জ্বলদর্চি

কোশের ভাষা /নিশান চ্যাটার্জী

জীবনের গভীরে বিজ্ঞান -১

কোশের ভাষা

নিশান চ্যাটার্জী

অনেকেই মনে করেন সাহিত্য বা দর্শনের মতো বিজ্ঞান ও একটি বিষয় মাত্র। কিন্তু বিজ্ঞান তার থেকেও বেশি। যতই দিন গেছে বিজ্ঞান নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ও পরিবর্তন ঘটিয়েছে। সূচনা থেকেই বিজ্ঞান তার নিজস্ব নিয়মনীতির মাধ্যমে সমগ্র জীবজগতকে ধারন করে রেখেছে। যে সাহিত্যিক কল্পনার জগতে বিচরণ করেন, মনে হবে তিনি হয়তো বা বিজ্ঞানের কার্যক্রম দ্বারা পরিচালিত নন। কিন্তু তার মস্তিষ্কের কয়েক বিলিয়ন নিউরোন সেই সময়ে বিশেষ "signaling system" এর মধ্যে রয়েছে যা তাকে ভাবতে বা লিখতে সাহায্য করছে। এই রকম একাধিক পদ্ধতি বা system জীবদেহে থাকলেও এর কোনোটিই বিজ্ঞানীরা সৃষ্টি করেননি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সঠিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই বিস্ময়কর ঘটনাগুলি মানুষের দৃষ্টির মধ্যে এনেছেন। 

এরকমই একটি মজার ঘটনা হলো কোশের "signaling" ব্যবস্থা। রাস্তায় ট্রাফিক signal যেমন যানবাহন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, ঠিক সেরকমই জীবদেহের অনুভূতি গুলি জীবদেহ গঠনকারী আনুবীক্ষণিক কোশের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়।তাই আমরা বলতে পারি আমাদের যেকোনো আচরণ বা মনোভাব সবই  আমরা নয়, নিয়ন্ত্রণ করছে এক অদৃশ্য "signal"। "আচরণ" বা "Behaviour" শব্দটি  সম্পর্কে আমরা কমবেশি সকলেই জানি। কারণ ব্যক্তির আচরণ ই প্রকৃতপক্ষে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায়। ধরে নেওয়া যাক কোনো এক ব্যক্তি খুব খাদ্যরসিক হলে তাকে আমরা "পেটুক" বলি। আবার কেউ যদি অল্পেতেই খুব রেগে যায় তাকেও আমরা খুব একটা পছন্দ করিনা। আমরা উল্লেখিত বৈশিষ্ট্য গুলির ওপর নির্ভর করে ব্যক্তিটি কে ভালো বা মন্দ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। কিন্তু ব্যক্তিটির আচরণ সম্পূর্ণ রূপে তার ইচ্ছাধীন নয়।

  তাই যেকোনো কারনেই হোক না কেনো আমরা ব্যক্তিটি কে দোষারোপ করতে পারিনা। একথা শুনলে হয়তো আশ্চর্য লাগতে পারে যে, কোনো ব্যক্তি কিরূপ আচরণ করবে সেটা নির্ভর করে সেই সময় ব্যক্তিটির কোশগুলি কি চাইছে তার ওপর। হ্যাঁ, "কোশ" বা "cell" সম্পর্কে আমাদের প্রত্যেকের কমবেশি ধারণা নিশ্চিত রয়েছে। কোনো এক বিশেষ সময়ে সমগ্র দেহের আচরণ কিন্তু কোশের দ্বারাই নির্ধারিত হয়। পৃথিবীতে যত রকমের এককোশী প্রাণী রয়েছে তারা যেমন নিজেরা নিজেদের মধ্যে বার্তা আদান-প্রদান করে তেমনি আমাদের মতো বহুকোশী প্রাণীদেরও কোশ সমূহ একইভাবে  নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করে। আমরা একে অপরের সাথে যেমন ভাষার মাধ্যমে ভাব বিনিময় করি তেমনি কোশেরাও তাদের নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ আদান-প্রদানের মাধ্যমে ভাব বিনিময় করে থাকে। এই সকল রাসায়নিক পদার্থ সমূহকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় signaling molecules ।

 এই ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে কোশ গুলিতে যে আচরণ জনিত পরিবর্তন ঘটে সেটাই ব্যক্তি আচরণ হিসেবে আমাদের চোখে ধরা পড়ে। প্রথমে ই যারা এককোশী প্রাণী তাদের কথায় আসা যাক।ইউক্যারিওটিক অর্থাৎ যে সকল কোশ গুলি উন্নত প্রকৃতির তাদের মধ্যে যে সকল এককোশী জীব রয়েছে যেমন ইষ্ট, স্লাইম-মোল্ড কিংবা আ্যমিবা এরা বিশেষ বিশেষ সময়ে একধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে, যা এদেরকে একে অপরের কাছাকাছি আসতে সাহায্য করে। এরা প্রধানত প্রজননের তাগিদেই একত্রিত হয়। এক্ষেত্রে ক্ষরিত রাসায়নিক পদার্থ টিকে বলা হয় "ফেরোমন" (pheromone)। অর্থাৎ এক্ষেত্রে একটি কোশের সাথে অপর কোশের ভাব বিনিময়ের ভাষা হলো "ফেরোমন"।

  অন্যদিকে বহুকোশী উদ্ভিদ ও প্রাণীরা তাদের বার্তা আদান-প্রদান নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। একটি কোশ থেকে অন্য কোশে বার্তা পরিবাহিত হয় এবং সামগ্রিক ভাবে জীবদেহে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সুতরাং এককোশী জীবেদের একটি কোশ অথবা বহুকোশী জীবেদের কোশ সমষ্টি যে আচরণ করে তাই সামগ্রিক ভাবে ঐ প্রাণী বা উদ্ভিদের আচরণ রূপে প্রতিভাত হয়। আবার এর মধ্যে মজার ব্যাপার হলো, আমরা একে অপরের কথা অনেক সময় যেমন শুনতে পাইনা, ঠিক তেমনি একটি কোশ ইচ্ছে করলেই তার পার্শ্ববর্তী কোশটিকে তার বার্তা ( "signal") পাঠাতে পারবে না, যদি না উক্ত কোশটির মধ্যে সেই রাসায়নিক বার্তা গ্রহণ করার জন্য একটি বিশেষ প্রোটিন না থাকে। এই প্রোটিন গুলিকে বলা হয় "রিসেপটর"। এই "রিসেপটর" গুলি কখনো কখনো প্রতিবেশী কোশ থেকে বাইরের দিকে আংশিক বেরিয়ে উঁকি মারে আবার কখনো কখনো কোশের মধ্যেই নিমজ্জিত থাকে। আমাদের যেমন রাগের, দুঃখের ভাষা গুলি আলাদা আলাদা। সেইরকম কোশ কর্তৃক নিঃসৃত ভাষা ও পৃথক ও তাদের জন্য নির্ধারিত "রিসেপটর" বা "গ্রাহক" ও নির্দিষ্ট। এই "গ্রাহক" যখন নির্দিষ্ট রাসায়নিকের সাথে যুক্ত হয় তখন কোশের আভ্যন্তরীণ বিশেষ কিছু পরিবর্তন ঘটে যার সামগ্রিক ফলস্বরূপ কোশের বিপাক ক্রিয়া সহ নানা পরিবর্তন ঘটে যাকে আমরা সাড়া বলি। উত্তেজনায় সাড়া দেওয়া জীবের বৈশিষ্ট্য একথা আমরা জানি কিন্তু তার বীজ লোকানো রয়েছে আনুবীক্ষণিক কোশের মধ্যেই। তবে মনে রাখা প্রয়োজন আমাদের সহ সমগ্র জীবজগতে কোশে কোশে এইরকম একাধিক "রিসেপটর" বা "গ্রাহক" যেমন রয়েছে তেমন একাধিক "signaling molecules" ও রয়েছে। আমরা উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি কোনো একটি বিশেষ অবস্থায় আমাদের যখন খুব দুঃখ, আনন্দ,রাগ প্রভৃতি মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয় তখন আমরা জানতে পারিনা যে এই দ্বন্দ্ব গুলি তৈরির মূল কারিগর হলো আমাদের কোশ। এই জরুরী কালীন পরিস্থিতিকে সামলে আমরা আবার সাম্যাবস্থায় ফিরে আসতে পারি, যখন আমাদের কোশের কাছে সাম্যাবস্থায় আসার "signal" পৌঁছয়। দেহের এই সাম্যাবস্থা নিয়ন্ত্রণের মূলে যেমন এই "signaling system" রয়েছে, একই ভাবে প্রতিদিন বহুসংখ্যক কোশ তার নির্দিষ্ট বয়সসীমা অতিক্রম করে মৃত্যুবরণ ও করছে এবং সেটিও এই "signaling system" এর মাধ্যমে। একটি জীবকোশের প্রতিটি ক্রোমোজোমের প্রান্তে টেলোমিয়ার নামে একটি অংশ থাকে। প্রতিবার কোশের বিভাজনের সময়ে এই টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য একটু একটু করে কমতে থাকে। যখন তা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে তখন ঐ কোশের বিভাজন বন্ধ হয়ে যায়। আবার পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান গুলিও কোশের "signal" হিসেবে কাজ করে। 

         অধ্যাপক হিলডেব্রান্ড দেখিয়েছেন পরিবেশের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে হ্রাস করলে উদ্ভিদ কোশেও তার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। একটি সদ্য বিভাজনে পদার্পণ করা কোশের চারপাশের তাপমাত্রা যদি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হয়, তাহলে তার বিভাজন থেমে যায়। আবার তাপমাত্রা বাড়ালে বিভাজন শুরু হয়। ফলস্বরূপ কোশীয় স্তরে যে সকল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তা জীবদেহেও ফুটে ওঠে। আবার বিশেষ কিছু উপাদান "signal" হিসেবে কোশকে দ্রুত এবং অনিয়ন্ত্রিত বিভাজনে উদ্দীপিত করে। যার ফলে ক্যান্সার নামক মারণ ব্যাধির সৃষ্টি হয়। যে সকল পদার্থ এই বিভাজন বাড়ানোর "signal" হিসেবে কাজ করে তাদের "কারসিনোজেন" বলা হয়।

       সুতরাং কোনো ব্যক্তি বা জীবের আচরণ যদি আপনার দুঃখের কারণ হয় তাহলে অবশ্যই সেই ব্যক্তির প্রতি আপনি বিরুপ না হয়ে, একথা ভেবে নেবেন যে, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে তার কোশের কাছে যে "signal" পৌঁছেছে, এবং তার ফলে তার কোশের মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটেছে,  এটি তার ই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। মজার বিষয় হলো বিজ্ঞানের এই বিশেষ দিকটি এক নতুন দর্শনের ও জন্ম দেয়, যা বলতে শেখায় "আমি কিন্তু আমার নয়" ।।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
       

Post a Comment

0 Comments