জ্বলদর্চি

আনুবিস: প্রাচীন মিশরের শেয়ালমুখো দেবতা/ প্রসূন কাঞ্জিলাল

আনুবিস: প্রাচীন মিশরের শেয়ালমুখো দেবতা 

প্রসূন কাঞ্জিলাল


প্রাচীন মিশরীয় দেবতা আনুবিস। মৃত্যু, সমাধি সৌধ এবং মমির দেবতা ছিলেন আনুবিস। দেবতা আনুবিসের শরীর মানুষের মতো অথচ মাথা শেয়াল মতো- যা এক গা ছমছমে অন্ধকার রহস্যময়তা সৃষ্টি করে। উপকথা মতে প্রাচীন মিশরে দেবতা আনুবিসই প্রথম মমি তৈরি করেছিলেন- যা এক অভিনব পরকালবাদী ধর্মবিশ্বাসের জন্ম দেয় এবং পরবর্তী যুগের সেমিটিক ধর্মমতগুলিকে প্রভাবিত করে ...

মিশরীয় শেয়াল। দেবতা আনুবিসের শরীর মানুষের মতো অথচ মাথা শেয়াল মতো। এর কারণ কি? প্রাচীন মিশরের মানুষ বিশ্বাস করত শেয়াল-এর ভিতরে বাস করে পবিত্র আত্মা । বিড়ালের মতোই প্রাচীন মিশরে শেয়ালও ছিল পূজনীয়।

দেবদেবীর সৃষ্টি নিয়ে প্রাচীনকালে মিশরীয় পুরোহিতরা সৃষ্টিতত্ত্ব রচনা করেছিল। সেই সঙ্গে রচনা করেছিল দেবতাদের কূলপুঞ্জী। সেই কূলপঞ্জীতে দেবতাদের আত্বীয়স্বজন কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাচীন মিশরের দেবদেবীরা একে অন্যের সঙ্গে সর্ম্পকিত ছিল। প্রাচীন মিশরীয় সৃষ্টিতত্ত্বে দেবদেবীর জন্ম হয়েছিল মিশরীয় নগর হেলিয়াপোলিসে।

হেলিয়াপোলিসের অবস্থানের এখানেই আনুবিসের উপাসনা কেন্দ্রটি রয়েছে। মিশরীয় সৃষ্টিতত্ত্বে ৯ জন আদি দেবদেবীর কথা বলা হয়েছে। একত্রে এদের বলা হয় Ennead। আনুবিস এননিয়াডের(Ennead) অন্যতম। 

আনুবিস এর জন্ম নিয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। তবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মত হল- আনুবিসের বাবা ছিলেন দেবতা ওসিরিস এবং মা দেবী নেপথিস। উপকথা মতে দেবতা ওসিরিস কে খুন করেছিল তারই ভাই সেথ। হত্যার পর দেবতা ওসিরিস-এর মৃত দেহটি চৌদ্দ টুকরো করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল । 

তারপর দেবী আইসিস সেই বিচ্ছিন্ন দেহখন্ড জড়ো করেছিল। তাকে সাহায্য করেছিল আইসিস-এর বোন দেবী নেপথিস। নেপথিস সম্পর্কে সেথ এর স্ত্রী এবং বোন। ( এভাবেই প্রাচীন পুরাণগুলি বিচিত্র এবং রোমাঞ্চকর ...)

যা হোক। কেবলমাত্র এক দিনের জন্য দেবতা ওসিরিস-এর পুনুরুত্থান ঘটেছিল। এবং ওই দিনেই নেপথিস আর ওসিরিস-এর মিলন হয়। এবং আনুবিস এর জন্ম হয়। কেননা বলা হয়েছে- আনুবিস-এর বাবা ওসিরিস এবং মা দেবী নেপথিস ...

যা হোক। আনুবিস তার বাবা ওসিরিস মৃতদেহটি মমি করে রাখে ... 

আর এভাবে প্রাচীন মিশরে ঘটে যায় এক যুগান্তকারী ঘটনা । 
কেননা, প্রাচীন মিশরে এটিই প্রথম মমি। এরপর প্রাচীন মিশরে এই বিশ্বাস ছড়িয়ে যায় যে চিরন্তন পরকালের জন্য একটি ভৌত শরীর অনিবার্য । যেহেতু ভৌত শরীর বাদে আত্মার থিতু হবার আর কোনও স্থান নেই। ভৌত শরীরের অভাবে আত্মা চিরদিনের জন্য স্থানচ্যূত হয়ে যাবে। এ কারণেই মৃতদেহটি যত দিন সম্ভব টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন। এই টিকিয়ে রাখার পদ্ধতিই -‘মমি’। 

আনুবিস-এর নামে এই অভিনব পরকালবাদী ধারণাটি প্রচলিত বলেই আনুবিস কে মনে করা হয় মৃত্যু, সমাধিসৌধ (পিরামিড) ও মমির দেবতা। শুধু তাই নয় .... মৃতের দেশে মৃতকে প্রবেশাধিকার দেয় আনুবিস । এ কারণেই শেষকৃত্যানুষ্ঠানে আনুবিসের উদ্দ্যেশে প্রার্থনা করা হয় ...

প্রাচীন মিশরে সমাধিসৌধে যে সব পুরোহিত ধর্মীয় কৃত্য পরিচালনা করত তারা আনুবিসের স্মরণে শেয়াল-এর মুখোশ পড়ত। 

প্রাচীন মিশরের ধর্মবিশ্বাস ছিল আনুবিসকে ঘিরে। প্রাচীন মিশরে এমন ধারণা প্রচলিত ছিল যে ... কারও মৃত্যু হলে মৃত ব্যক্তি মৃতের দেশে প্রবেশ করে। সেই মৃতের দেশকে বলা হত এবং সেই অথই শূন্যতাময় অন্ধকার দেশটি ছিল অত্যন্ত বিপদজনক স্থান। আনুবিস আত্মাকে স্বাগত জানাত এবং আত্মার যাত্রাপথে সুরক্ষা নিশ্চিত করত। এ কারণেই শেষকৃত্যানুষ্ঠানে আনুবিসের উদ্দ্যেশে প্রার্থনা করা হয় ... মৃতের দেশে আনুবিস-এর ভূমিকা সম্বন্ধে জনৈক মিশরবিদ লিখেছেন, .... The final place in the Underworld was the Judgement Hall where the Court of Osiris decided on their fate. Anubis, the God of the Dead would lead the dead in the Underworld at the Hall of Two Truths to a set of scales where his or her heart was weighed against the feather of truth and their fate would be decided - either entrance into the perfect afterlife or to be sent to the Devourer of the Dead.

... এতে বোঝা যায় দেবতা আনুবিস-এর উপকথা কী ভাবে পরবর্তীকালের সেমিটিক ধর্মসমূহে প্রভাবিত করেছে। খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে হিব্রুভাষীরা প্রাচীন মিশরে ছিল। তারা আনুবিসের উপকথায় প্রভাবিত হয়ে থাকবে ... 

 মিশরীয় জনগনের বিশ্বাস ছিল হেলিয়াপোলিসে ছিল দেবতার বাস। কেবলমাত্র ফ্যারাও ও পুরোহিত আনুবিস এর প্রার্থনাগৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারত। তবে প্রার্থনাগৃহে প্রবেশের আগে তাদের পাথরের গভীর জলাশয়ে প্রক্ষালন করে শুদ্ধ হয়ে নিতে হত। (জলের সঙ্গে শুদ্ধতার সম্পর্ক অনেক প্রাচীন ... এসব কারণে পরবর্তীকালে সেমিটিক ধর্মসমূহে মিশরের গুরুত্ব অনেক ...)

আনুবিস এর প্রার্থনাগৃহের অভ্যন্তরভাগে সাধারণ জনগনের প্রবেশ নিষেধ ছিল। তারা কেবল উপহার নিয়ে প্রার্থনাগৃহের মূল ফটক অবধি আসতে পারত। পুরোহিত উপহার গ্রহন করত। 

আনুবিস এর অন্য নাম আনপু এবং ইনেপু। স্ত্রীর নাম আনপুট। এদের কন্যার নাম কাবেচেট। 
এই গা ছমছমে অন্ধকার রহস্যময়তার জন্য প্রাচীন মিশরের মৃত্যুর দেবতা আনুবিসকে নিয়ে আজও কৌতূহলের শেষ নেই ...

মূল তথ্যসূত্র :--

Egyptian Book of the Dead, by Sir E. A. Wallis Budge in 1988.

চিত্র :-- Internet থেকে নেওয়া।

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments