জ্বলদর্চি

কিংবদন্তি শক্তি চট্টোপাধ্যায়/ ঈশিতা ভাদুড়ী

স্মৃতি ডট কম ১০
কিংবদন্তি শক্তি চট্টোপাধ্যায় 

 ঈশিতা ভাদুড়ী

১৯৭৭ অথবা ৭৮ সাল, তখন পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার খুব ভক্ত ছিলাম আমি (আজও আছি), আমাকে একজন জিজ্ঞেস করল, পূর্ণেন্দুতে ভর করে আছেন, শক্তি পড়েননি? সেই আমার শুরু হলো শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়া। আমার কবিতার ভুবন রঙ বদলাতে শুরু করল। ধীরে ধীরে সব বই পড়া আরম্ভ হলো, শুধু বই পড়া নয়, তাঁর সম্বন্ধে বিবিধ গল্পও শুনতে থাকলাম।
‘মধ্যরাতে কলকাতা শাসন’ করতেন যে যুবকেরা বলে পড়েছি বা শুনেছি, তার মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অন্যতম। আমরা পড়েছি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং ছ-সাতজন এক জায়গায় মিলিত হতেন, সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা-আটটা থেকে শুরু হতো তাঁদের কলকাতা ভ্রমণ। রাত বাড়ার পর ধীরে ধীরে যে-যার বাড়ী চলে যেতেন। শেষ অবধি চারজন থাকতেন। তাঁরা দোতলা বাসের ওপরে চড়ে, রিকশা করে, হেঁটে, গান গাইতে গাইতে সারা শহর ঘুরতেন। অবশ্য আমরা যখন লিখতে এসেছি, তখন তাঁরা প্রায় সকলেই থিতু হয়ে গিয়েছিলেন, শুধুমাত্র শক্তিদার ছন্নছাড়া যাপন তখনও জারি ছিল। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের থেকেই জেনেছিলাম নিত্যদিনের বোহেমিয়ান এবং নিয়ম ভাঙার নিয়ম কাকে বলে।
শক্তিদা সম্বন্ধে লিখতে গেলে একটি মজার কথা মনে পড়ে যায়। এখানে বলে রাখি অল্পবয়সে আমি মদ্যপান করে অপ্রকৃতিস্থ হওয়াকে এতটাই ভয় পেতাম যে, কী বলবো! সেই ছোট বয়সে যখন কবিতা লেখার শুরু হয়ে গেছে, তখন একবার বইমেলায় আজকাল বা প্রতিক্ষণ (মনে পড়ছে না)-এর স্টলে ঢুকবো বলে দাঁড়িয়েছি। হঠাৎ দেখি শক্তি চট্টোপাধ্যায় শিশুর মতো টলোমলো পায়ে এগোতে এগোতে প্রচন্ড হুঙ্কার মেরে আমাকে ডাক মারলেন ‘এই খুকী শোন্‌’। সেই স্টলে আর ঢোকা হলো না, ভয় পেয়ে আমি এমন দৌড় মারলাম উলটো দিকে, আজ হাসি পায় ভাবলে। আসলে আমি বা আমরা শক্তি-সুনীলকে চিনে নিয়েছিলাম, তাঁরা বিখ্যাত মানুষ, তাঁদের চিনতে অসুবিধে কোথায়! কিন্তু তাঁরা আমাকে চিনবেন কিভাবে! তবু সুনীলদা আমাকে দু-একবার দেখে থাকলেও শক্তিদার মুখোমুখি তো আমি খুব কমই হয়েছি। এ হেন অবস্থায় টলোমলো শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের হুঙ্কারে ভয় তো পাওয়ারই কথা। অথচ ভয় পাওয়ার কিছুই ছিল না, শক্তিদা কিন্তু আমাকে চিনতে পেরেই ডেকেছিলেন পরে জেনেছিলাম। শক্তি চট্টোপাধ্যায় অত্যন্তই ভদ্র এক মানুষ ছিলেন, কিন্তু সেসব তো পরে জেনেছি, তখন তো কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া গল্পগুলোই মাথার মধ্যে ছিল, তুমুল ভবঘুরের বিখ্যাত গল্প, তুমুল স্বেচ্ছাচারিতার কাহিনী। আসলে শক্তিদা নিজেই নিজের জীবনকে করে তুলেছিলেন কিংবদন্তীর মতো, আপাদমস্তক টলোমলো, অগোছালো জীবন ইত্যাদি। 
এরই মধ্যে আনন্দবাজার পত্রিকায় (১৯৮৭ সালের ২রা আগস্ট) শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন তুল্লেন ‘এত কবি কেন?’ শক্তিদা বলেছিলেন “আমার কাছে যদি কোনও তরুণ কবি আসে, লেখা দেখায়, আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে শেক্সপীয়রের সনেট অনুবাদ করতে বলি। বলি, বেশ কিছুকাল কর, তারপর অনুবাদগুলো নিয়ে আমার কাছে এসো। নিজস্ব কবিতা পরে লিখবে।” এর পরেও নানারকম উস্কানিমূলক বাক্য ছিল। বলা বাহুল্য এই লেখাটি নিয়ে খুবই বিতর্ক হয়েছিল। তরুণ কবিকুল বেজায় চটে গেল শক্তিদার ওপরে। এই লেখার কিছুদিন পর আরও একটি লেখা লিখলেন আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘কবিতা এখন মফস্বলের’। জেলা ধরে ধরে কবিদের নাম উল্লেখ করে। লিখলেন ‘…লেখে, আমি যা দেখছি আজ কয়েক বছর ধরে মফস্বলে কবিকুল। কী দুঃসহ নিষ্ঠায় তারা কাগজ বার করে, কী সযত্ন প্রয়াস তাদের লেখার পেছনে।…’ আমরা যারা মফস্বলে বসে কবিতা লিখতাম, এই লেখা পড়ে এবং লেখার মধ্যে আমাদের নাম দেখতে পেয়ে তাদের, আমাদের মতো তরুণদের মনের অস্থিরতা প্রশমিত হলো কিছুটা।
আমার প্রথম কবিতার বই আনন্দবাজারে গিয়ে আমার প্রিয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের হাতে দিয়ে এসেছিলাম, উৎসর্গের পৃষ্ঠায় নাম লিখে। সেই বই দীপঙ্করদার (সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তী) হাতে করে নবনীতাদির বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছিল, প্রফুল্ল সরকার স্ট্রীট থেকে হিন্দুস্তান পার্কে। উপহার পাওয়া বই আনন্দবাজারের ডেস্কে ফেলে চলে যাওয়া শক্তিদার উন্নাসিকতা ছিল, নাকি শক্তিদার বেখেয়াল ছিল জানিনা আমি। 
আগে হয়তো বলেছি, আমি ‘ঠুংরী’ নামে একটি পত্রিকা করেছিলাম কিছুদিন। কবিতা চাইতে গিয়েছিলাম কর্নেল বিশ্বাস রোডের ফ্ল্যাটে। এক সপ্তাহ পরে যেতে বলেছিলেন। বাজারে যেসব রটনা ছিল, তার মধ্যে এরকমও ছিল যে তিনি লেখা দেবেন বলে নির্দিষ্ট দিনে দেন না, কখনও হয়তো তিনি থাকেনই না, বা, মানুষকে অনেকবার তাঁর কাছে যেতে হয় তাঁর লেখার জন্যে ইত্যাদি। এইসব ভাবতে ভাবতে কবিতা পাবো না বলে নিশ্চিত হয়েই আমি গিয়েছিলাম বেকবাগানে তাঁর বাড়িতে নির্দিষ্ট দিনে। কিন্তু কী আশ্চর্য! কবিতা কিন্তু তিনি সেইদিনই দিয়েছিলেন। বাড়িতে গিয়ে অন্য শক্তিকে দেখেছিলাম সেইদিন। তখন তাঁর পুত্র-কন্যা ছোট ছিল, খাটের ওপর খাতা নিয়ে বসে পুত্র কিছু করছিল, আজ আর মনে নেই আমার। যাবতীয় গাল-গপ্পোর বাইরে শক্তিদা যে একজন অন্য মানুষ ছিলেন, পারিবারিক ও স্নেহশীল, সেসব বুঝেছিলাম সেইদিন।
আমাদের অফিস যেহেতু একই জায়গায় ছিল, আমাদের প্রায়শই দেখা-সাক্ষাৎ হতো। চাঙোয়া রেস্তোরাঁতে অথবা আমার বাড়ি যাওয়ার পথে (প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে যেতাম আমি), কখনো হাসি-বিনিময়, কখনো মামুলি কথা, কখনো সেসব কিছুই না।
১৯৮২ অথবা ১৯৮৩ সালে বইমেলা থেকে যে বই কিনেছিলাম, সেই বই ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’। নাম-কবিতা ছিল – “ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো। / এতো কালো মেখেছি দু’হাতে / এতোকাল ধরে! / কখনো তোমার ক’রে, তোমাকে ভাবিনি। / এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে / চাঁদ ডাকে আয় আয় আয় / এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে / চিতাকাঠ ডাকে আয় আয় / যেতে পারি / যে-কোন দিকেই আমি চলে যেতে পারি / কিন্তু, কেন যাবো? / সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো / যাবো / কিন্তু এখনি যাবো না / তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবো / একাকী যাবো না, অসময়ে”। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বহু কবিতা তাঁর জীবদ্দশাতেই মিথ হয়ে গিয়েছিল, যেমন এই ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’ কবিতাটি বা ‘অবনী বাড়ি আছো?’। অথবা, ধরা যাক তাঁর ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’ কবিতাটি – ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান ঘুরতে দেখেছি অনেক / তাদের হলুদ ঝুলি ভরে গিয়েছিলো ঘাসে আবিল ভেড়ার পেটের মতন / কত কালের পুরোনো নতুন চিঠি কুড়িয়ে পেয়েছে / এই অরণ্যের পোস্টম্যানগুলি / আমি দেখেছি, কেবল অনবরত ওরা খুঁটে চলেছে / বকের মতো নিভৃতে মাছ’। আধুনিক কবিতা সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয় এমন লোকেরও কন্ঠস্থ ছিল তাঁর একাধিক কবিতা। তাঁর কবিতা মানুষের মুখে মুখে ফেরার মতোই। শক্তিদার কলম থেকে আমরা অনেক আশ্চর্য সুন্দর কবিতা পেয়েছি। কবিতার বিষয়বস্তু, শব্দ নির্বাচন, ছন্দোময় প্রকাশভঙ্গি সবটুকু দিয়েই শক্তি চট্টোপাধ্যায় পৌঁছেছিলেন নিবিষ্ট পাঠকের কাছে। তাঁর স্বহস্তে লেখা একটি ছোট কবিতায় তিনি লিখেছিলেন – বিখ্যাত আলোক থেকে অন্ধকারে যাওয়া মোটেই সহজ নয়…
আমি চন্দননগরে যে পাড়ায় থাকতাম, সেখানে আমাদের প্রতিবেশী গোরাদা থাকতেন। একদিন বইমেলায় যাবো বলে রওনা হচ্ছি, সেইসময় গোরাদার স্ত্রী পাপাই বৌদি আমাকে ডাকলেন, ‘ঈশিতা শক্তিদা ডাকছেন তোমায়’। শক্তিদা! বিস্মিত আমি। তিনি আবার এখানে কেন! ভুল শুনলাম ভাবতে ভাবতে গিয়ে বাড়িতে ঢুকে দেখি, ওমা শক্তিদাই তো! বইমেলা গেল হাওয়ায়, বসে গেলাম গোরাদার বাড়ির ডাইনিং টেবিলে। অনেক গল্প হলো আমাদের, মামুলী সব গল্প, কবিতার কথা নয় কোনো। গোরাদাদের বাড়িতে একটা বড় পুকুর ছিল, সেই পুকুরে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন শক্তিদা। তাঁর বাড়িতে যাওয়ার নেমন্তন্ন করেছিলেন, হাতের কাছে বইমেলার নিমন্ত্রণ-কার্ড ছিল, সেই কার্ডের খামেই খসখস করে ঠিকানা (পূর্বাঙ্গনা…) লিখে দিলেন। তখন আর কর্নেল বিশ্বাস রোডে থাকতেন না, বেলেঘাটায় থাকতেন। আমার যাওয়া হয়নি, আপশোষ তো রয়েই গেল।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments