গ্রামের শহুরে রূপকথা
সুরশ্রী ঘোষ সাহা
ষষ্ঠ পর্ব - সংস্কারের ঝাঁপি
'সকাল থেকে একটা শালিখ সমানে এখানেই ঘুরঘুর করছে। এই যাহ্... যাহ্... হুশশ... নির্ঘাত আজকের দিনটা খারাপ যাবে।' বলতে বলতে নিজেরই একটা চোখের নীচের অংশকে আঙুল দিয়ে ঠেলে তুলে শালিখটাকে দুটো দেখার চেষ্টা করছিল বিনু। তারপর এক শালিখ দেখে ফেলার দোষ কাটানোর জন্য কলাগাছ দেখতে ছুটল।
বিনুর বড়দাদা কাজে বেরুবে, হঠাৎ পিছন থেকে ছোট বোনটা ঘর থেকে 'দাদা' বলে ডেকে উঠল। অমনি বিনু খেঁকিয়ে উঠল। 'দেখছিস দাদা পথে বেরুচ্ছে, অমনি তু পিছু ডাকলি? কেনে? তোরে মানা করছি না, পিছু ডাকা খারাপ!'
'এ হে, দাঁড়িয়ে যা, দাঁড়িয়ে যা বাপ। কালো বিড়াল রাস্তা কাটলো যে। যতক্ষণ না পিছন থেকে সেই পথে আর কেউ এগিয়ে যাবে, ততক্ষণ বিড়ালে রাস্তা কাটা পথে বিনু দাঁড়িয়ে থাকবে। তা ওর যতই দেরি হয়ে যাক না কেন।'
বিনু গ্রামের মেয়ে এবং নানা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। পল্লী বাংলার ঘরে ঘরে এমন অজস্র বিনু ছড়িয়ে আছে। যাদের মনের অলিতে গলিতে অজস্র কুসংস্কার আদিম যুগ থেকে সৃষ্টি হয়ে আজও ছড়িয়ে রয়েছে। যেমন, - বেরুনোর সময় হাঁচা খারাপ। খেতে বসে গাল কামড়ে ফেলা মানে কেউ গালি দিচ্ছে বুঝি। একটানা হেঁচকি তুললে নির্ঘাত কেউ তাকে মনে করছে। একটানা কুকুর - বিড়াল কাঁদা খারাপ। কাক ডাকা ভয়ঙ্কর অমঙ্গলের।
সকালে উঠে অন্যের এক চোখ দেখলেও নাকি সারাদিন বাজে কাটবে। তাই অন্যের দু-চোখ দেখার জন্য সামনের মানুষ পাগল হয়ে ওঠে। যতক্ষণ না দেখতে পাবে দু-চোখ দেখা, দু-চোখ দেখা বলতেই থাকবে। দুয়ারে জুতো উল্টে রাখলে নাকি সংসারে ঝগড়া বাধবেই। কেউ শুভ কাজে বেরুচ্ছে, তখন বেরোনোর সময় ঝাট দেওয়া চলবে না। শুধু গ্রাম কেন আজও শহর মফস্বলের পথঘাটে দেখতে পাওয়া যায় দেয়ালে, লাইটপোস্টে পোস্টার সাঁটা রয়েছে, এখানে বশীকরণ ও তুকতাকের মাধ্যমে....
গ্রাম্য পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের মধ্যেই কুসংস্কার বেশি। যা শুধু গ্রামেই আটকে নেই। যারা বিবাহ করে অথবা চাকরি সূত্রে শহরে চলে আসছে, তারাও দীর্ঘকাল শহরে বাস করার পরও সেসব সংস্কার ছাড়তে পারে নি, উল্টে ছড়িয়ে চলেছে। আগে দেখা যেত, বহু ঘরে স্ত্রীরা চুল দিয়ে স্বামীর পা মুছে দিচ্ছে। বাড়ির বউ সবার শেষে খাবে এটা তো প্রায় আজও বহু সংসারের রীতি। আমাদের সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকেই এই সকল কিছুর পিছনের আসল কারণ হিসেবে ধরা হয়। অথচ পুরুষরা যত না বেশি তা মানে বা মানায়, মহিলারাই বিশেষ করে মা - কাকিমারাই তা পালন করে ও করায় বেশি। তারা নিজেদের পিছিয়ে রাখতেই ভালবাসে। এ ব্যাপারে বলা যায়, নারীরাই নারীদের চরম শত্রু।
আমার বিয়ের পর পর আমাকে আমার শাশুড়িমা নাক বিঁধোতে বলেছিলেন। আর কারণ হিসেবে বলেছিলেন, নাক না বিঁধোলে সতীর সেই নিঃশ্বাস স্বামীর জন্য খারাপ। তারই মুখে শোনা, থালার উপর থালা রেখে খাওয়া খারাপ, তাতে নাকি স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে হয়। সেটা আর পরীক্ষা করতে যাওয়া হয়নি।
যাইহোক, কষ্ট লাগে, যখন শুনতে পাই, অশিক্ষা বা শিক্ষিত হয়েও মনের কোণে জমে থাকা সংস্কারের ছায়ায় কত কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, ও আজও হচ্ছে। আজ খবরের কাগজের প্রথম পাতায় আমরা সবাই যখন পড়তে পারি, ওমুকে চাঁদে জমি কিনেছে। তেমনি দ্বিতীয় পাতায় থাকে, পশ্চিমবঙ্গের তমুক গ্রামে ডাইনি সন্দেহে এক মহিলাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কিংবা সাপের কামড় খাওয়া ব্যক্তিকে কাছাকাছি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কিংবা হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে ওঝা ডেকে এনে ঝাড়ানো হয়েছে। কুকুরে-বিড়ালে কামড় দিলেও তাই। ওঝাই নাকি এই সব কিছুর থেকে একমাত্র পরিত্রাণ দাতা। দু'দিন, তিনদিন ধরে ওঝার ঝাড়ফুঁক ও ঝাঁটার মার খেয়ে সাপে কাটা - ভূতে ধরা - ডাইনি সন্দেহ করা মানুষ মারা যায় শেষমেশ। আজও বহু গ্রাম যতই ভিতরে ভিতরে শহর হয়ে উঠুক, নিজেদের মধ্যেকার পুরনো এমন বহু সংস্কার ছাড়তে পারেনি এতটুকু।
জেঠিমার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আচ্ছা, এই ডাইনি সন্দেহটা কোথা থেকে আসে মানুষের মনে, জানো?
জেঠিমা এক কথায় বলেছিল, অশিক্ষা ও কুসংস্কার থেকে। তারপর একটা ঘটনা বলেছিল —
গ্রামে একবার একটা মেয়ের আচমকা বমি শুরু হয়েছিল। অনেকে বলল, উঠতি বয়সের মেয়ে নিশ্চয়ই নজর লেগেছে। কীভাবে জানা যাবে, সত্যি নজর লেগেছে কিনা! শনি কিংবা মঙ্গলবার দেখে পাঁচটা কী সাতটা শুকনো লঙ্কা নিয়ে মেয়েটার সর্ব অঙ্গে বুলিয়ে পোড়ানো হল। নজর সত্যি লেগে থাকলে লঙ্কা পোড়ার ধোঁয়ায় নাকি কারুর হাঁচি হয় না। আর নজর না লাগলে সবাই হেঁচে মরবে। ওখানে উপস্থিত কারুরই একটাও হাঁচি হল না! অতগুলো লঙ্কা পোড়ার ধোঁয়া থেকে এতটুকু ঝাঁঝ ছড়াল না। ব্যস্, অমনি সবাই বুঝল, ঐ মেয়ের বিরাট নজর লেগেছে। অমনভাবে শনি কিংবা মঙ্গলবার করে বারবার লঙ্কা পুড়িয়ে মেয়েটার নজর ছাড়ানোর চেষ্টা চলল। এদিকে মেয়েটা আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছে দিনদিন। কারুর সেদিকে নজর নেই। চারদিনের দিন মেয়েটা বিনা চিকিৎসায় মরে গেল। গ্রামের ওঝা বলল, ঐ মেয়েটার মৃত্যুর জন্য তাদের পাশের বাড়ির দু'জন মহিলা দায়ী। গভীর রাতে গ্রামের একদল ক্ষিপ্ত লোক পাশের বাড়ির ঘরে ঢুকে ঐ দু'জন মহিলাকে চুলের মুঠি ধরে বাইরে টেনে আনল। তারপর তাদের নগ্ন করে নিষ্ঠুরভাবে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে এবং টাঙ্গি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে দিল৷ বলল, ওরাই নাকি মেয়েটাকে খেয়েছে। এসবের ক্ষেত্রে পুলিশের নজরের সামনেও নিয়ে যাওয়া হয় না ব্যাপারগুলো। ডাইনি নাম দাগিয়ে দেয় গ্রামের ওঝা আর গুণিনরাই৷ গাঁওবুড়া বা প্রধান তাঁর বিরোধিতা করতেও সাহস পায় না৷
কথাগুলো বলার সময় জেঠিমার চোখ চিকচিক করছিল। তারপর বুজে আসা স্বরে বলেছিল, সবকিছুর জন্য দোষ কার জানিস? দোষ হল, সেই সকল অশিক্ষিত গ্রামবাসীর। যারা গ্রামে দুর্ভিক্ষ, খরা, জলাভাব, সংক্রমণ রোগ বা ব্যাধি, কারুর অস্বাভাবিক আচরণ, চুরি - ডাকাতি যাই হোক না কেন, নিদানের জন্য ছুটে যায় গ্রামের ওঝা বা গুণিনের কাছে৷
জেঠিমার কথা শুনতে শুনতে গুগলে ঢুকে পড়েছিলাম। সেখানে জানলাম, একটি গণনা অনুযায়ী ভারতে ১৯৯৫ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে ডাইনি সন্দেহে হত্যার ঘটনা ঘটেছে আড়াই হাজার। এখন ভারত ২০২২ এ পা দিয়েছে। তাতেও ছবি এতটুকু বদলায়নি।
শুধুমাত্র কুসংস্কারের জন্যই যে এভাবে মৃত্যু দেওয়া হচ্ছে, তাই নয়। কুসংস্কার অন্যতম কারণ হলেও অপরাধটা মূলত হয় ব্যক্তিগত শত্রুতা, জমি বিবাদ, জাতপাত ও লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে৷ তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর শিকার হয় নারীরা। বিশেষত অসহায় বিধবা, সন্তানহীন, অবিবাহিত বয়স্কা মহিলারাই এর শিকার হয় বেশি৷ পুরুষরাও যে পুরোপুরি বাদ যায় তাও নয়। চোর - ডাকাত সন্দেহে, ছেলেধরা সন্দেহে পুরুষদেরও পিটিয়ে মেরে দেয় ওঝা ওরফে অশিক্ষিত গ্রামীণ মানুষ। আদিবাসীদের মধ্যে এইভাবে মৃত্যুর সংখ্যাটা সবচেয়ে বেশি।
ছেলেধরা ভেবে মারার প্রসঙ্গে নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতাটা মনে পড়ে যায় -
আটজন মৃতদেহ
চেতনার পথজুড়ে শুয়ে আছে
আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি
আট জোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে
আমি চিৎকার করে উঠি
আমাকে তারা ডাকছে অবেলায় উদ্যানে সব সময়
আমি উন্মাদ হয়ে যাব
আত্মহত্যা করব
যা ইচ্ছা চায় তাই করব।
(ক্রমশ...)
ছবি : পরীক্ষিত পাহাড়ী
0 Comments