খর্জুর বীথির ধারে
মলয় সরকার
(৪র্থ পর্ব ) চতুর্থ পর্ব
এই শোবাক দুর্গের চারধারে যে দেওয়ালগুলি ছিল , তার অল্পই অবশিষ্ট আছে। শোনা যায়, এখানে নাকি পরপর তিনটি দেওয়াল দিয়ে এটিকে দুর্ভেদ্য করা হয়েছিল।এখানে কিছু চার্চ ছিল। আর ছিল বাজার, স্কুল, কুয়ো এবং অনেক গোপন কক্ষ ও গোপন কয়েকটি পথ।টাওয়ারও রয়েছে। অনেক কিছুই দেখে আন্দাজে বোঝা গেল। আসলে এখানে খ্রীষ্টান এবং মুসলিম দুই ধর্মের রাজত্ব হওয়ায় দু’ ধর্মেরই প্রয়োজনীয় জিনিস অনেক কিছুই ছিল।সিঁড়ি দিয়ে নামার মত কুয়ো ছিল, যেখানে ৩৭৫ টি সিঁড়ি বেয়ে জলের কাছে পৌঁছানো যেত।আমাদের দেশে ,প্রায় এরকম কুয়ো দেখেছি গুজরাটে ধোলাভিরাতে। এই সিঁড়িওলা কুয়া যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা কিছুটা আন্দাজ করতে পারবেন। মরুভূমি বা রুক্ষ অঞ্চলে যেখানে জলের স্তর অনেক নীচে, সেখানে এই ধরণের কুয়ো রয়েছে, কুয়োর ভিতরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে জল নিয়ে উপরে আসা যেত।
একটা গোপন কক্ষ দেখলাম । সেখানে অনেক পাথরের জিনিস, যা যা মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে, তা সাজানো আছে।এগুলো সবই এই অঞ্চলের পাথর কেটে তৈরী। তবে দরজার যে মাথার আর্চ গুলো আছে তাতে কোন ধাতব ‘সাপোর্ট’ না দিয়ে, কি করে তৈরী হয়েছিল, এবং কি করে যে আজও দাঁড়িয়ে আছে জানি না। এই সব পাথর তো আর চুন সুরকি দিয়ে গাঁথা নয়। তবু আজও সেই সব দেওয়াল, বা কক্ষ কি করে দাঁড়িয়ে আছে জানি না।কত ভাল ভাল ইঞ্জিনীয়ার ছিলেন সেকালে, তাঁরা কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়েছিলেন যে, তাঁদের তৈরি জিনিস আজও দাঁড়িয়ে থাকে আর আমাদের, নতুন প্রযুক্তিতে দক্ষ ইঞ্জিনীয়ারদের তৈরী আধুনিক বিজ্ঞানের সেতু তৈরী হতে হতেই পড়ে যায়!
অনেক সিঁড়ি রয়েছে, পাকাপোক্ত দেওয়াল রয়েছে, একদিন সব লোকজনে গমগম করত। আজ এক নিছক ভুতুড়ে মরুভূমির মাঝে পরিত্যক্ত ‘খণ্ডহর’ হয়ে অতীত ইতিহাসকে বুকে নিয়ে নীরব সাক্ষী হয়ে বসে আছে আর বোধ হয় মরুভূমির বাতাসের সাথে তপ্ত দীর্ঘনিঃশ্বাস মিশিয়ে দিচ্ছে। হয়ত নীরব রাত্রে দু-এক ফোঁটা অশ্রুও ঝরে পড়ে তার বুক থেকে।
আমরা এই মরুদুর্গ ছেড়ে এগোলাম পাহাড়ী মরুপথ বেয়ে আর এক নতুন পথে। রাস্তায় দুপাশে সেই একই মরুদৃশ্য। কখনও পেরোচ্ছি ছোট ছোট লোকালয়, কিছু বাজার, কখনও আবার শুধু ধূ ধূ শূন্যতা। তবে আমি বললে অনেকে হয়ত বিশ্বাস করবেন না, যে, মরুভূমিরও একটা অদ্ভূত সৌন্দর্য আমার মনকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে।এর মাঝে এত রঙের বৈচিত্র্য দেখছি তা বলার নয়।কখনও গাঢ় হলুদ, কখনও ধূসর, কখনও লালিমার আভাস আবার কখনও নানা মিশ্র রঙের সমাহার। যাঁদের আধুনিক চিত্রকলার প্রতি প্রীতি আছে, তাঁদের, ঈশ্বরের এই রঙের বৈচিত্র্য ভাল লাগবেই। ভেবেছিলাম, পাহাড় , সবুজ বনানী, সমুদ্র তো অনেক দেখা হল, এবার একটু মুখ বদল খারাপ কি।সত্যিই এই বৈচিত্র্য মন কেড়ে নেবেই।
আমি রুক্ষতার সৌন্দর্য প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম, শান্তিনিকেতনে গিয়ে, বা ঝাড়গ্রামে যখন দীর্ঘদিন থাকতে হয়েছিল কর্মসূত্রে। তখন বুঝেছিলাম, কেন কবিগুরুর পিতৃদেবের, সে ই ধূ ধূ ভুবন ডাঙ্গার মাঠ পছন্দ হয়েছিল আশ্রমের জন্য। আসলে একে ভালবাসতে অন্য চোখ লাগে। আমি এখানে এসে প্রথম মরুভূমি দেখছি এমন নয়, তবে আমার যে বেশ ভাল লাগছে এটা বলতেই পারি।
রায়েধ বলে চলেছে, কি সিস্টার কেমন লাগছে এখানে? আমরা দুজনেই সমস্বরে বলে উঠলাম, খুব ভাল। ও বলল, আপনি কি জানেন, আমরা আপনাদের দেশের পিকচার খুব দেখি। আমরা চমকে উঠলাম। পিকচার দেখ? কি পিকচার? রায়েধ বলল, অনেক, আমার বাড়িতে তো টিভিতে সবসময় চলে ইংরাজী বই আর ইণ্ডিয়ার বই। আমার বড় ছেলে আর বৌ তো খুব ভক্ত আপনাদের শা’রুখ খান, অমিতাভ বচ্চন, হেমা মালিনী, শ্রীদেবীর। আমিও সময় পেলেই দেখি।তবে সব সময়, সময় পাই না। আমি শুনে, হাসব না কাঁদব আনন্দে বুঝলাম না।নিজের দেশের যত নিন্দেই করি, এখানে, বাইরে এসে যদি আমার দেশের কথা বিদেশীর মুখে শুনি , তার ভাল লাগাটা বুকের ভিতরে গিয়ে অনুরণন তোলে, তা বুঝতে পারি নিজের হৃদয়কে দিয়ে। পরে দেখেছিলাম, যদিও হিন্দী এ দেশের মানুষ প্রায় বলেন না, কিন্তু প্রচুর ভারতীয় এখানে থাকেন।শুধু ‘থাকেন’ বললে ভুল হবে, এখানের মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান করেন। এখানে একটি এন্টারটেনমেন্ট চ্যানেলও আছে যার নাম MBC Bollywood, যেটি তখন সদ্য ২০১৩ তে জন্ম নিয়েছিল। যদিও সবই আরবী ভাষাতে ‘ডাবিং’ করা হয়, ঘরে ঘরে এখানে বলিউডের সিনেমা চলে। বলিউড ড্যান্স ক্লাশও হয় এখানে। কিছুদিন আগে হিন্দী ছবি ‘ক্রিশ-৩’এর এখানে শ্যুটিং হয়েছে। এই হিন্দী সিনেমা দিয়ে নাকি জর্ডনের সাথে ভারতের ভাল গাঁটছড়া বাঁধা আছে। এখানে সিনেমা হলে অবশ্য কমই হিন্দী সিনেমা আসে, তবে যেগুলি আসে তার টিকিটের দাম অত্যন্ত চড়া হয়।
সত্যিই, কত কিছুই জানি না।
অনেক পথ ঘুরে আমরা পৌঁছালাম একটা আধা গ্রাম, আধা শহর মত জায়গায়।রায়েধ, আমাদের একটি একেবারে সাদামাটা ধরণের হোটেলে নিয়ে গিয়ে তুলল। এখানে দেখলাম বিশেষ কোন বোর্ডারও নেই। ও বলল, এখানে আপনার কোন অসুবিধা হবে না। মালিক আমার বন্ধু, যা দরকার সব বলবেন, সমস্ত আমি বলে যাচ্ছি ওকে। আজ বিকাল হয়ে গেছে। আপনারা বিশ্রাম করুন। কাল আমি সকালে এসে নিয়ে যাব।
রায়েধ চলে যেতে, দেখলাম, তখনও একটু বেলা আছে। বুলবুলকে বললাম, চল, বসে না থেকে একটু চারপাশটা হেঁটে দেখে আসি।কেমন জায়গা।
বেরোলাম দুজনে। দেখি জায়গাটা বেশ পাহাড়ী, উঁচু নীচু। আর রাস্তার ঢাল বেশ । নীচে নামলে হেঁটে ওঠা আমাদের পক্ষে মুস্কিল। অবশ্য ওরা তরতর করে উঠছে নামছে, মেয়ে পুরুষ সবাই। আর এ জায়গাটা একেবারেই ছোট বলেই মনে হচ্ছে। বাড়ী ঘরও খুব ভাল নয়। সবাই বোধ হয় মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত। অনেক বাড়ীতেও দেখছি বাড়ীর ছাদে টিভির এন্টেনা রয়েছে। রাস্তার পাশগুলোও খুব পরিচ্ছন্ন নয়। হয়ত, নোংরা পড়ে আছে, বা ভাঙ্গা গাড়ির গ্যারাজ রয়েছে। দোকানপত্রগুলোও কেমন ছোট ছোট শ্রী হীন। ওরই মধ্যে একটা দোকান থেকে কিছু মোটামুটি চেনা খাবার নিলাম রাতের জন্য। এখানে যে হোটেলে আছি, তারা নাকি খাবার দেবে না।তবে ব্রেকফাস্ট আর চা দেবে।
যাক, আজ রাতের মত নিশ্চিন্ত। বেরোনোর মুখে হোটেলের দরজার কাছেই বসেছিলেন হোটেল মালিক। ভদ্রলোককে মোটেই হোটেল মালিক বলে মনে হল না। একে বারে শান্তশিষ্ট ভদ্র সাধারণ মধ্যবিত্ত গোছের ঘরোয়া চেহারার কোন মানুষ।হোটেলে যেমন সাজানো গোছানো কিছু দেখিনি, কোন বয় বা চাকর বাকরও তেমন দেখি নি।উনি আমাদের বলে দিয়েছিলেন, পরের দিন ব্রেকফাস্টের জন্য পাশের একটি ছোট দোকানে বলা আছে, সেখানে গিয়ে স্লিপ দেখালেই ওরা দিয়ে দেবে।সেজন্য আমাদের দুটো হাতে লেখা স্লিপ দিলেন । আমরা আর কি করি, তাই নিলাম। আর একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, ঘরে পানীয় জলের কোন ব্যবস্থা নেই। আমরা বলতে দুটো ছোট বোতল দিয়ে গেল। এরপর যত বারই বলেছি, ছোট ছোট ওইরকম বোতল দিয়ে গেছে।
রাস্তায় এদিক ওদিক দেখতে দেখতে চলেছি। দেখি দুটি ছোট ছেলে আমাদের দেখিয়ে কাকে যেন বলছে নীচু স্বরে , ‘ইন্দিয়া ইন্দিয়া’। একটু পরে ওদের মধ্যে একটি ছেলে আমাদের দিকে ইশারায় ডেকে জিজ্ঞাসা করল, ইন্দিয়া? ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। কথা বলার ক্ষমতা তো নেই! ভাষাই জানি না।
কিন্তু আশ্চর্য হলাম, ওরা কি দেখে আমাদের চিনল, এবং একেবারেই ঠিক বলল, ইন্দিয়া! মনে হল, হয়ত এখানে অনেক বেশি লোক আসে ভারত থেকে, ওরা দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
চীনের টংলির বাজারেও এরকম আমাদের দেখে দোকানীরা বলছিল, ‘ইন্দু, ইন্দু’।তখন যে মনের কি অবস্থা হয়, কি বলব। যাই হোক, বুলবুল বেশি আর ঘুরতে চাইছিল না। বলল, কি জানি বিদেশ বিভুঁই জায়গা, সন্ধ্যেও হয়ে আসছে। দরকার নেই বেশিক্ষণ বাইরে থেকে।
পরে দেখেছিলাম, ভারত থেকে বহু মানুষ প্রতি বছর জর্ডন যান।এ ব্যাপারে জর্ডন নাকি ভারতের সাথে নতুন করে ব্যবস্থা করেছে। ফলে দিন দিন এখানে পর্যটক বাড়ছে অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারত থেকেও।আর এই ট্যুরিজম এই দেশের একটা বড় আয়ের সূত্র।কিন্তু বিপক্ষে কি জর্ডন থেকে অনেক মানুষ ভারতে আসেন ভ্রমণ করতে, মনে হয় না।
আমি ভাবছিলাম, আমার দেশের কথা। আমাদের দেশে প্রাচীন ইতিহাস, নদী, পাহাড়, মরুভূমি, সমুদ্র, স্থাপত্য, চিকিৎসা, জ্ঞানবিজ্ঞান সব আছে; কিন্তু তবুও আমরা দরিদ্র । কোন ট্যুরিজম ব্যবস্থাই নেই ভাল। দেশের সরকার আজ এত বছর ধরে শুধু উদাসীনতায় হাজার হাজার কোটি টাকা উপার্জনের ব্যবস্থা হারিয়েছে। এখনও হারিয়ে চলেছেন।
“আরব, মিশর ,পারস্য, তুরকী
তাতার তিব্বত-অন্য কব কি?
চীন, ব্রহ্মদেশ, অসভ্য জাপান,
দাসত্ব করিতে করে হেয়জ্ঞান,
ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয়”।
কি নেই আমাদের দেশে- সব আছে।ভগবান ঢেলে উজাড় করে দিয়েছেন, শুধু দেন নি সুবুদ্ধি। তার বদলে ভরে দিয়েছেন দুর্বুদ্ধি। তার ফলে আমাদের দেশের নেতৃস্থানীয়রা দেশের উন্নতির কথা চিন্তা না করে বহিরাগত বিদেশিদের মতই, নিজেরাই লুণ্ঠন করে দেশের সম্পদ বাইরে পাঠাচ্ছেন।ফলে আপামর ভারতবাসীর কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা আসে নি । আগে বিদেশীদের হাতে শোষণ ছিল, এখন দেশীয়দের হাতে শোষণ। ফল সেই একই , “রামা কৈবর্ত এর হাসিম শেখ”রা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে।আমি যত জায়গাতেই বেড়াতে গিয়েছি ভারতের বাইরে, সব দেশকে দেখেছি, এই দুঃখই আমার মনে বার বার এসেছে। প্রায় একই সময়ে বিদেশীদের হাত থেকে আমরা দুটি দেশ স্বাধীনতা পেয়েছি, তার উপর , আমাদের সব আছে ; আর এখানে, প্রায় কিছুই নেই, এমনকি খাওয়ার জল পর্যন্ত নেই। দেখার জিনিসও গুটি কতক মাত্র, পুরোই মরুভূমির দেশ; ভারতের তুলনায় কত ছোট দেশ, আমাদের দেশের ৩৭ ভাগের এক ভাগ মাত্র। তবু ওদের এক দিনার আমদের দেশের একশ’ টাকারও বেশি, যেটা আমেরিকার বিনিময় মূল্যের থেকেও বেশি। এটা কি করে হয়; সারা পৃথিবী থেকে লোক বেড়াতে আসেন এখানে অথচ আমাদের দেশে সেই তুলনায় আসেন না। এটা কি করে সম্ভব, এগুলো যখন ভাবি হীনমন্যতা আর হতাশায় ভরে ওঠে মন। (ক্রমশঃ)
এবার চলুন পরের পর্বে–
0 Comments