপম কতটা বিহ্বল হয়ে এই চুলের বন্যায় আর তার বিচিত্র সুগন্ধে। মায়াবী গলায়  শিখা বলে
-তুমি কি আমাকে বেশি ভালোবাসো না তোমার ঐ যোশি বুড়োকে?
এ কথার জবাব কোন পুরুষ দিতে পারে শুধু একভাবেই। রূপম সেই প্রাচীন গুহামানবের এলগরিদম ব্যবহার করে। দুহাত দিয়ে  শিখার মিষ্টি মুখ ফ্রেম করে ওর বড় বড় বাঙ্গালী মেয়ের চোখে গভীর ভাবে তাকায় আর বলে
-তোমাকে তো-মাকে তোমাকে। 
-তাহলে আমার কথা শোনো। তুমি এই জোচ্চুরির কাজ করো না।
সবারই ঈশ্বর আছে আলাদা আলাদা। এবং সেই ঈশ্বর তাঁর ভক্তদের জন্য যা করেন ভালোই করেন। 
ফোন বাজে। করুণ মুখ করে রূপম তাকায়  শিখার দিকে। চোখে কয়েক হাজার ভোল্টের একটা ফ্ল্যাশ দিয়ে  শিখা বালিশে কান ভাল মত ঢেকে শুয়ে পড়ে।

ক্রমশঃ…

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments