জ্বলদর্চি

ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ- ৫/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

পর্ব – ৫

ঠুমরী শব্দটি এসেছে হিন্দুস্তানী শব্দ 'ঠুমকনা' থেকে। 'ঠুমকনা' শব্দটির অর্থ এক প্রকারের আকর্ষক উদ্দীপনাময় অঙ্গ সঞ্চালনের কৌশল। সুতরাং আক্ষরিক অর্থে ঠুমরি গানের অর্থ সেই ধরনের গান যার সুর ও তান বা ছন্দের মধ্যে এবং গাইবার ঢঙে অন্য ধরনের মাদকতা বা আকর্ষণ আছে।                                            
  
  বেশিরভাগ ঠুমরি গান লেখা হতো ব্রজবুলিতে। এই ব্রজবুলি হল এক বিশেষ ধরনের হিন্দি উচ্চারণ এবং এই ভাষাতে সাধারণতঃ মথুরা ও তার আশেপাশের মানুষজন কথা বলেন। এই ভাষার উচ্চারণ ভঙ্গির সাথে উত্তর ভারতের বৈষ্ণব আন্দোলনের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র ছিল। অন্য একটি সূত্র অনুযায়ী ঠুমরীর জন্ম পবিত্র বৃন্দাবনধামে যেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাধা ও অন্যান্য গোপিনীদের সাথে রাসলীলায় যোগ দিতেন। এই স্বর্গীয় সুষমামণ্ডিত নৃত্যকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সাধকেরা রাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে বিভিন্ন গান ও কাহিনী রচনা করেছেন, যে গানগুলি 'ঠুমক' ছন্দে রচিত হয়েছিল এবং পরে সেগুলিই ঠুমরি গান নামে পরিচিত হয়েছে। প্রাচীনকালে রচিত একটি ঠুমরিতেও ব্রজভাষা ব্যতীত অন্য ভাষায় রচিত হয়নি। এই ভাষায় রচিত ঠুমরি গানের একটি পদের উল্লেখ করছি এখানে যাতে পাঠকের উপলব্ধি হয় ব্রজভাষা কেমন ছিল। " সখি রি, বুঁদ অচানক লাগি, শোভিত হুতি মদনমদ মাতি। ঘন গরজায়ো তবে জাগি দাদর মোর পাপিহা বোলাই, কোমল শব্দ সুহাগি, 'কুম্ভনদাস' লাল গিরিধর সো, জাই মিলি বড়ভাগি"। অর্থাৎ- ও সখি, বৃষ্টি বিন্দু সহসা শুষ্ক মৃত্তিকা স্পর্শ করেছে, যা এতদিন ঘুমিয়ে ছিল এবং বজ্রপাতের শব্দে যেন সে জেগে উঠল। ব্যাঙ ডেকে উঠল, কোকিল ও ময়ুর উচ্ছসিত হয়ে উঠল। তারা যেন গিরিধারীর সঙ্গে আমার মিলন উদযাপন করতেই সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে গান গাইতে লাগলো। আবার যেমন "উড়ি যা পনছি, খবর লা পি কী জাই বিদেশ মিলো পিতম সে কহো বিথা বিরহিন কে জি কী সোনে কী চোঁচ মাধাও মে পন্থি যো  তুম বাত করো মেরে হি কী 'মাধবী' লাও পিয়া কও সন্দেশওয়া জানি বুঝাও বিয়োগিনতি কী"। অর্থাৎ, ও পাখী, আমার এই বার্তা নিয়ে উড়ে যাও সেই দূর দেশে যেখানে আমার প্রিয়তম রয়েছে। তাকে আমার হৃদয়ের যন্ত্রণার কথা বল। আমাকে যদি তুমি প্রতিশ্রুতি দাও যে আমার প্রিয়তমের কাছে গিয়ে তাকে কেবল আমারই কথা শোনাবে তাহলে আমি তোমায় সোনার কন্ঠ বন্ধনী উপহার দেব। তোমার বার্তা আমার বেদনাবিদ্ধ হৃদয়ে শান্তির প্রলেপ দেবে।              

  এই ঠুমরি গান যারা গাইতেন তাদের শুধুমাত্র রাগ, তাল বা স্বরক্ষেপণের থেকেও বেশি প্রয়োজনীয় ছিল অভিনয় শিক্ষা। কোন গায়ক যখন ঠুমরি গান তখন তার পক্ষে গানের অর্থ বোঝা, প্রতি শব্দের গুরুত্ব অনুধাবন করা ও সেইসঙ্গে গানটির সংস্কৃতিগত অবস্থান ইত্যাদি সমগ্র ব্যাপারটি অত্যন্ত জরুরী। এছাড়াও দর্শকদের মর্জি বুঝে অঙ্গ সঞ্চালন ও নৃত্যের প্রতিটি পদক্ষেপ জরুরী। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে দু ধরনের ঠুমরি গানের প্রচলন ছিল - 'বন্দিশ' ঠুমরি ও 'বোল বনাও' ঠুমরী। তবে দু'ধরনের ঠুমরি গানের প্রথম অংশকে 'স্থায়ী' এবং পরবর্তী অংশকে 'অন্তরা' বলা হতো। এছাড়াও কিছু কিছু গানে মধ্যবর্তী একটি অংশ থাকতো যাকে 'মধ্য' বলা হত। সাধারণত বন্দিশ ঠুমরি সৃষ্টি করতেন লক্ষ্ণৌ অঞ্চলের কবিরা যাদের ভাষা ছিল কিছুটা উর্দু মিশ্রিত খড়িবোলি। বন্দিশ কথাটির অর্থ গানের কথা অর্থাৎ এই ধরনের ঠুমরিতে কবিরা গানের কথা বা 'লিরিকে'র উপরে বেশি গুরুত্ব আরোপ করতেন। উনবিংশ শতকে সবচেয়ে জনপ্রিয় ঠুমরি ছিল এই বন্দিশ ঠুমরি। এই সময়ের বিখ্যাত ঠুমরি গানের রচয়িতা হলেন বিনদাদিন মহারাজ।                                          

  হালকা চালের প্রাণবন্ত এই গান সাধারণত নাচের সংগে গাওয়ার জন্যই লেখা হতো। ধীরে ধীরে রাগের রূপ সৃষ্টির কৌশলের পরিবর্তে দ্রুতলয়ে তান বা সুরের কারুকার্য এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে তালের বিভিন্নতা করার সময়ে গানের কথা দ্রুতলয়ে প্রক্ষেপণ করা হয়। সাধারণতঃ একাধিক অন্তরার দীর্ঘ অংশ বেশিরভাগ সময়েই মধ্য এবং দ্রুতলয়ে গাওয়া হয়, সেই সঙ্গে জোর দেওয়া হয় 'বোল বনাও' এবং গানের কথা প্রয়োগ করার বিশেষ কৌশলের উপরে যাতে গানের কথা সুচারুভাবে বিস্তার, তান এবং লয়কারীতে ভাগ করা যায়। বেশিরভাগ সময়ে এই গানগুলি লেখা হতো কত্থক নাচ কেন্দ্রিক কোন রচনার কথা মনে রেখে। গানের ভিত্তি হিসেবে সাধারণত থাকে অপেক্ষাকৃত লঘু রাগ যেমন, কাফি, পিলু, গারা, খাম্বাজ, দেশ, তিলঙ, বিহারি, ঝিঁঝোটি, এবং এরকম আরো অনেক রাগে। বন্দিশ ও বোল বনাও - দু' ধরনের ঠুমরিতে লোক প্রচলিত দাদরা, কাহারবা, খেমটা এবং চরাচর প্রভৃতি বেশ কিছু তালের বিভিন্নতা এনে দীপচন্দী, আদ্ধা, ইকওয়ারি, সিতারখনি প্রভৃতি তাল ব্যবহার করা হতো।    

  বোল বনাও ঠুমরীর নাম থেকে প্রতীয়মান যে এই ধরনের ঠুমরীতে কথোপকথন বা বাংলার কবি গানের মত গান তৈরি হতো। সাংগীতিক বাকযুদ্ধ বা কথার মাধ্যমে আরও গভীরভাবে ভাব প্রকাশের জন্য ধীরে ধীরে সুরের মায়াজাল বিস্তার করা হয়। বোল বনাও ঠুমরীর উৎস মূলতঃ বেনারস ও গয়া থেকে যাতে ভাষার ব্যবহার করা হতো আওয়াধি ও ভোজপুরি হিন্দি ভাষা। পূর্বেই উল্লেখ করেছি ঠুমরী গান প্রধানত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকার প্রেমকাহিনী নিয়ে লেখা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ঘটনাবলী, গোপীদের সঙ্গে তাঁর লীলা, রাধাকৃষ্ণের চিরন্তনী প্রেমগাথা হোলি বা রাস উৎসবের বিষয়ে বোল বনাও ঠুমরীর কথার মাধ্যমে, সুরের নাটকীয়তা ও গভীরতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। গানের কথা যদিও বন্দিশ ঠুমরীর মত উচ্চ মানের নয় তথাপি কথার অমার্জিত ভাব, মুক্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য এবং কোন বাঁধাধরা গায়কী রীতির বাইরে থাকার জন্যই বোল বনাও ঠুমরীতে বহুমাত্রিক ধারা বা মডেলের সৃষ্টি হতে পারে এবং গায়কের পক্ষেও কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া গান গাওয়া সম্ভব। যেমন ' কৌন গলি গয়ো শ্যাম' অর্থাৎ কোন রাস্তায় শ্যাম গেল - এই কথাটির উপরে জোর দিয়ে গায়ক নিজের ইচ্ছে মতো বিভিন্ন ছন্দে গাইতে পারেন। বোল বনাও টুমরীর বিষয়বস্তু, রাগ ও ছন্দ সবকিছুই ছিল কম মার্জিত, মূলতঃ স্থানীয় প্রভাবে প্রভাবান্বিত এবং অনেক ধীর লয়ে স্বরের বিভিন্নতা করে গাইবার উপযুক্ত, যেটা বন্দিশের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।                                       
                                                                                               ক্রমশঃ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments