জ্বলদর্চি

জাওয়া করম /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৩৫

জাওয়া করম

ভাস্করব্রত পতি

"শাঁখলদীক বালিয়ানী জাওয়া পাতা বগঅ 
এমন জাওয়া হেলকী উঠে শালগাছেক পারা। 
চন্দন কাঠ কাটি কুটি মাচলা বনাব গ অ
নিহি খাওলঁ বাসী মাড় নিহি খাওলঁ তাতাগ
নিহি খাওলঁ ধুঁড়সা জন্হার পুড়া।
সেই মাচলায় জাওয়া বেঢ়বঅ।
জাওয়া জেগ দিলে তরহা কবে নিড়ন হেতগ অ একাদশীকে বার করি জাওয়া নিড়াব।"

এটি জাওয়া করমের গান। যা কিনা এই পরবের অন্যতম উপচার। গান ছাড়া জাওয়া করম অসফল। ভাদ্রের শুক্লা একাদশী তথা পার্শ্ব একাদশীর দিন সীমান্তবর্তী এলাকায় করম গাছ ডাল প্রতীকে করম রাজার পূজার প্রচলন রয়েছে। মূলতঃ মাহাতো, কুড়মি, ভূমিজ, কোল, দেশওয়ালী, ওঁরাও, ভুক্তা, লোধা, বীর, মাহালী, মাঝি, কোড়া, হড়, খেড়িয়া, ভুঞ্যা, মুণ্ডাদের কাছে এই উৎসব দারুন জনপ্রিয়। তেমনি ডোম, কুমার, বাগাল, গোয়ালা, ঘোড়ই, হাড়ি, বাউরী, কামার, মুচি, তাঁতিদের মধ্যেও প্রচলিত আছে। নায়কে মঙ্গলচন্দ্র সরেনের তাঁর মতে, "সাঁওতাল, কুড়মি, ওঁরাও, খেড়িয়া প্রভৃতি জাতি যেরূপ আড়ম্বরের সঙ্গে পূজা করে, অন্যান্য জাতিরা সেরূপ আড়ম্বরের সঙ্গে পূজা করে না"। মূলতঃ শষ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং নানা অপদেবতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই করম পূজা করা হয়। তাই এটি সম্পূর্ণ কৃষি উৎসব হিসেবেই পরিগণিত হয়ে থাকে।

করম পূজার ৭ থেকে ১১ দিন আগে কুমারী মেয়েরা নদী বা খাল থেকে বালি মাটি সংগ্রহ করে আনে। সেই বালিমাটির ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় পঞ্চশষ্য। পুঁতে দেওয়া হয় হলুদ ও ধানের চারা। কোথাও কোথাও গ্রামের ছোট ছোট মেয়েরা নতুন ঝুড়ি (টুপা) বা ডালাতে ১১ রকমের শস্যবীজ রেখে দেয়। এগুলোর অঙ্কুরোদগম হয়ে যাওয়াকে বলে 'জাওয়া' স্থাপন। 'জাওয়া' শব্দের অর্থ হল Germination। এবার জঙ্গল থেকে ধামসা মাদল বাজিয়ে মহা সমারোহে নিয়ে আসা হয় করম ডাল। 

প্রথমেই গভীর জঙ্গলে গিয়ে করম শাখা নির্বাচনের পর শাখা দুটিকে বরণ করতে হবে গানের সুরে। কচিকাঁচা কিশোরীদের কন্ঠে অনুরণিত হয় জাওয়া করমের সুরেলা গান। সেই গান করতে করতে কিশোরীরা করম ডালের গায়ে হলুদ অথবা লাল সূতা বাঁধবে। সিঁদুরও মাখিয়ে দিতে হয়। এখন করমের ডাল দুটি কাটতে হবে। একজন কিশোর তা কাটে। এগুলির নিচের অংশে লাল গামছা জড়িয়ে ফেলা হয়। তারপর সবাই মিলে সেগুলিকে নিয়ে আসবে গ্রামের থানে -- যেখানে করম পূজার আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে ইতিমধ্যেই গ্রামের প্রধান ‘মাহাতো' এবং ‘পাহানরা' করম পূজার যাবতীয় ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছে। পাহানের যিনি সহকারী থাকেন, তিনি এই ‘পূজার’ করম শাখা দুটি প্রাঙ্গণের নির্দিষ্ট বেদীতে পুঁতে দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করেন। এরপর চলে নির্দিষ্ট উপচারে পূজা পদ্ধতি।

প্রথমে পাহান একটি ফুল দিয়ে আরাধনা করে গ্রাম দেবীকে। আসলে তাঁকে সন্তুষ্ট না করলে চলেনা। তারপর আবারো কিছু ফুল ও তুলসীতে সিঁদুর মাখিয়ে করম শাখা দুটির নিচের অংশে দিয়ে করমের আরাধনা করা হয়। গোল হয়ে থাকা ভক্তদের সকলের হাতে একটি করে ফুল দিলে তাঁরা তা প্রনাম করে বেদীর দিকে ছুঁড়ে দেয়। পূজোর শেষে শুরু হয় ব্রতকথা। ধরম ও করম এই দুই ভাইয়ের কাহিনী নিয়েই ব্রতকথা এগিয়ে চলে।

কুমারী মেয়েরা এবার ঐ 'জাওয়া ডালি' এনে উঠোনের পূজোর মণ্ডপে রাখে। এই অনুষ্ঠানে লাগে শসা, গুড়, দই, মিস্টান্ন, হাঁড়িয়া, কলা, চিড়ে, দুধ, আলোচাল, হরিতকি, জলের ঘটি ইত্যাদি। এখানে শসা হল সন্তানের প্রতীক। সন্তানবতী মহিলারা ডালিতে আনে সিঁদুর মাখানো শসা। এই ডালিগুলো এই পূজার নৈবেদ্য। মহিলারা সেগুলো সাজিয়ে রেখে উচ্চারন করে -- 'আমার করম, ভায়ের ধরম'। আসলে শুধু সন্তান কামনার জন্য নয়, জঙ্গলমহলের আপাত সহজ সরল মহিলারা নিজের ভাই, সহোদর সহ সকলের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করে। এটাই এই লৌকিক উৎসবের মূল সুর। করমরাজের জন্য অন্নভোগেরও ব্যবস্থা থাকে কোথাও কোথাও। করম নাকি খিচুড়ি খেতে পছন্দ করেন। তাই খিচুড়ি দেওয়ার রীতিও লক্ষ্য করা যায়। আর সমগ্র অনুষ্ঠানের এলাকাটিকে সাজানো হয় শালুক ফুল দিয়ে। করম পূজায় শালুক হল প্রধান ফুল। এখানে যে মণ্ডপটি বানানো হয় তা একটু অন্যরকম। একটি বাঁশের অর্ধেক অংশ থেকে চার ভাগে ফালি করে একটি ফালি মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। আর বাঁশের মূল অংশটি মাঝখানে পোঁতা হয়। 

করম পূজোর আবহ সুন্দর ভাবে লিখেছেন, ড. স্বপন কুমার ঠাকুর। তাঁর বর্ণনায়, "শেষ ভাদ্রে গুমোট সাঁজবেলা। তারায় ভরা আকাশ। বনে বনে ডাকছে রাত ঝিঁঝিঁ। রাজোয়ার আর বুনোপাড়ার কুমারী মেয়েরা কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরেছে। সেজে গুজে হাজির হচ্ছে করম ঠাকুরের থানে। হাতে হাতে পূজার অর্ঘ্য। কাঁসার বগিতে হরেক রকমের ফলকুচো। পাঁচকলাই ভিজে। বুনোফুল বুনো পাতা। এক থান সিঁদুর। আর এক গেলাস কানায় কানায় মা গঙ্গা। বগিতে বসানো জ্বলন্ত মাটির প্রদীপ। করম ঠাকুরের থানে নামিয়ে পেন্নাম করে গোল হয়ে বসে।"

ড. সুহৃদ কুমার ভৌমিক লিখেছেন, "করম বা কদম গাছের সঙ্গে বর্ণ হিন্দুদের একটি ঘনিষ্ঠতাও রয়েছে। করম গাছের তথা শ্রীকৃষ্ণ বাঁশি বাজাতেন এবং কদম ফুল শ্রীকৃষ্ণের খুব প্রিয়, তাও আমাদের অজানা নয়। রাধাকৃষ্ণের প্রেম ভালোবাসার কাহিনীর সঙ্গে এ গাছের যোগ বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। করম দেবতা বা করম রাজা লৌকিক দেবতা, আদিবাসীদের দেবতা। এই দেবতাটি কি হিন্দুদের শ্রীকৃষ্ণের আদিবাসী সংস্করণ? এ কথা বলার তাৎপর্য এই যে, মানভূম অঞ্চলের ভুঁঞ্যা, মাহাতো প্রভৃতি কৃষক সম্প্রদায় মনে করে করম গাছ হল ভালোবাসার প্রতীক, কারণ এই গাছের সঙ্গে রাধাকৃষ্ণের প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে"। 

দুটি করম ডাল পূজা করার অর্থ কিন্তু ইঙ্গিতপূর্ণ। ডাল দুটি রাধা কৃষ্ণ উভয়ের প্রেম ভালোবাসার চিরায়ত রূপ বলে অনেকের অভিমত। এইসব দেখে অনেকের অভিমত আদিবাসীদের করম দেবতা এবং হিন্দুদের শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আর জঙ্গলের বুক চিরে অনুকম্পিত হয় মেঠো সুর -- "যাও যাও করম ঠাকুর আপনার দেশে / আরাবত আনব বটেক এই ভাদর মাসে"।


পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

3 Comments