জ্বলদর্চি

আগডুম রাজ্যে -৮/ অলোক চট্টোপাধ্যায়

আগডুম রাজ্যে -৮ 
অলোক চট্টোপাধ্যায়

এমন আচমকা প্রশ্নে চটপটি বেশ থতমত খেয়ে গেল। আমিও বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে কি বলা উচিত ঠিক ঠাহর করতে পারছিলাম না। আসলে যে লোকটা একটু আগেই এমন কেঁদে ভাসাচ্ছিল সে হঠাৎ এরকম ভোল পালটে ফেলতে পারে এমনটা আমরা কেউই ভাবিনি। কিন্তু অবস্থাটা সামলে নিল চকমকি। সে যে কোনো একটা গোলমাল হতে পারে আন্দাজ করেই পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছিল তা আমরা কেউই খেয়াল করিনি। এখন কেষ্টদাদার প্রশ্ন শুনে ঝামরে উঠে বলল – ও মা, ই কি কথা? ও কেন বাইরের লোক হবে? ওতো আমাদের নিতাইদাদা, ঘোঁতলদাঙ্গার আলতা পিসির ভাসুরের ছেলে। ক’দিনের জন্যে এখানে এসেছে কাজকম্মের খোঁজে। বোঝাই গেল চকমকি বুদ্ধি খাটানোর ক্লাসে ভাল ভাবেই পড়াশুনো করছে।
কেষ্টদাদা কিন্তু সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। কাষ্ঠ হেসে জেরা করার ভঙ্গিতে বলল – আচ্ছা, তোমাদের সেই ঘোঁতলদাঙ্গার পিসির বাড়ির লোক? তারপরেই সরাসরি আমাকেই জিগ্যেস করল – তা, ওখানে ক’দিন আগে যে গুঁফোকাঁঠালের ভুতি খাওয়া নিয়ে হাঙ্গামা হয়েছিল তারপরেই পালিয়ে আসা হয়েছে বুঝি?
আমি কিছু বলার আগেই চকমকি তেড়ে ঊঠল – তা হবে কেন? ওসব হাঙ্গামার আগেই এসেছে। কেন, কাকিমার ভাইএর বাড়িতে আসতে পারে না? আর তোমাকেও বলি, অন্যের ব্যাপারে নাক না গলিয়ে নিজের ছেলেটাকে একটু দেখো। সে তো আবার শুনলাম কাঠকারিগরীর পরীক্ষায় দু দুবার গাড্ডূ পেয়েছে।
চকমকির এ হেন প্রতি আক্রমনে কেষ্টদাদা বেশ দমে গেল। ম্রিয়মান মুখে বলল – আচ্ছা, তা বেশ, তা বেশ। আমি তাহলে যাই। 
সে যেতেই চটপটি ক্ষেপে উঠল আমার ওপর। - এতবার করে বলছি, কক্ষোনো কোনো লোকের সামনে ঐ – ‘কি আশ্চর্য্য, কি অদ্ভুত’ এসব কথা বলবে না, তোমার সে কথা মাথায় ঢোকে না। এ কথা শুনলে তুমি যে এখানে নতুন লোক তা বুঝতে কারো কি বাকি থাকবে? মনে রেখো, একদল কি দু দল লোকে তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। আর তাছাড়া ওই কেষ্টদাদা লোকটি মোটেও সুবিধের নয়। ওর নিজের ভগ্নীপতি ফোড়নদাসের বাড়ির বাগানে মালির কাজ করে।
আমি লজ্জিতমুখে দোষ স্বীকার করে নিলাম। চকমকি কিন্তু তার দাদাকেও ধমকে দিল। - আর তোমাকেও বলি দাদা, এরকম একটা বিপদের মধ্যে কোথায় তাড়াতাড়ি মুশকিল মামার কাছে পৌঁছোবে, তা নয়, দাঁড়িয়ে পড়ে আব্বুলিশ লাগানো দেখছো, কে কোথায় বসে বসে কাঁদছে তারও খোঁজ করছো – আর দোষ দেবার বেলায় নিতাই দাদা? এখন পা চালিয়ে চল।
চটপটিও দেখলাম বোনের ধমক খেয়ে ভারি থিতিয়ে গেল। আমি এই সুযোগে চকমকিকেই জিগ্যেস করলাম – আচ্ছা, ঐ গুঁফো কাঁঠালের ভুতির ব্যাপারটা কি? যদ্দুর মনে হচ্ছে বটকেষ্টও অমনি একটা কিছু নিয়ে গন্ডগোলের কথা বলেছিল বটে। তখন ঠিক বুঝতে পারিনি।
চকমকি বলল – সেসব তোমার বোঝার কথাও নয়। আমাদের নিয়মে গুঁফো কাঁঠালের ভুতি খাওয়া একদম বারণ। ওদিকে বাগডুমের লোকেদের ওটাই খুব প্রিয় খাবার। এই নিয়ে মাঝেমাঝেই ভারি গোলমাল হয়। এখানে বাগডুম রাজ্যের কিছু লোক তো থাকেই। তারা সুযোগ পেলে খেয়ে নেয়। কিছু কিছু দোকানে তাই লুকিয়ে লুকিয়ে ওই ভুতি বিক্রিও হয়। কিন্তু জানাজানি হয়ে গেলে তখন মারপিট, দোকানে ভাঙচুর এসব হয়। ও নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। ওটা হল গিয়ে, মাস্টার মশাইরা কি যেন একটা বলে ? ও হ্যাঁ, ওটা হল আমাদের আভ্যন্তরীন ব্যাপার।
-কিন্তু ভুতি তোমরা খাও না কেন? আর বাগডুমরাই বা কেন খায়? আমি বললাম। -তবে আমাদের দেশের কথা যদি বল, কাঁঠালের ভুতি আমরা মোটেও খাই না। ওটা আদৌ খাবার জিনিস নয়।
-আমরা খাই না, আমাদের প্রাচীন বইপত্তরে বারণ আছে বলে। চটপটি বলল। - গুঁফোকাঁঠালের কোয়া খাওয়া যায়, ফুল খেতেও আপত্তি নেই, খোসার ভেতরটা দিয়ে চচ্চড়ি বানানো যায়, শুধু ভুতি খাওয়াই মহাপাপ। আর বাগডুমরা কেন খায়? বোধহয় আমাদের নিষেধ আছে বলে।
ও রকম বলা ঠিক নয় দাদা। চকমকি বলল। - ওদেরও পুরোনো কেতাব পুঁথি আছে। আমরা জানিনা, কিন্তু তাতে লেখা থাকতেই পারে যে ভুতি খাওয়া যায়। কোনো নিষেধ নেই।
চটপটি তবু হার মানতে রাজি নয়। - কেন সেই যে একবার নাকি ওদের ঘুষুড়ি পুজোর দিনে এক গামলা বুনো কুলের পায়েসে একটা মেঠো বেড়াল মুখ দিয়েছিল। বেজায় ঝামেলা। বেড়াল পায়েসে মুখ দিলে কি করা উচিত কেউ বলতে পারে না। ওদিকে অতগুলো লোক সকাল থেকে উপোস করে আছে, পায়েস ফেলা গেলে খাবে কি? ওদের প্রধান পুরুত তখন সবাইকে ডেকে জিগ্যেস করল – কেউ কি জানে এরকম অবস্থায় আগডুমরা কি করে? একজন বুড়ো মানুষ, যে নাকি বানিজ্য করার জন্যে অনেক দিন আগডুমে ছিল, এগিয়ে গিয়ে বলল সে দেখেছে আগডুমরা বেড়ালে মুখ দেওয়া খাবার ফেলে দেয়। ব্যাস, নিশ্চিন্ত। প্রধান পুরুত রায় দিল – তাহলে খেয়ে নাও। তবেই দেখো, কেতাবে কি আছে সেটা কেউ দেখে না, উলটোটা করতে পারলেই হল। সেটাই তখন নিয়ম হয়ে যায়।
চকমকি তাও তর্ক করতে ছাড়ল না। - এমনটাও তাহলে হতে পারে, ওরা ভুতি খায় বলে আমরাই সেটা খাওয়া নিষেধ করে দিয়েছি।
চটপটি এবার আর যুক্তির ভেতর না গিয়ে সোজা ধমক লাগাল – যা যা, তোকে আর বাগডুমদের হয়ে ওকালতি করতে হবেনা। যেমন আগে আগে যাচ্ছিলি সেই রকম যা। কোনো কিছু গোলমাল দেখলে সঙ্গে সঙ্গে জোরে  কু দিবি। চকমকি তাই শুনে হনহনিয়ে হেঁটে আমাদের থেকে অনেকটা এগিয়ে গেল।
আমার একবার মনে হোল কু দেবার ব্যাপারটা কি সেটা জিগ্যেস করি কিন্তু সম্ভবত বোনের সঙ্গে তর্ক করে আর বিশেষ করে তর্কে প্রায় হেরে যাবার জন্যেই হয়তো, চটপটি বেজায় ব্যাজার মুখ করে হাঁটছিল, তাই আর ওকে প্রশ্ন করলাম না। অবশ্য তখনও জানতাম না যে প্রায় তক্ষুনিই এর উত্তরটা জেনেই যাব।
আমরা মোটামুটি ফাঁকা ফাঁকা রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম। চারপাশে বাড়ি ঘর, দোকানপাট তেমন নেই। মাঝে মাঝেই খোলা মাঠ, গাছপালা, পুকুর। নানা পাখ পাখালির ডাক শোনা যাচ্ছিল। বিকেল গড়িয়ে এসেছে। এখন ওদের ঘরে ফেরার সময়। এরই ভেতর একটা চেনা ডাক শুনতে পেলাম। কোথাও কোকিল ডাকছে। চটপটিকে বললাম – এই এতক্ষনে একটা চেনা পাখির গলা পেলাম। 
চটপটি অন্যমনস্ক ভাবে বলল – হ্যাঁ, ঘেঁটিকোকিল। এই সময়ে ওদের ডাকাডাকি খুব শোনা যায়। বাড়ি ফেরার সময় কিনা। সঙ্গী সাথিদের ডেকে বাসা খুঁজে নেয়।
বলল বটে, কিন্তু কোকিলটার ডাক ক্রমশই যেন বেড়ে উঠল। খুব ব্যস্ত ভাবে ঘন ঘন ডাকতে লাগল সেটা। কান ঝালাপালা হবার জোগাড়। যেন খুব বিপদে পড়েছে এমন ভাব। চটপটিকে সে কথা বলতেই তার অন্যমনস্ক ভাবটা হঠাৎ কেটে গেল। যেন আচমকা ঘুম ভেঙে উঠে কান পেতে ডাকটা শুনেই, কোকিলটা তখনও তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছিল, তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মুখে বলল – সর্বনাশ!
কি হল ? আমি জিগ্যেস করলাম। -কোকিল ডাকের মধ্যে সর্বনাশের কি দেখলে?
চটপটি মহা বিরক্ত মুখে বলল – ওটা মোটেও কোকিলের ডাক নয়। আমারই দোষ, তুমি বলার পরও খেয়াল করিনি। ওটা তো চকমকি কু দিচ্ছে। তার মানে সামনে বিপদ। সাবধান।
তখন অবশ্য আর সাবধান হবার সময় ছিল না। চকমকি অনেকক্ষন থেকেই চেষ্টা করে গেছে, চটপটিই খেয়াল করেনি। যখন বুঝতে পারল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
রাস্তার দু ধারে ছড়ানো ছেটানো কয়েকটা ঘরবাড়ি ছিল। তারই আড়াল থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এল বেশ কয়েকজন শক্তপোক্ত চেহারার লোক। মুহূর্তের মধ্যে ঘিরে ফেলল আমাকে আর চটপটিকে।  পালাবার কোনো উপায় নেই। চটপটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার মুখটা বড় অসহায়। চোখ দুটো ছল ছল করছে। কি যেন বলতে চাইছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু কাষ্ঠহাসি হাসার চেষ্টা করলাম। হাজার হোক, আমাকে বিপদের থেকে বাঁচাবার প্রানপন চেষ্টা তো ও করেছে। শেষটা সামলানো গেল না, তাতে ওর আর কি দোষ?
এবার ওই লোকগুলোর আড়াল থেকে বেরিয়ে সামনে এল ঝলমলে পোশাক পরা সিড়িঙ্গে চেহারার একজন। সে আর কেউ নয়, স্বয়ং ফোড়নদাস।
কোথা থেকে যেন হাঁফাতে হাঁফাতে দুজন লোক এল আরো। তারা ফোড়নদাসকে বলল – পাখিটাকে ধরতে পারলাম না হুজুর। উড়েই পালালো প্রায়। ফোড়নদাস বলল – সে যাক গে। আসলটাকে তো ধরা গেছে। এতেই কাজের কাজ হবে।
আমি শুকনো মুখে বললাম – আমাকে কেন ধরেছো জানিনা, তবে যদি আমার সঙ্গেই তোমার দরকার থাকে তাহলে অনুরোধ করছি আমার বন্ধুকে ছেড়ে দাও। আমাকে নিয়ে যেখানে যাবে চলো।
ফোড়নদাস সেই শুনে মহামায়া অপেরার দুঃশাসনের মত বিকট সুরে হেসে বলল – ওহো, খুব বন্ধুত্ব দেখছি। দাঁড়া, তোদের দুজনকেই একসঙ্গে কোতল করব। তবে আগে আমার দরকারি কাজটা তোকে দিয়ে করিয়ে নিয়ে, তারপর।
লোকগুলো খুব নিপুন হাতে কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলল চটপটি আর আমাকে। তারপর দুটো পেল্লায় থলিতে ঢুকিয়ে ফেলল আমাদের। একটু বাদেই দুলুনি শুরু হল। বুঝলাম আমাদের পিঠে বা কাঁধে নিয়ে রওনা হোল তারা।
একটা ভারি আশ্চর্য ব্যাপার খেয়াল করলাম, যতক্ষণ বিপদের ভয় ছিল আমরা কেমন যেন সিঁটিয়ে জড়সড়ো হয়ে ছিলাম। যখন সত্যিকারের বিপদ ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল তখন মাথাটা কেমন যেন পরিষ্কার হয়ে গেল। থলির ভেতর ঝুলতে ঝুলতেই মাথায় নানান ফন্দি ফিকির এসে গেল। একটা রক্ষে ঘড়িটা আমার কাছে নেই । চকমকির বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। এখন ঘড়িটা চাইলে এমন ভান করতে হবে যেন সেটা হারিয়ে গেছে। সেইমত বাঁধা অবস্থাতেই নখ দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে থলির গায়ে একটা বড় ফুটো করতে লাগলাম। ধীরে ধীরে একটা একটা  সুতো সরতে সরতে একটু ফাঁক হতেই সেটা আঙুল দিয়ে টেনে টেনে বাড়িয়ে ফেললাম।
যে লোকটা আমাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সে ধমকে বলল – অত নড়ছো কেন হে? চুপচাপ পড়ে থাকতে পারছো না? আমি করুণ গলায় বললাম – বড্ড ঝাঁকুনি লাগছে যে। লোকটা কিছুটা নরম গলায় বলল – তা অবশ্য লাগতেই পারে। পালকি চড়ে তো আর যাচ্ছো না। একটু সয়ে থাকতে হবে। এইতো, এসেই গেলাম প্রায়।
কতক্ষণ বাদে কে জানে, একটা জায়গায় এনে লোকটা বেশ সাবধানেই থলিটা নামিয়ে আমাকে টেনে বার করল। দেখি একটা খুপরি মত ঘর। একটা কুপির আলো টিমটিম করে জ্বলছে। বাইরে সন্ধ্যের অন্ধকার। চটপটিকে দেখলাম না। দরজার পাশে ফোড়নদাস দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে তাকাতে দেখে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে খানিক হেসে বলল – কি বাছাধন, এবার কি করবে?
আমি বললাম – আমার বন্ধু চটপটি কোথায়?
-সে এখন বলা যাবে না। ফোড়নদাস জানাল। - আমার কাজটা হয়ে গেলেই তাকে পেয়ে যাবে। 
-কি কাজ তোমার? আমি জিগ্যেস করলাম। 
-তোমার ঐ সময় মাপার যন্ত্রটা। সে বলল।– আর ওটা কি করে কাজ করে সেটাও বুঝিয়ে দিতে হবে। যন্ত্রটা কোথায়?
আমি ভয় ভয় গলায় বললাম – সেটা তো আমার ফতুয়ার বাঁ পকেটেই আছে। ওটা নেবে নাও। আমি সব কিছু শিখিয়েও দেব। শুধু দয়া করে আমাদের দুজনকে ছেড়ে দাও।
ফোড়নদাস খিঁক খিঁক করে হেসে বলল – সে তো নাহয় ছেড়ে দেব, কিন্তু আগে যন্ত্রটা তো দেখি। নিজেই এগিয়ে এসে আমার ফতুয়ার পকেটে হাত ঢোকাল। বাঁ পকেটে না পেয়ে ডান পকেটটাও আঁতিপাঁতি করে খুঁজল। আমি সাধ্যমত অবাক হওয়া গলায় বললাম – একি, নেই নাকি? সর্বনাশ!
ফোড়নদাস আমার পাজামার পকেট, ছিল না অবশ্য,  তবে থাকলে যেখানে থাকার কথা সেখানে থাবড়ে থাবড়ে প্রানপনে খুঁজল। কোমরে পিঠেও থাবড়ে দেখল কোথাও কিছু লুকিয়ে রাখা আছে কিনা। না পেয়ে হিসহিসে গলায় বলল – কোথায় রেখেছিস বল। নাকি জাদু করে সরিয়ে ফেলেছিস?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments