(বাংলা ছোটোগল্পের ইতিহাসের দিকে তাকালে দ্যাখা যাবে, মাঝে মাঝেই বাঁক বদল হয়েছে তার। বিষয়— আঙ্গিক সমস্ত দিক থেকেই বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে। আর এই বদলের সঙ্গে গভীরভাবে সংযোগ রয়েছে সময়ের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে বিশ শতকের পঞ্চাশের বছরগুলিতে লিখতে আসা গল্পকারদের নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চাশ-পরবর্তী ছোটোগল্প ও গল্পকারদের নিয়ে তেমন আলোচনা আমাদের নজরে আসেনি। কিন্তু এই সময়ে বাংলা ছোটোগল্প বৈভব ও ঐশ্বর্যে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। এই সময়-পর্বে লিখতে আসা নির্বাচিত লেখকদের চারটি করে গল্প নিয়ে বিন্যস্ত হবে এই আলোচনা। কিন্তু ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় আলোচনা সম্ভব হবে না। বিভিন্ন সংখ্যায় বিভিন্ন সময়ের গল্পকার উঠে আসবেন। এভাবেই বাংলা গল্পের অভিমুখকে চিহ্নিত করবার চেষ্টা করা হবে।)
বাংলা গল্পের পালাবদল— ৯
তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
বিশ্বজিৎ পাণ্ডা
সাহিত্যের আঙিনায় তপন বন্দ্যোপাধ্যায় (জন্ম-১৯৪৭)-এর আবির্ভাব কবি হিসেবে। কবিতাচর্চার অনেক বছর পরে গদ্য লিখতে এলেন। তবে আজও কবিতা লেখেন। কবিতা তাঁর পিছু ছাড়েনি। তাঁর একাধিক কাব্যগ্রন্থও রয়েছে। কবিতার অনুবাদও করেন। সীতাকান্ত মহাপাত্রর ‘ভারতবর্ষ’ কাব্যটি মূল ওড়িয়া ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। এই গ্রন্থের জন্য অনুবাদ সাহিত্যে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারও (২০১৯) পেয়েছেন। সত্তরের দশকের শেষদিকে গদ্য লেখা শুরু করেন। প্রথমে উপন্যাস, পরে গল্প। ১৯৭৯ সালে ‘সমতট’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল প্রথম গল্প ‘হরিণের মাংস’। আশির দশক থেকে নিয়মিত গল্প-উপন্যাস লিখে চলেছেন।
আমলাতন্ত্রের দাপটে সময়ের এক নাজেহাল বাস্তব চিত্র তাঁর গল্পগুলি। রাষ্ট্র-প্রশাসনের নির্মম স্বরূপ বারবার উন্মোচিত হয়েছে তাঁর গল্পে। নিয়মতন্ত্রের মধ্যে প্রতিদিনের জমতে থাকা অজস্র নিরুচ্চার প্রশ্নগুলোকে উস্কে দিয়েছে তাঁর কলম। তাঁর হাত ধরে লাল ফিতেয় মোড়া জগৎটাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছি আমরা।
আমলাতন্ত্রকে বিষয় করে লেখা গল্পগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প ‘রাজ্যপালের অসুখ’ (‘ঋতুপত্র গাঙ্গেয়’ ১৯৮৪)। সাড়া জাগানো এই গল্পের মাধ্যমে বৃহত্তর পাঠকের কাছে গল্পকার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। কলকাতার বাইরে গ্রামীন এলাকা পরিদর্শনে এসে রাজ্যপালের ‘একটু ক্লান্তি’-র জন্য গোটা প্রশাসন কীভাবে অকারণ নাকাল হয়েছিল তারই বর্ণনা এই গল্প। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাকদ্বীপ পাথরপ্রতিমা সাগরদ্বীপ এলাকা পরিদর্শনে এসেছেন বৃদ্ধ রাজ্যপাল। তিন-তিনটি মিটিং সেরে পাঁচ-ছ গ্লাস জল খেয়ে ফেলেছেন। দুপুরের রান্নাও জুতসই হয়নি। রাতে বাংলোয় খাবার সময় তিনি শুধু বলেছিলেন, “বহুত তকলিফ হুয়া।”
এতেই টেনশন শুরু হয়ে যায় তাঁর পারিষদ এ.ডি. কংতোর। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ডি.এম.কে ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে বলেন। জিপ ছুটে গিয়ে এলাকার একমাত্র ডাক্তারকে ধরে আনল ভাতের থালার সামনে থেকে। রাজ্যপালের বিরক্তিতে ঠিক মতো পরীক্ষাও করতে পারলেন না। শুধু নাড়িটা ধরেছিলেন। স্পেশালিষ্ট আনার পরামর্শ দিলেন। রাজ্যপালের সঙ্গে যে বিরোধী দলের এম.পি. এসেছিলেন তিনি “অ্যারেঞ্জ ফর ব্রিঙিং এ স্পেশালিষ্ট ফ্রম ক্যালকাটা” বলে পাশের ঘরে ঘুমোতে চলে যান। এরপর ডি.এম. বি.ডি.ও.কে, বি.ডি.ও ও.সি.কে, ও.সি. ওয়ারলেস অপারেটারকে ধমক ধামক দিয়ে কলকাতায় খবর পাঠান। খবর আসে “স্পেশালিষ্ট টিমও রেডি। অর্থোপেডিক্স, নিউরোলজিস্ট, কার্ডিওলজিস্ট, ই.এন.টি.। কিন্তু একজন স্পেশালিষ্ট এখনো এসে পৌঁছোননি। তিনি ডেন্টিস্ট।”
আবার খবর আসে— “সি.এম.-কে জানানো হয়েছে। গভর্নর অসুস্থ জেনে চীফ মিনিস্টার খুবই অ্যাংশাস। কী ভাবে উনি অসুস্থ হলেন তার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে ডি.এম. যেন এখুনি রিপোর্ট পাঠান।” রাজ্যপালের হোম সেক্রেটারি পনেরো মিনিট ছাড়া ছাড়া খবর জানতে চান। তিনি ডি.এম. এবং এস.পি.-র উপর বিরক্ত। সবাই সন্ত্রস্ত। চাকরি হারানোর ভয়। “সবাই উৎকণ্ঠায় টানটান। ঘরের ভেতর রাজ্যপাল কেমন আছেন বোঝা যাচ্ছে না।” ডাক্তাররা এক সময় এসে পৌঁছলেও ঘুমন্ত রাজ্যপালের ঘরে ঢুকতে পারছেন না। একসময় রাজ্যপালের ঘরে আলো জ্বলল, ঢক ঢক জল খাবার শব্দ। “সুযোগ বুঝে এ.ডি. কং. দরজায় ঝুঁকে পড়ে বলল, স্যার আপনি কি জেগেছেন ? ঘুমচোখে দরজা খুলে রাজ্যপাল অবাক হলেন, আপ সব হিঁয়া কিঁউ রহতা হ্যায়। যাও, যাও, শো যাও।” ডঃ মাত্রে শরীরের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন— “সামকো বুকমে কুছ দরদ হুয়া, লেকিন আভি সব ঠিক হ্যায়।”
এতে ভয় পেয়ে যান ডাক্তাররা। ভোরেই শিফ্ট করতে হবে। গাড়িতে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না, হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি হেলিকপ্টার গৌহাটি গেছে আসামের মুখ্যমন্ত্রীকে লিফট দিতে। গৌহাটিতে যোগাযোগ করে জানা গেল, দিল্লি গেছে, একটা ফল্ট ধরা পড়েছিল তা সারাতে। হেলিকপ্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলেও তা এসে নামবে কোথায়। ডি.এম. নির্দেশ দিলেন এক ঘণ্টার মধ্যে হেলিপ্যাড তৈরি করতে। বি.ডি.ও. ছুটতে ছুটতে গেলেন পি.ডবলিউ.ডি.-র ইঞ্জিনিয়ারের কোয়ার্টারে। ইঞ্জিনিয়ার ঘুম থেকে উঠে বলেন— “এস্টিমেট করতে হবে, টেন্ডার ডাকতে হবে, কনট্রাকটারকে ওয়ার্ক-অর্ডার দিতে হবে। সে অনেক হ্যাঁপা।” অনেক চেষ্টা চরিত্র করে ভোরবেলা হেলিপ্যাড তৈরি হল। খড় পাওয়া মুশকিল। খড়ে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া বেরুলে তবে হেলিকপ্টার নিশানা বুঝতে পারবে। ও.সি. ছুটে গিয়ে এক গরিবের কুঁড়ের চাল থেকে খড় ছিঁড়ে আনলেন।
রাজ্যপাল ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসেছেন। সাগরদ্বীপ যাবার প্রোগ্রাম আজ। সে কথা বলে মর্নিং-ওয়াকে বেরলেন। “ফির ন বাজসে সাগরদ্বীপ। রাজ্যপালের পিছু পিছু এ.ডি. কং. চললেন, মর্ণিং-ওয়াকে। আর তখন গোঁ গোঁ শব্দে আকাশ কাঁপিয়ে হেলিকপ্টার এসে পৌঁছুচ্ছে দিল্লি থেকে। ওদিকে খড়ের চাল ভেঙে খড়ে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়ার সিগন্যাল দিচ্ছেন ও.সি.।”
আপাত মজার এই গল্পে সরকারি ব্যবস্থার প্রতি লেখকের শাণিত ব্যঙ্গ প্রকাশ পেয়েছে। বাস্তব অবস্থার কথা না ভেবে উঁচুপদের লোকজন তাঁর নীচের আমলাদের নির্দেশ দিয়ে কীভাবে নাকানি-চোবানি খাওয়ান, তাও প্রকাশিত এখানে। আর বেচারারা চাকরি বাঁচাতে উপরওয়ালার নির্দেশ মানতে বদ্ধ পরিকর। যেমন এখানে চিফ মিনিস্টার ডি.এম.-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন তখনই তদন্ত রিপোর্ট পাঠাতে। ডি.এম., এস.পি., এস.ডি.ও. প্রমুখদের আপাতভাবে মনে হয় ঝঞ্ঝাটমুক্ত সম্মানীয় চূড়ান্ত ক্ষমতাশীল পদে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছেন। কিন্তু তাঁদেরও যে সর্বদা ঊর্ধ্বতন অফিসারের ভয়ে থাকতে হয়— লেখক সুন্দরভাবে তা দেখিয়েছেন। এখানেও এক ধরনের শোষণ চলে প্রতিনিয়ত। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাঁর অধঃস্তন অফিসারদের শোষণ-পীড়ন করেন। তথাকথিত শোষণ হয়তো বলা যায় না একে, কিন্তু প্রশাসনের ব্যবস্থাটাই এরকম। এই ব্যবস্থায় প্রত্যেকেই তাঁর ক্ষমতা প্রতিপত্তি মেজাজ দেখাতে চান অধঃস্তনের উপর। এভাবেই নিজেদের পদে টিকে থাকেন সবাই। এভাবেই পূর্বের নিয়মে টিকে থাকে প্রশাসন। নিজেদের দায় অনায়াসে অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে মুক্ত হবার চেষ্টা করেন প্রত্যেকে।
পেশায় আমলা ছিলেন তিনি। আমলা-জীবন তাঁর সাহিত্যজীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় ‘আমলাগাছি’ গদ্যগ্রন্থটির কথা। আমলা-জীবনের নানান মজার ঘটনা নিয়ে লেখা খবরের কাগজের কলামগুলি সংকলিত হয়েছে এই গ্রন্থে। এর ভূমিকায় তিনি লিখেছেন— “...সে সময় অগ্রজ লেখকেরাও বলতেন যা চারপাশে দেখবে সেই বিষয় নিয়ে লেখাই শ্রেয়। তা আমাদের জীবনের একটা বড়ো অংশ কেটেছে অফিসের প্রবল ঝঞ্ঝাটের মধ্যে, একসময় ভেবেছি সেই অভিজ্ঞতাই তো হয়ে উঠতে পারে লেখার বিষয়।” হ্যাঁ সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তপন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন একটার পর একটা লেখা। লিখেছেন গল্প, লিখেছেন উপন্যাস।
সরকারি আমলা তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় প্রথমাবধি গুরুত্ব পেয়েছে অফিস-আদালত-থানা-পুলিশ-সরকারি প্রকল্প, তা নিয়ে সমস্যা, রাজনীতি ইত্যাদি। তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য গল্প ‘প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা’ (‘গল্পসমগ্র—১ম খণ্ড’, করুণা প্রকাশনী, বইমেলা ২০০২)। সুবর্ণরেখা-সংলগ্ন খড়িগেড়িয়্যা গ্রামের পটভূমিতে লেখা এ গল্পে প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ মানুষদের এবং আমলাদের উৎসাহের শেষ নেই। প্রধানমন্ত্রী যে পথ দিয়ে যাবেন সেই পথের দুদিকে শালখোঁটা ও কাঁটাতার দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়, পুলিশি ব্যবস্থা জোরদার করতে হয়। এই রাজপুত্তুর প্রধান মন্ত্রী বাঁধা গতে চলেন না। নিজে ড্রাইভ করে গলি ঘুঁজি রাস্তায় ঢুকে পড়েন। যেমন দুখুর বাড়িতে ঢুকে ছিলেন।
গ্রীষ্মের রাঢ়ের বিভিন্ন অঞ্চলে জলের অভাবে কী ভয়াবহ রূপ নেয় এ গল্পে সে প্রসঙ্গও এসেছে। “খরার প্রকোপ আরও বেড়ে গেল। কোন টিউকলেই আর জল উঠছে না। এরকম খরা নাকি বহু বছরের ইতিহাসে দেখা যায়নি। খড়িগেড়িয়্যা গাঁয়ের লোক লাইন দিয়ে জল আনতে যায় তিন গাঁ পার হয়ে দূরের একটা গাঁয়ে। সেখানে এখনও একটা টিউকল হেঁচকি তুলে তুলে জল দিচ্ছে... গাঁয়ের পুকুরগুলোও শুকিয়ে ডা ডা করছে।”
জলের সমস্যা এই এলাকার মানুষদের প্রাথমিক ও প্রধান সমস্যা। তাই কোনো এক খেয়ালে প্রধানমন্ত্রী অসহায় দরিদ্র দুখু মুর্মুর বাড়িতে এসে তার সমস্যার কথা জানতে চাইলে দুখু বলে— “আমার বেড়ার ধারে একটা টিউকল চাই। এ গাঁয়ে মোটে একটা টিউকল, সে-ই দক্ষিণ কোণে। জল আনতে বড় কষ্ট।”
প্রধান মন্ত্রী টিউবওয়েল দেবেন বলে গিয়েছিলেন বলে পঞ্চায়েত থেকে কল বসানোর ব্যবস্থা হচ্ছে না। জলের কষ্ট ঘুচল না।
বহুদিন পরে আবারও প্রধান মন্ত্রীর আসার খবর হল। আবারও শাল খোঁটা পোঁতার ব্যবস্থা হল। গতবার যেখানে যেখানে প্রধান মন্ত্রী গিয়েছিলেন, সেখানে সাংবাদিকরা পৌঁছে গেল।
কিন্তু অনিবার্য কারণে প্রধান মন্ত্রীর আসা বাতিল হয়ে গেল। কিন্তু রাত জেগে দশ লক্ষ টাকার শাল খুঁটি পোঁতার কাজ শেষ করা হল। কারণ কাজ শেষ না-হলে কনট্রাকটর টাকা পাবে না।
সুবর্ণরেখা প্রোজেক্ট থেকে এই অঞ্চলে জলের লাইন আসবে ঠিক হয়। তাও একসময় বাতিল হয়ে যায়। গ্রামের মানুষেরা জলের অভাবে ঘর ছাড়ে। আর যেতে যেতে দুখু মানসচক্ষে দেখতে পায়— “সুবর্ণরেখার জল এসে একদিন ভোরে যাবে জায়গাটা। টিউকলটা থেকে অঝোরে জল পড়বে...।” দুখুরা আজীবন স্বপ্ন দেখে যায়। আর বাবুরা শুধু স্বপ্ন দেখিয়ে চলে। এই স্বপ্নটাই তাদের নিত্যনৈমিত্তিক বাস্তব। তীব্র স্যাটায়ার এই গল্পেও।
আলোচিত গল্পগুলি ছাড়াও ‘ইঁদুর’, ‘মুখ্যমন্ত্রীর উপহার’, ‘প্রধানমন্ত্রীর সফর’ ইত্যাদি গল্পেও তীব্র স্যাটায়ারের শাণিত ঝলক দ্যাখা গিয়েছে। তাঁর কৌতুকোজ্জ্বল গল্পগুলি সমাপ্তিতে এক ধরনের বিদ্রোহ, এক ধরনের প্রতিবাদমুখরতায় কেঁপে ওঠে। শুধু হাসির গল্পের নিগড়ে আর বেঁধে রাখা যায় না। তাঁর বিদ্রূপের লক্ষ্য আমলাতন্ত্র, সরকারি ব্যবস্থা, প্রশাসন-রাজনীতি ইত্যাদি। শাণিত বিদ্রূপে তিনি জর্জরিত করেছেন প্রশাসনের অন্তঃসারশূন্যতাকে। অধিকাংশ গল্পেই ফুটে ওঠে প্রশাসনের অদ্ভুত সব চেহারা। যে ইতিহাসকে নেতারা ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চান, সেই ইতিহাসকে লেখক শিল্পীরাই টেনে হিঁচড়ে প্রকাশ্যে আনার সাহস রাখেন। লেখক এই কাজটি আন্তরিকতার সঙ্গে করেছেন। আর তা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে কৌতুককর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। সে সব গল্প থেকেও পাঠক হাসির খোরাক পান। তার কারণ তাঁর গদ্যভাষার বিন্যাস।
পরিবর্তিত গ্রাম, পরিবর্তিত সময় তাঁর গল্প-উপন্যাসের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তাঁর মহাকাব্যোপম উপন্যাসত্রয়ী ‘টাঁড়বাংলার উপাখ্যান’, ‘টাঁড়বাংলার রূপাখ্যান’ এবং ‘টাঁড়বাংলার রূপকথা’-য় পরিবর্তিত সময়ের গ্রামীণ রাজনীতির ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। বর্তমানে এই তিনটি আখ্যান একত্রে ‘দ্বৈরথ’ নামে প্রকাশিত হয়েছে।
বিভিন্ন গল্পেও গ্রামীণ সমাজ-রাজনীতির নানান চেহারা উদগ্র হয়ে আছে। ‘আই আর ডি পি’ (‘গল্পসমগ্র—১ম খণ্ড’, করুণা প্রকাশনী, বইমেলা ২০০২) গল্পের নামেই বোঝা যায় গল্পের বিষয়। আই-আর-ডি-পি নিয়ে গ্রাম-গঞ্জে কী প্রহসন চলে গল্পে তার পাশাপাশি এসেছে এই প্রোজেক্টের সরকারি বিধিও। অর্থাৎ একদিক থেকে এই গল্পের একটা তথ্যের (documentary) দিকও রয়েছে। “আই আর ডি পি অর্থাৎ ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্ট এ রাজ্যে চালু হয়েছে সেই ১৯৭৮-৭৯ সালে ১৯৮০ সালের ২ অক্টোবর থেকে রাজ্যের ৩৩৫টি ব্লককেই আনা হয়েছে আওতায়। গাঁয়ের গরীব মানুষ, যাদের বাৎসরিক আয় ৩৫০০ টাকার কম, একমাত্র তাদেরই এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা আছে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে, এই প্রত্যেকটি পরিবারকেই আমাদের সাহায্য করতে হবে আই আর ডি পি স্কিম দিয়ে—যাতে এই প্রকল্পের মাধ্যমে রুজি রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন প্রত্যেকে।”
প্রতিটি স্কিমে টাকার পরিমাণ ৬০০০ টাকা। প্রান্তিক চাষি বা ভূমিহীন হলে ১/৩ ভাগ সাবসিডি। আর তপসিলি উপজাতি হলে অর্ধেক ছাড়। শোধ করতে হয় অর্ধেক। স্বাভাবিকভাবে প্রলুব্ধ হয় মানুষেরা। কিন্তু অশিক্ষিত মানুষরা লোন নিতে এগিয়ে এলেও তাকে কাজে লাগাতে পারে না। গ্রামের রাজনৈতিক নেতারা লোন পাইয়ে দেবার ব্যাপারে উৎসাহী হলেও, তারপর আর খোঁজ রাখেন না। ফলে দেখা যায়— “যার মুড়ি ভাজার কথা সে-লোক লোনের টাকা দিয়ে ঘর ছেয়ে নিয়েছে, যার হাঁস-মুরগি কেনার কথা, সে কিনেছে রেডিও, যার মাদুর বোনার কথা, সে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে।” ফলে অর্ধেক টাকা যে লোন তাই শোধ হয় না। কিন্তু লোন পাইয়ে দেবার বিনিময়ে পার্টিফান্ডের চাঁদাটা নিতে ভোলেন না নেতারা। কারো কারো ইচ্ছে থাকলেও যথাসময়ে ট্রেনিং-র অভাবে কাজে নামতে পারে না। এভাবেই সরকারের সৎ প্রচেষ্টা বিফলে যায়। গ্রাম্য নেতাদের সদিচ্ছার অভাবে। গল্পের শেষে দেখি—পঞ্চায়েত গ্রাম্য সম্বোধনে ‘পঞ্চাৎ’ শব্দটি মোটর বাইকের শব্দে মিশে ‘বাঞ্চোৎ’ হয়ে কানে বাজে পঞ্চায়েতের কাছে।
এদিকে লোনীদের উপর ঋণের পাহাড়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘পঞ্চাৎ’ তাদের আশ্বাস দেয়— “তোমাদের কোনও ভাবনা নেই। পঞ্চায়েত সমিতির মিটিঙে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আর-একটা করে সাবসিডিয়ারি স্কিম করা হচ্ছে। প্রত্যেকের আরও দু-হাজার টাকা করে লোন—।” এভাবেই দরিদ্ররা ঋণের জালে জড়িয়ে আরও দরিদ্র হয়। সরকার প্রোজেক্টের অপর প্রোজেক্ট ঘোষণা করে। এভাবেই চলে সরকারি ব্যবস্থা। এভাবেই অন্ধকারে পড়ে থাকে গ্রামের মানুষ।
মধ্যবিত্ত মানুষদের অফিস-যাপন নিয়ে লিখেছেন। অফিস মানুষকে বদলে দেয়। অরণ্যচারী লোধা-শবর-সাঁওতালরা বারবার এসেছে তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে। আর এই দরিদ্র আদিবাসীদের সম্পর্কে শহুরে বাবুদের মনোভাবকে আড়াল করেননি লেখক। ‘বিবমিষা’ (‘গল্পসমগ্র—১ম খণ্ড’, করুণা প্রকাশনী, বইমেলা ২০০২) গল্পে দেখি— মেদিনীপুরের একটি প্রত্যন্ত জংলি গ্রামে আদিবাসী শুকদেবের বাড়িতে এসেছে তারই কলকাতার অফিসের কয়েকজন বন্ধু, কলিগ। এই আদিবাসী মানুষদের নাচগান দ্যাখার উদ্দেশ্যে এলেও মহুয়া-হাঁড়িয়ার প্রতি তাদের দুর্বার আকর্ষণ। শুকদেবের প্রতিবেশীরা যথাসাধ্য আয়োজন করেছে শহুরে বাবুদের জন্য। তাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ শুকদেবের কলিগরাও। আপ্যায়নে নিয়োজিত স্বাস্থ্যবতী আদিবাসী মেয়েরা নেশা ধরায় তাদের চোখে। রাতে খাওয়ার পর নিখিলেশ ও বিলাস, দলিয়া ও জানকীকে নিয়ে চোখের আড়ালে চলে যায়।
পরদিন তারা কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। গ্রাম ছেড়ে আসার পর শুকদেব কলিগদের কাছে জানতে চায় কেমন লাগল তাদের গ্রাম। বিলাসই উত্তর দিল— “দারুণ, দারুণ, তবে তার চাইতে ভালো তোমাদের গাঁয়ের মেয়েরা।”
শুকদেব হাসল— “কিন্তু খুব কষ্টে আছে আমাদের গ্রামের লোকজন। ওই যে দলিয়া বলে মেয়েটা, ক’দিন আগে ধরা পড়েছে ওর টিবি হয়েছে। ... কিন্তু তার চেয়েও খারাপ অসুখ হয়েছে জবা আর জানকীর।”
জানকীর কুষ্ট হয়েছে জানতে পেরে “বিলাসের চোখ মুখ হঠাৎ কেমন বিকৃত হয়ে গেল। পরমুহূর্তে তার গলায় ওয়াক শব্দ। তারপর হড়হড় করে বমি করে ফেলল জিপের মধ্যে।”
শহুরে মানুষদের গালে সজোরে এক থাপ্পড়।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি সাঁওতালি কবিতার অনুবাদ করেছেন। সাঁওতালদের জীবন নিয়ে নিয়ে বহু আখ্যান রচনা করেছেন। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে ‘মহুলবনীর সেরেঞ’, ‘মহুলবনীর সেংগেল’ উপন্যাসদুটির কথা। এখানেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাঁওতালদের জীবনচর্যার পরিবর্তন ধরা হয়েছে দুটি আলাদা সময়ের প্রেক্ষাপটে। টাঁড়বাংলা সিরিজের উপন্যাসেও এসেছে সাঁওতালদের কথা। লোধা-শবর আদিবাসীদের জীবনকথা।
তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের সবচেয়ে বড়ো জোর অভিজ্ঞতার জোর। একজন অতি ব্যস্ত আমলার প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতাকে দক্ষতার সঙ্গে শিল্প করে তুলতে পেরেছেন তিনি। পূর্বে উল্লেখিত ‘আমলাগাছি’র ভূমিকায় আরও লিখেছেন— “আজ থেকে চল্লিশ বছরেরও বেশি আগে কালেক্টরেটের চাকরিতে যোগদান করে, শব্দটির মহিমা জেনে কিছুটা পুলকিত হইনি তা নয়। একটু একটু করে আমলাতান্ত্রিকতার যে-পৃথিবী আবিষ্কার করেছিলাম, তার মধ্যে প্রতি মুহূর্তে বিজবিজ করে যেমন টেনসন, তেমন খুঁজে পাওয়া যায় অজস্র মজার ঘটনাও। এই চাকুরির আরও একটা সুবিধে এই যে, কোনও একটি জায়গায় থিতু হতে দেয় না মহামান্য সরকার, ফলে ক্রমাগত বদলে যায় পায়ের তলার মাটি, আর বারে বারে স্থানান্তর হওয়ার কারণে এলাকার সমস্যার ধরন যেমন বদলে যায়, তেমনই রূপান্তর ঘটে অভিজ্ঞতার। কত বিচিত্র চরিত্রের সম্মুখীন হয়ে খুঁজে পেয়েছি জীবনের নানান অর্থ। যেমন দ্যাখা পেয়েছি আকবর বাদশাদের (পড়ুন মুখ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের), সান্নিধ্য পেয়েছি অসংখ্য ব্যুরোক্র্যাটের, তেমনই বর্ষে বর্ষে দলে দলে হরিপদ কেরানিরাও এসেছেন জীবনে, স্পর্শ করেছেন তাঁদের কলমের কালি (পড়ুন হৃদয়) দিয়ে। তাঁদের প্রত্যেকের কাছেই পেয়েছি লেখার রসদ।” তাঁর লেখার এত বৈচিত্র্যর মূলেও রয়েছে কর্মজীবনের এহেন বিস্তার। জীবন থেকেই তুলে নিয়েছেন গল্পের রসদ। এভাবেই আলাদা হয়ে যায় তাঁর গল্প।
তাঁর গল্পের বিশেষ আকর্ষণ সরস এবং বুদ্ধিদীপ্ত ভাষাশৈলী। কখনো-বা বৈঠকি আড্ডার মেজাজ। সেই সরস গদ্যে তুলে ধরেন মানুষের স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের অভাবনীয় ছবি। গ্রামীণ হতাশ ও অসহায় মানুষদের টালমাটাল জীবনচিত্র তাঁর গল্পগুলি। আর তারই মধ্যে কখনো ফ্যানটাসি, আবার কখনো তীব্র স্যাটায়ারের চাবুক ; হালকা মজা আর মাঝে মাঝে হাসির ঝড়। আর তার ভিতর দিয়ে উঠে আসে বাংলা তথা ভারতের সমাজ-রাজনৈতিক ইতিহাস। গ্রামীণ ভারতবর্ষকে নতুন করে আবিষ্কার করি আমরা তাঁর হাত ধরে।
গত প্রায় দু-দশক ধরে উপন্যাস বেশি লিখছেন তিনি, তুলনায় গল্প বেশ কম। তবুও পাঠক আজও অপেক্ষায় থাকেন সমাজ-রাজনীতির অদ্ভুত সমস্যানির্ভর তাঁর কৌতুকোজ্জ্বল গল্পগুলির জন্য।
5 Comments
সমৃদ্ধ হলাম।
ReplyDeleteবাংলা গল্পের পালাবদলের সঙ্গী হয়ে আজ পেলাম তপন বন্দ্যোপাধ্যায় কে। আলোচক বিশ্বজিৎ পাণ্ডা র চোখ দিয়ে গল্পগুলো পড়তে পড়তে এক সময় সে অনুভব যেন আমারই হয়ে গেল। আমলা জীবনের সাদা-কালো অজস্র কথামালা গল্পের কথা শরীরে বাঙময় হয়ে উঠেছে। অনেক অজানা তথ্য,না জানা কাহিনি প্রকাশিত হয়ে গেল।বিশ্বজিৎ কে অভিনন্দন জানাই।
ReplyDeleteভালো লাগলো বিশ্বজিতের বিশ্লেষণ।
ReplyDeleteভালো লাগল। লেখককে নতুনভাবে চিনলাম
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো
ReplyDelete