জ্বলদর্চি

যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা / বিজন সাহা


যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা 

বিজন সাহা 

কত বার বললাম ছেলেমেয়েদের কিছু চাল, গ্রেচকা, তেল, লবন এসব কিনে রাখতে। তুমিও তো ওদের কিছু বলতে পার?
কী হবে ওসব কিনে? 
কিনতে সমস্যাটা কি? থাকুক না ঘরে পড়ে। ওরা কি খেতে চায়? যুদ্ধ লাগলে তখন বুঝবে। 
যুদ্ধ লাগলে ঐ চাল ডাল কোন কাজে আসবে না। অযথা পয়সা নষ্ট হবে। 
কথায় বলে কাঙালের কথা বাসি হলে ফলে। যখন যুদ্ধ লাগবে তখন বুঝবে।
দেখ, তুমি যে যুদ্ধের কথা ভাবছ তার ধাক্কা মস্কোয় তেমন লাগবে না, আর যদি মস্কোয় লাগেই তাহলে উত্তর গোলার্ধের কারোই তেমন টিকে থাকার সম্ভাবনা থাকবে না। তাই এ নিয়ে ভেবে অযথা প্রেশার বাড়িয়ে লাভ নেই।
টিভিতে ইউক্রাইনকে কেন্দ্র করে সব মহলের সাজ সাজ রবের খবরে এটা গুলিয়ার প্রতিক্রিয়া আর আমার উত্তর। জানি না অন্যান্য পরিবারেও এরকম কথাবার্তা হয় কি না। হয়তো হয়, হয়তোবা হয় না। আসলে আমরা সবাই একেক জায়গায় থাকি বলে এ ধরণের কথা কাটাকাটি। একসাথে থাকলে হয়তো নিজেরাই কেনাকাটা করতাম। না, নিজেদের ঘরে আমরা চাল ডাল কিনে রাখিনি। নিজেদের জন্য তেমন ভয় বা দুশ্চিন্তা নেই। বাবা মায়ের সব দুশ্চিন্তা ছেলেমেয়েদের নিয়ে। তবে এটা শুধু বাসাতেই। অফিসে, ক্লাবে, বন্ধুদের আড্ডায় কখনই এসব নিয়ে কথা হয় না। তবে টিভিতে প্রায় প্রতিদিনই ইউক্রাইন নিয়ে একাধিক প্রোগ্রাম হয়। সেখানে বিভিন্ন পক্ষের লোকজন থাকে, থাকে ইউক্রাইনের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ। বেশ উত্তেজিত ভাবেই তারা তাদের মতামত প্রকাশ করে। থাকে ইউরোপ বা আমেরিকার বিশেষজ্ঞরা। অনেক সময় বন্ধুদের জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা এসব প্রোগ্রামের কি আদৌ কোন  দরকার আছে? ওরা বলে আছে। এভাবে সাধারণ মানুষ অন্তত জানতে পারে কি হচ্ছে ওখানে, কি ভাবছে সেখানকার লোকজন, কি ভাবছে দেশের নেতৃত্ব। এটাও সাধারণ মানুষের মানসিক চাপ কমানোর এক ধরণের পদ্ধতি।    

আমি ইউক্রাইন প্রথম যাই ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সেবার খারকভ গিয়েছিলাম আমাদের ছাত্র সংগঠনের সম্মেলনে। এরপর ১৯৮৭ সালে কিয়েভ  আর ১৯৮৮ সালে ওদেসা সম্মেলন। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন এক বিশাল দেশ। পেরেস্ত্রইকা, গ্লাসনস্তের তুষার ঝড়ে এগিয়ে যাওয়া এক দেশ। সব জায়গায় নতুন উদ্যোগে দেশ গড়ার স্বপ্ন। ব্রেঝনেভের স্থবিরতা কাটিয়ে হঠাৎ যেন সবাই জেগে উঠেছে। সারা দেশ জুড়ে সেই পেরেস্কত্রইকা আর গ্লাসনস্তের অশরীরী আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে যতটা না প্রেরেস্ত্রইকার তার চেয়ে বেশি গ্লাসনস্তের। অনেক দিন পরে কথা বলার সুযোগ পেয়ে সবাই যেন একযোগে বলতে শুরু করেছে, বলতে শুরু করেছে তাদের অভিযোগের কথা, তাদের সমস্যার কথা। তবে যেহেতু এসব ট্রিপ ছিল ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত তাই দেশটা যে খুব বেশি করে দেখেছি তা কিন্তু নয়। আরও একবার খারকভ গিয়েছিলাম ১৯৯১ সালে। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বত্রই অভাব আর অভাব – পণ্যের অভাব। গিয়েছিলাম খারকভ থেকে ওয়াশিং মেশিন আনতে দীপ্রার জন্য। পরবর্তীতে যখন ওদিকে যাই – সোভিয়েত ইউনিয়ন ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে। সেটা ১৯৯২ সাল। অনেকেই গেছিলাম – ক্রিমিয়ায় – সামার ট্রিপে। খুব আনন্দে কেটেছে সেই দিনগুলো। রুমা, হাফিজ, তমাল, ইমদাদ, ডেইজি। ইয়াল্টায় সেই কটা দিন ছিল অনাবিল আনন্দের। আসলে কখনই, এমনকি ১৯৯২ সালেও ইউক্রাইনকে রাশিয়ার থেকে আলাদা মনে হয়নি। তখনও অনেকেই ভাবত এই ভাঙ্গন সাময়িক। কিছুদিন পরে কোন এক ফর্মে সবাই এক হয়ে যাবে। এরপর যখন ওদিকে যাই – অনেক জল গড়িয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন নদী দিয়ে। সেটা সামার – ২০১২। একদিনের জন্য কিয়েভ – সেখান থেকে ক্রিমিয়া। আসলে সরাসরি সিম্ফেরাপোলের টিকেট না পেয়ে কিয়েভ হয়ে যাওয়া। খুব ভোরে কিয়েভ এসে পৌঁছুই। সিম্ফেরাপোলের ট্রেন রাতে। তাই জিনিসপত্র স্টেশনে রেখে সারাদিন ঘুরে বেড়ানো। সেই এক দিনে কিয়েভের বিভিন্ন জায়গায় হেঁটে বেড়িয়েছি বাচ্চাদের নিয়ে। কি ভাষা, কি আমার গায়ের রঙ – কোন সমস্যা হয়নি। আমি ব্যাগ থেকে পাসপোর্ট বের করতে ভুলে গেছিলাম, তাই সেইফ খুলে সেটা নিয়ে আবার নতুন করে সেইফের জন্য পে করতে হয়। মস্কোয় পাসপোর্ট বা অন্য কোন ডকুমেন্ট ছাড়া সেই সময় বিদেশীদের বাইরে বেরুনোর কথা আমরা চিন্তাও করতাম না, তাই বৌয়ের পীড়াপীড়িতে পাসপোর্ট নেওয়া। কিন্তু সারাদিন কোথাও কেউ পাসপোর্ট চায়নি। সত্যি বলতে খুব ভাল লেগেছিল তখন কিয়েভ। আর ক্রিমিয়া – সে আর কী বলব! ওদের দেখে, ওদের কথা শুনে মনে হয়েছে ওরা নিজেদের রুশ ভাবতেই বেশি ভালবাসে। কিয়েভের চেয়েও মস্কোর প্রতি বেশি টান অনুভব করে। আসলে অনেক আগে গ্রীকরা ক্রিমিয়ায় জনপদ গড়ে তোলে যার নিদর্শন এখনও সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শুধু ধ্বংসপ্রায় প্রাচীন নিদর্শন নয়, বিভিন্ন জনপদের নামেও সেটা বিদ্যমান। এমনকি প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যেও এসব নাম পাওয়া যায়। এরপর সেটা চলে যায় অটোম্যান সাম্রাজ্যের দখলে। ১৭৮৩ সালে ক্রিমিয়া রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। সে সময় ইউক্রাইন নামে কোন দেশই ছিল না পৃথিবীর মানচিত্রে। এরপরে ইউক্রাইনে যাই ২০১৩ সালে। যাই ওদেসা আর ভিলকভা। ভিলকভা – এটা রুমেনিয়া আর ইউক্রাইনের বর্ডারে ছোট্ট এক শহর, এখানেই দানিউব বা দুনাই নদী ব্ল্যাক সীতে পড়ছে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সেটাই দেখা। ওদেসা থেকে ভিলকভা যাওয়ার পথে গাড়ি চেক করল – অনেকটা দেশের মত, বিশেষ করে বর্ডার এলাকায় যেমনটা হয়। ওখানে মূলত থাকে স্তারোভেররা অর্থাৎ প্রভস্লাভ আদি কানুনে বিশ্বাসী যারা তারা। ওখানেই প্রথম দেখলাম লোকজন ঘরে তালা দেয় না, কোন ভয় ছাড়াই ঘরের দরজা চাপিয়ে কাজে চলে যায়। ওখানে কয়েক দিন কাটিয়ে আমরা যাই ক্রিমিয়ায়। তবে এর আগে বেলগোরাদ দনেস্ত্রভস্কি আর কুলেভচা ঘুরে আসি। কিন্তু কোথাও রুশ বিরোধিতা চোখে পড়েনি। স্ত্রীর মুখে শুনেছি ওরা যখন জাকারপাতিয়া, ল্ভভ এসব শহরে গেছে সেখানে ব্যবহার মোটেই ভাল ছিল না। তবে এসব এলাকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা ইউক্রাইনের দখলে আসে তাই সেখানে স্থানীয় লোকজন কখনই সোভিয়েত শাসনের প্রতি লয়াল ছিল না যেমনটা ছিল না বাল্টিকের দেশগুলোয়। ওখান থেকে আমরা চলে যাই ইভপাতেরিয়া। গভীর রাতে সেভাস্তপোলগামী বাস থেকে নামি সিম্ফেরাপোল রেল স্টেশন থেকে বেশ দূরে বাস স্টেশনে। ক্রিস্টিনা আর সেভা আমাদের সাথে। সেই রাত দুপুরে প্রায় আধা ঘন্টা/ চল্লিশ মিনিট নির্জন শহরের ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলাম রেল স্টেশনে। এই অপরিচিত শহরে গভীর রাতে হাঁটতে কোন ভয় ছিল না। মনে হচ্ছিল যেন সোভিয়েত আমলে ফিরে গেছি। আর সমস্ত ক্রিমিয়ায় ছিল রুশদের প্রতি অপরিসীম ভালবাসা। তাই ঠিক ছয় মাস পরেই এ দেশে যে এমন পরিবর্তন ঘটবে সেটা ভাবতে পারিনি।  
সে সময় সামারে আমার পরিবারের সবাই ইউক্রাইন, ক্রিমিয়া, ককেসাস – এসব এলাকা ঘুরতে যেত। আমি তেমন একটা যেতাম না। আসলে কাজে মানে অফিসেই আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই। তাই না যাওয়ার সুযোগ থাকলে দুবনায় থেকে যাই। আমার স্ত্রী নববর্ষের সময় থেকেই পরের বছর কোথায় যাবে না যাবে, কোন রাস্তায় যাবে, কোন এক্সকারশনে যাবে না যাবে তার একটা ছক তৈরি করে ফেলে, আমরা সেভাবেই তৈরি হই। সাধারণত সেটা হয় মূল ইউক্রাইন প্লাস ক্রিমিয়ার কয়েকটা শহর প্লাস ককেসাস অথবা ক্রিমিয়া – ককেসাস। ২০১৪ সালেও প্ল্যান কমবেশি তৈরি। আর সে সময়ই শুরু হল ক্রাইসিস। সেবার আমরা ক্রিমিয়ায় না গিয়ে গেলাম আবখাজিয়া – সোচি – আদিগেইয়া। শুরু হল নতুন অধ্যায়। 

আসলে ঘটনা যে এ দিকে যাবে সেটা ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পরে কোন কিছুই আর অকল্পনীয় মনে হয় না। বর্তমানে যেটাকে ইউক্রাইন বলি সেটা লেনিনের উদ্যোগে বিপ্লবের পরে তৈরি। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়ন এক অর্থে দেশ ছিল না, সেখানে যেমন যেকোনো দেশ যোগ দিতে পারত, তেমনি সেখান থেকে যে কেউ বেরিয়ে যেতে পারত। অন্তত সোভিয়েতের সংবিধান এমনই ছিল। সে সময় লেনিন সহ অনেকের ধারণা ছিল রাশিয়ায় কেবল শুরু, এরপর সারা ইউরোপে বিপ্লব ছড়িয়ে পড়বে। আর বিপ্লবের পর যখন শ্রমিক রাজ প্রতিষ্ঠিত হবে তখন এসব দেশ এক এক করে সেই ইউনিয়নে যোগ দেবে। আর সেকারণেই বিপ্লবের পরে রুশ সাম্রাজ্যের মত কোন সাম্রাজ্য তৈরি না করে এই ইউনিয়ন গঠন। সেই সময় খারকভ থেকে শুরু করে ওদেসা পর্যন্ত দক্ষিণ পূর্ব বেল্ট যা বরাবরই ছিল রুশ অধ্যুষিত ও রুশদের দ্বারা গঠিত তাকে উত্তর - পশ্চিম দিকের কিছু এলাকার সাথে জুড়ে ইউক্রাইন রিপাবলিক তৈরি করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল অপেক্ষাকৃত উন্নত রুশ এলাকার সাহায্যে সমস্ত এলাকা উন্নত করে গড়ে তোলা। এরপর খ্রুশেভ কোন আইনের তোয়াক্কা না করে ক্রিমিয়া জুড়ে দেন ইউক্রাইনের সাথে, যদিও ক্রিমিয়ার মানুষ নিজেদের রুশ ফেডারেশনের অংশ ভাবতেই স্বচ্ছন্দ্য বোধ করত। প্রতিবাদও হয়েছিল। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নে সেসবের তোয়াক্কা কেউ করত না। তাছাড়া কোন দিন যে দেশ ভাঙবে সেটাই বা কে ভেবেছিল! ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ক্রিমিয়ার লোকজন বার বার চেষ্টা করেছে ইউক্রাইন থেকে বেরিয়ে রুশ ফেডারেশনে যোগ দেবার। ইউক্রাইনের প্রথম প্রেসিডেন্ট ক্রাভচুক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে বেলভেঝস্কায়া চুক্তির সময় ইয়েলৎসিন চাইলে তিনি কোনই আপত্তি করতেন না ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার হাতে তুলে দিতে। কিন্তু ক্ষমতার লোভে ইয়েলৎসিন সাধারণ মানুষের কথা ভাবেননি, এ নিয়ে কোন দাবি করেননি। ফলে ১৯৯১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ক্রিমিয়ার সময় কেটেছে পূর্ব পাকিস্তানের মত। যদি পূর্ব পাকিস্তান স্বেচ্ছায় (যদিও সেটা জিন্নাহর চালাকির কারণে) পাকিস্তানে যোগ দেয়, ক্রিমিয়া সেটা করেছে বাধ্য হয়ে। তবে দুটো এলাকাই ঠিক ২৪ বছর পরে নিজ নিজে বলয়ে ফিরে এসেছে। ইউক্রাইনের বিভিন্ন শাসক রুশ ভাষাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হবে সেই আশ্বাস দিয়ে ক্ষমতায় এলেও পরে সমস্যা জিইয়ে রেখেছে রাজনৈতিক লাভ লোকসানের হিসেব করে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে সে দেশের প্রায় ৫০% মানুষের মাতৃভাষা রুশ, তাছাড়া প্রায় ১০০% মানুষ রুশ বলে ও বোঝে। ইতিমধ্যে কিয়েভে কেন্দ্রের অবহেলায় উগ্র জাতিয়তাবাদী শক্তি, যারা হিটলারের সাথে সহযোগিতাকারী বান্দেরাকে নিজেদের আইকন হিসেবে মানে, শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাই ২০১৪ সালের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই শক্তি ক্ষমতায় এসেই রুশ ভাষার উপর, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পুণ্য স্মৃতির উপর আঘাত হানে। এটাই মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে, ক্রিমিয়া বেরিয়ে আসে ইউক্রাইন থেকে এবং গণভোটের মাধ্যমে রুশ ফেডারেশনে ঢোকার কথা জানায়। এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে ভোটের ফল যে এমনটাই হত তা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। 

এখন প্রশ্ন হল – কেন এমন হল? ১৯৯১ সালে যেহেতু ইউক্রাইন ও বেলারুশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙতে, বিশেষ করে গরবাচভের হাত থেকে ক্ষমতা ইয়েলৎসিনের হাতে তুলে দিতে সাহায্য করেছিল – তাই সেসব দেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন রুশ বিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ে রাশিয়া জোরেশোরে কখনও তেমন প্রশ্ন তোলেনি। অবশ্য সে সময় সেই শক্তিও তার ছিল না। বিভিন্ন সরকারকে তেল ও গ্যাসের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিলেও নিজেদের স্বার্থ সেখানে রক্ষা করতে পারেনি। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকা সেখানে রুশ বিরোধী মনোভাব গড়ে তুলেছে একটু একটু করে। এখানে হয়তো কাজ করেছে ব্রেঝিন্সকির সেই অমর বাণী «ইউক্রাইন ছাড়া রাশিয়া দ্বিতীয় সারির দেশ।» তারা এটাকে মন্ত্রের মত নিয়েছে এবং ছলে বলে কৌশলে ইউক্রাইনকে অ্যান্টিরাশিয়া বানাতে সব কিছুই করেছে, করছে। 
যদি রাশিয়া ইউক্রাইনের সাথে যুদ্ধ করতেই চাইত বা তার আঞ্চলিক অখন্ডতা ভঙ্গ করতে চাইত, সে কখনই ইউক্রাইনের সাথে বন্ধুত্ব চুক্তি করত না, সে দেশের ইকনমিতে ইনভেস্ট করত না, ভর্তুকি দিয়ে তার কাছে তেল বা গ্যাস বিক্রি করত না, সে দেশের শিল্প চলমান রাখা চেষ্টা করত না। মনে রাখতে হবে যে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রায় সমস্ত কলকারখানা সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে করা হত। ফলে রাশিয়ার বিমান ও রকেট  টেকনোলজির একটা বিরাট অংশই তৈরি হত ইউক্রাইনে। এসব কলকারখানা খারকভ, জাপারঝিয়ে ইত্যাদি এলাকায় অবস্থিত যা মূলত রুশ অধ্যুষিত। তাই রাশিয়া কখনই চাইত না সেসব কলকারখানা বন্ধ হোক বা এসব সেন্সেটিভ টেকনোলজি চীন বা অন্য কোন দেশের হাতে পড়ুক। একই ভাবে মস্কো কখনই চাইত না সেভাস্তপোল থেকে তাদের নৌ ঘাটি তুলে দেওয়া হোক। কিন্তু কিয়েভ খুব সম্ভব পশ্চিমা বিশ্বের মদদ পেয়ে বিভিন্ন সময় এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলত। সেভাস্তপোল – এটা মস্কোর জন্য জীবন মরণ প্রশ্ন, কেননা সেখানে যদি আমেরিকা বা ন্যাটো ঘাটি করে তাহলে রাশিয়া বলতে গেলে অরক্ষিত থাকে। তাই ২০১৪ সালে ইনুকোভিচ বিরোধীদের সব শর্তে রাজী হয়ে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে রাজি হলেও তারা ক্যু করে। তখন মস্কোর সামনে সেভাস্তপোল রক্ষা না করে উপায় ছিল না। সেটা অনেকটা কিউবায় সোভিয়েত সামরিক ঘাটি স্থাপনের মত। 

তবে এর আগে অন্য ঘটনা ঘটে। রাশিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্থান মিলে কাস্টমস তুলে দিয়ে ইউরো-এশিয়া নামে এক নতুন ইকনমিক ব্লক গড়ে তুলে। তারা ইউক্রাইনকেও সেখানে চায়। এদিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইউক্রাইনকে বিশেষ শর্তে নিজেদের দলে টানতে চায়। তখন প্রশ্ন দাঁড়ায় ইউক্রাইন যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যায় তাহলে সে ইউরো-এশিয়ান ইউনিয়নে থাকতে পারবে না, কেননা সেক্ষেত্রে ইউরোপের পণ্য বিনা সুল্কে এসব দেশে প্রবেশ করবে। তাছাড়া তখন ইউক্রাইন রাশিয়ায় বিভিন্ন বানিজ্য সুবিধা পেত, সেগুলো রাশিয়াকে নিজের স্বার্থেই বন্ধ করতে হবে। এ নিয়ে এক অচলাবস্থার তৈরি হয়। রাশিয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে ইউক্রাইনকে নিয়ে এক ত্রিমুখী চুক্তির কথা বলে যাতে সব পক্ষের স্বার্থই রক্ষা হয়। কিন্তু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অনমনীয় মনোভাবে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইউক্রাইনের ডানপন্থী উগ্রবাদীরা, যাদের এত বছর ধরে আমেরিকা ও কানাডা অ্যান্টিরাশিয়ান মন্ত্রে দীক্ষিত করেছে, সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ফ্যাসিস্টদের সহায়তাকারী অনেক ইউক্রানিয়ান উগ্রবাদী কানাডা ও আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় পায় যেমনটা পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের অনেকেই। সে সময় ১৯৮৯ সালের সেই ভিলনুস স্টাইলে কিছু উস্কানিমূলক হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়, বেরকুট নামক স্পেশাল বাহিনীর কয়েকজন মারা যায়। পশ্চিমা বিশ্বের হুমকির কারণে ইনুকোভিচ বেরকুতকে এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে বিরত রাখে আর এই সুযোগেই উগ্রপন্থীরা প্রেসিডেন্ট ভবন দখল করে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে বর্তমানে আমেরিকার ডেপুটি সেক্রেটারি অফ স্টেট ভিক্টরিয়া নুল্যান্ড স্বীকার করেছেন যে ইউক্রাইনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাড় করাতে আমেরিকা ৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। তিনি নিজে কিয়েভের ময়দানে উপস্থিত থেকে বিরোধীদের উৎসাহ যুগিয়েছেন। এটা আবার প্রমাণ করে যে রাষ্ট্র সময় মত অল্প রক্ত ঝরাতে ভয় পেলে পরে অনেক রক্ত দিয়ে তাকে সেই ভুলের মাসুল দিতে হয়। সেটা শুধু এ দেশেই নয়, দেশে দেশেই দেখা যায়। আমাদের দেশেও। এর ফলে পশ্চিমা দেশগুলো যেখানে শক্ত হাতে বিরোধীদের আন্দোলন দমন করে (যেমন ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট), ছোটোখাটো দেশ পশ্চিমা বিশ্ব কি বলবে সেই ভয়ে ঘটনাকে অনেক দূর এগুতে দেয়। কিয়েভের ঘটনার হাত ধরে আসে ওদেসার ঘটনা। সেখানে উগ্রপন্থীরা অনেককে পুড়িয়ে মারে। খারকভের ফ্যাসিবাদ বিরোধীদের উপর নেমে আসে স্টিম রোলার। এর মধ্যে দনবাস, যেখানে খনি শ্রমিকদের বাস, ক্রিমিয়ার মতই নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করে। সেখানে সেই বিদ্রোহ দমনে কিয়েভ সৈন্য পাঠায়। শুরু হয় যুদ্ধ। 

এখানে দুটো জিনিস কাজ করতে পারে। প্রথমত রাশিয়ার সাথে বর্ডার আছে বলে অনেকেই সেখানে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া খনি শ্রমিকরা যথেষ্ট কর্মঠ। মানসিক ও দৈহিক শক্তির অধিকারী। সেই সাথে তাদের ছিল যোগ্য নেতৃত্ব। সব মিলে তারা যুদ্ধে কিয়েভকে কোণঠাসা করে ফেলে। মূলত তখন মৃত্যুর হাত থেকে কিয়েভের সৈন্যদের বাঁচাতেই এগিয়ে আসে রাশিয়া। হয় মিনস্ক চুক্তি যার মূল কথা হল ইউক্রাইনের সংবিধান পরিবর্তন করে একে ফেডেরেটিভ কান্ট্রি করতে হবে, বিরোধীদের অ্যামনেস্টি দান করতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু কিয়েভ প্রথম থেকেই সেই চুক্তি ভঙ্গ করে আসছে। ইতিমধ্যে এই এলাকার প্রায় ছয় লাখ মানুষ রুশ নাগরিকত্ব নিয়েছে, ফলে যুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়া নীতিগত ভাবে বাধ্য হবে তাদের রক্ষা করতে। কথা হল – রাশিয়া কি চায় এই এলাকা ক্রিমিয়ার মত নিজের অধীনে নিয়ে আসতে? না। কেন? কারণ তাহলে সেটা ইউক্রাইনের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পথ খুলে দেয়। তাই দনবাস ইউক্রাইনের ভেতরে বিশেষ অধিকার নিয়ে থাকলে ন্যাটোর সদস্য না হওয়ার ক্ষেত্রে রুশ পক্ষ অবলম্বন করতে পারে। কিন্তু বিরোধী ভাবাপন্ন এই মানুষ সহ কিয়েভের দনবাস দরকার নেই – তাদের দরকার মাটি। না হলেও অসুবিধা নেই। কিন্তু নিজেদের উদ্যোগে যে তাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেবে সেটাও পারছে না। আসলে ইউক্রাইন এখানে অন্য শক্তির হাতের পুতুল। তাদের কিছুই করার নেই হুকুম মানা ছাড়া। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ১৯৯১ সালে ইউক্রাইন যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করে সে কোন ব্লক ভুক্ত হবে না বলে সংবিধানে ঘোষণা করে। যখন থেকেই ইউক্রাইন ন্যাটোর সদস্য হবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে তখন থেকেই দু দেশের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। তাছাড়া ইউক্রাইনের জাতিগত ভাবে রুশ নাগরিকরা সে দেশের ন্যাটোয় যোগদানের বিরুদ্ধে থাকায় সমাজেও এর প্রভাব পড়েছে। দেশটি আসলে পূর্ব – দক্ষিণ ও উত্তর – পশ্চিম এই দুই লাগেরে ভাগ হয়ে গেছে। 
দনবাসের এই অচলাবস্থা নিয়ে বিভিন্ন মত আছে। অনেকের ধারণা যাতে ক্রিমিয়া দখল করার পর এ নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের সৃষ্টি না হয় সেজন্যে এই দনবাস সমস্যার সৃষ্টি। আর সেটা মস্কোর মদদে। প্রথম দিকে বেশ কিছু রুশ জাতীয়তাবাদী সেখানে যুদ্ধ করেছিল। অনেকের বিশ্বাস রুশ সরকার তাদের পেছনে ছিল যা মস্কো অস্বীকার করে। আবার অনেকের ধারণা এক ধরণের বিশ্বাস কাজ করেছিল যে একবার কোথাও শুরু করলে খারকভ থেকে ওদেসা পর্যন্ত পুরো বেল্ট এতে সাড়া দেবে। সেরকম কিছুর আভাসও পাওয়া গেছিল। তবে বিভিন্ন অলিগারখ বিশেষ করে কালামইস্কির বিশেষ বাহিনী গোড়াতেই সেসব ধ্বংস করে দেয়। ওদেসায় ট্রেড ইউনিয়ন ভবনে প্রায় চল্লিশ (সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মত আছে)  মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা তার একটা অংশ। আর এর পেছনে তথাকথিত গণতান্ত্রিক বিশ্বের সরব সায় ছিল। 
   
পশ্চিম ইউরোপ ও রাশিয়ার মাঝে থাকার কারণে ইউক্রাইন হতে পারত দুই এলাকার সংযোগকারী শক্তি যেমনটা মধ্যযুগে আরবরা ছিল ইউরোপ আর চীন-ভারতের মধ্যে। দুই শক্তির মধ্যে বন্ধুত্বের বদলে তাদের পারস্পরিক বিরোধিতায় খেলতে গিয়ে এখন নিজেই পুড়ে মরছে আর এতে ইন্ধন যোগাচ্ছে আমেরিকা ও ব্রিটেন। কেন? 

ইউরো জোন ঘোষণার পর থেকে যখন ইউরো ডলারের প্রতিদ্বন্দ্বী কারেন্সিতে পরিণত হয়েছে তখন থেকেই ইউরোপের সুখের সময় শেষ হয়েছে। ১৯৯৯ সালে ইউরোর আত্মপ্রকাশের পর থেকে ইউরো যখনই ডলারের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে তখনই কোন না কোন অজুহাতে ইউরোপে যুদ্ধ বা ওই জাতীয় কোন না কোন ঘটনা ঘটেছে। অর্থনৈতিক ভাবে ইউরোপ বিশেষ করে জার্মানিকে দুর্বল রাখার একটা পদ্ধতি হল এই উত্তেজনা।  সেটা আমেরিকা সব সময়ই করছে পোল্যান্ড ও বাল্টিকের দেশগুলোকে ব্যবহার করে। আর রাশিয়াকে শত্রু হিসেবে দেখাতে পারলে তো কথাই নেই। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়। রাশিয়া ইউরোপের অন্যতম প্রধান এনার্জি সাপ্লাইয়ার। এমনকি ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার মাত্র দুই ঘণ্টা আগেও এ দেশ জার্মানিতে ওয়াগন ভর্তি শস্য পাঠিয়েছে। এটা এ জন্যেই বলা যে রাশিয়া বরাবরই আস্থাশীল রপ্তানিকারী দেশ। এই তো কিছুদিন আগে যখন ইউরোপে গ্যাসের সংকট দেখা দেয় বেশি দাম পেয়ে আমেরিকা ইউরোপের জন্য নির্ধারিত গ্যাস এশিয়ায় পাঠায় আর রাশিয়া চুক্তির বাইরেও আগের দামে সেখানে অতিরিক্ত গ্যাস সাপ্লাই করে। আমেরিকা চায় না, জার্মানি কম দামী রুশ গ্যাস পেয়ে তাদের শিল্পকে প্রতিযোগিতামূলক করতে পারুক আর এ কারণেই সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে নর্থ স্ট্রিম বন্ধ করতে। তাই খেলাটা মূলত ইউরোপের বাজার নিয়ে যদিও রাশিয়ার সাপ্লাই বন্ধ হলে যে ঘাটতি হবে কোন ভাবেই আমেরিকা সেটা পুরন করতে পারবে না। কিন্তু এ নিয়ে আমেরিকার মাথা ব্যথা নেই। যদি যুদ্ধ লাগে সেটা হবে ইউক্রাইনে, তাদের উঠানে নয় বা ইংল্যান্ডের উঠানেও নয়। আসলে এই দুটো দেশ দেড় শ বছরের বেশি হল নিজের উঠানে যুদ্ধ করেনি, যুদ্ধের ভয়াবহতা কি এটা সে দেশের সাধারণ মানুষ জানে না, জানলেও জানে টিভি নিউজ থেকে। কিন্তু ইউরোপের মানুষ সেটা জানে আর তাই তো জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন এরা তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আর পোল্যান্ড, রুমেনিয়া, বাল্টিকের দেশগুলো – এরা আগ বাড়িয়ে যুদ্ধে নামতে চাইছে  এই ভেবে যে আমেরিকা তাদের রক্ষা করবে, আমেরিকার হাত দিয়ে তারা জয় পেয়ে যাবে। কোন রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ নিজের দেশে যুদ্ধ চায় না, অথচ এরা চায়। এরা নিজেদের দেশে আমেরিকার ঘাটি চায় এটা না বুঝেই যে সেক্ষেত্রে তারাই প্রথম আক্রমণের শিকার হবে, ধ্বংস হবে তাদের দেশ। জর্জিয়ার কথা তারা ভুলে গেছে।     

বর্তমানে যুদ্ধের ব্যাপারটা মনে হয় শুধুই হুমকি। রাশিয়া তার নিজের দেশে কোথায় সেনা মোতায়েন করতে সেটা তাদের ব্যাপার। এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের আপত্তি, কিন্তু পোল্যান্ডে, বাল্টিকের দেশগুলোয় আমেরিকার সৈন্যে তাদের সমস্যা নেই। রাশিয়া বারবার বলছে তাদের কোনই প্ল্যান নেই ইউক্রাইন আক্রমণ করার যদি না তারা নিজে আগ বাড়িয়ে দনবাস আক্রমণ করে। আসলে মনে হয় এই যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্য দিয়ে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা – এরা ইউক্রাইনে অস্ত্র সাপ্লাই দিতে চায়। তারা এখন যে অস্ত্র সাপ্লাই দিচ্ছে সেটা আসলে এখন ব্যবহারের জন্য নয়, ইউক্রাইনকে ন্যাটোর সদস্য না করেও সেখানে ন্যাটোর ঘাঁটি করাই তাদের লক্ষ্য। তাই শেষ পর্যন্ত কি হয় কে জানে। কেন না রাশিয়া নেতৃত্ব একটা জিনিস বোঝে যে আমেরিকা যতক্ষণ না নিজেকে ভালনারেবল মনে করছে এ খেলা চলবেই। তাহলে? হয়ত আন্দ্রেই শাখারভের নীতিতেই যেতে হবে, মানে সমুদ্র থেকে আমেরিকা, কানাডা ও ইংল্যান্ডকে আঘাত করার শক্তি ও টেকনোলজি ডেভেলপ করতে হবে। একমাত্র তখনই হয়ত এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা বন্ধ হবে।   

একনায়কত্ব সব সময়ই খারাপ – তা সে পরিবারে হোক, দেশে হোক আর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেই হোক। একই রকম খারাপ মনোপলি। কথায় আছে ক্ষমতা মানুষকে নষ্ট করে আর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা মানুষকে নষ্ট করে চরম ভাবে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার ক্ষমতা ছিল নিরঙ্কুশ। সে ভেবেই নিয়েছিল তার কথা, তার ইচ্ছাই আইন। ইতিমধ্যে চীন অর্থনৈতিক ভাবে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে গেছে। নব্বুইয়ের দশকের নতজানু অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া। ২০১৪ সালের পর থেকে একটার পর একটা এম্বারগো এদের নতুন করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে  শিখিয়েছে। বিগত বছরগুলোতে প্রায় ধ্বংসপ্রায় এগ্রিকালচার এখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে খাদ্য রপ্তানি করছে। ইউক্রাইন এ দেশে বিমানের পার্টস সাপ্লাই বন্ধ করলে মাত্র কয়েক বছরে নিজেরা নতুন কারখানা তৈরি করেছে। আবার নতুন করে শুরু হয়েছে বিমান তৈরি, তৈরি হচ্ছে জাহাজ। বাল্টিকের দেশগুলো তাদের শিপইয়ার্ড ব্যবহার করতে দিতে না চাইলে পিতেরবারগে তৈরি হয়েছে নতুন শিপইয়ার্ড আর এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বাল্টিকের দেশগুলোই। আসলে রাশিয়া প্রথম দিকের জড়তা কাটিয়ে ধীরে ধীরে পুঁজিবাদী দেশে পরিণত হচ্ছে। তারা এখন পয়সা গুনতে শিখছে। আর সে কারণেই  আগের মত ইউক্রাইন বা অন্য কোন দেশকে শুধু শুধু পয়সা দিচ্ছে না।  

আসলে এই ইউক্রাইন নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ সাজে ইউক্রাইন ছাড়া আর সবার স্বার্থ আছে। তবে ইউক্রাইন নিজে সেটা কতটুকু বোঝে সেটাই কথা। যদি একটু খেয়াল করি দেখব ইউক্রাইন সীমান্তে রুশ সেনা, রাশিয়া ইউক্রাইন আক্রমণ করছে এ ধ্বনি প্রথমে উঠে পশ্চিমা পত্রপত্রিকায়। সে সময় কি ঘটছে ইউরোপে? গ্যাসের দাম আকাশচুম্বী, এমনকি এক হাজার কিউবিক মিটার গ্যাসের দাম তিন হাজার ডলার পর্যন্ত উঠেছে। কে দায়ী? রাশিয়া। কেন? আসলে এসব রাজনৈতিক কথাবার্তা। নিজেদের ভুল ঢাকার প্রচেষ্টা। আগেই বলেছি রাশিয়া কখনই সাপ্লাই বন্ধ করেনি। গ্যাসের জন্য বিভিন্ন দেশের সাথে আগে থেকে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি হয়। কেননা গ্যাস তুলে রাখা যায় না, সেটাকে সাপ্লাই দিতে হয়। তাই ওই চুক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে গ্যাস সাপ্লাই করা হয় আর সে অনুযায়ী গ্যাস তোলা হয়। আগে সেটাই ছিল, তাই সমস্যা ছিল না। এখন ইউরোপ প্রাকৃতিক শক্তির দিকে ঝুকেছে, মানে সৌর শক্তি আর বায়ু শক্তি। কিন্তু সমস্যা হল সেটা নির্ভর করে আবহাওয়ার উপর। তাছাড়া উইন্ড মিল আর সোলার প্ল্যান্ট করতে গিয়ে যে পরিমাণ জায়গা ব্যবহার করতে হয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই যে পরিমাণ বন কাটতে হয় সেটা পরিবেশের জন্য কতটুকু উপকারী সেটাও ভাবার বিষয়। পারমাণবিক পাওয়ার স্টেশনে রিস্ক থাকলেও এখনও পর্যন্ত সেটাই সবচেয়ে বিশুদ্ধ বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করে। তাই ভাবা দরকার কিভাবে চেরনোবিল জাতীয় দুর্ঘটনা শূন্যের কাছাকাছি আনা যায়। আর সেটা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু ইউরোপ প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে বসে আছে। তাদের সার্বিক হিসেবে ভুল হওয়ার কারণে দেখা দিয়েছে বিদ্যুৎ শক্তির অভাব। ফলে জার্মানি সহ অনেককেই এমনকি পরিবেশের জন্য অধিক ক্ষতিকর কয়লায় ফিরে যেতে হয়েছে। বেড়েছে গ্যাসের দাম। তবে সেটা রাশিয়ার কারণে নয়, সময় মত চুক্তি না করার জন্য। এটা ইউরোপের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা। কিন্তু এখন গণতন্ত্র আর নিজের ভুল স্বীকার করার মত সাহসী অবস্থানে নেই। তাই সবাই মিলে সুর তুলেছে – রাশিয়া দায়ী। যেহেতু তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ – তাই সব পাপ মাপ। 

এর সাথে যোগ হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের বিশেষ করে আমেরিকা ও ব্রিটেনের রাজনৈতিক সমস্যা। আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতি কখনই শান্তিবান্ধব ছিল না। সেটা আমরা এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ই দেখেছি। তাদের কাছে মানবতা কথার কথা, জাতীয় স্বার্থ – এটাই প্রধান নিয়ামক। একই কথা ব্রিটেনের ক্ষেত্রে। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া – একের পর এক ব্যর্থতা। অবশ্য তাদের লক্ষ্য যদি পৃথিবীকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয় আর ঘোলা জলে মাছ ধরা হয় তবে ভিন্ন কথা। তারা অনেক দূরে, যুদ্ধের ইকো ওসব দেশে তেমন যায় না, তাই আমেরিকার সাধারণ মানুষ তাদের পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। কিন্তু বিশেষ করে ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে সেই সমাজ এখন দ্বিধাবিভক্ত। তার উপর করোনা। তাই সব কিছুতেই তারা রাশিয়ার হাত দেখতে পায় বা দেখাতে চায়। এটা আসলে মূল সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর জন্য। তাছাড়া রাশিয়াকে কেন্দ্র করে দুই দল অনেক দিন পরে কিছু কিছু প্রশ্নে একসাথে কাজ করছে, কমছে আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উত্তেজনা। কিন্তু যেহেতু কী অর্থ, কী মিডিয়া, কী অস্ত্র – সব দিক থেকেই আমেরিকা শক্তিশালী তাই নিজের মত অন্যের উপর বিশেষ করে রাশিয়ার উপর চাপিয়ে না দিতে পারলেও অন্যদের চোখে রাশিয়াকে দানব করতে সে পারে। আচ্ছা, নোবেল বিজয়ী ওবামা ইরাকে আর লিবিয়ায় কত মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে? তার পরেও রক্তপিপাসু পুতিন। আমরা যতদিন পর্যন্ত গণতন্ত্রের গালভরা বুলি চোখ বুজে বিশ্বাস করব – এসব বার বার ফিরে আসবে। অন্য দিকে ব্রিটেন অনেক দিন থেকেই বিশ্ব রাজনীতিতে প্রায় খরচের খাতায়। আগের সেই পরাক্রম তার আর নেই। ব্রেক্সিট না রাজনৈতিক, না অর্থনৈতিক কোন প্রকার  ডিভিডেন্ড বয়ে আনেনি। আর এ কারনের স্ক্রিপাল কেলেঙ্কারি। এখন কোভিড-১৯ কেন্দ্র করে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলেও প্রাইম মিনিস্টার  সহ বিভিন্ন মন্ত্রীরা যখন সেসব আইন লঙ্ঘন করছেন আর এ নিয়ে জনগণ প্রশ্ন তুলছে তখন রাশিয়াকে বলির পাঁঠা হিসেবে দাড় করাতে ব্রিটেন উঠেপড়ে লেগেছে। একই কথা বলা যায় কানাডা সম্পর্কে। কানাডায় ১.৩ মিলিয়ন এথনিক্যালি ইউক্রাইনিয়ান বাস করে, যারা প্রথমত ক্রিমিয়াকে ইউক্রাইনের বলে মনে করে এবং অ্যান্টিরাশিয়ান। সেই সাথে আছে ১.১ মিলিয়ন পোলিশ  যারাও একই রকম অ্যান্টিরাশিয়ান। এই সম্মিলিত প্রায় আড়াই মিলিয়ন জনগণ কানাডার ৩৮ মিলিয়ন জনসংখ্যায় এক বিশাল ফ্যাক্টর। এছাড়া ইউক্রাইনিয়ানরা শিক্ষিত, সমাজে ও রাজনীতিতে ভাল ভাল পদে অধিষ্ঠিত। কানাডা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কখনই গুরুত্বপূর্ণ ফিগার ছিল না, এখন আফ্রিকা সহ বিভিন্ন জায়গায় তার প্রভাব আরও কমেছে। জি-৭ এর মেম্বার হবার পরেও  সে এখন আমেরিকা আর ন্যাটোর দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তাই রুশ বিরোধিতা তাকে অন্তত নিজে দেশের মানুষের সামনে মুখ রক্ষা করতে সাহায্য করে। তবে এটাও ঠিক, এসবের পরেও কানাডা ও রাশিয়ার বাণিজ্যিক আদানপ্রদান গত দু বছরে বেড়েছে। আমেরিকার সাথে রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক কখনই তেমন বেশি ছিল না এবং এম্বারগোর কারণে সেটা খুব একটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে। এই এম্বারগোর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে রাশিয়া আর সবচেয়ে বেশি ইউরোপ। তাই এদিক থেকে দেখলেও যেটা পরিষ্কার তা হল এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা আসলে ইউরোপকে দুর্বল করে। মনে রাখতে হবে রাশিয়া আমেরিকার সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বী, অর্থনৈতিক নয়। আমেরিকার অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও ইউরোপ। ইউরোপকে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল করতে হলে সেখানে সস্তায় জ্বালানি সরবরাহ ব্যহত করতে হবে আর সেটা করা যাবে ইউরোপের সাথে রাশিয়ার কলহের মাধ্যমে। কিন্তু সমস্যা হল এতে করে শুধু আমেরিকা নয় চীনও লাভবান হচ্ছে। ইউরোপের সাথে এই সমস্যার কারণে রাশিয়া ইতিমধ্যে চীন পর্যন্ত পাইপ লাইন তৈরি করেছে। এর মানে চীন কমদামে জ্বালানি পাচ্ছে, তার পণ্য আরও প্রতিযোগিতামূলক হচ্ছে। তাছাড়া চীন বোঝে রাশিয়ার পরে আমেরিকা তাকে ধরবে। ফলে রাশিয়া আর চীন এককাট্টা হয়ে মাঠে নেমেছে।      
 
যদিও দেশে থাকতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় অন্ধভক্ত ছিলাম, এ দেশে এসে ধীরে ধীরে সেই মোহ কেটে যায়। অনেক ভালোর মধ্যেও অনেক কিছু দেখতে পাই যা যেকোনো স্বাধীনচেতা মানুষের পক্ষে মানা কষ্ট। যদিও সে সময় স্তালিন আমলের সেই নিপীড়ন ছিল না, তবু দেখেছি মানুষ কথাবার্তা বলার ক্ষেত্রে কতটা সাবধান। আমি যখন এখানে এসেছিলাম তখন দেশে সামরিক শাসন ছিল, তারপরেও মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে আমাদের এতটা জড়তা ছিল না যেটা দেখেছি সোভিয়েত বন্ধুদের মাঝে। সেই সময় বাক স্বাধীনতা সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমালোচনা করা হয়েছে যা মোটেই ভিত্তিহীন ছিল না। তখন এদেশে বিবিসি, ভয়েজ অফ আমেরিকা সহ বিভিন্ন পশ্চিমা মাধ্যম পারতপক্ষে নিষিদ্ধ ছিল। এখন সেই খারাপ দিকগুলোই দেখছি পশ্চিমা বিশ্বে। বিভিন্ন অজুহাতে আরটি বন্ধ করছে। সোভিয়েত ইউনিয়নে যেমন বিরুদ্ধ মতকে প্রায় বিনাবিচারে দোষী সাব্যস্ত করা হত এখন সেটাই হচ্ছে পশ্চিমে। অনেক সময় ওখানকার কাগজ পড়ে বা টিভি দেখে মনে হয় প্রাভদা বা ইজভেস্তিয়া পড়ছি অথবা সোভিয়েত টিভি দেখছি। উল্লেখ করা যেতে পারে যে সে সময় একটা জোক ছিল “প্রাভদায় ইজভেস্তিয়া নেই আর ইজভেস্তিয়ায় প্রাভদা নেই, মানে সত্যে খবর নেই আর খবরে সত্য নেই।”
ফিরে আসি ইক্রাইন সীমান্তে। যুদ্ধ কি অবশ্যম্ভাবী? মনে হয় না। তবে কয়েক দিন আগে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী সেরগেই লাভরভ বলেছেন, “যদি আমাদের উপর নির্ভর করে তবে যুদ্ধ হবে না, কিন্তু কেউ যদি আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে তার দাঁতভাঙা উত্তর দিতে রাশিয়া প্রস্তুত।” তাহলে? ২০০৮ সালে আমেরিকার কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েই জর্জিয়া দক্ষিণ অসেতিয়া আক্রমণ করে। ফলাফল সবার জানা। রাশিয়া বারবার বলছে যদি ইউক্রাইন দনবাস আক্রমণ করে তবে রাশিয়া উত্তর দেবে। এর মধ্যে আমেরিকা সহ ন্যাটো দেশগুলি বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র সরবরাহ শুরু করেছে ইউক্রাইনে। যদি এরই মধ্যে জার্মানি নর্থ স্ট্রীম বন্ধ করবে না সে রকম কোন সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে ইউক্রাইন দনবাস আক্রমণ করতেই পারে। সেক্ষেত্রে রাশিয়া উত্তর দেবে। তখন জার্মানি ইচ্ছা অনিচ্ছায় বাধ্য হবে নর্থ স্ট্রীম বন্ধ করতে। আর রাশিয়া যদি গ্যাস সাপ্লাই বন্ধ করে? সেটা আমেরিকার জন্য ভাল, কেননা আমেরিকা অনেক দিন হল ইউরোপের গ্যাসের বাজার নিজে নিতে চায়। এতে দুটো লাভ। একদিকে নিজেদের তেল গ্যাস ইন্ডাস্ট্রিকে সাহায্য করা আর একই সাথে যেহেতু আমেরিকার গ্যাসের দাম রাশিয়ার চেয়ে বেশি হবে (কেননা রাশিয়া গ্যাস সাপ্লাই দেয় পাইপ লাইনের মধ্যে, আমেরিকাকে গ্যাস ইউরোপে আনার জন্য সেটাকে তরল করতে হবে, ফলে খরচ বাড়বে) ফলে ইউরোপের পণ্যের কম্পিটিটিভনেস কমবে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল রাশিয়া বলছে নর্থ স্ট্রীম যদি পূর্ণ ক্ষমতায় কাজ করে তবুও ইউক্রাইনের পাইপ লাইন সে ব্যবহার করবে, করতে হবে। আর ইউক্রাইন সহ ইউরোপ ভয় পাচ্ছে এই ভেবে যে নর্থ স্ট্রীম ওপেন করলে রাশিয়া ইউক্রাইনের পাইপ লাইন ব্যবহার করবে না। কিন্তু কথা হল ইউক্রাইনের লাইন ব্যবহার প্রথমত ব্যয় সাপেক্ষ, দ্বিতীয়ত ইকলজিক্যালি অনেক ক্ষতিকর (সেসব তৈরি করা হয়েছে সত্তরের দশকে সোভিয়েত আমলে এবং বিগত তিরিশ বছর ইউক্রাইন সেখানে কোন রকম ইনভেস্ট করেনি বললেই চলে) এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ফলে রিস্কি। তাছাড়া রাশিয়া থেকে ইউরোপ যদি গ্যাস নিতে না চায় বা রাশিয়া যদি যদি ইউরোপে গ্যাস সাপ্লাই বন্ধ করে দেয় অথবা আমেরিকা যদি রাশিয়ার জায়গা দখল করে তাহলে ইউক্রাইনের পাইপ লাইন পরিত্যাক্ত মেটাল ছাড়া আর কিছুই হবে না। তাই ইউক্রাইনের দরকার ছিল নর্থ স্ট্রীমের বিরোধিতা না করে রাশিয়ার সাথে ভাল সম্পর্ক রাখার যাতে তাদের ট্র্যানজিট চলমান থাকে। উল্লেখ্য যে ইউক্রাইন গ্যাসের ট্র্যানজিট থেকে প্রতি বছর বেশ ভাল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা পায় যা তার বাজেটে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। একেই হয়ত বলে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা। 
আসলে একটা সময় ছিল যখন পশ্চিমা বিশ্ব ধারণা করেছিল যে রাশিয়ার দিন শেষ হয়ে এসেছে। এক ইন্টারভিউয়ে পুতিন নিজে বলেছেন তার কোন কোন পশ্চিমা কলিগ স্বীকার করেছেন যে তাদের কোন সন্দেহ ছিল না যে সোভিয়েত ইউনিয়নের মত রাশিয়াও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। প্রশ্ন একটাই -কখন? তাই তারা চিচেন যুদ্ধে ওদের বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেছে আর যখনই রাশিয়া চিচেনদের চেপে ধরেছে বেরেজভস্কি বা অন্যান্য অলিগারখদের মাধ্যমে সেটা বন্ধ করেছে। ইয়েলৎসিন যেহেতু ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন ১৯৯৬ সালে ও বিভিন্ন ভাবে পশ্চিমা বিশ্বের উপর নির্ভরশীল ছিলেন, তাই এ নিয়ে তেমন কিছু করতে পারতেন না। ২০০০ সালের নির্বাচনে ব্যাপক জনসমর্থন  পুতিনকে অলিগারখদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করে, তাছাড়া কেজিবি তথা সামরিক বাহিনী থেকে আসার ফলে সেখানেও তাঁর সমর্থন ছিল। আর ইতিমধ্যে চেচনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি দেখিয়েছিলেন যে এর শেষ না দেখে তিনি ছাড়বেন না। তারপরেও অনেকদিন পর্যন্ত পুতিন চেষ্টা করেছেন পশ্চিমা বিশ্বের সাথে হাতে হাত রেখে চলতে। দীর্ঘ দিন পূর্ব জার্মানিতে কাটানোর ফলে তিনি সোভিয়েত সিস্টেমের দুর্বলতা বুঝতেন। তবে তিনি চেয়েছিলেন পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে সমমর্যাদা দিক আর সেটা না পেয়ে ২০০৭ সালে তিনি মিউনিখে তাদের সতর্ক করে দেন। তখন কেউ সেটাকে পাত্তা দেয়নি। তবে রাশিয়া ধীরে ধীরে নিজেকে গড়ে তুলেছে। সেটা আমরা দেখেছি জর্জিয়া, ক্রিমিয়া আর বিশেষ করে সিরিয়ায়। আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় রাশিয়ার এই প্রত্যাবর্তন তারা সহ্য করতে পারেনি। এমনকি ক্রিমিয়ার অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন অজুহাতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এম্বারগো জারি করেছে। তাই রাশিয়ার পেছনে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানো ছাড়া কোন উপায় ছিল না। সেই সময় যদি পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার উপর বিভিন্ন এম্বারগো আরোপ না করত, রাশিয়া আজ খাদ্য সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হত না, রাশিয়ায় করোনার ভ্যাক্সিন তৈরি হত না। অনেকের ধারণা পশ্চিমা বিশ্বের সাথে এই স্নায়ু যুদ্ধ রাশিয়ার জন্য শাপে বর হয়েছে। 

কিছু কিছু সময় আসে যখন মানুষ যাই করুক না কেন, সেটা কেমনে কেমনে যেন ভুল হয়ে যায়। আজকাল আমেরিকার সেই অবস্থা। কী নিজ দেশের নির্বাচন, কী বিদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অভিযান – সব কেমন যেন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। মুক্তি সেনা, গণতন্ত্রের অগ্র সৈনিক – যে নামেই তৈরি হোক না কেন, দিনের শেষে সব হয় সেই আল কায়েদা বা ইসলামিক স্টেট। মাঝে মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারি অফ স্টেটের প্রেস ব্রিফিং শুনি। আর এদের কথা শুনে এরা যে আমেরিকার মত একটা উন্নত রাষ্ট্রের প্রতিনিধি সেটা ভাবতেই মাথা হেঁট হয়ে যায়। এই রকম গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে লোকজন যে এরকম অজ্ঞ সেটা বিশ্বাস করা যায় না। আমাদের সব দেশে, যেখানে এমনকি স্কুল পাশ না করেও অনেকে অনেক বড় বড় পদে নির্বাচিত হয় তাদের কথা বাদ দিলাম, কিন্তু বাঘা বাঘা ইউনিভার্সিটি শেষ করে মানুষ যে এতটা অজ্ঞতার পরিচয় দিতে পারে সেটা অবিশ্বাস্য। আসলে পদ মানুষকে অলংকৃত করে না, মানুষই পদকে অলংকৃত। জাতি সংঘে কলিন্স পাওয়েলের টেস্ট টিউব ভেল্কির পর থেকে আমেরিকার উপস্থাপিত বিভিন্ন তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করার যথেষ্ট কারণ আছে। যখন প্রেস সেক্রেটারি রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনে আর উপস্থিত সাংবাদিকরা এটা নিয়ে প্রশ্ন করে তখন হয় তারা বলে সামাজিক মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য অথবা আমেরিকা বা ব্রিটিশ সরকার যে বলছে এটাই সত্যতার বড় প্রমাণ। আসলে সব দেখে মনে হয় পশ্চিমা বিশ্বের রাজনীতি আজ মিডিয়ার হাতে বন্দী। আগে মিডিয়াকে বলা হত চতুর্থ শক্তি। তারা সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতি প্রকাশ করে সরকারকে জবাবদিহিতার অধীনে আনত। কিন্তু বিগত কয়েক বছর মিডিয়া এতটাই শক্তিশালী যে তারাই বলতে গেলে সরকারের নীতি নির্ধারণ করে। যেহেতু ভোটারদের উপর মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ অপরিসীম, তাই সরকার বাধ্য হয়ে মিডিয়ার সত্য মিথ্যা সব চোখ বুজে গ্রহণ করে। অথবা বলা যায় সরকার ও মিডিয়া (মিডিয়ার এক অংশ) মিলে সিন্ডিকেট গঠন করে দেশের রাজনীতি ও জনমত নিয়ন্ত্রণ করে। আগে যদি এরা একে অন্যকে সংশোধন করত, এখন এরা এক টিমে খেলে বিধায় নিজেদের স্বার্থে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেয়। একদা বাকস্বাধীনতার পুণ্যভূমি পশ্চিমা বিশ্বে ভিন্নমতের সুযোগ নেই। তাই তো আরটি প্রায়ই বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়। আজ প্রতিক্রিয়া স্বরূপ রাশিয়া ডয়চে ভিল্লি নিষেধ করল।  
আসলে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার ইউক্রাইন আক্রমণ নিয়ে মিথ্যে প্রোপ্যাগান্ডা চালাতে চালাতে মনে হয় শেষ পর্যন্ত নিজেই সেটা বিশ্বাস করে বসে আছে। অথবা এমন হতে পারে বিশ্বাস না করেও পিছু হটতে পারছে না। ওরা অবশ্য দিবা নিশি একই স্বপ্ন দেখে – রাশিয়া ইউক্রাইন আক্রমণ করুক। শত হলে দুটো স্লাভিয়ান দেশ। বলতে গেলে একই জাতি। আর তাহলে রাশিয়ার উপর নতুন করে এম্বারগো আরোপ করতে সুবিধা হবে। অবশ্য নিষেধাজ্ঞা ওরা এমনিতেই আরোপ করতেই পারে। রাশিয়া সেটা জানে। জানে এতে ক্ষতি হবে, তাই প্রস্তুত। তবে বাস্তবতা এই যে এই এম্বারগো এক তরফা হবে না। ২০১৪ সালের এম্বারগোর পর ইউরোপ অর্থনৈতিক ভাবে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কিন্তু যেহেতু আমেরিকা বা ব্রিটেনের সাথে রাশিয়ার বানিজ্যের পরিমাণ নগণ্য তাই ওদের গায়ে লাগে না। কিন্তু রাশিয়া যদি উল্টো এম্বারগো ঘোষণা করে তবে বিশ্ব অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। অনেকেই এখানে  সেক্ষেত্রে ইউরোপে তেল গ্যাস সাপ্লাই বন্ধ করতে, পশ্চিমা দেশের বিমান চলাচলের জন্য রাশিয়ার আকাশ বন্ধ করতে আহ্বান জানাচ্ছে। তবে তাতে রাশিয়া শুধু অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে না, বিশ্ব রাজনীতিতে তাদের প্রভাব কমবে। তাই হয়ত সে পথে যাবে না। যদি রাশিয়াকে সুইফট থেকে কেটে দেওয়া হয় তাহলে সে  বানিজ্য করবে ইউয়ানের মাধ্যমে। যেসব দেশ, বিশেষ করে ইউরোপ গ্যাস পেতে চাইলে তাদেরও ইউয়ানের পথে যেতেই বাধ্য হতে হবে। তাই এমন কোন এম্বারগো নেই যেটা পশ্চিমা বিশ্বের ক্ষতি না করে রাশিয়ার অর্থনীতিকে ধ্বংস করবে। তাছাড়া যেক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকা বিশ্ব বানিজ্যের ৪০% উৎপাদন করত, এখন তার পরিমাণ ১৫%। চীন, ভারত সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উৎপাদনের পরিমাণ ইউরোপ আমেরিকাকে অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। পিকিং অলিম্পিকে গিয়ে রাশিয়া ও চীন এক দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে ইউরোপ নয় চীন হবে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বানিজ্য পার্টনার। চীন রাশিয়াকে অর্থনৈতিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে আমেরিকার হুমকি কানে না তুলে। এভাবে পশ্চিমা বিশ্ব এক এক করে তাদের সব অস্ত্র হারাচ্ছে। এমতাবস্থায় ওয়াশিংটনের যুদ্ধবাজরা কিয়েভকে বলতে পারে যুদ্ধ লাগাতে। সেটা কারও জন্যেই ভাল হবে না। কেননা রাশিয়া পাল্টা উত্তর দেবে। সেক্ষেত্রে দুই পরাশক্তির মধ্যে নিউক্লিয়ার ওয়ার অসম্ভব কিছু নয়। অন্তত আমেরিকার হঠকারিতার উত্তর দেবার মত রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব বর্তমান রুশ নেতৃত্বের নেই।      

আজকাল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাসকে পুনরায় লেখার চেষ্টা চলছে। করছে আমেরিকা আর ব্রিটেন সেই যুদ্ধে নিজেদের গৌরব বাড়ানোর জন্য, করছে ইউরোপ – তাদের কুকর্ম ঢাকার জন্য। উল্লেখ করা যেতে পারে যে তখন সমস্ত ইউরোপ জার্মানি ও ইতালির কাছে বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেছিল। এরাই পরে একজগে আক্রমণ করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুদ্ধের পরে এদের অনেকে সমাজতান্ত্রিক শিবিরে যোগ দেওয়ায় ন্যুরেনবারগ ট্রাইব্যনাল এড়িয়ে গেছে। এই যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন  হারিয়েছে ২৬ মিলিয়ন মানুষ। চীন ৩৫ মিলিয়ন যেটা সেভাবে কখনও উঠে আসেনি। এছাড়া কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, বার্মা, থাইল্যান্ড, কাম্পুচিয়া, মালয়েশিয়া ইত্যাদি এশিয়ার দেশগুলোর প্রাণহানিও ইংল্যান্ড, আমেরিকার চেয়ে কম নয়। তাই সেই যুদ্ধের ইতিহাস কেউ নিজেদের রাজনৈতিক বিবেচনায় পালটাবে – সেটা তারাও চায় না। রাশিয়া ও চীনের ঘোষণায় সেটাও উঠে এসেছে। তাই বিভিন্ন প্রশ্নে ইউরোপ আর আমেরিকার সাথে রাশিয়ার মতবিরোধ থাকলেও রাশিয়ার পক্ষে এশিয়ার অনেক দেশ। তাই তাকে একঘরে করা ততটা সহজ নয় যেটা পশ্চিমা বিশ্ব ভাবছে। 

সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকতে ন্যাটো ছিল রাজনৈতিক ব্লক, তারা কখনও কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। এখন তারা বিভিন্ন যুদ্ধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে। যুগোস্লাভিয়া দিয়ে শুরু, এরপর একে একে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া আর প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রচণ্ড ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। কোয়ান্টিটি সেখানে কোয়ালিটেটিভ চেঞ্জ এনেছে – খারাপের দিকে। বিশ্ব নিরাপত্তা আরও বেশি ভঙ্গুর আর সেটা ন্যাটোর যুদ্ধংদেহী মনোভাবের ফলে। কিন্তু দিন দিন কী ন্যাটো, কী পশ্চিমা বিশ্ব তার শক্তি হারাচ্ছে, হারাচ্ছে সবক্ষেত্রেই। হোক সে সামরিক, হোক অর্থনৈতিক, হোক রাজনৈতিক, হোক নৈতিক। ন্যাটোর আক্রমণে ইউরোপে যে উদ্বাস্তু সংকট তৈরি হয়েছে তাতে তাদের মাল্টিকালচারাল পলিসি ভেঙে পড়েছে। 
ইতিমধ্যে ইংল্যান্ড ঘোষণা করেছে যে যে সমস্ত রুশ ধনকুবের, বিশেষ করে পুতিনের ক্লোজ সার্কেলের যাদের সম্পত্তি সে দেশে আছে, সেসব বাজেয়াপ্ত করা হবে। কিন্তু সমস্যা হল, পুতিনের ক্লোজ সার্কেলের কেউ হয়ত এখন আর সেদেশে নেই আর যারা আছে তারা দেশের রাজনীতিতে কোন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে না। নব্বুইয়ের দশকে তারা শুধু ধনকুবেরই ছিল না, এরা দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। ইয়েলৎসিনের অজনপ্রিয়তা ও নড়বড়ে অবস্থা ব্যবহার করে তারা নিজেদের ইচ্ছেমত আইন প্রণয়ন করত। বলতে গেলে বরিস বেরেজভস্কি নেপথ্য থেকে দেশ চালাত। কথিত আছে ২০০০ সালে বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের পর পুতিন সব অলিগারখদের ডেকে বলেন এতদিন যা হয়েছে হয়েছে, এখন থেকে তিনি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যাপারে বিজনেসের হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করবেন না। মিটিং শেষে খাদারকভস্কি পুতিনকে শুনিয়ে শুনিয়ে পতানিনকে বলেন, তুমি প্রেসিডেন্ট হও আর আমি প্রাইম মিনিস্টার। এটা পরে কোন এক সাক্ষৎকারে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের তৎকালীন প্রধান গেরাসেঙ্কো বলেছিলেন। ধারণা করা হয় এ কারণেই পরে খাদারকভস্কির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তাকে জেলে পাঠান হয়। এভাবেই তখনকার সবচেয়ে বড় কোম্পানি ইউকস সর্বস্বান্ত হয়। সে সময় চাইলে প্রতিটি অলিগারখের বিরুদ্ধেই গুরুতর অভিযোগ আনা যেত। তবে এভাবে পুতিন অন্যদের সাবধান করে দিয়েছেন। তাই লন্ডনের এই পদক্ষেপ কতটুকু কার্যকরী হবে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাছাড়া ওখানে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তারা যদি ব্রিটিশ সরকারের সাথে সহযোগিতা করতে শুরু করে রাশিয়া তাদের ফরেন এজেন্ট ঘোষণা করে ব্যবস্থা নিতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা এইসব ধনকুবের, আমলা ইত্যাদির বিরুদ্ধে মস্কো বা লন্ডন ব্যবস্থা নিলে রুশ জনগণ উল্টো খুশিই হবে। পুতিন অনেক আগেই তাদের বলেছেন সমস্ত সম্পদ দেশে আনতে, তাই যদি কেউ সেটা না করে থাকে তা হবে নিজেদের রিস্ক। এছাড়া লন্ডনের এই পদক্ষেপের বিপরীতে মস্কো বিপির সম্পত্তি এখানে বাজেয়াপ্ত করতে পারে যার পরিমাণ অনেক বেশি। যদি রাশিয়ার সম্পদ আটক করা হয় তবে মস্কো অনুরূপ ব্যবস্থা নিতে পারে। বর্তমানে রাশিয়ায় ইউরোপ আমেরিকার হাজার হাজার কোম্পানি কাজ করছে। তাদের সম্পদ আটক করলে সেটা বিশ্ব বানিজ্যে প্রভাব ফেলবে। এছাড়া রাশিয়া বিদেশি ঋণ পরিশোধ স্থগিত রাখতে পারে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে সোভিয়েত ইউনিয়নের বেশ বড় অংকের বিদেশি ঋণ ছিল। নব্বুইয়ের দশকে সেটা বেড়ে ১৩৫ বিলিয়নের মত হয়। পুতিন এসে প্রথমেই যেটা করেন – তা হল এই ঋণ পরিশোধ করা। অনেকেই এর বিপক্ষে ছিলেন, কিন্তু তিনি বলেন ঋণের সুদ টানার চেয়ে সেটা মিটিয়ে ফেলা ভাল। বর্তমানে (০১ জানুয়ারি ২০২২) রাশিয়ার বিদেশি ঋণ ৪৭৮ বিলিয়ন ডলার যার ৫৫% প্রাইভেট সেক্টরের। তবে সে সময় রাশিয়ার রিজার্ভ বলতে কিছু ছিল না, যা এখন ৬৩৪ বিলিয়ন ডলার। তাই রুশ সম্পদ আটক করার ব্যাপারেও তাদের দু বার ভাবতে হবে। 

নব্বুইয়ের দশকে সব কিছুর মত এদের আর্মির অবস্থাও করুন ছিল। আসলে সেটা যতটা না আর্মির কারণে তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে। চেচনিয়ার যুদ্ধে রুশ আর্মি বার বার জয়ের মুখে এসেছে, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব প্লাস অলিগারখদের কিছু অংশের, বিশেষ করে বেরেজভস্কি, যে মানুষের কষ্ট আর মৃত্যুকে পুঁজি করে বিত্ত কামিয়েছে, কারণে বারবার অপমানিত, লাঞ্ছিত হয়েছে। পিটার দ্য গ্রেট ইউরোপের জানালা খুলে দিয়েছিলেন, নৌবহর তৈরি করেছিলেন। বলেন আর্মি ও নৌবহর সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। সেটা এরা বারবার প্রমান করেছে। কী জারের রাশিয়া, কী সোভিয়েত ইউনিয়ন – আর্মি সব সময়ই দেশের মুখ উজ্বল করেছে, কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব সব সময় সেটা পারেনি। যার গ্লানি নিতে হয়েছে আর্মিকে। কিন্তু নব্বুইয়ের দশকেই আর্মি ঘুরে দাঁড়ায়। ন্যাটোর মুখের উপর থেকে প্রিস্টেন এয়ারপোর্ট দখল করে ১৯৯৯ সালে। সেটা অবশ্য ইয়েলৎসিনকে না জানিয়ে। আর্মির হাই কম্যান্ড সমস্ত প্ল্যান তৈরি করে তখনকার রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি পুতিনকে বলে আর পুতিন ইয়েলৎসিনকে না জানিয়ে গ্রীন সিগন্যাল দিয়ে দেন। এভাবেই শুরু হয় রাশিয়ার ঘুরে দাঁড়ানো। তারপর প্রধানমন্ত্রী প্রিমাকভ আটলান্টিকের উপর থেকে বিমান ঘুরিয়ে চলে আসেন আমেরিকার বেলগ্রেড আক্রমণের প্রতিবাদে। আসলে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা নতুন নয়, এমনকি অক্টোবর বিপ্লবের পরেও নয়। সেটা শুরু হয় ৯৮৮ সালে যখন কিয়েভের রুশ রাজা ভ্লাদিমির কনস্টান্টিনোপল থেকে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহন করেন।        

প্রকৃতির নিয়ম হল যে সে সব সময় স্থিতিশীল থাকতে চায় আর এটা সম্ভব যখন সে শক্তির সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করে। ইউক্রাইনকে কেন্দ্র করে যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়েছে তার কোন শেষ নেই। সেটা বরং দিন দিন বাড়ছে। পশ্চিমা দেশগুলো একের পর বানোয়াট অভিযোগ তুলে আসর গরম রাখছে। বলা হয় পাহাড় যখন তুষারে পরিপূর্ণ তখন সামান্য ইকো তুষারধ্বসের কারণ হতে পারে। মহবিশ্বের উৎপত্তি থেকে শুরু করে সবই ঘটে আক্সিডেন্টালি। পরিবেশ যখন ক্রোধ, ক্ষোভ, অভিযোগ, অনুযোগে পরিপূর্ণ তখন ছোটখাটো যেকোনো ঘটনা বড় যুদ্ধের কারণ হতে পারে। প্রিবাল্টিক, ইউক্রাইন, পোল্যান্ড, জর্জিয়ার মত দেশ যারা অন্যের শক্তির উপর নির্ভর করে তাদের দায়িত্ববোধ বরাবরই কম, ভাবে কিছু একটা করে বসলে আমেরিকা এসে রক্ষা করবে। কিন্তু বর্তমান কালে, যখন একটু ভুলের কারণে রাশিয়া-আমেরিকার মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ লেগে যেতে পারে তখন এ ধরণের বন্ধুদের বন্ধুত্ব সারা পৃথিবীর জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। 

এখানকার বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি একমত যে এম্বারগো আরোপিত হবে। পশ্চিমা বিশ্ব কোন এক কারণে ভাবছে রাশিয়া এতই দুর্বল যে এতেই তার পতন হবে, কারণ তাতে অলিগারখ ও সাধারণ মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে। আমার ধারণা এটা তাদের ভুল ক্যাল্কুলেশন। আরও একটা কথা। আগে ধারণা করা হত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতৃত্বের অভাব শক্তিশালী সিস্টেম বা সংগঠন দিয়ে পূরণ করা যায়। এতদিন পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বে সিস্টেম ঘড়ির কাটার মতই কাজ করেছে। কিন্তু বর্তমানে একদিকে যেমন নেতৃত্বের অভাব তেমনি সিস্টেমের দীনতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। 

উল্লেখ করা যেতে পারে যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের সময় ইউক্রাইন ছিল কী কৃষিতে, কী শিল্পে অন্যতম উন্নত রিপাবলিক। কিন্তু এখন? এখন সে ইউরোপের অন্যতম দরিদ্র দেশ। ১৯৮৯ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ইউক্রাইনের জনসংখ্যা ছিল ৫১,৭ মিলিয়ন, ২০১৪ সালে  ৪৫.৫ আর ক্রিমিয়া ও দানবাস ছাড়া ৩৬,৫ মিলিয়ন। করোনাকালীন হিসেবে ২০২০ সালে সেটা  ৪১,৭ মিলিয়ন যদিও অনেকের ধারণা বাস্তবে সেটা অনেক কম।  বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী  এই জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ কাজ করে রাশিয়ায় অথবা ইউরোপে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা অড জবের সাথে জড়িত। আগেই বলেছি ইউক্রাইনের শিল্প প্রায় ধ্বংসের পথে। যদিও সংবিধান অনুযায়ী বিদেশিদের কাছে জমি বিক্রি নিষিদ্ধ কিছুদিন আগে ইউক্রাইনের পার্লামেন্ট রাদা সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। এর অর্থ ইউক্রাইনের জমি যাবে বিদেশিদের দখলে আর দেশের মানুষ আরেক দফা নিঃস্ব হবে। কিন্তু ইউক্রাইনের সোনার জমি কৃষি কাজে ব্যবহৃত হবে না,  সেখানে উৎপাদিত হবে শেল গ্যাস।  বলা হয়ে থাকে আমেরিকা সেখানে স্থানীয় রুশদের বাইও ম্যাটেরিয়াল সংগ্রহ করছে। কেন? বাইওলজিক্যাল অস্ত্র তৈরিতে? আসলে সমস্যা এত গভীর যে এ থেকে বেরিয়ে আসা কষ্ট। দু পক্ষ থেকেই বাজির টাকার অংক বিশাল। এখানে যে রাশিয়ার দোষ নেই তা নয়। এতদিন তারা নিজেদের ঘর গোছাতে  ব্যস্ত ছিল, প্রতিবেশিদের দিকে নজর দিতে পারেনি। হয়ত ভেবেছে যাবে কোথায়? দীর্ঘ দিন যাবত রাশিয়া ইউক্রাইনের ইকোনমিতে যে ভর্তুকি দিয়েছে সেটা গিয়েছে অলিগারখ ও ক্ষমতাসীনদের পকেটে। জনগণ এর ছিটেফোঁটাও পায়নি। এক কথায় ইউক্রাইনের বর্তমান অবস্থার জন্য ইউক্রাইন নিজের যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্ব। ইউক্রাইনের ভৌগলিক হতে পারত আসেট অপরিপক্ক হাতে তা হয়েছে রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে অশান্তির আপেল।    

আগেই বলেছি রাশিয়া ও ন্যাটোর সাথে সম্পর্ক প্রশ্নে ইউক্রাইন দুই ভাগে বিভক্ত। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যুদ্ধ থামানো ও রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ভাল করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জেলেনস্কি ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু সে সব প্রতিশ্রুতি পূরণ করা তো দূরের কথা বর্তমান প্রেসিডেন্ট আরও বেশি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছেন দেশকে। এখানে উল্লেক্ষ্য যে ইউক্রাইনে প্রায় ৫০% জাতিগত ভাবে রুশরাই বসবাস করে না, সে দেশের ব্যাপক সংখ্যক মানুষ রুশ অর্থোডক্স চার্চের অনুসারী। সাবেক প্রেসিডেন্ট পারাশেঙ্কো এমনকি কনস্টান্টিনোপলের পাট্রিয়ারখকে রাজী করিয়ে আলাদা ইউক্রাইন চার্চ করেছেন, রুশ চার্চের অনুসারীদের বিভিন্ন ভাবে নিগ্রহ করার চেষ্টা করেছেন, কোন ফল হয়নি। তাই যেকোন যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। বিগত তিরিশ বছরে ইউক্রাইন নিজেকে অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী করার কোন পদক্ষেপ নেয়নি। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল একদিকে রাশিয়ার তেল গ্যাস থেকে ট্র্যাঞ্জিট মানি আর পশ্চিমা বিশ্বে রুশফোবিয়া বিক্রি করে দেশকে কোন ভাবে ভাসিয়ে রাখা। নব্বুইয়ের দশকে রাশিয়া মূলত অলিগারখদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। ইউক্রাইন এখনও সে অবস্থার মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। সেই সমাজের সব রকমের দ্বন্দ্ব আসলে বিভিন্ন অলিগারখদের জাতীয় সম্পদ ভাগবাটোয়ারার দ্বন্দ্ব। আর এটাকে ব্যবহার করে পশ্চিমা বিশ্ব এখানে রুশ বিরোধী মনোভাব উস্কে দিচ্ছে। কিন্তু সত্য কথা হল দুর্বলতা দুর্বলতাই। দুর্বলতার কথা বলে অন্যের সহানুভূতি অর্জন করা যায়, কিন্তু দুর্বলতা বিক্রি করে সবল হওয়া যায় না। দুর্বলতা বিক্রি করতে গেলে আসলে নিজের স্বাধীনতাকেই বিক্রি করতে হয়, অন্যের করদ রাজ্যে পরিণত হতে হয়। আর যারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজের স্বার্থেই সেটা করে। অন্যের সমস্যার সমাধান তাদের লক্ষ্য নয়, অন্যের দুর্দশাকে পুঁজি করে নিজেদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানই তাদের লক্ষ্য। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ, অধিকাংশ দেশের নেতৃবৃন্দ সেটা বোঝে না, বুঝতে চায় না বা তাদের বুঝতে দেওয়া হয় না। ক্ষমতার নেশা এমন যে মানুষের সাধারণ বিচারবুদ্ধি পর্যন্ত লোপ পায়। বিগত কয়েক বছর ইউরোপ আর ন্যাটোর সদস্য হওয়ার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও ইউক্রাইন গণতান্ত্রিক দেশ হওয়ার পথে দু কদমও এগোয় নি, তাদের দুর্নীতি আগের মতই আকাশচুম্বী, ভিন্নমত পদদলিত, মানুষের অধিকার ভূলুণ্ঠিত। এ জন্যে রাশিয়াকে দায়ী করা যায়, ইউক্রাইন নিজে ও পশ্চিমা বিশ্ব সেটাই করে। কিন্তু তাতে মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হয় না, হবে না। রাশিয়াকে দায়ী করার আগে আয়নার নিজেদের মুখ দেখতে হয়, নিজেদের ভুলত্রুটির চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হয় আর সবচেয়ে বড় কথা দেশকে, দেশের মানুষকে ভালবাসতে হয়। সাগর পাড়ের আঙ্কেল স্যাম নয়, নিজের দেশের মানুষই দেশকে এ অবস্থা থেকে বের করে আনতে সবচেয়ে বড় শক্তি; উগ্রবাদীদের নয়, সাধারণ মানুষের স্বার্থই দেশের স্বার্থ এটা উপলব্ধি করতে হয়।           

যদিও যুদ্ধের দামামা বাজছে যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত মনে হয় লাগবে না। কিছু দিন আগে রাশিয়া তার বিভিন্ন দাবিদাওয়া জানিয়ে আমেরিকা ও ন্যাটোকে চিঠি দিয়েছে। সে চিঠির উত্তরও এসেছে। তা নিয়ে অনেক কথা হবে, হবে আলোচনা। এ সবই মনে হয় সে আলোচনায় বসার আগে নিজ নিজ অবস্থানকে শক্তিশালী করার প্রয়াস। এখন সর্বত্র চলছে ডিপ্লোম্যাটিক প্রসেস। তবে সবাই উত্তেজিত। সবাই একে অন্যকে দোষ দিতে ব্যস্ত। তাই শেষ পর্যন্ত কী ঘটে কেউ বলতে পারে না।  তবে চেখভ যেমন বলেছিলেন – দেয়ালে অস্ত্র ঝুললে একদিন না একদিন তা থেকে গুলি বেরুবেই। সেটা যাতে না হয় সেজন্যে দরকার অস্ত্র সরানো, দরকার উত্তেজনা কমানো। আমরা শুধু অপেক্ষাই করতে পারি। 
             
১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট মেনুফেস্টে মার্ক্স লিখেছিলেন “ইউরোপ ভূত দেখেছে, কমিউনিজমের ভূত।” এখন মনে হয় পশ্চিমা বিশ্ব ভূত দেখেছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূত। 


গবেষক ও শিক্ষক 
জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ ও পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো, রাশিয়া

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments