জ্বলদর্চি

আগডুম রাজ্যে -৪ / অলোক চট্টোপাধ্যায়

আগডুম রাজ্যে - ৪ 

 অলোক চট্টোপাধ্যায়

বন্দিশালাটাও ভারি অদ্ভুত জায়গা। একটা উঁচু পাঁচিল ঘেরা মস্ত বাড়ির উঠোনে সারি সারি খাঁচার মত লোহার গরাদ লাগানো অনেকগুলো খুপরি পানা ঘর। প্রতিটার ভেতরে দুজন করে লোক। আমাকে আর একজন কমবয়সি লোকের সঙ্গে অমনি একটা খাঁচায় পুরে মেজো কোতোয়াল আর বটকেষ্ট চলে গেল। কিন্তু কি আশ্চর্য্য, দরজাটাতে তালা টালা কিছুই লাগাল না। বাইরে অন্ধকার হয়ে আসছে। আমার সঙ্গের লোকটা এদিকে ভেতরে ঢুকেই একপাশে পাতা বিছানার ওপর দিব্যি শুয়ে পড়েছে। আমি তাকে ডেকে বললাম – ওহে শুনছো –
লোকটা বিরক্ত গলায় বলল – আমার নাম ‘ওহে’ নয়, ঘটপটি। 
আমি বললাম – তা নয় হল। কিন্তু ভাই ঘটপটি, সেপাইরা তো ভুল করে খাঁচার দরজা খুলে রেখেই চলে গেল। আশপাশেও পাহারাওয়ালা কাউকে দেখছি না। এই ফাঁকে পালিয়ে গেলে হয় না?
ঘটপটি হাই তুলতে তুলতে বলল – ভুলে খুলে রেখে গেছে না ঘেঁচু। এ সব ওদের কায়দা। তুমি কি নতুন নাকি এ লাইনে? ওরা তো চাইছে যে আমরা পালাই। আর তারপর –
আমি কাতর গলায় বললাম – তারপর যেই কেউ পালাবে অমনি তাকে ধরে শূলে চড়িয়ে দেয় নাকি? আসলে আমার কেমন আবছা আবছা মনে পড়ল কোথায় যেন বন্দিদের এইভাবে পালিয়ে যাবার সুযোগ দিয়ে তারপর যেই তারা পালাতে যায় তখন সেপাইরা তাদের পেছন থেকে দমাদ্দম করে  –
আমাকে পুরোটা ভাবতে না দিয়েই ঘটপটি বলল – ধুর, তাতে ওদের কি লাভ? ওরা কি অতই বোকা নাকি ? তারপর সে কিছুক্ষণ আমাকে বেশ নিরীক্ষণ করে বলল – নাঃ, মনে হচ্ছে তুমি কিছুই খোঁজ রাখো না। আগে ধরা পড়োনি কখনো? আচ্ছা তা নয় পড়নি। কিন্তু এটা তো শুনেছ যে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে? ওরা তো চায় যে আমরা পালাই আর ওদের বুদ্ধি বেড়ে যাক।
-কিন্তু ওটা তো একটা কথার কথা। আমি বললাম। -সে রকম সত্যি সত্যি হয় নাকি? শুনে ঘটপটি তাড়াতাড়ি বলল – হয় কি হয় না জানিনা তবে প্রাচীন বই পত্তরে ওরকমই তো লেখা আছে। সে সব বইকে কি মানো না নাকি? তাহলে কিন্তু খুব ঝামেলায় পড়বে বলে রাখলাম।
আমি তক্ষুনি বললাম – না না ওসব আমি খুব মানি। খালি মাঝে মাঝে মাথাটা একটু গুলিয়ে গিয়ে ভুলভাল হয়ে যায়। 
-যাক গে। ঘটপটি বলল। - মোট কথা ওরা চায় যে চোরেরা পালাক আর ওদের বুদ্ধি বাড়ুক। সেই জন্যে দরজা খুলে রাখে যাতে তোমার মত উটকো লোকেরা সেই ফাঁদে পা দেয়। তোমাকে বলে দিচ্ছি ওরা এই এল বলে। খবর্দার, দরাদরি না করে কিছুতেই রাজি হবে না।
কিসের দরাদরি কিছুই বুঝলাম না। তবে ঘটপটিকে বললাম – ঠিক আছে, তুমি যেমন যেমন বলবে আমি ঠিক সেই রকমই করব। শুনে সে বেশ খুশি হল বলে মনে হল।
কি আশ্চর্য্য। একটু বাদেই দেখি মেজো কোতোয়াল আর বটকেষ্ট এসে উপস্থিত। - একি, তোমরা এখনো খাঁচায় বসে আছো? পালাওনি?
ঘটপটি সোজা সাপটা জবাব দিল – না, আমরা পালাব না।
মেজো কোতোয়াল চোখ কপালে তুলে বলল- সে কি কথা! সক্কলে পালায় আর তোমরা বলছ পালাবে না! সে রকম আবার হয় নাকি? 
ঘটপটি চটপট জবাব দিল – হ্যাঁ হয়। হওয়ালেই হয়। যারা পালাচ্ছে পালাক, আমি আর আমার বন্ধু এখানেই থাকব। এই বলে সে পাশ ফিরে ঘুমোবার উপক্রম করল।
তখন তাদের সে কি কাকুতি মিনতি। কি সাধ্যসাধনা। কিন্তু ঘটপটি অটল। কিছুতেই পালাবে না সে। আমি এদিকে ভাবছি একবার বাইরে বেরোতে পারলে মন্দ হয়না, নতুন জায়গাটা একটু ঘুরে ফিরে দেখে নেওয়া যায়। কিন্তু ঘটপটির কথা ভেবেই সে কথা বলতে পারছি না, এমন সময়ে নিরুপায় হয়েই মেজো কোতোয়াল বলল – আচ্ছা ঠিক আছে, পাঁচটা করে টঙ্কই না হয় দেবো। তাহলে পালাবে তো? বুঝলাম টঙ্ক জিনিসটা ওদের দেশের টা্কার মত কিছু হবে ।
ঘটপটি দরাদরি আরম্ভ করল – পাঁচে হবে না। দুজনের দশ দশ টঙ্ক চাই। তাছাড়া রাত্তিরের খাবার খেয়ে তারপর পালাব। তারপর চলল কিছুক্ষন দর কষাকষি। শেষ অবধি রফা হল আট টঙ্কতে। রাতের খাবারও এসে গেল। ঝকঝকে থালায় ভাতের মত কিছু একটা , সঙ্গে মেলানো মেশানো অনেক রকম অচেনা সব্জির তরকারি। আমার বেশ ক্ষিধে পেয়েছিল। থালা হাতে পেতেই খেতে শুরু করে দিয়েছিলাম। বেশ ভালোই খেতে। ঘটপটি কিন্তু তাতেও খুশি নয়। ব্যাজার মুখে বলল – মিষ্টি কোথায়?
মেজো কোতোয়াল দাঁত কিড়মিড় করতে করতে কাকে যেন হুকুম করল। গোল গোল সবুজ রঙের মিষ্টি এল আমাদের জন্যে। সেগুলোও ভারি চমৎকার।
খেয়ে উঠে ঘটপটি দুবার আড়মোড়া ভেঙে বলল – একটু ঘুমিয়ে নিতে পারলে হত। তবে আপনি যখন তাড়া লাগাচ্ছেন তখন এখনই পালাচ্ছি। আমাকে বলল, - চলো ভাই, দৌড় লাগাই।
খাঁচার বাইরে আসতে মেজো কোতোয়াল খুব অপ্রসন্ন মুখে আমাদের হাতে গুনে গুনে আটটা করে টিনের ছোটো ছোটো গোল চাকতি দিল। সে গুলোর ওপর কিসব ইকড়ি মিকড়ি কাটা। বুঝলাম ওগুলোই টঙ্ক। তারপর সে উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল। ঘটপটি আমাকে বলল – এবার জোরসে ছুট লাগাও। বলেই নিজে ছুটতে শুরু করল আর আমিও কিছু না ভেবেই তার পেছন পেছন ছুটলাম। উঠোনের মত জায়গাটা পেরিয়ে গেট অবধি পৌঁছোতে না পৌঁছোতেই মেজো কোতোয়াল –‘ ধর ধর, পালালো পালালো’ বলে মহা শোরগোল বাধিয়ে দিল।
ছুটতে ছুটতেই ঘটপটিকে শুধোলাম – এটা কিরকম হল ভাই? নিজে থেকেই আমাদের পালাতে দিয়ে আবার ‘ধর ধর’ বলে চ্যাঁচাচ্ছে কেন?
ঘটপটিও তেমনি ছুটতে ছুটতে বলল – বাঃ চ্যাঁচাবে না? চোর পালাচ্ছে বলে কথা। দ্যাখো না এক্ষুনি ঢং ঢং করে পাগলা ঘন্টিও বাজাবে। আর তারপরে ধীরে সুস্থে একদল সেপাই বেরোবে আমাদের খুঁজতে। তেমনিই তো নিয়ম।
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম – তাহলে তাড়াতাড়ি চল কোথাও গিয়ে গা ঢাকা দিই। আমি তো এখানে নতুন, পথ ঘাট চিনিনা । তুমিই নিয়ে চল আমাকে।
ঘটপটি বলল – না না। পালাবোই বা কেন আর লুকোবোই বা কেন? এই একটু দূরে গিয়ে রাস্তার ধারে বসে থাকব। যতক্ষন না সেপাইরা এসে ধরে নিয়ে যায়।
শুনে তো আমি নেই। সে আবার কিরকম ব্যাপার! তবে আর বন্দিশালা থেকে পালালাম কেন?  ঘটপটি তখন বুঝিয়ে বলল – আজকে ধরে নিয়ে যাবে। কালকে আবার টঙ্ক নিয়ে আবার পালাবো। পরশু আবার ধরবে আবার টঙ্ক দেবে পালাবার জন্যে। আমার পাড়ার খলপট দাদা এই করে গেল মাসে ছত্তিরিশ টঙ্ক কামিয়েছে।
আমি ভারি অবাক হয়ে বললাম – এরকম হয় নাকি? কতবার এমনি করা যায়? ঘটপটি জানাল – একটানা সাত বারের বেশি করা যায় না। অমনিই নিয়ম। বইতে আছে চোরের সাতদিন আর কার যেন একদিন। সেপাইদেরই হবে মনে হয়।  দু একবার করেই দ্যাখো না। নিজেই সব বুঝে যাবে।
ছুটতে ছুটতে আমরা একটা মাঠের ধারে এসে পৌঁছেছিলাম। সেখানে বড় বড় গাছের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ চলে গেছে।  রাস্তার ধারে একটা পাথরের বেদি মতন জায়গায় বসল ঘটপটি। আমাকেও বসালো। আর ইতিমধ্যে দূরে কোথাও ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজতে শুরু করল, সম্ভবত পাগলা ঘন্টিই হবে। আমি উঠে আবার দৌড় লাগাতে যাচ্ছিলাম সে আমার হাত ধরে আটকালো।
-বুঝতে পারছি তুমি চাওনা ওদের বুদ্ধি বেশি বেড়ে যাক। বা তোমার হয়ত অন্য কাজ আছে। তবে তাড়া করার দরকার নেই। সকালের আগে কেউ আমাদের ধরতে আসবেনা। ততক্ষণ বরং তোমার ব্যাপারস্যাপারটা একটু বল দেখি। তুমি কোথাকার লোক? এখানে এলে কি করে? এখানকার নিয়ম কানুন আদব কায়দা কিছুই তো দেখছি জানোনা বাপু। তোমার মনে হয় বন্দিশালায় থাকাই ভাল, নইলে বাইরে থাকলে আরো বিপদে পড়ে যাবে।
আমি তাকে বললাম কিভাবে লোকের তাড়া খেয়ে একটা পাঁচিল টপকে কুয়ো মতন কিছুর ভেতর পড়ে গিয়েছিলাম আর জ্ঞান ফেরার পরে দেখলাম এমনি একটা জায়গায় পৌঁছে গেছি। সে কিছু বুঝল বলে মনে হল না। বোঝবার কথাও নয়, কারণ আমিই কি ছাই সে কথা এখনো বুঝেছি নাকি। কিন্তু সে খুব মন দিয়ে শুনে বলল – আমার দাদার এক বন্ধু বলেছিল এরকম কখনো কখনো হয়। অন্য কোনো জায়গা থেকে এমনি এক দু জন লোক কিভাবে যেন এখানে চলে আসে। সে নাকি নিজে এমনি একজন অদ্ভুত লোক দেখেছিল । পন্ডিতেরা এদের বলে মাত্রাছাড়া লোক। তুমিও মনে হয় সেরকম।
তার কথাবার্তা বিশেষ বুঝলাম না, বোঝার চেষ্টাও করলাম না। কত কিই তো আমার বোঝার বাইরে আছে । আর একটা নয় বাড়ল। তবে আমি ঘটপটিকে বললাম যে ভাবেই হোক না কেন, এসে যখন পড়েছি তখন এ জায়গাটা ভাল করে ঘুরে ফিরে দেখতে চাই। আর সেজন্যেই আবার বন্দিশালায় ফেরৎ যেতে রাজি নই। সব শুনে সে বলল যে ঐ মাঠের অন্য পারে কিছুটা এগিয়েই তাদের বাড়ি। সেখানে তার সেজোভাই চটপটি থাকে। তার কাছে গিয়ে ওর কথা বললে সে সব রকম সাহায্য করবে।
আমি বললাম – কিন্তু আমি তাকে চিনব কি করে?
ঘটপটি বলল – সে খুব সোজা। মাঠের ওপারে গিয়ে দেখবে গিয়ে সামনেই দেখবে একটা লাল রঙের বাড়ি। খুব সাবধান, সেটা একটা পাগলা গারদ, ধারে কাছে যাবেনা। তার পাশ দিয়ে দুটো রাস্তা চলে গেছে। একটা ডানদিকে, অন্যটা বাঁ দিকে। ডান দিক দিয়ে একটু দুর গেলেই একটা বাজার পড়বে। সেখানে যে কোনো দোকানে ঘটপটি চটপটিদের বাড়ি জিগ্যেস করলেই সবাই দেখিয়ে দেবে। চটপটিকে আমার নাম করে বললেই সে ঠিক কিছু ব্যবস্থা করবে। আর তাকে চেনাও শক্ত হবেনা। অবিকল আমারই মত দেখতে, শুধু ডান গালে একটা বড় আঁচিল আছে। তবে তুমি এখন রওনা হও। সকাল হয়ে এল। যে কোনো সময়ে সেপাইরা আমাদের ধরতে চলে আসবে। তোমার খোঁজ করলে আমি তাদের উলটো দিকের রাস্তা দেখিয়ে দেব। তুমি নিশ্চিন্তে আমাদের বাড়ি পৌঁছে যাবে।
ঘটপটির থেকে বিদায় নিতে খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু উপায় নেই। এখন আমার বন্দিশালায় ঢুকে বসে থাকলে চলবেনা। 
মাঠের পথে যেতে যেতে শুনলাম ঘটপটি চিৎকার করে গান ধরেছে ‘ ইলাডিং বিলাডিং – ঘোড়ার ল্যাজ মোষের শিং’ এই জাতীয় কিছু। তারই মধ্যে একটা হৈ হৈ ধর ধর চ্যাঁচামেচি শুনে চট করে একটা গাছের আড়ালে গিয়ে উঁকি মারলাম। দেখলাম দুজন সেপাই এসে ঘটপটিকে জাপটে ধরল। তারপর কি কারণে জানিনা, তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল।  মনে হল, হয়ত এখানকার এই রকমই নিয়ম। পালিয়ে যাওয়া চোরকে ঐ ভাবেই নিয়ে যেতে হয়। তবে ঘটপটি কিন্তু বেশ খুশি মনেই ওদের সঙ্গে যাচ্ছিল, কারণ ঐ অবস্থাতেও তার গান বন্ধ হয়নি।
ওরা রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত গাছের আড়ালেই থেকে তারপর রওনা হলাম আবার। সকাল হয়ে আসছে। মাঠের অন্য প্রান্তে গাছপালার ফাঁক দিয়ে তখন পাঁচিল ঘেরা একটা লাল রঙের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি পা চালালাম সেদিকে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments