জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -১০৫

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -১০৫


সম্পাদকীয়,
যেই আমি তোমাদের বলব, এক রাজা আর এক রাণী ছিল। অমনি তোমরা বলবে, জানি জানি। না গো না, তোমরা জানো না। কারণ সেই রাজা বা সেই রাণী কোনো রূপকথার গল্পের চরিত্র নয়। সেই রাণী সত্যি সত্যি কলকাতার জানবাজারের রাণী রাসমণি গো। তাঁর জানবাজারের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়, তাঁর প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে কালীপুজো হয়। করুণাময়ী রাণী রাসমণির কথা বলেছে শ্রেয়সী দিদি। শুধু কি রাণী, কৃষ্ণনগরের রাজার কথাও বলেছে গো। রাজা রাণীর গল্প কিন্তু এতেই শেষ নয়। বর্ধমানের রাজার বাড়ি, রাজার সাধের গোলাপের বাগান, তার গল্প বলেছেন তোমাদের জয়ন্তী আন্টি। রাজকুমার? না না রাজকুমার নেই তবে পুষ্পকুমার আর রাগকুমার আছে বইকি। তারা কারা? সেটা জানতে পড়তে হবে শরণ্যা আন্টির গল্পটি। কি বিশ্বাস হল কিনা, গল্পেরও যেমন রাজা রাণী থাকে, বাস্তবেও একসময় ছিল বইকি। এই যেমন গল্পের গরু গাছে ওঠে বলে আমরা জানি, এদিকে মলয় জেঠু বলে কিনা বাস্তবের মাছ সিঁড়ি বেয়ে ওঠে! বোঝো কান্ড! মাছের কথায় মনে পড়ে গেল, অয়ন আঙ্কেল আবার ছড়া লিখতে গিয়ে মাছ ভেবে গাছ খেয়ে ফেলেছেন। আমি তো হেসেই মরি।  হাসতে হাসতে শুনি আমার হাসি কে যেন ভ্যাঙাচ্ছে। ভূতে নাকি! হতেই পারে। অসীম আঙ্কেলের লেখা পড়ে মনে পড়ল কাল কালী পুজো।  আজ ভূত পুজো।  তাই মৃণাল আঙ্কেল 'দীপ' জ্বেলেছে প্রচ্ছদে। উৎসব শুরু হয়েছিল শরতে। কবে যে কার্তিক হাত ধরে হেমন্তকে নিয়ে এল বোঝাই গেল না। পীযূষ আঙ্কেলের পূজা এল পূজা গেলো ছড়া পড়ে সব মনে পড়ে গেল। সন্দীপন আঙ্কেলও শরতের ছড়া লিখে আমাদের মন ভাল করে দিল। সবই বুঝলাম, কিন্তু কে যে খ্যাক খ্যাক করে হাসছিল তা তো বুঝলাম না। যদিও আমিও তোমাদের মতো ভূত টুতে বিশ্বাস করি না। এলিয়েনে হাসলো নাতো?  সহেলী আন্টির গল্পের এলিয়েনগুলো  নেমেছে হয়তো। না না, রূপম আঙ্কেলের গল্পের ছোটো বাচ্চাটাই হবে তাহলে। তবে চিন্তার কিছু নেই, দীপাবলিতে সব অজানা অন্ধকার দূর করে আলোর উৎসবে মেতে উঠি আমরা। তাইতো তপশ্রী আন্টির উপন্যাসে নিউটনরা বিশাখার খোঁজ পেল। সায়নী, শুভশ্রী, অন্বেষা, শ্রেয়া, সৌনকশৌর্য, তোমাদের মতো ছোটোদের আঁকা নিয়ে ছড়া লিখেছেন, সবিতা পিসি। এই আলোর উৎসবে এসো আমরা ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালি। তোমাদের জ্বালানো প্রদীপের আলোয় আল্যকিত হবে পৃথিবী, আলোকিত হবে ছোটোবেলা।    -- মৌসুমী ঘোষ।


এক রানি ও এক রাজার গল্প

শ্রেয়সী মুখোপাধ্যায়
স্নাতক প্রথম বর্ষ 


রানি রাসমণির বয়স তখন মাত্র এগারো বছর যখন তাঁর বিয়ে হয়। বয়স অল্প হলেও অসম্ভব বুদ্ধিমতী এবং তেজস্বিনী 
ছিলেন তিনি। তাঁর স্বামী রাজচন্দ্রের কাছ থেকে সামান্য লেখাপড়াও শিখেছিলেন ঐ ছোট বয়সেই। রামচন্দ্রের দেহত্যাগের পর জমিদারী ও ভূসম্পত্তির সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ল রাসমনির ওপর। রাসমনি ছিলেন কোনা গ্রামের বাসিন্দা কৃষিজীবী হরেকৃষ্ণ দাসের রূপবতী কন্যা।অগুণতি দাস-দাসী রানির বাড়িতে, রাজবাড়ির
ঝি-চাকরদের মেজাজও রাজার মতো। রাজবাড়ির সব কর্মচারীরা ছিল রাসমনির একান্ত আপনজন, মায়ের মতোই তাঁদের অন্যায় আচরণ দেখে যেমন শাসন করেছেন, তেমনি পরমুহূর্তে তাদের স্নেহভরে কাছে টেনে নিয়েছেন। রাসমণি রাজচন্দ্রের দানশীলতা, সাহসের কথা সকলেরই জানা । এ-হেন রাজপরিবারের দাস-দাসীদের মানসিক অবস্থা রাজার মতো হলে তাতে আশ্চর্যের কী!
     এদের মধ্যে কৃষ্ণকান্ত ছিল রানির অত্যন্ত প্রিয়। উড়িষ্যার এক গ্রাম থেকে খুব ছোটো বয়সেই
রাজবাড়ির ভৃত্যের চাকরি পেয়েছিল সে। জাতিতে ওড়িয়া হলেও, তার কথা শুনে তা বোঝা মুশকিল,বাংলা ভাষা বেশ রপ্ত হয়ে গেছে তার। সুদর্শন, জামাকাপড়ের বেশ পারিপাট্য ছিল। রানিমার ব্যক্তিগত ও বিষয় সংক্রান্ত সমস্ত কার্যকলাপ কৃষ্ণকান্তই করত। ফলে ঝি মহলে তার প্রবেশাধিকার ছিল। ঝি চাকর সকলের সাথে কৃষ্ণকান্ত রসিকতা করত। রাসমনির নিজস্ব দাসী সৌদামিনী কৃষ্ণকান্তের সাথে বিবাহ করতে ইচ্ছুক, কৃষ্ণকান্ত নিজেও। কিন্তু রানিমায়ের মেজাজের কথা চিন্তা করে কেউই সাহস পেলনা, যদি চাকরি চলে যায়? এমন কি গর্দানও হতে পারে। তবে অবশেষ রানি মা জেনেই গেলেন। দুজনকেই ডেকে পাঠান। তীক্ষ্ণ স্বরে, সোজা প্রশ্ন: ''তোমরা দুজন বিয়ে করতে চাও?'' দুজনেই ভয়ে কাঠ, তবুও জবাব দিল -হ্যাঁ। ভয়ানক পরিণতির কথা ভেবেই সেই দুজন মাথা নীচু করে পাষাণের মতো দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ রানি মা বলেন "তোমাদের বিয়ের সমস্ত খরচ আমি দেব।" কৃষ্ণকান্ত এখনও ভয়ে ভীত। ভাবে, চাকরি চলে গেলো কিনা। তাই সাহসভরে জিজ্ঞাসা করে
"আমরা কোথায় থাকব মা?"
রাণী মা বললেন "কেন, যেখানে আছ সেখানেই। তোমাদের জন্য পৃথক ঘরের ব্যবস্থা করে দেব।" 
শতকোটি প্রনাম জানাতে থাকে দুজনে, তাদের রানিমাকে। 


২.
কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নাকি বিধবা বিবাহের বিপক্ষে ছিলেন! 
প্রবল প্রতাপশালী রাজা রাজবল্লভ সেনের একজন মেয়ে সন্তান ছিল, নাম অভয়া। সমাজের সকল রীতি মেনে বিয়ে হয় তাঁর আট বছর বয়সেই। কিন্তু কিছুদিন পরই সে বিধবা হয়ে যায় । বাল বিধবা অভয়ার তখন জীবন সম্বন্ধে সাধারণ ধারণা টুকুও নেই। এতোটুকু ছোট মেয়েকে সাদা থান পডরতে দেখতে পিতা রাজবল্লভ কিছুতেই মানতে পারছেন না।  ধনদৌলত মানসম্ভ্রম সব থাকলেও সুখের সন্ধান নেই কোথাও। সারাদিন তাঁর চিত্তে যেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। 
অভয়ার মায়ের ও মানসিক অবস্থা সমান। বারবার মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকেন আর কেঁদে ওঠেন। শেষে বলেন ওকে আবার বিয়ে দাও। অবশ্য রাজাও তাই চাইতেন, কিন্তু সমাজ? সমাজের বিধি? 
        এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আশ্রিত সভা-পণ্ডিতদের ডেকে পাঠান। জিজ্ঞাসা করেন, শাস্ত্র বিচার করে বলুন আমার আট বছরের বিধবা কন্যাকে পুনরায় বিয়ে দেওয়া সম্ভব কিনা। পণ্ডিতেরা শাস্ত্র  বিচার করে জানালেন এটা সম্ভব। কারণ পরাশর সংহিতায় পরাশর মুনি বলেছেন: 'নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে  চলে পতিতে পতৌ।/ পঞ্চস্তাপৎসু নারণাং পতিরন্যো বিধিয়তে।।' 
অর্থাৎ স্বামী অনুদ্দেশ হলে, মারা গেলে, ক্লীব স্থিরকৃত হলে, সংসার ধর্ম পরিত্যাগ করলে স্ত্রীরা আবার বিয়ে করতে পারবে। তবে বলে দিই  বিদ্যাসাগর-প্রবর্তিত বিধবা-বিবাহ আন্দোলনের পূর্বের ঘটনা এটি। পণ্ডিতদের কথা শুনে রাজবল্লভ  একটু স্বস্তি পেলেও সম্পূর্ণ সংশয়মুক্ত হতে পারলেন না। কারণ শাস্ত্রে বিধবা-বিবাহের প্রচলন থাকলেই হবে না, দেশ-বিদেশের পণ্ডিতদের পরামর্শ নিতে হবে। তৎক্ষণাৎ কাশি মিথিলা প্রভৃতি বহু জায়গায় দূত পাঠালেন সকলেই শাস্ত্রের পক্ষে মত দিলেন। কিন্তু আসল সমস্যা শুরু হলো যখন নবদ্বীপের পণ্ডিতদের কাছে রাজবল্লভের সভা পণ্ডিতেরা গেলেন। 

       তার আগে বলি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আসলে বিধবা বিবাহকে সম্মতি জানাতে চান না, তার কানে ওই খবর আসতেই ছিঃ ছিঃ করেন, বলেন এমনটা ঘটলে নাকি হিন্দুধর্ম রসাতলে যাবে। অন্যদিকে নবদ্বীপের সকল টোলের পণ্ডিতেরা শাস্ত্রসম্মত বিচার করে এতে সম্মতি দিয়েছেন। তাছাড়া এরকম একজন প্রতাপশালী শাসন-কর্তার সাথে বিরোধিতা করার কথা তিনি চিন্তাও করতে পারেন না। তবে তার কাছে উপায় একটা আছে, টোলের পণ্ডিতেরা সম্মতি জানালেও রাজ পণ্ডিতদের অসম্মতি জানাতে শিখিয়ে দেন। সবাইকে বলে রাখেন  কৃষ্ণচন্দ্র নিজে বারবার সভা পণ্ডিতদের সম্মতি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেও যেন তারা না শোনেন। তাই হলো, রাজ পণ্ডিতেরা  বলেন শাস্ত্র ছাড়াও দেশাচার বলে  কিছু আছে, সমাজে এতদিন ধরে যে আচার চলে আসছে তা কেউ লংঘন করতে পারবে না। ওদিকে রাজবল্লভের সভা পণ্ডিতেরা বলেন  কুসংস্কারের ওপরে হল শাস্ত্র বাক্য। 
কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র যেন নিরপেক্ষ হওয়ার ভান করলেন। এভাবেই কথোপকথন চলতে থাকাকালে অন্দরমহল থেকে পণ্ডিতদের জন্য আসে স্তুপীকৃত মণ্ডা মিঠাই, কিন্তু এটা কি মেষশাবক? পণ্ডিতদের জন্য মেষশাবক পাঠানো হয়েছিল। রাজবল্লভের সভা পণ্ডিতেরা আশ্চর্য হয়ে যান যদিও কৃষ্ণচন্দ্রের সভা পণ্ডিতেরা আগে থেকে জানতেন। কৃষ্ণচন্দ্রের এক  সভা পণ্ডিত বলেন, "এই মেষটি আপনারা বাড়িতে গিয়ে রান্না করে খাবেন।" রাজবল্লভের সভা পণ্ডিতেরা কিঞ্চিৎ রেগে গিয়েই বললেন, "একী অন্যায়! মহারাজ কি আমাদের উপহাস করছেন!" 
কৃষ্ণচন্দ্র বলেন তাঁর পণ্ডিতেরাই নাকি আপ্যায়নের জন্য এই  খাবারের বিধান দিয়েছেন।
এই শুনে তাঁরা বললেন, "ব্রাহ্মণ কি মাংস খায়?" প্রতিপক্ষ পণ্ডিতের জিজ্ঞাসা। এ পক্ষে পণ্ডিতের উত্তর, পুরাকালের মুনি ঋষিরা গোমাংস বা ভেড়ার মাংস খেতেন। এ কথা শাস্ত্রে লেখা আছে। প্রতিপক্ষের উত্তর শুধু শাস্ত্রে থাকলে হয় না, সমাজের বিধি নিষেধ লোকাচার বলে কিছু হয়, তা কেউ লংঘন করতে পারে না । 
হঠাৎই, মহারাজ হেসে উঠলেন। রাজবল্লভের পণ্ডিতদের আর কিছু বোঝানোর দরকার হলো না।



পুজোর ছবি 
সবিতা বিশ্বাস 

সামনে খোলা খাতার পাতা রঙ পেন্সিল ধরে  
ভাবছে খুকু পুজোর ছবি আঁকবে কেমন করে? 
ভাল্লাগে না খুকুমনির রাগ হয়ে যায় খুব 
জলপিঁপিটা বললো ডেকে দাওনা মনে ডুব 

কাশ-শিউলি অপরাজিতা সবাই বলে ডেকে 
ভাবছো কেন? নদীর ছবি দাওনা বাপু এঁকে 
শাপলা-শালুক পদ্মকলি আঁকতে যদি পারো 
নীল আকাশে মেঘের ভেলা সাজিয়ে দাও আরো 

এবার আঁকো মায়ের ছবি কাজল টানা চোখ 
পঞ্চমীতে বেলতলায় মায়ের বোধন হোক 
ঢাকির কাঁধে ঢাকটি আঁকো খোকার হাতে কাসি 
শুনতে পাবে আলোর বেণু বেজে উঠবে বাঁশি 

নদীর পারে দাও ছড়িয়ে চামর দোলা কাশ
জুড়নবিলে বসুক এসে দূর দেশের হাঁস 
বাজুক বাঁশি ইষ্টিশনে আসুক বাড়ির লোক 
অষ্টমীতে অঞ্জলিটা জমজমাটি হোক 

এবার দেখো রঙবাহারে পুজোর ছবির সাজ 
একচালার ঠাকুর ঘিরে শোলার কারুকাজ 
পুজোর ছবি আঁকার পরে ফুটল মুখে হাসি 
আদর করে খুকুসোনাকে রুকুনপুরের মাসি |



স্মৃতির সরণী বেয়ে
অসীম হালদার

১.
যদি কেউ প্রশ্ন করা হয় কারো জীবনে কোন্ ঘটনা স্মরণীয় বা এমন কোন্ বিষয়ের কথা আজও চোখে ভাসে, তাহলে কেউ বলবেন তাঁর ছেলেবেলার কথা, পিকনিকের মজার কথা, কোনো অনুষ্ঠান ঘিরে বিশেষ কোনো মুহূর্তের কথা, এসবই। কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনার মধ্যে এমন কোনো বিশেষ ঘটনা দাগ কেটে যায়, যার কাছে অন্যান্য সমস্ত ঘটনা নিমেষে চাপা পড়ে যায়। তেমনই একটি ঘটনা আজ শোনাব, যা চিরাচরিত সমস্ত বিশেষ ঘটনাকে ম্লান করে দেয়। স্মৃতিপটে গেঁথে থাকা তা কোনদিন ভোলার নয়। তবে তার সাথে কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথাও আছে, তা-ও আজ শোনাব বলে কলম ধরলাম। পাঠকের আসন থেকে বড়োরা যেমনই মন্তব্য করুন, তোমরা মানে "জ্বলদর্চি" পত্রিকার সব গুণমুগ্ধ পাঠকরা, পড়ার পর বলবে, এগুলো স্রেফ বুজরুকী ছাড়া আর কিছু নয়; অথবা চোখের ভুল। ভাবনা যে পথেই চলুক, সে আলোচনায় না ঢুকে আমি বরং কয়েক মুহূর্তের জন্য তোমাদেরকে আমার সাথে শিমুলতলা, দেওঘরে নিয়ে যাব। এখন তো কোভিডের একটু থিতু অবস্থা, প্রায় সবাই ভ্যাকসিনও নিয়ে নিয়েছো। তাহলে আর চিন্তা কি! অতএব "আর বিলম্ব নয়। এখনও আছে সময়।" হাতে হাত রেখে চলো যাই ঘুরে আসি শিমুলতলা, দেওঘর।  সাথে অবশ্য গিরিডিও, বিশেষত্ব সেখানেই।

অফিসের নীরস কাজে ডুবে থেকে যখন ক্লান্তি বাসা বাঁধছে, নীরস জমিতে চাষ করে মনের উৎপাদন শূন্য, তখন আমার অফিসার বস্, স্বরূপদা বললেন, "চলো অসীম, শিমুলতলা, দেওঘর ঘুরে আসি"। ভেবে দেখলাম, তখন আমার কাছে তো প্রায় সব জায়গাই নতুন, সুতরাং গেলেই হয়। আর স্যারের সাথে যাওয়া মানে অফিসের কাজের চাপও থাকছে না। অতএব বাড়িতে প্রাথমিক আলোচনা পর্ব মিটিয়ে দিনক্ষণ ঠিক করে টিকিট কাটলাম।

যাত্রা শুরু করলাম ১লা নভেম্বর, ২০০৫, আজ থেকে সতেরো বছর আগে। আমি, গিন্নী, মানু (বড় মেয়ে), মা আর স্বরূপদা ... পাঁচজনে মিলে পাড়ি দিলাম অজানা অচেনা শিমুলতলার উদ্দেশ্যে। কোথায় থাকবো, খাওয়া দাওয়া কোথায় করা হবে, এসব নিয়ে খুব বেশী পরিকল্পনা না করেই পাড়ি দিলাম। স্লিপার কোচে রিজার্ভেশন করা। জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি দু পাশে বিভিন্ন গাছের পর গাছ, বিস্তৃত আবাদের জমি সবকিছুকে টপকে আমরা চলছি, সব কেমন সবুজের চাদরে মোড়া। ট্রেনে জানলার ধারে সীট পেলে সময় কখন কেটে যায়, টের পাওয়া যায় না। বছরশেষে মনোরম আবহাওয়া উপভোগ করতে করতে আমরা গল্পগুজবে মজে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে ট্রেন যখন বিহারে ঢুকলো, আমাদের মোবাইল নেটওয়ার্ক জানিয়ে দিলো যে আমরা আমাদের রাজ্য পেরিয়ে গেছি। এর পরে একটি স্টেশনে ট্রেন থামতে হুড়মুড় করে একদল মানুষ ঠেলেঠুলে আমাদের কোচে ঢুকে পড়লো। তাঁদের কাঁধে, মাথায়, বগলে করে পোঁটলা পুঁটলি। গায়ের কাপড় বেশ অপরিষ্কার, তার ওপর মাথায় কি তেল মেখেছে তারা, কে জানে! স্লিপার কোচের রিজার্ভেশন বগিতে এরা উঠলোই বা কি করে, মাথায় এল না। একে একে তারা আমাদের সীটের মাঝে ঢুকে এমন কাণ্ড করলো যে গোটা কম্পার্টমেন্ট তখন লেবু লেবু তেলের উগ্র গন্ধে ভরে গেল। রীতিমতো শ্বাস  প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো। স্বরূপদা বলেই ফেললেন, এবার তো দম বন্ধ হয়ে সবাই মারা পড়বো। একটু খেদিয়ে টেদিয়ে তো দূরে সরে দাঁড়ালাম। কিন্তু কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না। অগত্যা চেকার ডাকলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই চেকারের সাথে পুলিশ লাঠি নিয়ে এসে তাদের একপ্রকার গরু ছাগলের মতো করে বের করলো গোটা কম্পার্টমেন্ট থেকে। দেখতে খারাপই লাগছিল। কিন্তু কি করবো! ওভাবে থাকা যায় না কি! স্বরূপদার কাছ থেকে জানলাম, ওখানকার এলাকাতে প্রচুর শ্রমিক, বিশেষ করে মহিলা শ্রমিক শিল্প কলকারখানায় কাজ করে। খুবই অল্প মাইনের বিনিময়ে প্রচুর পরিশ্রম করে তারা সংসার চালায়। এটা ওদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রারই মতোন। সাধারণ কামরা ছেড়ে একটু আরামে সফর করার জন্য উঠে পড়েছিল স্লিপার কোচে। কিন্তু আমরা তো তেমন জীবনযাত্রার সাথে পরিচিত নই। তাই একটু অমানবিক বোধে পরে সেসব ভেবে একটু কষ্টও হলো। কি জীবন সংগ্রাম মানুষের! আমরা যাচ্ছি যখন প্রকৃতির সৌন্দর্য্য দেখতে, আর এরা পেটের জন্য বেরিয়েছে কারখানায়। একটু বাদে আমাদের গন্তব্যস্থল, শিমুলতলা স্টেশনে পৌঁছালাম।
পৌঁছে মনে হলো, এ কোথায় এসে পড়লাম রে বাবা! বাড়ি ঘর যা-ই দেখি, কেমন ঝুপড়ির মতো, লাল সুড়কির মতো রাস্তার আশেপাশে যাঁদের দেখছি তাঁরা স্যাণ্ডো গেঞ্জি লুঙ্গি গায়ে কেউ আড়ম্বরহীন মুদির দোকানে, কেউ জিলিপি ভাজায় ব্যস্ত। গ্রাম্য পরিবেশ, কিন্তু এত ফাঁকা ফাঁকা লাগছে! রাস্তার দুধারে অনেক গাছপালা। দু চারখানা ঘরবাড়ি যা নজরে এলো, বহু পুরনো। তার মধ্যে কিছু বাড়ির ফলকে বাঙালি নাম। চলে তো এলাম, কিন্তু থাকবো কোথায়! কোথায় পরিবার নিয়ে উঠবো, মাথায় আসছে না। ঘোরার কথা তখন ভুলতে বসেছি। একজনকে জিগ্যেস করে আমরা একটা সাইকেল ভ্যানকে দাঁড়া করিয়ে রওনা দিলাম একটি পুরনো গেস্ট হাউসের সন্ধানে। এখানে যাঁরা আসেন, তাঁদের বেশীর ভাগ নাকি সেখানেই ওঠেন। বেশ, তবে সেখানেই যাওয়া যাক। যেতে যেতে রাস্তার দুধারে খান কতক ছোট ছোট বাড়ি দেখলাম। লোকজন খুবই কম। তবে গাছপালা বেশ অনেকই। কোথাও ঘন ঝোপঝাড় এত উঁচু যে তাদের ফাঁক ফোকড় দিয়ে ইঞ্জিনের ঘড় ঘড় শব্দে মনে হলো, খুব বেশী দূরে নয় রেল লাইন, এবং সেটি পীচের রাস্তার সমান্তরালেই চলেছে আমাদের সাথে। অদ্ভুতভাবে চারিদিকে কেমন নিস্তব্ধতা, নির্জনতা, যা কিনা আমি আমাদের গ্রামের বাড়ি শিবগঞ্জেও দেখি নি। মানুষের কোলাহল, যানবাহনের ব্যস্ততা, কোত্থাও কিচ্ছুটি নেই। একরাশ নির্জনতার মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র ভ্যানের প্যাডেলের শব্দ। শিমুলতলা জায়গাটার সাথে আমার এই প্রথম পরিচয় ছিল নিতান্তই সাদামাটা। কারণ উল্লেখ করার মতো তখন কিছুই তো নজরে আসে নি। অথচ কি তার আকর্ষণক্ষমতা! 

২ 
অল্প সময়ের মধ্যেই ভ্যানটি এসে থামলো যেখানে, নেমেই বাঁদিকে দেখি বিশাল এলাকা জুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু পুরনো বাড়ি ঘর। ডানদিকে একটি বাড়ি দোতলা, আর প্রায় সবগুলোই একতলা। একেবারে সোজা একতলা ঘরটির মাঝে ওপরের দিকে লেখা "আম্রপালী"। বাড়িগুলো বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আর তাদের মাঝে মাঝে রয়েছে বেশ কিছু গাছপালা। বুঝলাম, পাকা অট্টালিকা যতোই থাকুক, গাছপালাকে এখানের মানুষ নিজেদের সঙ্গী হিসাবেই মানেন। মানুষে প্রকৃতিতে এই বন্ধন, তা কল্পনা করে মনে মনে খুব খুশী হলাম, তবে বিস্মিত হলাম তার চাইতেও বেশি। এবার বাক্স প্যাঁটরা রেখে খানিক বিশ্রাম দরকার। প্রাথমিক কথাবার্তা সেরে তিনটে তোরণবিশিষ্ট ঘরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আমাদেরকে ওখানের কেয়ারটেকার, বালুদা নিয়ে গেল ঘর দেখাতে। পুরনো দরজা জানালা, মেঝে। ঘর খুলতে ভেতরে ঢুকে দুটো চৌকি, একটি চেয়ার আর একটি ড্রেসিং টেবিল ছাড়া আর কিছুই নজরে এলো না। তোষক বালিশ দেখে তো গিন্নীর মুখ ভার। একটু পরিষ্কার দেখে বালিশ আর বেড কভার পাল্টে নিয়ে আমরা কুয়ো থেকে আনা জলে সবাই স্নান সারলাম। এখন বেশ আরাম লাগছে। কিন্তু পেটে তো ছুঁচো ডন দিচ্ছে। উঠোনের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে দু পা দূরে রান্নাঘরের পাশে দেশী ডাইনিং রুমে আমরা বসলাম খাবার টেবিলে। কিছু মাছিও ছিল অবশ্য। যাইহোক, আলু ভাজা, ডাল আর ডিমের ঝোল দিয়ে দুপুরের আহার পর্ব শেষ হতে তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম। ভোজনপর্ব শেষ হতে না হতেই একটি গাড়ি এসে থামলো প্রধান দরজার সামনে। একজন ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির সুঠাম দেহের ভদ্রলোকের সাথে এক যুবতী আর দুই বন্ধু। পরিচয় হলো, জানলাম ওঁরা কোলকাতা থেকে অবসরে এসেছেন সময় কাটাতে। যদিও কথার মধ্যে বাউল বাউল ভাবের কথার আদান প্রদানে লোকদেখানো কিছু সস্তা কথাবার্তাই দেখলাম। তাই তার মধ্যে গভীরতা খুঁজতে না গিয়ে আমরা একটু বিশ্রামের জন্য ঘরে ঢুকে পড়লাম। স্বরূপদা দোনামনা করতে গিয়ে তাঁদের আবদারে চলে গেলেন অল্প দূরের 'হলদী ঝর্ণা' দেখার জন্য। মজার ব্যাপার, যাওয়া আসার স্পন্সরশীপ স্বরূপদাকেই নিতে হয়েছিল, যা তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে থাকলেও তাঁদেরকে বলার সুযোগ হলো না।

যাক সে কথা, বিকেলের দিকে এবার আমরা লাট্টু পাহাড়ের পথে। মাত্র ১০০০ ফুট না কি উচ্চতা! আমি তো গড় গড় করে তার শিখরে উঠে পড়লাম। বাকিরা কিছুটা এসে আর এলো না। এর শিখর থেকে চারিদিকে তাকালে যতদূর চোখ যায়, শুধু গাছ আর গাছ। একটু ভাল করে তাকিয়ে দেখি সেই রাজপ্রাসাদটি। ওখান থেকে চলে গেলাম সেই রাজপ্রাসাদ দেখতে। ক্লান্তি কোথায় চলে গেছে, টের পাই নি। নির্জনতার মধ্যে এমন গভীর টান আগে কোনদিন অনুভব করি নি। রাজপ্রাসাদের সামনে পৌঁছে মনে হতে লাগলো, কয়েকশো বছর আগে এখানে ছিল রাজা, রাণী, দাস, দাসী, নর্তকী বাঈজিদের আনাগোনা। খাজনা দিতে ব্যর্থ চাষা মজুরদের পিঠে চাবুক মারার ব্যাথায় তাদের কাতর প্রাণভিক্ষা, হয়তো বা সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার মতো হল্লা রাজার রাজ্য আক্রমণের উদ্দেশ্যে নির্লজ্জতার ক্ষমতা প্রদর্শন। মান্না দে-র সেই বিখ্যাত গানটির মতো, মুকুট কোথায় তো জানা নেই। কিন্তু রাজাই তো সেথা নেই। নিশুতি রাতের হাসি কান্না চিৎকারের প্রতিধ্বনি বোধহয় আজ এই রাজপ্রাসাদের আঁধারে বাচ্চা ভোলানো গল্পকথার মতো এখানের মানুষের মুখে মুখে আজও ফেরে। লাল সুড়কির মাটির ওপর দাঁড়িয়ে সেই রাজপ্রাসাদের সাথী বেড়ে ওঠা কিছু জংলা গাছ আর একাকীত্ব। তাকে ঘিরে চারিদিকে শুধু ধূ ধূ করছে ফাঁকা মাঠ আর ছড়ানো ছিটোনো এদিক সেদিক গাছপালা। রাজাদের অহঙ্কার এবং অলঙ্কার আজ ধুলোর সাথে মিশে হাওয়ার তীব্র বেগে এদিকে সেদিকে ধেয়ে চলেছে। বুঝলাম, রাজতন্ত্র খুব বেশিদিন মানুষ সহ্য করে না, চাপিয়ে দেওয়া নীতির তুঘলকী রাজত্বের ধ্বংস এভাবেই হয়। জংলাগাছও তাকে ফেলে উঁচুতে মাথা তুলে দাঁড়ায়। ফাটিয়ে দেয় মোটা মোটা দেওয়াল, সাধের দেওয়ালে লেখা থাকে কেবল বেড়াতে আসা কিছু সস্তা প্রেমিক প্রেমিকার আলগা প্রতিশ্রুতি। সেসব প্রেমের চিহ্ন খেয়াল করার নয়, মনে রাখা তো দূরের কথা।

ভাবের ঘোর কাটলো মানুর ডাকে। সন্ধ্যে গড়িয়ে আসছে। 'আম্রপালী'তে ফিরতে হবে। আসার সময় গিন্নী বলছিল, "জানো আজ কালীপুজো!" আরে! এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার! এ তো মনেই ছিল না। গেটের ভেতর ঢুকতেই দেখি গেরুয়া সাজে বাউল শিল্পীরা উপস্থিত। সাথে তাঁদের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। 'বালু'দার কাছ থেকে জানলাম আজ এখানে কালীপুজো হবে। সারা রাত ধরে বাউল গান হবে। এ তো মেঘ না চাইতেই জল! মনটা আনন্দে ভরে গেল। বাঁদিকের তোরণদ্বারের মধ্য দিয়ে শ্যামা মা আমাদের দিকে চেয়ে। পাশে বসে বাউলশিল্পীরা। আমাদের ঘরে ঢোকার সময় লাইটের সুইচ দেখিয়ে দিল বালুদা। টিম টিম বিদ্যুতের আলো; তার ওপর ঘুটঘুটে অন্ধকার গোটা এলাকা জুড়ে। সামনের রাস্তা দিয়ে কে চলে যাচ্ছে, বোঝার উপায় নেই। অন্ধকার যে এত জমকালো হতে পারে, কোনদিন বুঝি নি। এখানে এসে কোলকাতার সাথে মেলালে চলবে না। আজকের দিনে কোলকাতার অলিতে গলিতে যেখানে আলোর রোশনাই, শব্দযন্ত্রের আসুরিক লাম্পট্যে প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রদর্শনের অসম প্রতিযোগিতা, সেখানে শিমুলতলা কিভাবে তার সাথে সখ্যতা করবে! বরং অচেনা আঁধারের সাথে আমরা একটু বেমানান হলেও কিছু সময়ের জন্য একাত্ম হওয়ার চেষ্ট‍া করা যাক। সেই ইচ্ছেতে একটু চা খেয়ে সবাই পুজো দেখতে চলে গেলাম। শুরু হলো বাউল গান। সে রাতে তখন শিল্পীরা গাইছেন, কেউ হারমোনিয়াম, তবলা, বেহালায় সুর তুলছেন। সুরের মুর্ছনায় তখন মাতোয়ারা সবাই। আহা! সে কি পাগল করা গান আর পুজোর মুহূর্ত! আজও চোখ বন্ধ করলে যেন দেখতে পাই। বিভোর হয়ে আছি তখন 'আম্রপালী'র ঘন আঁধারী রূপশোভায়।

সামান্য ভুঁরিভোজনশেষে বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দেবার সময় আমাদের মনে হলো, এমনভাবে রাত কাটানো এই প্রথম। দরজা বন্ধ করার পর মনে হলো, কোথাও শেয়াল ডাকছে। একটু তন্দ্রাছন্ন থাকার মধ্যে ঘুম চটকে গেল ইঞ্জিনের চলে যাওয়ার শব্দে। গিন্নীও যে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে, এমনটা নয়। এবার তাই কালকের পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমের দেশে চলে গেলাম, কে জানে। ঘুম ভাঙ্গলো একটা অস্বস্তির মধ্যে, পরে বুঝলাম ছারপোকা অবতারে গত রাতে যারা এসেছিল, তারা আমাদের সুখনিদ্রা ব্যাঘাত করতে সফল হয়েছে। অগত্যা আর দেখাদেখি নেই, এবার দেওঘরের অভিমুখে যাত্রা শুরু করা যাক। প্রায় কাকভোরে যখন উঠলাম  তখন রাস্তার দিকে চেয়ে দেখলাম, কোত্থাও কিছু দেখা যায় না, এখনও কালো রঙে মাখামাখি গোটা এলাকা জুড়ে। সেবারের মতো শিমুলতলা বেরানো সারা গেল এবং তারপর সবাই রওনা দিলাম শিমুলতলা স্টেশনের দিকে দেওঘরের উদ্দেশ্যে। পিছনে ফেলে এলাম ঘন আঁধারের নিস্তব্ধতা। সূর্যের লাল আভা গায়ে মেখে আমরা ট্রেনে উঠে চলে গেলাম জসিডি।

যে ঘটনার কথা তোমাদের পাড়বো বলে কলম ধরলাম, এক ধাক্কায় আমাকে সেখান থেকে নিয়ে গেল শিমুলতলার সেই পরিত্যক্ত রাজবাড়ি আর শ্যামা মায়ের কাছে সেই তবলাবাদক বাউল শিল্পীদের অপূর্ব সঙ্গীত। তবে এসব ঘটনার সাথে সতেরো বছর পর কিভাবে আবার সংযোগ ফিরে পেলাম তা আমার কাছে আবেগের। কিন্তু না, এখন সে কথা বললে আমি আবার নিজেকে কোথায় হারিয়ে ফেলবো বলতে পারবো না। তার চাইতেও সন্দেহ, ক্ষুদে পাঠকরা বিরক্ত হতে পারো। তাই সে কথায় নিজেকে না ভাসিয়ে আমি এবার সত্যি নিয়ে যাচ্ছি 'হোটেল জ্যোতি'তে, যেখান থেকে আমাদের দেওঘর ভ্রমণ শুরু হয়েছিল আর সেখানেই ঘটেছিল সেই বিস্ময়কর ঘটনাটি। 

জীবনে প্রথম কোনরকম পরিকল্পনা বা হোটেল বুকিং না করেই আমাদের এই সফর আজো মনে নাড়া দেয়। জসিডি থেকে আমরা যখন দেওঘর শহরের মধ্যে ঢুকলাম, বাক্স প্যাঁটরা নামানোর পর হোটেল খোঁজা শুরু। দেখেশুনে আমরা 'হোটেল জ্যোতি'কে বেছে নিলাম। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া সারলাম। আশেপাশে অনেক রেস্তোঁরা। খেতে বসে স্যালাডের প্লেটে পিঁয়াজের বদলে যখন মুলোর কুচি পড়লো, স্বরূপদা একটু মজাও করলেন তা নিয়ে। আমি তো খেয়ালই করি নি।

খাওয়া দাওয়ার পর হোটেলে এসে খানিক গল্পগুজব করে বিকেলবেলা রিক্সা করে চলে গেলাম নন্দন পাহাড়। চমৎকার একটি পার্ক। পাহাড়ী ঢালের সাথে সবার জন্য বিনোদনের সুন্দর ব্যবস্থা। বেশ চমৎকার উপভোগ করলাম। মানু তো হেব্বি খুশি! চোখের খিদেতে একটু স্বাদ নিলাম পার্কের খাবারের। শুধুমাত্র সঞ্চয় যদি জীবনের লক্ষ্য হয়, তাহলে তা নিঃসন্দেহে ব্যাধীর কারণ। আমি তাতে বিশ্বাসী নই। পরিবারের সাথে আনন্দ একটি বিশেষ মাত্রা পায়। বিশেষ করে মহিলারা; তাঁরা সারাজীবন ধরে রান্নাঘর আর ছেলেমেয়েদের মানুষ করতেই সময় কাটিয়ে দেন। সুতরাং তাঁদের জন্য সামান্য আবহাওয়া পরিবর্তন করা নিতান্ত প্রয়োজন। খানিক স্বস্তি এবং টুকরো আনন্দের স্মৃতি মানুষকে অনেক সজীব করে তোলে, প্রাণবন্ত করে। আর কোলাহলপূর্ণ এলাকা ছেড়ে এই যে অন্যত্র বেরিয়ে পড়া এবং এত সুন্দর প্রকৃতির কোলে পাহাড়ী সৌন্দর্য্য উপভোগ করা, তা সত্যিই মনে রাখার মতো। সেদিন স্বরূপদার প্রস্তাবমতো বেরানোর সিদ্ধান্তটা হঠাৎ নিয়েছিলাম ঠিকই, তবে এখানে এসে নওলাক্ষা মন্দির, ত্রিকূট পাহাড়, অনুকূলচন্দ্রের আশ্রম, বৈদ্যনাথ মন্দির ... এইসব দর্শন করার পর মনে হতে লাগলো, না এলে সত্যিই মিস্ করতাম প্রকৃতির এই নিবিড় সৌন্দর্য্য!


৩ 
স্বরূপদার কাছ থেকে পরেশনাথ পাহাড়ের কথা শুনেছিলাম। একটু জিজ্ঞাসাবাদ করে জানলাম সেখানে যেতে গেলে গিরিডি হয়ে যেতে হয়। পাহাড়ের কথা শুনতেই মনটা কেমন আকুপাকু করতে লাগলো। যুবক শরীরে তখন একটা রোমাঞ্চ লাগছে পরেশনাথ পাহাড়ের কথা শুনে। ভাবলাম, এতটা যখন চলেই এসেছি, সে জায়গাটাও না হয় একটু ঘুরে আসি না, ক্ষতি কি! যেই ভাবনা, সেই কাজ। তাই পরের দিন চলে গেলাম গিরিডির উদ্দেশ্যে। স্বরূপদা আর মা রয়ে গেলো তাঁদের হোটেলে। স্বরূপদাকে বলে এলাম খেতে যাবার সময় মাকে ডেকে নিতে। মা-ও একটু ক্লান্ত, বয়স হয়েছে, অনেকটা ঘোরাঘুরি করা হয়ে গেছে। সে হোটেলেই থেকে গেল বিশ্রামের জন্য। 

এই গিরিডির কথাই পড়েছিলাম সেই কবে ভূগোল বইএ; আজ সেখানে যাচ্ছি, ভাবতেই কেমন মনটা করে উঠলো। ট্রেন ছাড়তেই একটা আলাদা অনুভূতি। সেইসাথে এই পাহাড় আমার জীবনে হয়ে উঠলো বিশেষ স্মৃতিমাখা স্বপ্নের মতো অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী, যা আজও নিজের কাছে বিস্ময়কর লাগে। আজ তা বলার দিন এসেছে তোমাদের মাঝে। 
স্টেশনে পৌঁছে একটা অটো বুক করলাম। পিচের রাস্তা ধরে অটো এগিয়ে চলছে দু ধারের গাছপালা ছাড়িয়ে। দুপুর পেরিয়ে সূর্য পশ্চিমে হেলার দিকে। রূপোলী আভায় আমাদের মুখ উজ্জ্বল। ঠাণ্ডার শুরুতে বেশ আরামদায়ক আবহাওয়া। তবু কোন কেরামতি নয়, একটা মাফলার জড়িয়ে নিলাম। বাড়িঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দূর থেকে দিগন্তে পরেশনাথের আবছা রেখা চোখে পড়লো। বুঝলাম, আমরা কাছাকাছি চলে এসেছি। পৌঁছে গেলাম পরেশনাথের কোলে। পাহাড়ে ওঠার জন্য তার বুকের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে বাঁধানো পথ চলে গেছে একেবারে তার শিখরে। তার সারা শরীর জুড়ে শুধু বড়ো বড়ো গাছ, আর তার নীঁচে ঝোপঝাড় গুল্মজাতীয়। দূর থেকে দেখলে মনে হবে এক নিরাবরণ লোমশদেহী ঋষি গভীর ধ্যানে মগ্ন। বাঁধানো রাস্তা ছাড়াও আর একটা পথ নজরে এলো বটে পাহাড়ের কোন কোন স্থানে ... যেখানে চলাচলের জন্য সরু রেখা তৈরী হয়েছে, কিন্তু তা বেশ খাড়াই এবং দুর্গম। কারণ ও পথে কোন মানুষের চলাচল একেবারেই অসম্ভব। যদিও ট্রেকিং যাঁরা করেন, তাঁদের জন্যই হতে পারে। যাইহোক, মানু তো বাঁধানো রাস্তা দেখে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গী করে উঠতে লাগলো ওপরের দিকে। গিন্নী আর আমিও পিছনে পিছনে চলেছি। খুব বেশী মানুষজন চোখে পড়লো না আমাদের যাত্রাপথে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা ছবি তুললাম। একটা সুন্দর স্থানে দাঁড়িয়ে গাছপালার ভেতর দিয়ে এবার বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি ঘরবাড়িগুলো কত ছোট ছোট লাগছে। গাছপালা, রাস্তা ছাড়া মানুষদের লিলিপুটের মতো লাগছে। এতটা ওপরে উঠে এসেছি ভাবতেই কেমন পর্বত আরোহণকারীদের মতো মনে হলো, ভাবলাম, পাহাড়ে ওঠা এ আবার কি কঠিন কাজ! কিন্তু না, টের পেলাম দমে কুলোচ্ছে না, তাই আর বেশি কেরামতি দেখানো চলবে না। ততক্ষণে গরম পোশাকের মধ্যে ঘামের নিঃশব্দ ধারা বইছে। সবাই ওসব ছেড়েছুড়ে একটু হাল্কা হয়ে নিলাম।

বুক ভরে অক্সিজেন নিলাম আর প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে তখন আমরা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছি। হঠাৎ সেই দৃশ্য নজরে এলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। পাহাড়ের শিখর বা বা তার কোন উঁচু অংশ থেকে একজন তিড়িক তিড়িক করে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে সম্ভবতঃ ঐ দুর্গম সরু রাস্তা দিয়ে নীঁচের দিকে দ্রুতগতিতে নেমেই আমাদের চোখের সামনে দিয়ে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলো! পরনে তাঁর একটুকরো সাদা পোষাক শুধুমাত্র লজ্জা নিবারণের জন্য, হাতে একটি লাঠি, ধবধবে সাদা উলঙ্গ দেহ, রোগা পাতলা গরন ... ব্যস্ আর কিছুই মনে নেই। কেমন দেখতে, বয়স কতো, কিচ্ছু দেখতে পেলাম না, পায়েও তো কিছু পরে ছিলেন না! পুরো ঘটনাটাই কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ঘটে গেলো আর এতটাই আকস্মিকভাবে ঘটলো যে আমরা দুজনে একে অপরের দিকে চেয়ে রইলাম কয়েক মুহূর্ত বোবার মতো। সে কি মানুষ, না কি কোন মহাশক্তিধর যোগীপুরুষ, কে সে! কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে তো এমন কাজ সম্ভব নয়। আর যদি জাদুবিদ্যাই হয়, তাহলে এমন জাদুর মানে কি! কি লাভ সে জাদু দেখিয়ে যেখানে শুধুমাত্র আমরাই দর্শক! না কি আমরা ভূত দেখলাম! এইসব ভাবনার অথৈ সাগর থেকে বেরোতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো আমাদের। মানুর কথায় তখন একটু ধাতস্থ হয়ে দেখছি একটু কেমন অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। তার মানে টুপ করে সন্ধ্যে গড়িয়ে আসবে এবার। নাহ্ এবার হোটেলে ফিরতে হবে। পরেশনাথের অব্যক্ত আহ্বানে এতখানি চলে এলাম, এবার নামার পালা। এমন নৈসর্গিক রূপে কত আত্মভোলা মানুষ বছরের পর বছর এসব স্থানে বেরাতে এসে হারিয়ে যান প্রকৃতির কোলে। সত্যি এই পাহাড়, জঙ্গল, নদ নদী যিনি সৃষ্টি করেছেন, তাঁকে অন্তরের প্রণাম নিবেদন না করে উপায় কি! যুগ যুগ ধরে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা তাদের জেগে থাকা, অবিরাম ধারায় তাদের সময়ের সাথে সাথে বয়ে চলা ... এসবের মাঝে তাদের না আছে কোন আশা, স্বপ্ন বা পরিকল্পনা। তারা অপেক্ষা করে না কারো জন্যই। সুউচ্চ পাহাড়ের বুকে আশ্রিত গাছপালা, পশুপাখী, কীটপতঙ্গ এসে বাসা বেঁধেছে, অথচ তাদের মুখে কোন রা নেই। আর আমাদের মাথায় ঘুরতে থাকা একটার পর একটা আশা মগজকে শুধু জানান দেয় যে আমি কিন্তু এখনও জেগে তোমার জন্য, আমি যে তৃষ্ণাৃর্ত। আর আমরাও কেবল তার জ্বালায় জ্বলছি আর সেসব পূরণের জন্য পাগল হয়ে ঘুরে বেরাচ্ছি জলে জঙ্গলে। এ জ্বালার পরিত্রাণ কোথায়! সে কোন্ যোগী বাস করেন ঐ সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায়, যাঁর কাছে এ সবকিছুর মূল্য শূন্য, যিনি জয় করেছেন সব রিপুকে, যাঁর দিব্যজ্ঞানের চোখে প্রপঞ্চময় জগতে আমরা পাগলের মতো কবে থেকে শুধু ঘুরেই চলেছি এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। 

দিনের আলো শেষের দিকে। একটি অটো পাকড়াও করলাম। তার আগে পাশের দোকান থেকে মশলা মুড়ি, ফুচকা খেলাম। এবার গিরিডি স্টেশনে ফেরার পালা। পরেশনাথের স্মৃতি নিয়ে আমরা দেওঘরে ফিরে এলাম। তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে সাতটার মতো। স্বরূপদার কাছে গিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতার কথা বললাম। যদিও বিশেষ ঘটনাটুকু বাদই রাখলাম। কারণ বুঝেছিলাম, আমাদের দেখা ঐ ঘটনার কথা কেউ বিশ্বাস করবেন না বা শুনলে তেমন পাত্তাও দেবেন না। আর তোমরাও এটুকু পড়ার পর নিশ্চয়ই ভাবছো যত্তসব ভুতুড়ে কাণ্ড বটে। যাইহোক, স্বরূপদার কথামতো গিরিডি না ঘুরে এলে আমার জীবনে এর বৈচিত্র্য কোনদিন ধরা পড়তো না। কথাবার্তা চলছে, এমন সময়, স্বরূপদা বললেন, "অসীম এই হোটেলটায় কি ভূত আছে না কি গো"! শুনলাম, হঠাৎ উনি দুপুরে শুয়ে টিভি দেখছেন ঘরে, অমনি জলের ঝর ঝর শব্দ; একবার নয়, বেশ কয়েকবার। কিন্তু ঘরময় খুঁজে কোথাও জলের দেখা মিলল না! তাহলে জলের ঐ শব্দ কোত্থেকে এলো! তারপর বললেন, বারান্দায় এসে একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর নজরে এলো মাথার ওপর দিয়ে ওপর তলার ওয়াশরুমের পাইপ লাইন চলে গেছে, আর তারই শব্দ! দেখো কাণ্ড। আমরা সবাই হেসে লুটোপুটি আর কি স্বরূপদার কথা শুনে। বেজায় খাপ্পা হয়ে তিনি তার পরের দিনই চলে গেলেন অন্য হোটেলে। 

এর পরের দিন আমরা ত্রিকূট পাহাড়, খাণ্ডলী পার্ক ঘোরার জন্য বেরোলাম। সেখানে অবশ্য আমরা সবাই গেলাম। আমি সাহস করে মেয়েকে পাথরের উঁচু একটা স্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে স্বরূপদা ভয় পেয়ে বলেই দিলেন, "তোমার সাহস থাকলে তুমি যাও, ওদেরকে নিয়ে একদম যাবে না।" আমি তো পাহাড় দেখে নিজেকে ঠিকই থাকতে পারি না, তো কি করবো আর! অগত্যা একাই একটা উঁচু জায়গায় উঠে ছবিও তুললাম। বড়ো বড়ো পাথরের খণ্ড কেটে কেটে মানুষ, সিংহ, কুমীর ... বানিয়ে রাখা পাহাড়ের তলদেশে। ছোটদের জন্য বেশ সুন্দর মজাদার ব্যবস্থা। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ময়ুরাক্ষী নদীর নীল প্রবাহ। এত ধীর স্থির অথচ মনোরম দৃশ্যে যেকোন মানুষ আত্মহারা হতে বাধ্য। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে দেওঘরের বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গাগুলো তোমরা যারা এখনও দেখার সুযোগ পাও নি, বলবো, একটি বার বাবা মায়েদের সাথে বেরিয়ে এসো। সাথে অবশ্যই রাখবে শিমুলতলাকে। যদি নির্জন প্রকৃতির প্রেমিক হও, আমি নিশ্চিত, তোমাদের এই প্রকৃতি সাদরে কাছে টেনে নেবে তাঁর মোহময়ী রূপের দ্বারা। তাছাড়া স্বাস্থ্যকর স্থানের বিচারে শিমুলতলা, দেওঘর, মধুপুর অত্যন্ত ভাল জায়গা। ফ্ল্যাটের বদ্ধ পরিবেশ থেকে নিজেদের বাঁচাতে সবুজ প্রকৃতি এক কথায় নতুন জীবন দান করবে, নিঃসন্দেহে বলতে পারি।


৪ 
কোলকাতা ফিরে অফিসে জয়েন করার পর একদিন স্বরূপদা বললেন, একটা অবাক কাণ্ড হয়েছে। সে আবার কি! শুনলাম, দেওঘরের প্যাঁরা খুব বিখ্যাত। তাই তিনি বাড়ির আত্মীয়স্বজনদের জন্য বেশ কিছু প্যাঁরা কিনে নিয়ে এসেছিলেন। বাড়ি ফিরে তাঁর বাড়িওয়ালা মাসীমাকে কিছু প্যাঁরা দেবেন বলে দোতলায় গেলেন। তারপর তাঁর সাথে বেরানোর অভিজ্ঞতার কথাও বলেছেন খুশি মনে। এইসব কথা বলতে কয়েক মিনিট সময় লাগলো। এবার তিনি একতলায় নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখেন, বাকি প্যাঁরাগুলো বেশ তারিয়ে তারিয়ে সাবাড় করতে লেগেছে দু দুটো মোটুসোটু বিড়াল। এমনিতে তাঁর ঘরে অনেক সময় একটা বিড়াল আসে। কিন্তু কোত্থেকে আরও একটা এসে উপস্থিত হলো, কে জানে রে বাবা। স্বরূপদা বললেন, "বিড়াল যে এত তৃপ্তি করে প্যাঁরা খেতে পারে, জানা ছিল না আমার। আমার চোখের সামনে দেওঘরের সমস্ত প্যাঁরার সত্যনাশ হতে দেখে কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কাজ কি!" বুঝলাম, আমাদের শিমুলতলা আর দেওঘর ভ্রমণের ইতিহাস শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল বিভিন্ন ঘটনায় ভরা, যা আজকের দিনেও সমান জাগ্রত।

অনেক চেষ্টায় স্মৃতির পাতা উল্টে এটুকু সাজিয়ে গুছিয়ে বলার মতো অসাধ্য সাধন করেছে যে বস্তুটি, সেটি হলো আমার সেই অতি সাধারণ পুরানো কোডাক ক্যামেরায় তোলা ২০০৫ সালের সেইসব ছবিগুলো, যা খুঁজে পেয়ে আমি হারিয়ে গেলাম আজ থেকে সতেরো বছর আগে। লিখতে লিখতে একবার ফেলে আসা হোটেলগুলো আর বালুদার খোঁজ নেওয়ার সাধ হলো। ইন্টারনেট এ ব্যাপারে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পূর্ণ সহযোগিতার। আর তাই একদিন খুঁজতে গিয়ে একটি হোটেলের দিশা পেলাম। সেখানে কথোপকথন শুনতে শুনতে একটি নাম আর তাঁর অবয়ব দেখে হঠাৎ আমার মনে চরম খটকা লাগলো। এ তো সেই বালুদা, যে আমাদের আপ্যায়নের কাজে ব্যস্ত ছিল শিমুলতলার সেই "আম্রপালী"তে। সেটা না হয় হলো, কিন্তু যে হোটেলের ভিডিও দেখছি, সেটা তো "আম্রপালী" নয়। তাহলে কি পাল্টে গেলো! অতএব, খোঁজ খোঁজ খোঁজ। অফিস থেকে বাড়িতে এসে দেখলাম। পরের দিন আবারও খুঁজলাম নতুন হোটেলের ঠিকানা। সাথে আরও একটি ভিডিও শুনে এবার বেশ বুঝলাম যে সে "আম্রপালী" এখন হাত বদল হয়ে নতুন রূপে। আমার সন্দেহ দূর করতে নতুন হোটেলে ফোন করলাম, আমার তোলা ছবিগুলো পাঠালাম হোটেলের ম্যানেজারকে। সেদিন রাত অব্দি কোন উত্তর পেলাম না। পরের দিন, হোটেলের ম্যানেজার ভিডিও কলে বালুদাকে যখন আমার সাথে কথা বলিয়ে দিলেন, আমি চিনতে পারলাম আর তিনিও আমাকে চিনতে পারলেন। মনের মধ্যে তখন এক অদ্ভুত আনন্দের ধারা। মনে হচ্ছিল, এক্ষুণি ছুটে চলে যাই শিমুলতলার সেই স্থানে, যেখানে আমি আমার ফেলে আসা স্মৃতিগুলোকে চাক্ষুষ দেখবো, বালুদার হাতের চা খেতে খেতে গল্পে মেতে উঠবো। কানে এখনও ক্ষীণ সুরে বাজছে বাউল শিল্পীদের গানের মূর্ছনা, নিশুতি রাতের আঁধারে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা শিমুলতলার সেই গভীর ঘন সবুজ বীথিবনছায়ায়। আহা! আজ যদি এই স্মৃতি সুখের না হয়, তাহলে সুখ আর কিসে? এর স্বাদ তো আমি না চাইতেই পেয়ে গেলাম। আর যিনি একে তিল তিল করে হাতের জাদুতে গড়ে তুলেছেন, তিনি নিশ্চয়ই তারও চাইতে অনেক বেশি সুন্দরী। আমরা সবাই তো তাঁরই মায়ায় আচ্ছন্ন।


রচনাকাল 
অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়

আমি যখন লিখতে বসি
মাথায় ওঠে বাড়ি
রান্নাঘরে কান্না লাগায় 
ডেকচি এবং হাঁড়ি

বাড়ির মাথায় হাজার ফুটো
উড়ছে জোরে শাড়ি—
মিলগুলো কই? খিল দিয়েছে?
করছে বাড়াবাড়ি? 

‘মাছ’ ভেবে আজ ‘গাছ’ খেয়েছি—
‘বাটার’ ভেবে ‘আঠা’!
‘মুরগি’ ভেবে ‘মুড়কি’ চিবোই—
খাই পাঁঠা না, আটা?

লিখতে গিয়ে সটান বুকের
জানলা দিলাম খুলে... 
‘ভাবনা’ ভেবে ‘আলনা’ সরাই,
‘দুল’ খেয়ে নিই ভুলে! 

হতচ্ছাড়া কল্পনারা
বড্ড বাউন্ডুলে;
এই তো গিয়ে বসছে ডালে
ওই তো ওড়ে ফুলে

নড়ছে বাড়ি সরছে মাটি
কাঁপছে লেখার ঘর—
বেয়াক্কেলে চিন্তাগুলো
কম্পিত, থরথর...

আমি যখন লিখতে বসি
আসছে গরু তেড়ে—
ঘাস ছিঁড়েছে শোওয়ার ঘরে
কচিদাঁতের এঁড়ে! 

শিং কী নাড়ায়, শিং কী নাড়ায়
ফেলবে নাকি পেড়ে!
চৌবাচ্চায় ঝাঁপ দিয়েছে
পুকুর ভেবে কে রে? 

লিখতে বসে দেখছি আজব
কান্ডের কারখানা! 
টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে শালিখ
বুড়বকও চারখানা—

লেখাটি শেষ, উঠে দাঁড়াই
শান্ত বাড়ি ও ঘর
বনের ভেতর কোথায় গেছে
হারিয়ে ডাইনোসর!


সুবীরবাবুর বন্ধু
রূপম চট্টোপাধ্যায় 

সুবীরবাবুর বাস্তববোধ বড়ই কম। বেঁচে থাকতে তাঁর মা বলতেন, বউ বলতেন। 
এমনিতে সুবীরবাবু নির্বিরোধী মানুষ। স্রোতে ভাসেন না, বিরুদ্ধেও যান না, বরং নিজের মনে থাকেন। একসময় ভূগোল পড়াতেন মফস্বলের এক হাইস্কুলে। স্কুল আর ঘর করেই সারাটা জীবন কাটল। চাকরি থেকে যখন অবসর নিলেন, ততদিনে ছেলে ভোপালে, মেয়ে কানাডায়। ভেবেছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে বাকি জীবনটা রাজারহাটে কেনা নতুন ফ্ল্যাটেই কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু বিধি বাম, বছর পাঁচেকের মধ্যেই স্ত্রী গত হলেন। ছেলে তারপর কিছুতেই রাজি হল না বাবাকে একা ছেড়ে দিতে। সুবীরবাবুর যেটুকু প্রতিরোধ ছিল, সেটুকুও মুছে গেল যখন সাত বছরের নাতি রনি তার কচি কচি আঙুল দিয়ে ওঁর হাত ধরে বলেছিল, "চলো না দাদু, আমার সঙ্গে  থাকবে.."

তা এখানে এসে খুব একটা খারাপ নেই সুবীরবাবু। টুকটাক বইপত্র পড়ে, খেয়ে-ঘুমিয়ে, নাতির সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেশ কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। তিনি শুনেছেন, পাশেই একটা বাঙালি ক্লাব আছে, তাঁর বয়সী অনেকেই সেখানে আসেন, সন্ধ্যেবেলা তাস-দাবা, আড্ডা চলে। ছেলে সৌরভ নিয়ে যেতেও চেয়েছিল। তিনি রাজি হননি। আসলে কারও সঙ্গেই সহজে মিশতে পারেন না সুবীরবাবু। যেখানে পাঁচজন লোক গল্প করে, হাজার পরিচিত হলেও সেই জটলার মধ্যে প্রবেশ করতে পারেন না তিনি। 
ছেলের বাড়ির কাছেই একটা বিশাল পার্ক আছে। রোজ সকালে স্বাস্থ্যান্বেষী মানুষজন জমা হয় সেখানে। প্রথমদিকে ওই পার্কে যেতেও আপত্তিই করেছিলেন সুবীরবাবু। কে কী বলবে কে জানে!
কিন্তু বৌমা পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিল, "কে কী বলবে, বাবা? চলুন, আমিও আপনার সঙ্গে  দু'দিন যাই, লোকজনের সঙ্গে আলাপ হলেই দেখবেন আর সমস্যা হচ্ছে না।"
বাস্তবেও তাই হল। তিন-চারদিনেই বেশ সহজ হয়ে গেলেন সুবীরবাবু। এখন ভোরে উঠে নিজেই চলে আসেন পার্কে, সামান্য হাঁটাহাঁটি করেন, বেঞ্চে বসেন। মুখচেনা কেউ পার হওয়ার সময় মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কার করলে সুবীরবাবুও মিষ্টি হাসি উপহার দেন। 
তবে দুপুরবেলা খুব একলা কাটে সুবীরবাবুর। ছেলে-বৌমা চলে যায় অফিসে, নাতি স্কুলে। বিকেল চারটে অব্দি বাড়িতে কেউই থাকে না। যদিও তাতে অসুবিধে বিশেষ নেই, এখনও তিনি যথেষ্ট সক্ষম। ছিমছাম শরীর নিয়মিত পরিশ্রমের অভ্যাসে সুগার, প্রেসারকে বাসা বাঁধতে দেয়নি।
#
অন্যদিন তিনি ফ্রিজ থেকে খাবার বার করে, গরম করে খেয়ে নেন। তারপর নিজের ঘরে শুয়ে বই-পত্র পড়েন। কিন্তু আজ খাওয়ার পর পড়তে ইচ্ছে করছিল না। তাই পায়ে চটি গলিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বাগানের দিকে।
চারদিকে উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাগানবাড়ি। এ পাড়ায় অধিকাংশ বাড়িই এ'রকম দেখতে। বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি, সামনে লন। তাতে কেউ টেনিস কোর্ট বানিয়েছে, কারও দোলনা রাখা আছে, কেউ বা শখ করে বিভিন্ন ধরনের গোলাপ লাগিয়েছে। আর পেছনে অনেকটা জায়গা জুড়ে বাগান। তাতে আম, জাম, শিশু, মেহগনি ইত্যাদি বড় বড় গাছ লাগানো রয়েছে। সৌরভের মতো কোম্পানির উঁচু পদে থাকা অফিসারেরা এইসব বাড়িগুলো পায়।
সুবীরবাবু হাঁটতে হাঁটতে বাগানের শেষপ্রান্তে চলে এলেন। কোথাও এক ফোঁটা নোংরা নেই, আগাছা নেই। ঘাস সর্বত্র সমান করে কাটা। প্রতি রবিবার ছেলের কোম্পানি থেকে লোক আসে বাগান পরিষ্কার করার জন্য। 
সুবীরবাবু ঘুরতে ঘুরতে লক্ষ করলেন মেহগনি গাছের তলায় বেশ কিছু ডাল পড়ে আছে। ডাল না বলে কাঠি বলাই ভাল। ফুটখানেক লম্বা উলের কাঁটার মতো মেহগনির প্রশাখা। আজ শুক্রবার, ফলে পাঁচদিন ধরে এরকম অনেক টুকরো পড়ে জমা হয়ে রয়েছে। সেগুলো হাতে নিতেই একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল তাঁর। পরশুই রনি টিভিতে অ্যানিমেশন রামায়ণ দেখতে দেখতে বায়না ধরেছিল তীর-ধনুকের জন্য। আর সৌরভ শুনতে পেয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, "ওকে ডিয়ার। আর একটু বড় হও, আমি তোমায় আর্চারি ক্লাসে ভর্তি করে দেব।" 
মেহগনির ছোট্ট ডালটা হাতে নিয়ে সুবীরবাবুর মনে হল, এইগুলো মাপমতো কেটে নিতে পারলেই কী সুন্দর তীর হয়ে যাবে। তারপর একটা আমডাল বা নিমডাল দিয়ে ধনুক বানাতে কতক্ষণ? ছেলেমানুষি স্বভাব কারও কারও সারাজীবনই রয়ে যায়। তিনি ছোটবেলায় নিমকাঠি দিয়ে তলোয়ার বানাতেন। আঙুল সমান লম্বা নিমের কাঠি, তাই নিয়ে গাছ ভাগ হতো বন্ধুদের সঙ্গে। প্রতিটি গাছ একেকটি রাজ্য। প্রতিটি কাঠি অসিরূপী সেনানী। কত বয়স তখন সুবীরবাবুর? আট কি নয়।
তীর বানাতে বানাতে মনে মনে হাসলেন তিনি। কল্পনার দৌড় ঠিক থাকলে গাছের এই টুকরো দিয়ে বানানো তীরগুলোই হয়ে উঠবে পাশুপত, বৈষ্ণবাস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্র।
।।২।।
রনি স্কুল থেকে ফেরে চারটে নাগাদ, ওর মা'র সঙ্গে। সৌরভের বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় ছ'টা বেজে যায়। 
পাঁচটা নাগাদ মিতালী জলখাবার খেতে ডাকল ছেলে আর শ্বশুরকে। সুবীরবাবু এসে দেখলেন টেবিলে ওটস দেওয়া হয়েছে। মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। এইসময় গরম চপ দিয়ে মুড়ি খেতে ইচ্ছে করে, তারপর এক কাপ চা। কিন্তু সেসব নাকি অস্বাস্থ্যকর খাবার! বাধ্য হয়ে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে প্লেট টানলেন তিনি।
"ডোন্ট ইউ এনজয় দিস?" ওটসের দিকে আঙুল দেখিয়ে প্রশ্ন করে রনি। 
সুবীরবাবু হেসে উঠলেন, বাচ্চারা খুব সহজেই ধরে ফেলে মনের কথা। তিনি ঘাড় নেড়ে বলেন, "ইয়েস স্যার, ভেরি মাচ।"
রনি বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে, "জানো দাদু, এতে প্রচুর ফাইবার থাকে। ফাইবার আমাদের শরীরের জন্য খুব হেল্পফুল। তুমি ফাইবার জানো তো?"
সামান্য অপ্রস্তুত হওয়ার ভঙ্গি করেন সুবীরবাবু, অসহায় মুখ করে বলেন, "জানি না তো, তুমি আমাকে পড়াবে?"
তাঁর কথা শুনে রনির মুখে একরাশ খুশি উপচে পড়ল। স্কুলপড়ুয়া সব বাচ্চাদের অবচেতনেই বোধহয় শিক্ষক হওয়ার বাসনা জন্মে থাকে। ছড়ি হাতে অতজনের ওপর কর্তৃত্ব করার অমোঘ টান উপেক্ষা করতে পারে না কেউই। তাই সুযোগ পেয়ে রনি বলল, "ওকে, আমি তোমাকে পড়াব। কিন্তু.."
ওদের কথার মাঝে মিতালী বাধা দেয়, "খাবার সময় কথা বলতে নেই। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।"
সুবীরবাবুও সায় দিয়ে বলেন, "হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ রেখেছি।"
মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রনির চোখ। সে গোগ্রাসে খেতে লাগল।
#
খাওয়া শেষ হয়ে গেলে দাদুর ঘরে এল সে। প্রথম প্রথম সুবীরবাবু যখন এসেছিলেন রনি তখন খুব বায়না করত দাদুর কাছে শোওয়ার জন্য। কিন্তু বাবার কষ্ট হবে ভেবে সৌরভ রাজি হতো না। সুবীরবাবুর অবশ্য ভালই লাগত। দেশ-বিদেশের গল্প শোনাতেন নাতিকে। শুনতে শুনতে হাঁ হয়ে যেত রনি। সেই আদ্যিকাল থেকেই দেশ-কাল-ভাষার গণ্ডি ছাড়িয়ে মুখে বলা গল্পের আকর্ষণ একই রয়ে গেছে। আজও ভাল করে গল্প বলার ক্ষমতা থাকলে বাচ্চা-বুড়ো সবাই হাঁ করে শোনে। তবে বাচ্চাদের একটা সমস্যা হল, নতুন জিনিসের মোহ খুব দ্রুতই কেটে যায়। এখন আর রনি দাদুর কাছে শোওয়ার জন্য বায়না ধরে না। বরং মাঝে মাঝে আলাদা ঘরে একা শোওয়া অভ্যাস করে।
সুবীরবাবু ওকে একটা চেয়ারে চুপ করে বসতে বললেন। তারপর সারা দুপুরের পরিশ্রমে তৈরি করা তীরগুলো দু'হাতের তালুতে মেলে, চেয়ে রইলেন হাসিমুখে। 
রনি কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল, তারপর অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, "এই কাঠিগুলো নিয়ে কী করব দাদু?"
নিমেষে অন্ধকার হয়ে গেল সুবীরবাবুর মুখ। কোথাও মৃদু বাজ পড়ল যেন। কোনরকমে বললেন, "তুমি তীর-ধনুক চাইছিলে না দাদুভাই, তোমার জন্য আমি নিজের হাতে.."
রনি হতাশকণ্ঠে বলে, "দিজ আর নট রিয়েল দাদু। আয়াম নট আ কিড অ্যানি মোর!"
রনি বিরক্ত হয়ে উঠে চলে যায়। জল রাখতে এসে মিতালীও সুবীরবাবুর ছেলেমানুষি কাণ্ড দেখে হেসে ফেলল। তারপর তাঁর আহত মুখের দিকে তাকিয়ে সান্ত্বনার সুরে বলল, "রনির বুদ্ধি নেই বাবা। নইলে অমন করে কেউ বলে! আমি দেখছি, দাঁড়ান।"
সুবীরবাবু পুত্রবধূর কথার উত্তর দিলেন না। নিজের বানানো তীরগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন, "কাঠি..!"
#
রাত্রে খেতে বসে তিনি শুনতে পেলেন পাশের ঘরে মিতালী হাসতে হাসতে সৌরভকে বিকেলের ঘটনা শোনাচ্ছে। সুবীরবাবু রুটি চিবোতে চিবোতে টিভির সাউণ্ড বাড়িয়ে দিলেন।

।।৩।।
বুধবার পর্যন্ত টানা ছুটি পড়েছে সৌরভদের। সেন্ট্রাল হলিডে, ফলে রনিরও স্কুল ছুটি। ঠিক হয়েছে সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যাবে। রনি জঙ্গল পছন্দ করে বলে সৌরভ ঠিক করেছে গাড়ি নিয়ে কুনো-পালপুর ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি হয়ে উজ্জয়িনী ঘুরে আসবে।
সুবীরবাবু শুনে বলেছিলেন, "খুব ভালো। ওখানে এশিয়াটিক সিংহ রাখার ব্যবস্থাও হচ্ছে। গুজরাটের গিরের পর ভারতবর্ষের দ্বিতীয় অভয়ারণ্য হতে চলেছে ওদের জন্য।"
মিতালী অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, "আপনি গেছেন ওখানে, বাবা?"
মৃদু হেসে তিনি উত্তর দিলেন, "না, মা। আমার দৌড় ওই বইয়ের মধ্যেই। চেয়ারে বসেই আমি সারা দুনিয়া দৌড়াই।"
আসলে টানা চারদিন গাড়ির ধকল নিতে পারবেন না বলে সুবীরবাবু যেতে চাইলেন না। বললেন, "আজ তো সকাল হয়েই গেছে, বাকি তিনটে দিনও কেটে যাবে। তোরা ঘুরে আয়।"
কিন্তু সৌরভও রাজি নয় বাবাকে নতুন জায়গায় একা রেখে যেতে। শেষ পর্যন্ত বাড়িতে একজন লোক থাকবে এই শর্তে রফা হল, এবং সুবীরবাবুকে কথা দিতে হল সামান্যতম অসুবিধা হলেই ছেলেকে ফোন করবেন।
#
সবাই চলে যাওয়ার পর সকালের দিকটা এমনিতেই কেটে গেল, মনে হল সবাই রোজকার মতো অফিস-স্কুলে গেছে। দুপুরে খাওয়ার পর শুতে গিয়ে টেবিলে রাখা তীর-ধনুকে চোখ পড়ল সুবীরবাবুর।
নিজের উপরেই বিরক্ত হলেন সামান্য। আজ রবিবার ছিল, সকালে বাগান পরিষ্কার হয়েছে। ওগুলো ফেলে দিলে এতক্ষণে তাঁর নজরের বাইরে চলে যেত। অবশ্য ডাস্টবিনেও ফেলা যায়, কিন্তু কাজের লোক দেখতে পেলে আবার কী মন্তব্য করবে কে জানে!
সাত-পাঁচ ভেবে তিনি উঠে পড়লেন। তীর-ধনুক হাতে নিয়ে চলে এলেন বাগানে, কিন্তু ফেলতে গিয়েও কী মনে হতে একটা বাঁধানো সিমেন্টের চেয়ারে বসে পড়লেন। 
বেশ মোলায়েম হাওয়া দিচ্ছে এখানে, শান্ত ছায়া। দু'য়েকটা চেনা-অচেনা পাখির ডাক কানে আসছে। আশেপাশে কেউ না থাকলেও প্রকৃতির কোলে নিজেকে একা লাগছে না তাঁর।
সুবীরবাবু একটা মেহগনি ডালের তীর ধনুকে লাগিয়ে টান দিতেই হাত দশেক দূরের আমগাছে গিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই ধড়ফড় করে একটা নীল-কালো রঙের ছোট্ট পাখি উড়ে পালাল ভয়ে। 
বটে! নিজেকে বেশ অর্জুন-অর্জুন মনে হল তাঁর। আশপাশে তাকিয়ে দেখলেন একবার। না, কেউ দেখার মতো নেই। মনের আনন্দে এবার একটার পর একটা তীর ছুঁড়তে লাগলেন তিনি।
"একা একা কি যুদ্ধ হয় নাকি?"
কচি গলার আওয়াজে হঠাৎ থমকে গেলেন সুবীরবাবু। একটা বাচ্চা ছেলে কখন এসে দাঁড়িয়েছে ওঁর পাশে। এতক্ষণ মন দিয়ে তাঁর তীরচালনা দেখছিল।
সুবীরবাবু লক্ষ করলেন, বাচ্চাটা রনির চেয়ে বছরখানেকের ছোটই হবে। ফর্সা গায়ের রঙ, মাথায় এক মাথা কোঁকড়া চুল। রঙিন টি-শার্ট আর ব্লু জিন্সের হাফপ্যান্টে বেশ লাগছে দেখতে। পায়ের দিকে তাকিয়ে সামান্য অবাক হলেন তিনি। ফিতে দেওয়া চটির আড়ালে পায়ের যতটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে আলতা পরানো আছে। কার বাড়ির বাচ্চা কে জানে! তবে বাংলায় কথা বলছে যখন, তখন বাঙালিই হবে।
সুবীরবাবু বেশি মাথা ঘামালেন না, হাতের ধনুক দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন, "চালাবি?"
সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল, কিন্তু ধনুক নিল না। থুপ থুপ করে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল উল্টোদিকে। সুবীরবাবু বুঝলেন ওর নতুন ধনুক চাই, হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। 
সুতো এনে, আমডাল ভেঙে নতুন ধনুক বানিয়ে দেওয়ার পর শুরু হল যুদ্ধ। ওইটুকু বাচ্চা হলে কী হয়, সমানতালে তীর ছুঁড়তে লাগল সুবীরবাবুর দিকে। ওঁর গায়ে তীর লাগলেই খিলখিল করে হেসে উঠছিল বাচ্চাটা।
ঘন্টাখানেক এভাবে খেলার পর সে বলল, "এবার বাড়ি যাব। মা বকবে।"
সুবীরবাবু একরাশ আশা নিয়ে বললেন, "আবার কবে আসবে?"
বাচ্চাটা হাসিমুখে বলল, "কাল আসব। তুমি ওগুলো ভাল করে রাখতে পারবে তো?"
তিনি আশ্বাসের সুরে বললেন, "নিশ্চয়ই। আমি আমার টেবিলে যত্ন করে রেখে দেব।"
"টেবিলে?" যেতে গিয়েও থেমে যায় বাচ্চাটা, "টেবিলে কেন রাখবে? তুমি কিছুই জানো না দেখছি।"
তারপর চারদিক দেখে ফিসফিস করে বলল, "তীর-ধনুক গাছে রাখতে হয়, লুকিয়ে। আমি দেখেছি। ওই গাছটাতে রেখে দাও।"
"কোথায় দেখলে, দাদুভাই?" সুবীরবাবুও গলা নামিয়ে প্রশ্ন করলেন, "মহাভারতে?"
বাচ্চাটা বিজ্ঞের মতো ঘাড় নাড়ে, "হ্যাঁ, হ্যাঁ, মহাভারত, রামায়ণ সব আমার দেখা আছে। আমি আসি এবার।"
কথাগুলো বলেই কচি পায়ে ছুট লাগায় সে। 
বাচ্চাটা চোখের আড়াল হতেই সুবীরবাবু তৃপ্ত মনে তীর-ধনুক লুকিয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ওইটুকু একটা বাচ্চা উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল, তালা বন্ধ দরজা পেরিয়ে বাগানে ঢুকল কী করে, গেলই বা কোথায়, সে ভাবনা তাঁর মাথাতেই এল না।


ধারাবাহিক উপন্যাস
শয়তানের উঁকি

তপশ্রী পাল


পরদিন সকাল থেকে অষ্টমীর অঞ্জলি নিয়ে ব্যস্ত ছিলো বাড়ির সবাই! মা কাকিমা সবাই অঞ্জলি দিতে গেছেন কী সুন্দর লালপাড় সাদা শাড়ি পরে, গলায় সোনার হার! বড় বড় চোখ করে দেখছে নিউট্রন! এমন সাজগোজ সে বিদেশে কোনদিন করতে দেখেনি তার মাকে! যাই হোক অঞ্জলি দিয়ে দুপুরে পাড়ার প্যান্ডেলে খিচুড়ি খেয়ে ঘুমটা বেশ জমিয়ে এলো। কিন্তু বিকেল না হতে মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। পাকড়াশী আঙ্কলের ফোন এসেছিলো! ওদের একদম রেডি হয়ে থাকতে বলেছেন! উনি আসছেন এক্ষুণি!

কী ব্যাপার হলো? নিশ্চই কিছু জানা গেছে বিশাখার ব্যপারে! খুব উত্তেজিত হয়ে চটপট জিন্স টিশার্ট পরে রেডি হয়ে নিলো ওরা। নিউট্রন ওর একটা ভাঁজ করা ছুরি নিয়ে নিলো সঙ্গে! এবার এয়ারপোর্টের শপ থেকে কিনেছে এটা! একটু পরেই হুটার বাজিয়ে পাকড়াশী আঙ্কল এসে গেলেন। গাড়িতে উঠেই বললেন “আমরা কিন্তু খুব খারাপ কিছু লোকজনের সামনে যাচ্ছি! যে কোন সময় যা কিছু হতে পারে! বাড়ির লোক জানলে তোমাদের কিছুতেই যেতে দিতো না এই পুজোর দিনে। কিন্তু তোমাদের দুজনেরই খুব সাহস আর বুদ্ধি! তোমাদের বুদ্ধি ছাড়া এতোদূর এগোনোই যেতো না। তাই রিস্ক নিয়েও তোমাদের সঙ্গে নিলাম। এখন তোমাদের বলি কী হল –
“ঐ ফোনটার নম্বর থেকে আই এম ই আই নম্বর পাওয়া পুলিশের কাছে কিছু ব্যাপার নয়। ফোন অফ থাকলেও পাওয়া যায়। কিন্তু ওই সিমটা সম্ভবতঃ আর ব্যবহারই হচ্ছে না ওই ফোনে। খুলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ফোনটাও অফ। তাই আই এম ই আই নম্বর আমরা পাইনি। আমরা ঐ তোতলা লোকটিকে সঙ্গে নিয়ে এয়ারপোর্টের কাছে সেই ধাবায় যাই। দেখি ধাবাটা বন্ধ! যখন হতাশ হয়ে ফিরে আসবো ভাবছি, সেই সময় একেবারে উল্টোদিকের দেখি এক পানওয়ালা। তার কাছে পান খেতে যাই। তাকে জিজ্ঞাসা করি ধাবাটা বন্ধ কেন। সে বলে মাল পাচার হয়ে গেলেই আবার খুলে যাবে। আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি মাল পাচার মানে? সে বলে “বাবু ঐ ধাবার পিছনে একটা ঘরে নানা জায়গা থেকে বাচ্চা মেয়েদের তুলে এনে রাখা হয়! তারপর রাত্তিরবেলা কালো গাড়িতে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়! বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি সাব। কিন্তু এর পিছনে বড় বড় আদমী আছে! তাদের মদতে সব হয়। আমাদের খারাপ লাগে কিন্তু মুখ বুজে থাকা ছাড়া গরীব আদমী কী করবে?” প্রোটন জিজ্ঞাসা করে “কী করে এই বাচ্চা মেয়েদের নিয়ে? ওদের মেরে ফেলে?” মিস্টার পাকড়াশী গম্ভীর মুখে বললেন “না, তার চেয়েও খারাপ। তুমি বুঝবে না। পরে বুঝিয়ে বলবো!” নিউট্রন কিছুক্ষণ প্রোটনের হতবাক মুখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো “গার্ল ট্রাফিকিং! দুষ্টু লোকেরা করে! বিদেশে অনেকদিন থেকেই হতো! এখন এখানেও খুব বেড়ে উঠেছে! বিশাখার খুব বিপদ!” প্রোটন বুঝলো না কিছুই। শুধু বোদ্ধার মতো ঘাড় নাড়লো। মিস্টার পাকড়াশী বললেন “যদি আগেই নিয়ে গিয়ে থাকে কিছু করার নেই। যদি না নিয়ে থাকে, আমার ধারণা, আজ রাতেই ওদের এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হবে! তার আগেই যে করে হোক কিছু করতে হবে! আমার পিছনে আলাদা পুলিশ ফোর্স প্লেন ড্রেসে অন্য গাড়িতে আসছে। আমরা আপাততঃ দূরে গাড়ি রেখে কোথাও একটা গা ঢাকা দিয়ে বসে থাকবো। এতোটুকু সন্দেহ হলে কিন্তু ওরা সাবধান হয়ে যাবে আর মেয়েগুলোরও প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে! ওদের গাড়ি বাইপাস দিয়ে প্রায় বাগুইহাটি চলে এসেছে! অষ্টমীর রাতে চারিদিকে আলোর রোশনাই! মাইকে তারস্বরে গান বাজছে! প্যান্ডেলগুলোতে ঢাক বাজছে! কিন্তু প্রোটন নিউট্রনের তখন আর কোনদিকে মন নেই। ঠাকুর দেখার ইচ্ছেটাই চলে গেছে যতক্ষণ না বিশাখাকে বাঁচানো যায়!

ধাবাটা এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে অনেকখানি এগিয়ে একেবারে হাইওয়ের ধারে খালি জায়গায়। হাইওয়ের ধারে অনেকটা দূরে গাড়ি দাঁড় করালেন মিস্টার পাকড়াশী। চারিদিকে বেশ অন্ধকার। এই জায়গাটায় কোন আলো নেই। আস্তে আস্তে এগোতে লাগলো ওরা। প্রায় কিলোমিটার দুয়েক হাঁটতে হলো। মিস্টার পাকড়াশী আঙ্গুল তুলে দেখালেন ঐ হলো সেই ধাবা। পুরোপুরি বন্ধ। তালা মারা। উল্টোদিকের পানের দোকানও বন্ধ। অষ্টমীর সন্ধ্যায় কে আর খুলে রেখে দেবে দোকান এমন জায়গায়? পানের দোকানটা বেশ উঁচু! চারটি পায়ার ওপর দোকান। নীচে খানিকটা জায়গা চৌকো করে ঘেরা। ওখানে বালতিতে জলে পান টান ভিজিয়ে রাখা হয়। মিস্টার পাকড়াশী বললেন “তোমরা দুজনে গুঁড়ি মেরে ওখানে ঢুকে বসে থাকো। বাইরে থেকে কিচ্ছু দেখা যাবে না। পানের দোকানের পিছনে ঐ বড় গাছটা দেখতে পাচ্ছো? আমি ওর পিছনে আছি। ঠিক সময় তোমাদের বলবো! আমি না বললে একদম বেরোবে না!

রাত বেড়ে চলে! পানের দোকানের নীচে বসে বসে মশার কামড়ে পা ফুলে ওঠে দুজনের। দুরাগত ঢাকের আওয়াজও কমে আসে। নিউট্রন ঘড়িতে দেখে প্রায় রাত দশটা! মা বাবা খুব ভাববে দেরী দেখে! কিন্তু পাকড়াশী আঙ্কলের সঙ্গে আছে বলে হয়তো একটু কম চিন্তা করবে! এমন সময় ধাবাটার দরজার নীচে একটা খুব সরু আলোর রেখা দেখতে পায় ওরা। কেউ আলো জ্বেলেছে! ও মা! ডানদিকে তাকিয়ে দেখে কখন একেবারে নিঃশব্দে একটা কালো ভ্যান এসে দাঁড়িয়েছে! খুট করে খুলে যায় ধাবার দরজার একটা সরু কপাট! একটা তাগড়া চেহারার লোক বেরিয়ে আসে। ভ্যান থেকে নেমে একটা ঝাঁকড়া চুলো লোক কী সব বলে তাগড়া লোকটাকে। হাত পা নেড়ে বেশ উত্তেজিতভাবে কথা হচ্ছে। যদিও কিছু শোনা যাচ্ছে না, তবে সম্ভবতঃ ঝাঁকড়া চুলো লোকটা তাগড়া লোকটাকে বকাবকি করছে কোন কারণে। 

একটু পরে তিন চারটে মেয়ে, সবই প্রোটন বা নিউট্রনের বয়সী, কিন্তু একেবারে রোগা, ঢোলা ফ্রক পরা, বেরিয়ে এলো দরজা দিয়ে। তাগড়া লোকটা মূহূর্তে তাদের তুলে দিলো ভ্যানে! এবার তাগড়া লোকটা কোলে করে একটা মেয়েকে নিয়ে এলো বাইরে! এই মেয়েটা রোগা নয়। বেশ হেলদি! খোলা চুল! প্রোটনের কেমন চেনা লাগলো চেহারাটা! মুখটুখ কিছুই দেখা যাচ্ছে না! কিন্তু কেন যেন মনে হলো এই মেয়েটাই বিশাখা! কিন্তু অজ্ঞান হলো কী করে? এই জন্যই মনে হয় ঝাঁকড়া চুলো লোকটা বকছিলো তাগড়া লোকটাকে! হয়তো বাধা দেওয়ায় মেয়েটাকে মেরেছে তাগড়া লোকটা অথবা কিচ্ছু খায়নি বিশাখা কদিন ধরে – তাই অজ্ঞান হয়ে গেছে! হঠাত পিছন থেকে একটা হাল্কা বাঁশি শুনলো প্রোটন নিউট্রন! মনে হয় পাকড়াশী আঙ্কল বেরোতে বলছেন ওদের! ওরা গুঁড়ি মেরে বেরোতে থাকলো! হঠাত গুলির আওয়াজে ওদের কান ফেটে গেলো! পাকড়াশী আঙ্কল গুলি ছুঁড়ছেন ঝাঁকড়া চুলো লোকটার দিকে! ভ্যানটা থেকে অনেকগুলি গুলি ধেয়ে এলো অন্ধকারে! ভ্যানটায় স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে ওরা! আর এখানে অপেক্ষা করা সম্ভব না ওদের পক্ষে! তাগড়া লোকটা বিপদ দেখে অজ্ঞান মেয়েটাকে নিয়ে আবার ভিতরে ঢুকতে গেলো! এবার পাকড়াশী আঙ্কল গিয়ে চেপে ধরলেন লোকটাকে! দুই থাপ্পড়ে কাত হয়ে পড়লো লোকটা। পাকড়াশী আঙ্কল ওর পায়ে একটা গুলি করলেন! বাছাকে আর উঠে দাঁড়াতে হচ্ছে না! ও মা ঐ অবস্থায় ও প্রোটনকে জড়িয়ে ধরলো! তারপর ওর মাথায় বন্দুক তাক করে বললো “একে মেরে ফেলবো যদি এখনি এখান থেকে না যাস আর মেয়েটাকে ফেরত না দিস!” পাকড়াশী আঙ্কলও একটু হতভম্ব হয়ে গেছিলেন। এমন সময় নিউট্রন হঠাত লোকটার বন্দুক ধরা হাতে ওর সেই ভাঁজ করা ছুরি দিয়ে বেশ জোরে দিলো এক টান! যন্ত্রনায় লোকটার হাত থেকে বন্দুক গেলো পড়ে। এবার পাকড়াশী আঙ্কল একলাফে বন্দুকটা নিয়ে লোকটাকে মাটিতে ফেলে আরো দুটো গুলি চালিয়ে দিলেন ওর হাতে পায়ে। গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগলো। লোকটা যন্ত্রনায় ছটফট করতে লাগলো! 

ততক্ষণে প্রোটন আর নিউট্রন জলের ছিটে দিয়ে চলেছে বিশাখার মুখে! হ্যাঁ ওটা বিশাখাই বটে! অনেকক্ষণ পর চোখ খুলে তাকালো বিশাখা! ওর গায়ে খুব জ্বর! পাকড়াশী আঙ্কল ওদের বললেন গাড়িতে গিয়ে বসতে! এখানে বিশাখাকে এক মূহূর্ত রাখা যাবে না। পাকড়াশী আঙ্কল বললেন তার আরো কাজ বাকী। করে তিনি পুলিশের অন্য গাড়িতে ফেরত যাবেন! গাড়ির ড্রাইভারকে বলা হলো অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে যেতে ভিতর ভিতর দিয়ে! চেনা রাস্তায় হয়তো ওরা কেউ অপেক্ষা করতে পারে! অলি গলি দিয়ে ছুটে চললো গাড়ি! পাকড়াশী আঙ্কলের জন্য বেশ চিন্তা হতে লাগলো ওদের। কিন্তু কিছু করার নেই! গোটা পথ বিশাখা কেমন ভূতের মতো বসে রইলো। মুখে কোন কথা নেই। নিউট্রন বললো “ও প্রচন্ড শক পেয়েছে! নরম্যাল হতে সময় লাগবে!”          ( ক্রমশ)



পরাণগঞ্জের আজব কাণ্ডকারখানা
শরণ্যা মুখোপাধ্যায়

।।১।।
“পিথিবির কেউ ভালো তো বাসেনা, এ পিথিবি ভালোবাসিতে জানে…”
খুড়ো তুমি আবার গান ধরেছ!পটলা নিচ থেকে চেঁচাল। এই নিয়ে তিনবার!
“ওরে অলপ্পেয়ে, হুঁকোমুখো, আমার পোতিভার তুই কি বুঝবি রে ড্যাকরা! সেই কবে থেকে আমি গঙ্গারাম গুঁইয়ের পেঁড়াবাঁধা শিষ্য, নেহাত গুরু অকালে পটল তুললেন নইলে আজ আমি ঘেটিরাম পাঁতির থেকেও বড় ওস্তাদ হতুম! তিনহাতা ঘি আর দুসেরী পাঁঠার কম বায়না নিতুমই না!তুই কোথাকার হনু রে!” হাত উলটে আকাশের পানে তাকালেন বিন্দুসরণ পোদ্দার। নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত পাগলা ডাক্তার বেণুচরণ পোদ্দারের কনিষ্ঠ পুত্র। পোদ্দারবাড়ি চেনেনা, পরাণগঞ্জে এমন লোক মেলা ভার। এ হলো এ গঞ্জের সবচেয়ে বিখ্যাত বাড়ি যাতে সবধরণের লোকের একখানি করে উদাহরণ মজুত রয়েছে। গায়ক, নায়ক, সন্নিসী, চোর, কুলাঙ্গার কেউ বাদ নেই। 
এই ঘটনা অবিশ্যি রোজকারই। প্রায় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই বিন্দুসরণের জীবনের একটিই উদ্দেশ্য, গায়ক হওয়া।ভাইপো পটলার সাথে এই নিয়ে রোজই লাগে তাঁর। কাক আর চিল দুইই পটলার হাত থেকে দানাপানি খায় এই পোদ্দারবাড়িতে, কারণ ওই দুটি প্রাণীই একমাত্র শান্তিকামী বলা যায়। পটলার গুরুর নির্দেশ, রোজ যদি শান্তিকামী জীবের সেবা করা যায় তাহলে নাকি অঢেল ঐশ্বর্য্য পাওয়া যাবে। তা পটলার সেসব দিকে ভারি লক্ষ্য। কিছু টাকাপয়সা হলেই সে একখানা ঘুড়ির দোকান দেবে।পাশের পাড়ার কেল্টুকে দেখিয়ে দেবে সে!ত ওই কাক আর চিল বাদ দিয়ে বাকি সকলেই এ বাড়িতে ফুটছে, যাকে বলে ফুল ফুটুক না ফুটুক,… ইত্যাদি! এদিকে শেষ একমাস সকালবেলায় রেওয়াজ শুরু করেছেন বিন্দুসরণ।ওদিকে কাক-চিল আসাও বন্ধ হয়ে গেছে বাড়ীতে! পটলার তো নাভিশ্বাস ওঠার যোগাড়। আজ সকালে একটু আগেই উঠে পড়েছিল যে। বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াতেই, ওই বাজখাঁই গর্জন। কাল-চিল দূরের কথা তিনটে চড়ুই বসেছিল, সেগুলোও ফুড়ুৎ হয়ে গেল। ঠিক এমনিতর সময়ে বাড়ীর দরজায় এসে হাজির হলো লোকটা।
“আজ্ঞে, কাব্যিপু্রটা কোথায় যদি একটু বলেন… ভারি উপকার হয় আজ্ঞে?”
“কে হে তুমি? কাব্যিপুরের খোঁজ চাইছ?”
“আজ্ঞে আমি পুষ্পকুমার। অনেক দূরদেশ থেকে আসছি যে।”
আড়ে চাইল পটলা, বছর কুড়ির ছোকরা ছেলেটির মুখটা ভারি সরল।মাথায় উস্কোখুস্কো চুল, পরণে একটা ধুতি আর ফতুয়া। পায়ে দু-তিনবার সেলাই হওয়া একখানা কেডস। কাঁধে একটা বাউল-ঝোলা, বেশ ভারিভুরিই বোধ হচ্ছে। মনে হয় তার নিজের সংসারের সব জিনিসপত্র নিয়েই এসেছে। 
এরমধ্যেই পটলার কাঁধের কাছ থেকে হুঙ্কার দিলেন অলক্ষন পোদ্দার। পটলার মেজজ্যাঠা। তিনি নাকি সকালে উঠে যেদিকেই তাকান সেদিকেই সব গোলমাল হয়ে যায়, তাই সকাল সকাল কেউ চট করে তার মুখ দেখতে চায় না। কিন্তু পুষ্পকুমার তো আর সে সব কথা জানে না। সে ড্যাবডেবে চোখে তাকাল অলক্ষণের দিকে। অলক্ষণের বয়স অন্তত পঞ্চাশ। চিমসে, পাকানো চেহারা। অলক্ষণ বুঝলেন এই সুযোগ! তাঁর মাইনে করা লোক রয়েছে বাজারে। চটু পাল নাম। তা সে নামে যেমন, কাজেও তেমন। খুব চটপটে। সে রাস্তা থেকে অনেক সময়ই উমনো-ঝুমনো লোক ধরে আনে। সকালবেলা উঠে একজনের অন্তত দিনখারাপ করে তবে ভাতহজম করেন অলক্ষণ। আজ তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন। বেমক্কা হাতের কাছে এরকম মাতব্বরি করার লোক! অলক্ষণ, যাকে বলে যারপরনাই খুশ হলেন। 
পুষ্পকুমার লোকটি নেহাৎই ভালোমানুষ। তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে বেশ খানিকটা সময় নিল। এতটা সময় তো নাদিপিসি উপরের বারান্দা থেকে পটলার মাথায় পানের পিক ফেলা আর তারপর, তলায় দাঁড়িয়ে থাকা পটলার পিসিকে সুমধুর সম্ভাষণের মাঝখানে লাগে! অলক্ষণ তাঁর বিখ্যাত সরু-ক্ষুর গলায় পুষ্পকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তা তুমি কেন এখেনে এসেছ বাবা?”
“আজ্ঞে, সে ভারী গোপন ব্যাপার। আমার দাদাশ্বশুরের ইয়েতে হওয়া ফোঁড়ার থেকেও গোপন!” হাত কচলে বলল পুষ্প। 
“তাই নাকি। তাহলে বাপু তুমি এস গিয়ে, আর কী সব কাব্যটাব্যর কথা বলছ, ওসব এখানে নেই।”
হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করলেন অলক্ষণ।
তা পুষ্পকুমার চুপসে যাওয়া গ্যাসবেলুনের মত মুখ করে এগিয়ে পড়ল। মুখ তো খোলা যাবে না। এদিকে বেলা বয়ে যাবার আগে যে তাকে খুঁজে বার করতেই হবে লোকটাকে!
।।২।।
বাড়ির মালিক ডাক্তার বেণুচরণ পোদ্দারের কথা বলাই বাহুল্য।রোজ সকালে কুড়ি বিকালে কুড়ি করে মোট চল্লিশজন রোগী দেখেন বেণুচরণ। যাদের মধ্যে অধিকাংশই এই গঞ্জের বাতিকগ্রস্ত লোক। এদের মধ্যে পল্টু পাল আসেন সবার আগে।যেমন এসেছেন আজ সকালে… 
“কী হে পল্টু, আজ আবার কী হলো?”
“এজ্ঞে, চিত্তশূল!”
“সেকি কথা! পিত্তশূল শুনেছি, তা চিত্তশূল আবার কী হে!”
“আজ্ঞে পরাণ গোঁসাইয়ের মেয়ের বিয়ে আমার ছেলের থেকে বেশী ঘটা করে হয়েছে। সেই থেকেই চিত্তশূল! বড় ব্যাদনা। আপনি কিছু একটা ওষুধ দিন ডাক্তারবাবু।”
নাক থেকে রোলগোল্ডের চশমাটা নামিয়ে শিয়ালপণ্ডিতের ভঙ্গিতে পল্টুকে দেখলেন বেণুচরণ। যাকে বলে অবলোকন করলেন, তারপর খানিক কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন “একটাই ওষুধ আছে, এই গ্রীষ্মের দুপুরে উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে টানা একঘণ্টা উদুম গরম জল মাথায় ঢালো। সব চুল ফরসা হয়ে গিয়ে নরম চাঁদিটা বেরোলে, ওটায়, বিধু গয়লার গোয়ালের রাধারাণীর গোবর লেপে দিয়ে আরো দু-ঘণ্টা বসে থাকো, দেখবে চিত্ত, পিত্ত, বিত্ত সব হু হু করে কুল হয়ে গেছে। মানে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। নেক্সট…” পল্টুর হাঁ করা মুখের উপর দিয়েই বাঘা হাঁক পাড়লেন বেণুচরণ।
কসাই জানা ছিল পরের রোগী। তাবিজ-কবচে তার বড্ড বিশ্বাস!
“ইয়ে ডাক্তারবাবু…”
“আজ কী? কোমরে ব্যথা না অম্ল? নাকি কফ?”
“আজ্ঞে ওসব কিছু না, গ্রহদোষ চলছে, বৌয়ের পেটখারাপ হয়েছে।”
বাঘের মত চোখে ভুরুদুটো জোড়া করলেন ডাক্তারবাবু, “তা তাকে না এনে, তুমি কী মনে করে এখানে এসেছ?”
“আজ্ঞে পতির পুণ্যে…” 
“অ…” সোজা হয়ে বসলেন বেণুচরণ…
“আজ্ঞে, ডাক্তারবাবু, তাইলে… একটা জড়িবুটি কিছু…”
“ওষুধ আছে,… কিন্তু তুমি কী তা পারবে?” 
গভীর চিন্তান্বিত মুখে ঘাড় নাড়লেন বেণুচরণ। তারপর থুতনি চুমরে বললেন, “একটা পাথর, বুঝলে, একটা দশসেরী গ্রানাইট পাথর…”
“গ্রানাইট পাথর!” চোখ গোলগোল করে তাকাল কসাই!
“আজ্ঞে, দশসেরী পাথর, আঙুলে!”
“হ্যাঁ, পাথর, কিন্তু আঙুলে না, পাথরটা ভালো করে দড়ি দিয়ে নিজের গলায় বেঁধে নাও, নিয়ে মা গঙ্গায় ডুব দিয়ে এসো। বুঝলে!ওতেই কাজ হবে। যাও এখন!” চোখ পাকালেন বেণুসরণ!
।।৩।।
“তা, দূরদেশ থেকে এখানে কি মনে করে!”
“আজ্ঞে, আমি লিখি, গাইও। তা শুনেছি কাব্যপুরের এক মানুষ আছেন। অম্লান তাঁর নাম। তিনি নাকি যাদুকর। অনেক বিদ্যে আছে তাঁর। তাঁর কাছে কিছু শেখা যাবে, তাইজন্যেই…”
অবাক চোখে তাকালেন চিতলবাবু। কিন্তু তিনি ঘোড়েল ব্যক্তি! তো, গলায় উদাসী সুর খেলিয়ে বললেন, “অ… এইকথা, তা সে আগে বলতে হয়! কাব্যপুরের কথা জানিনা, তবে ওই হাড়হাভাতে অমুর কথা বলচ তো? 
“আজ্ঞে, হাড়হাভাতে…”
অলক্ষণের বন্ধু চিতলবাবু লোকটি বড়ই ট্যাড়াবেঁকা! সরুচোখে ঠিক সজারুর মতই পুষ্পকুমারের দিকে তাকিয়ে রইলেন চিতলবাবু! ঠিক এমনি সময় তাঁর কানে একটা বেসুরো গান ভেসে এল।
…………………………………………………………………………………………………………………………
কাব্যপুর কি তবে এখানে নয়?  নামটা কেউ জানেই না। পথে কত লোককে জিজ্ঞেস করল পুষ্প। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। রাস্তায় একখানাও লোক নেইকো। কিন্তু সেই হাড়হাভাতে অমুর বাড়িই বা কোথায়? ফাঁকা রাস্তার দুপাশ জুড়ে গাছের ভিড় বাড়ছে, এমন সময় দূরে একটা পোড়োবাড়ির আভাস পেল পুষ্পকুমার। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে সেদিকে কিছুটা এগোতেই সাঁ করে কি একটা কানের পাশ দিয়ে গাছের গুঁড়িতে গিয়ে লাগল। পুষ্পকুমার কাঠ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর খুব আস্তে বাঁদিকে ঘাড় ঘোরাতেই চক্ষু ছানাবড়া। একটা আস্ত কাটারি। 
কী চাস এখানে?
বজ্রগম্ভীর স্বরটা সামনে এগিয়ে আসছে ক্রমশ। টানা টানা চোখ মেলে ভ্যালভেলিয়ে তাকালো পুষ্পকুমার!
লম্বা সাদা দাড়ি বুক অব্ধি নেমেছে। কোটরগত দুখানা চোখ যেন আগুণের ভাঁটা, গায়ে পাঞ্জাবি, পরণে পাজামা। 
“জলদি বল, না হলে ধড়ে আর মাথা থাকবে না!” 
জড়োসড়ো হয়ে একটা পেন্নাম ঠুকলো সে, “পেন্নাম হই খুড়োমশাই। আমি পুষ্পকুমার।”
 “কী কারণে এসেছিস এখানে?”
“আজ্ঞে, আমি এসেছি অম্লানবাবুর কাছে। শুনেছি উনি অনেক যাদু জানেন। উনি মানুষের সব দুঃখ দূর করে দিতে পারেন নিমেষে। আমার বাবা বাণীকুমারের বন্ধু ছিলেন অম্লানবাবু। বাবা চলে গেলেন আর আমিও ভারি আতান্তরে পড়ে গেলাম। বাবা যাবার সময় বলেছিলেন কিছু উপায় করতে না পারলে যেন অম্লান বাবুর খোঁজ করি। তাই…”  
নরম চোখে চাইলেন তিনি। “এই কথা! বোসো এখানে।” বাড়িটার বাইরের চাতালটার দিকে আঙুল তুলে দেখালেন পুষ্পকে। তারপর বললেন, “আমি গুড়-জল আনছি, তুমি বোসো”।
সুড়ুৎ করে দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন ভদ্রলোক। চাতালে বসে নিভন্ত সন্ধ্যায় চারদিকটা দেখে বিশেষ ভরসা হলো না রাগকুমারের। বাড়িটা একেবারেই ভাঙাচোরা। এককালে হয়ত জাঁকজমক ছিল। কিন্তু এখন তার কঙ্কালটুকু আছে কেবল। উপরের দুইমহলা ঘরগুলো ভেঙে পড়বে যে কোনওদিন। আর ঘরগুলো কী অন্ধকার। বাড়ির চারিদিকে নানা ফুল-ফলের গাছ। মনে হয় বাগানটা বেশ সাজানো, কাল সকালে একবার দেখতে হবে। ফুল ভারি ভালোবাসে পুষ্প। 
এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই যেমন হঠাৎ চলে গিয়েছিলেন তেমনই হঠাৎ ফেরত এসেছেন খুড়োমশাই, হাতের সানকিতে ধোঁয়া-ওঠা চা, খানিক গুড় আর জল। কপাকপ সেগুলো উদরস্থ করার পর প্রশ্নটা মাথায় এলো তার। এতক্ষণ খিদেতে চোখে অন্ধকার দেখছিল কিনা। 
 “আজ্ঞে আপনিই কি শ্রী শ্রী…”
“শ্রীযুক্ত না বিযুক্ত, তা জানি না। তবে আমিই অম্লান রায়। আমার ডাকে বাঘ আর গরু একসঙ্গে জল খায়।” 
“আজ্ঞে, আমি আগে বুঝিনি।”
শশব্যস্তে উঠে দাঁড়াল  পুষ্পকুমার। আমার নিবাস অনেক দূরে। ওই পুবপারে। ছেলেপুলেদের পড়াতাম আগে। তাদের নতুন কাব্যির কথা, গানের কথাও, শোনাতাম। আঁকাও শেখাতাম। ছেলেরাও আমায় ভালোবাসত খুব। তা ইস্কুল তো সব বন্ধ হয়ে গেল রোগে-ভোগে। কবে খুলবে কেউ জানে না। এর মধ্যে বাবা অসুখে পড়লেন। মা তো আগেই গিয়েছিলেন। আমরা যে ভাড়াবাড়িতে থাকতুম ভাড়া পড়ল বাকি। একদিন বাড়িওয়ালাও দিল খেদিয়ে!বাপ-মা নেই, স্বজন-বন্ধু কাউকে চিনি না, লেখালিখি মাথায় উঠেছিল। কোথায় যাব, কি করব কিচুই বুঝতে পারছিলুম না, বড় দুঃখে ছিলুম। তখনই আমাদের মেসের পুরোন লোক গৌরের সঙ্গে দেখা। সেই বললে আপনার কথা। আপনি নাকি গুরুকুল খুলেছেন, শিক্ষানবিশ নেবেন।আপনার লেখা কত পড়েছি… আপনি গভীর লোক, আপনার কাছে আছে সুখের সন্ধান! তাই ত দৌড়ে চলে এলাম…”
“হুম, তা তুই কিছুদিন থাক, বাকি তারপরে দেখা যাক…”
“আজ্ঞে, আপনি আমাকে…”
নিতাই সোমের পাকানো চোখ দেখে আর বেশী কিছু বলার সাহস হলো না রাগকুমারের। সে সোমের পিছুপিছু ঢুকে গেল পোড়ো বাড়িটার ভিতর।যার নাম “রত্নকুঞ্জ”।বাইরের বাগানে তখন সন্ধ্যারাতের চাঁদ উঠেছে। বাতাসে শরীর জোড়ানো মৃদু হাওয়া…
।।৪।।
“কোন সন্ধান পেলি?”
“না হুজুর, শঙ্খমণির কোন সন্ধান ওই বুরবাক জানেই না।”
“সে জানার কথাও না”, গোঁফ চুমরে বললেন কুঞ্জসুন্দর, “তবু তুই নজর রাখবি ঝানু!”
……………………………………………………………………………………………………………………………
আজ মাসখানেক হলো নিতাই সোমের বাড়ি আছে রাগকুমার। দিন তার খারাপ কাটছে না।তবে ব্যাপার ভারী অশৈলী!শিক্ষানবিশি বলতে সে একাই। আর তাকে দিয়ে উস্তুম-খুস্তুম কাজ করান নিতাইবাবু।বাগান পরিস্কার, জলতোলা, দুধ আনা, ঘরঝাঁট, এমন কি সময় সময় কড়াইবুড়ির হাত-নুড়কুৎ হয়ে রান্নার এটা-ওটা সাহায্য।তবে কাব্যিকথা বিশেষ হয় না, এই যা দুঃখু। ভয়ে ভয়ে দুবার বলতে গিয়েছিল, দুবারই বিরাশিশিক্কার ধমক খেয়ে ফিরেছে।নিতাই সোম পরিস্কার জানিয়েছেন, তাড়াহুড়ো করলে এখানকার থাকা-খাওয়া সব উঠবে। তা এসব তার অভ্যেস আছে। গরীব মায়ের ছেলে।বাপ ত কবেই চলে গেছেন।সেই থেকেই লড়াই। তবু ভালো কড়াইবুড়ি ছিল। নাহলে ত হাত পুড়িয়ে খেতেও হত তাকে। 
বেশ মানুষ এই কড়াইবুড়ি। বয়স নাকি একশ-আট।এই বয়সে একলা কাঠ কুড়োয়, রাঁধে-বাড়ে, খায়-দায়। সবচেয়ে বড় কথা, অমন বাঘের মত নিতাই সোমকে বিন্দুমাত্র ভয় পায় না।তার নাকি দুঃসম্পর্কের মাসী সে।“রত্নকুঞ্জে”র থেকে দশ-পা দূরে বুড়ির ঘর। যতদিন রাগকুমার এসেছে, এই কড়াইবুড়ির কাছেই তার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন নিতাই সোম। উনি নিজে কখনো খেতে আসেন না বুড়ির কাছে। সত্যি বলতে কি উনি কখন খান, কখন শুতে যান, সারাদিন কি করেন, এ সবকিছুই রহস্য রাগকুমারের কাছে। কেবল দিনের আলো পড়লেই বাগানে ওনার কাছে ডাক পড়ে।সেখানে কাজ হল রোজ নতুন একখানা করে গাছ চেনা।বাগানটাকে যে কি ভালোবাসেন নিতাইবাবু, অথচ বাগানের একটা কাজও নিজে করেন না।সারাসকাল রাগকুমার বাগানে কাজ খাটে, আর সারাসন্ধ্যা তার সারাদিনের খতিয়ান নেন নিতাই সোম। 
“তা ছেলে, আজ কি খেলে?”
“আজ্ঞে বকা, কেস, মারধোরটাও হত, কিন্তু…” সরল মনে বলল রাগকুমার।
“তুমি ত বেকুব শিরোমণি, ক্যামনে পাবে শঙ্খমণি?”
“শঙ্খমণি?”,অবাক প্রশ্নটাতেই বাঘ হয়ে উঠলেন নিতাই!
“কে বলছিল ঝানুর সাথে কথা? পিঠে পড়লে, বুঝবে ব্যথা!” 
হ্যাঁ, আজ ঝানু পাল এসে কড়াইবুড়ির বাড়ির দরজায় তার সাথে বকছিল বটে! ঝানু পালকে চিনতে বেশী সময় লাগেনি রাগকুমারের। গঞ্জের বিচ্ছিরি বড়লোক কুঞ্জসুন্দরের, যাকে বলে ডানহাত।তাকে যে চটানো যাবে না, সেকথা কি করে বোঝানো যাবে নিতাইবাবুকে! তাছাড়া সে এসে মাঝেমাঝেই খোঁজ নেয় রাগকুমারের, সে কেমন আছে, কার কাছে খাচ্ছে, কি করছে, এইসব। কড়াইবুড়ি অবশ্য তাকে দেখলেই গাল পাড়ে! আর হ্যাঁ, নিতাই সোমের কথা ঝানুর কাছে বলতে কড়াইবুড়ি কড়া করে নিষেধ করেছে! তাই ত রাগকুমার চুপচাপই থাকে, তাতেও এত হ্যাটা! বলি, দাবিটা কি!
আর আজকের গাছটাও তেমনি।কৃষ্ণচূড়া গাছ আবার চেনার কি আছে বলো দেখি! এসে ইস্তক কেবল গাছ আর বাগান! উফ, এই নাকি কাব্যের শিক্ষানবিশি, এর চেয়ে হিমালয়ে গিয়ে সাধু হওয়া ঢের ভালো ছিল!হাতের হ্যারিকেনটা তুলে ধরল বিরক্ত রাগকুমার।আর ঠিক তখনই, “ওরে ওরে, ফেল ত দেখি আলো, করছে ঝলমলো”… “কি, কোথায়!” হইচই করতেই আবার ধমক! “চুপ কর, চারদিকে আছে চর!” নিতাই সোমকে অনুসরণ করে আস্তে আস্তে বাগানের উত্তর-পূর্ব কোণে গিয়ে দাঁড়াল রাগকুমার। একটা গাছ, নতুন নাকি!একমাস ধরে এই বাগান পরিস্কার করছে, এ গাছ ত দেখেনি!পানপাতার মত বড় বড় পাতা, ঝাউগাছের মত একহারা উপরে উঠে গেছে, হাত-দুই লম্বা, আর উপরে ওটা কি?আরে কুঁড়ি ত! চাঁদের আলো পড়ে সাদা কুঁড়িটা ঝকঝক করছে!“দুধের মত সাদা!” বিগলিত হয়ে বলে ফেলে রাগকুমার, আর এই প্রথম মিঠে সুরে কথা বললেন নিতাই সোম, “ঠিক, দুধে কি থাকে বলত…”
“আজ্ঞে, আমি জানি না, তবে ঝাঁটুগোয়ালা জানবে, কাল সকালে…!” 
“ওরে কুটকুটে কপোতাক্ষ!দুধে রস থাকে!কাল মাঝরাতে এইখানে আসবি। কাল পূর্ণিমা, তোর শিক্ষা পূর্ণ হবে, তুই সুখের সন্ধান পাবি!”
“কি শিক্ষা, কিভাবে পূর্ণ হবে কিছুই বুঝল না রাগকুমার, নামে রাগ থাকলেও আসল রাগপ্রধান ত এই নিতাইবুড়ো, গজগজ করতে করতে নিজের মনে রত্নকুঞ্জের দোতলায় নিজের ঘরে ঘুমোতে গেল রাগকুমার।রাগের চোটে খেয়ালই করল না, নিতাই সোম পদ্য ছেড়ে গদ্যে কথা কইছেন।
।।৪।।
জ্যৈষ্ঠ্যসন্ধ্যার চাঁদ উঠেছে বাগানে। সত্যি একমাসে বাগানটাকে একদম অন্যরকম করে ফেলেছে রাগকুমার।এক্কেরে, যাকে বলে ফাস্টোকেলাস! “রাগকুমার!” নাম ধরে ডাকছেন নিতাইকবি! গুটিপায়ে এগিয়ে গেল রাগকুমার। “আয় এখানে!” উত্তর-পূর্ব কোণের গাছটার দিকে গিয়ে অবাক হয়ে গেল রাগকুমার! একদিনে কুঁড়িটা এতবড় হয়ে উঠেছে!
“শোন বলি, আজ থেকে ঠিক চব্বিশ বছর পূর্বে এই পরাণগঞ্জের নাম ছিল সপ্তসুরপুর। এ ছিল ভারী চমৎকার জায়গা। গাছে গাছে বানর, মাঠে মাঠে দস্যি ছেলেপিলে, ঘরে ঘরে লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের দল।সকালে উঠে সবাই রাগসাধনা করত। গান-বাজনা কবিতার পালা বসত প্রতিসপ্তাহে। আমার বাপ-মাও ছিল তারমধ্যে।কিন্তু, সে বেশীদিন রইল না। সবাই দলে দলে শহরের দিকে গেল।সেখানে অনেক টাকা…” 
“তার সাথে টাক, পুরো ফ্রি, যাকে বলে…” স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কথাখানা বলেই জিভ কাটল রাগকুমার, এইরে!” কিন্তু না, একবার ভস্মকারী চাউনি দিয়ে, আবার শুরু করলেন নিতাই সোম।
“এই সপ্তসুরপুর তার দিশে হারালো।তার নাম তারপর কে যেন দিন পরাণগঞ্জ। বাবা-জ্যেঠা-কাকারা চলে গেলেন। পড়ে রইলাম মা আর আমি। তাও লেখায় কিছু নামডাক হওয়ায় আমার দিন চলে যেত। তেমন অভাব হয়নি। এমনসময় মা পড়ল অসুখে। যখন বুঝলাম কিছু করার নেই, তখন মনখারাপ করে এই বাগানে এসে মায়ের পাশে বসে থাকতাম। তখনই মা আমার হাতে শঙ্খমণি গাছের বীজ দিয়েছিল।মায়েরই নির্দেশমত এই বীজ বাগানের উত্তর–পূর্ব কোণে পুঁতে দিয়েছিলাম। মা বলেছিল, এই গাছে একযুগ, মানে বারো বছরে একবার ফুল হবে। শঙ্খমণি ফুল, আর তখনই গাছটা দেখা যাবে।যে ফুল পাবে, সে হবে অমিত ঐশ্বর্য্যের অধিকারী।
“গুপ্তধন?” মাথা নাড়লেন নিতাইবাবু।
বারোবছর অপেক্ষা করেছি, যখন ফুল তোলার সময় এলো, ঠিক তখনই… ওই কুঞ্জসুন্দর আমায় আক্রমণ করল গুপ্তধনের লোভে। আর…”
“তারপর…” অধৈর্য্য গলায় জিজ্ঞেস করল।
“ওই কাদাখোঁচার বাচ্চা ঝানু ছিল আমার চাকর।ও-ই গিয়ে লাগাল কুঞ্জসুন্দরকে, সে তখন সদ্য গঞ্জে এসেছে। ব্যস। আমার আর পাওয়া হলো না শঙ্খমণি!কিন্তু মাতৃদায়, কারোর না কারোর হাতে তুলে দিতেই হবে এই ফুল, নাহলে আমার এই ল্যাজেগোবরে অবস্থা থেকে মুক্তি নেইকো।মা-ই বলেছিল উত্তরাধিকারী আসবেই!তোল ঐ কুঁড়ি।”
ভেবলু বালকের মত রাগকুমার ফুলটা তুলতেই সেটা তার সাত-পাপড়ি মেলল। আর সঙ্গে সঙ্গে কেউ যেন ধাক্কা দিল রাগকুমারকে। সে বুঝতে পারছে সবকিছু, অনুভব করতে পারছে, প্রত্যেকটি গাছ, প্রাণ। সুর-কাব্যের ঢেউ খেলছে মনের ভেতর। সে এক উথাল-পাথাল অবস্থা। 
“ওরে, গোবরমুখো পুতেরা জানত না, শঙ্খমণি হলো জ্ঞানপুষ্প, তার মূল্য হলো চৈতন্য, কোন সাধারণ রত্ন বা অর্থ নয়।জেনে রাখ রাগকুমার, প্রত্যেক গঞ্জে, শহরে, দেশে এইরকম জ্ঞানপুষ্প থাকে, কিন্তু আসল মানুষের অভাবে, মাটির অভাবে তা ফুটতে পায় না।সেখানেই আছে প্রকৃত সুখের সন্ধান। আজ থেকে আবার সপ্তসুরপুর তার পুরোন গৌরব ফিরে পাবে!এই একমাসের কৃচ্ছসাধন ছিল তোর রেওয়াজ।তুই এখানে পাঠশাল খুলবি, কাব্যি-গান, জ্ঞান-বিজ্ঞানে বড় করবি ছেলেপিলেদের।সময় হলে এই জ্ঞানপুষ্প তুলে দিবি যোগ্য লোকের হাতে, বুঝলি নিড়বিড়েটা?”
চোখের সামনেই বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছেন নিতাই সোম।“সেদিন আমার মাথায় লাঠি মেরে ওরা আমার প্রাণটা নিয়েছিল, কিন্তু আত্মাটা আটকে ছিল রে!”
এসব শুনে অন্যসময় হলে ভিরমি যেত রাগকুমার, কিন্তু এখন কেন কে জানে একটুও ভয় খেল না সে, যাকে বলে অকুতোভয় হয়ে সে বলল, “কিন্তু, কিন্তু আমি যে শুনেছিলুম, এখানে এক সুখী লোক আছেন, যিনি কিনা অমর, যাঁর দেখা পেলে সব দুঃখ ঘুচে যাবে?কিন্তু আপনি ত… তাহলে,…”
“জলাতঙ্ক, ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস!ওরে ছাগলের পুত! সে আছে, পোদ্দারবাড়িতে! তার গান শুনিসনি!”
“সেই বেসুরো গান! হ্যাঁ, পোদ্দারবাড়িতে, শুনেছিলুম গো!”
“ওরে গোশালা! সেই ত একমাত্র লোক রে, যার জন্য এই গাছ আজো বেঁচে আছে, সে সব জানে! ওই গাছে ত ওই পাগলই জল দেয়, সার দেয়! শোন রে বোকাহাঁদা, সত্যিকারের সুখী লোকের পুনর্জন্ম হয় ত, তাই ত সুখী লোক অমর, আমার কাজ শেষ, এরপরের কাজ ঐ বিন্দুসরণের। ও ত পোদ্দারবাড়ির সন্নিসীরে, টাকা নেই, পয়সা নেই, খেলা নেই, মেলা নেই, নিজের বেসুরো গান নিয়েই দিব্যি আছে। ওই দ্যাখ, সে আসছে!ওই যে সুখীর উদাহরণ, ওর কাছে যা, আমার ছুটি হয়েছে, মাটির কাব্য আমার শেষ, এবার আকাশের দেশে যাবার পালা।”
জোড়হাতে অবাক আকাশপানে একটা পেন্নাম ঠুকল রাগকুমার।দূর থেকে তখন গান শোনা যাচ্ছে,
“যেথায় আছে শুধু ভালো বাসাবাসি, সেথা যেতে প্রাণ চায় মা…”






বর্ণচোরা
সহেলী রায়

না না মিকির সমস্যাটা ঠিক সেই ম্যাজিক পেন্সিলের গল্পের মতো একেবারেই নয়। সেখানে তো যাদু পেন্সিলে যা আঁকা হোত, তাই প্রাণ পেত। মিকির কাছে এমন কোন পেন্সিল মোটেই নেই। তার অন্য একটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। সে রঙ ছিনিয়ে নিতে পারে। প্রাকৃতিক যেকোন রঙ। এই যেমন গাছের পাতার সবুজ, টমেটোর  লাল, বেগুনের বেগুনী , নদীর শ্যাওলা সবুজ অথবা নীল এমন অনেক কিছুই। এই রঙগুলো প্রকৃতি থেকে নিয়ে সে নানারকম শিশিতে পুরে রাখে। প্রয়োজনমতো ব্যবহার করে তার আঁকার খাতায়। মিকির আঁকা ছবিগুলো তাই ভীষণ প্রাণবন্ত। দেখে বিশ্বাসই করা যায় না, ওগুলো হাতে আঁকা। তাও আবার মাত্র ন’ বছর বয়সী ছোট্ট ছেলের।      
 
ঘটনাটি প্রথম ধরা পড়ে যখন মিকির তিন বছর হ’ব হ’ব বয়স। শীতকালে নরম রোদে চাটাই পেতে মিকির মা মিকিকে ছাদের উপর বসিয়ে দেয় কিছু সাদাপাতা আর পেন্সিল দিয়ে, খোসা ছাড়িয়ে কমলালেবুর  কোঁয়াগুলো একটা ছোট্ট বাটিতে তার সামনে রাখেন। মিকিকে এভাবে ব্যস্ত রেখে রোদে মেলা জামাকাপড়গুলো ওলটপালোট  করতে থাকেন উনি। খানিক পরে মিকির কাছে ফিরে এসে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে  পারেন না যেন। সাদা পাতা জুড়ে মিকি একটা গোল কমলালেবু এঁকেছে শুধু তাই নয়, আঁকাটিতে হুবহু কমলালেবুর খোসার রঙ। অথচ মিকির কাছে কোন রঙ পেন্সিলই নেই। লেবুর ছবিটি  যেন ক্যামেরায় তোলা আসল লেবু। মিকির জলের বোতলে কিছুটা কমলা রঙ পড়েছিল। কিন্তু এই রঙ এল কোথা থেকে? লেবুর  খোসাগুলো তেমন করেই পড়ে আছে। মিকির মা খুব ভয় পেয়ে যান। ঘটনাটি যখন মিকির বাবাকে তাঁর অফিসে টেলিফোন করে জানানো হয় উনিও নীরব থাকেন। কিছু যেন গোপন করার ইঙ্গিত থাকে সে নীরবতায়। 
  
অফিস থেকে ফিরে বিপ্লববাবু অর্থাৎ মিকির বাবা সবটা দেখে শুনে ভারি গম্ভীর হয়ে যান। মিকির মাকে বলেন, এখনই কাউকে বিষয়টা না জানাতে। দিনে দিনে আঁকার প্রতি মিকির একটা ঝোঁক তৈরি হয়। সাদা  কাগজ পেলেই সে আঁকতে বসে যায়। যা আঁকে সবই রাঙিয়ে ফেলে প্রাকৃতিক রঙে। গাছের পাতার সবুজ প্রয়োজন হলে সে বাগানে চলে যায়। একবার একটি ছোট্ট হলুদ পাখি তাদের ঘরে কীভাবে যেন ঢুকে পড়ে।  মিকি তাকে কৌশলে ধরে পুরনো জুতোর বাক্সে খাবার, জল দিয়ে বশ করে ফেলে। পাখিটি ড্রইং খাতায় এঁকে তার গায়ের হলুদ রঙটি বসিয়ে দেয় খাতায়। একটা শিশির প্রায় আধ শিশি এই হলুদ রঙ ধরে রেখেছিল মিকি। তারপর পাখিটাকে উড়িয়ে দিয়েছিল আকাশে। বিপ্লববাবু আর মিকির মা অনেকদিন বিষয়টি লুকিয়ে রাখলেন।  তারপর একদিন মিকিকে নিয়ে ছাদে গেলেন বিপ্লববাবু। খুলে দিলেন ছাদের একটা ঘর। ঘরভর্তি নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস। পুরনো রেডিও, টিভি, নানারকম তার, ব্যাটারি, শিশি বোতল, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার অ্যাপারেটাস, অবুবীক্ষণ যন্ত্র, নানারকম পাউডার কী নেই সেই ঘরে। মিকির দাদু অধীরবাবু খুব বড়ো বিজ্ঞানী  ছিলেন। এই ঘরটা তাঁরই। মিকিকে উনি দেখে যেতে পারেননি। আকস্মিক একটা দুর্ঘটনায় উনি চলে যান পৃথিবী ছেড়ে। মিকিকে বিপ্লববাবু ঘরটি দেখিয়ে বলেন, ‘এই ঘরটি এখন থেকে তোমার, যখনই আঁকতে ইচ্ছে  করবে এই ঘরে এসে আঁকবে’। ক্যানভাস, আঁকার কাগজ, পেন্সিল সব এনে দেন বিপ্লববাবু। দাদুর রাখা  শিশিগুলোই মিকির সবসময়ের সঙ্গী এখন। সময় পেলেই সে শিশিগুলো নিয়ে বাগানে, পুকুরে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। বাবা বাজার আনলে সব্জীপাতি এনে জড়ো করে ছাদের ঘরে। পরিবারের সঙ্গে সমুদ্রে বা পাহাড়ে বেড়াতে গেলেও মিকি শিশিগুলো নিতে ভোলে না।    
 

২)
জড় হোক বা জীব, সবকিছু থেকেই মিকির রঙ প্রস্তুত করার পদ্ধতিটি বড়োই বিস্ময়কর। মিকি তার ছোট্ট হাত দিয়ে বস্তুটিকে চেপে ধরে আর শিশিগুলো তার গায়ে আটকে দেয়। একটু একটু করে রঙ চুইয়ে জমা হতে থাকে শিশিতে। বিকেলবেলা দারুণ বৃষ্টি হয়ে গেল। কালো মেঘ কেটে একটু একটু করে আলো ফুটছে। মিকির মা ছাদে এসে চমকে গেলেন। আকাশে ঘন নীল মেঘের উপর কেউ যেন সূর্যটাকে ডিমের কুসুমের মতো ঘেঁটে দিয়েছে। এদিক ওদিক মেঘের কালো কালো ছোপ আকাশ জুড়ে। অদ্ভুত মায়াবী দৃশ্য। মিকি ছাদের কার্নিশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে। তার এক হাত আকাশের দিকে পেতে রয়েছে, অন্য হাতে খোলা শিশি। বৃষ্টির ফোঁটার মতো টুপ টুপ করে আকাশী, কমলা, কালো রঙগুলি রামধনুর মতো পর পর সেজেগুজে জমা  হচ্ছে শিশিতে। এমন একটি স্বর্গীয় দৃশ্য দেখে মিকির মায়ের পা আটকে গেল। বিপ্লববাবু সবটা শুনে ছাদের  ঘরে এসে দেখেন মিকি ক্যানভাসে মস্ত আকাশ এঁকেছে। সেই আকশে ঠিক মিকির মা যেমন বর্ণনা করেছিলেন তেমনই রঙের বাহার। উনি আবারও মিকির মাকে সাবধান করেন মিকির এই ক্ষমতার কথা  যেন কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে। মিকি এমনিতে স্বভাবে ভারি শান্ত। স্কুলে দু’ একটি বন্ধু থাকলেও বেশির  ভাগ সময় সে শুধুই শ্রোতা। তাও তাকে বিপ্লববাবু বুঝিয়ে বললেন মিকি যদি কাউকে জানায় এই রঙগুলোর   কথা তবে হয়তো আর এমনি করে রঙেরা তার কাছে ধরা দেবে না। তাই মিকিও সবসময় সজাগ থাকে। প্রাকৃতিক রঙ  শিশি বন্দী করতে তার খুব ভালো লাগে। স্কুলে তার আঁকা দারুণ প্রশংসা পায়। শিশি করে রঙ নিয়ে যায় সে। সকলেই জানে তার বিজ্ঞানী দাদু এসব ভেষজ রঙ তার জন্য তৈরি করে রেখেছিলেন। প্রতিটি ছবি সম্পূর্ণ হওয়ার পর সকলেই অবাক হয়ে যায়, যেন ক্যামেরায় তোলা আসল বস্তুর স্থিরচিত্র।    
‘আমি একটা কথা ভাবছিলাম জানো। মিকির এই রঙ বানানোর ব্যাপাটা সকলেরই জানা উচিৎ। ও এমন একজন আশ্চর্য শিশু, সারা পৃথিবীর জানা উচিৎ সেটা। তাছাড়া কীভাবে এটা সম্ভব হচ্ছে তারও তো একটা যুক্তি পেতে হবে। বাবা থাকলে নাহয় নানা বিজ্ঞানীমহলে জানিয়ে একটা উপায় বের করতেন’। 
মিকির মায়ের প্রস্তাব শুনে শিউড়ে উঠলেন বিপ্লববাবু।
‘একেবারেই না। ছাদের ঘরে কাজ করতে করতে একটা বিস্ফোরণের শব্দ পেয়েছিলাম মাত্র। দরজা ভেঙে যখন ঢুকলাম যত্রতত্র বাবার শরীরের অংশ ছড়িয়েছিল। ডাক্তার বললেন কোন রাসায়নিক পরীক্ষা করতে গিয়ে বিস্ফোরণটি ঘটে। উনি আরও একটা কথা বলেছিলেন। বেশ কিছু বডি পার্টস মিসিং ছিল। মা কথাটা সহ্য করতে পারবেন না বলে বাড়ির কাউকেই আমি বলিনি, সমস্তটা একটা থলিতে ভরে সাদা কাপড়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছিল।  কিন্তু সেদিন থেকে দারুণ অস্বস্তিতে আছি। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। আজ পর্যন্ত সেই রহস্যের কোন কুলকিনারা করতে পারিনি। এরপর মিকির এই বিষয়টা জানাজানি হলে যদি ওর কোন বিপদ হয়?’  
মিকির মাও খুব ভয় পেয়ে গেলেন। মিকির দাদু মারা যাওয়ার পর মিকির ঠাকুরমা একপ্রকার নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলেছেন। কারও সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলেন না। আজ মিকি ঠাকুরমার ঘরে বসেই ছবি আঁকছে। উনি খুব মন দিয়ে দেখছেন মিকিকে। মিকি রঙবেরঙের কিছু পাথরের ছবি আঁকছে। যে পাথরগুলো ঠাকুরমার ঘরে শোকেসে রাখা আছে। পেন্সিল স্কেচ সম্পূর্ণ হতেই মিকি শোকেসের কাচ সরিয়ে পাথরগুলো বের করতে গেল। পাথরের রঙগুলো প্রয়োজন তার। বেশ কিছু ছোট শিশি সে সাজিয়ে রেখেছে মেঝেতে।  
‘ওগুলো হাত দিও না দাদুভাই!’  
মিকির ঠাকুরমা আর্তনাদ করে উঠলেন। মিকি চমকে গেল। এভাবে ঠাম্মি কখনোই কিছু বলেননি। চেঁচামেচি শুনে মিকির বাবা মা দৌড়ে এলেন। ঠাকুরমা বেশ হাঁপাচ্ছেন। মিকির মা ওঁর পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত হতে বললেন। মিকিকে নিজের ঘরে যেতে বললেন। মিকির তখন চোখ ফেটে জল আসছে।    
‘আমার কাছে একবার এসো দাদুভাই। ওই পাথরগুলো ভালো নয়। তোমার বিপদ হতে পারে সোনা’। 
বিপ্লবাবু তার মায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। পাথরগুলো মায়ের ঘরে অনেকদিন ধরেই সাজানো। বাবা কোথাও থেকে এনে দিয়েছিলেন সম্ভবত।  
‘কী বিপদ হবে মা? বলো আমাদের’। 
‘তোর বাবা ক’দিন খুব অস্বস্তিতে ছিলেন। সারাদিন সারারাত ছাদের ঘরেই কাটাতেন। খালি বলতেন আর সময় নেই। প্রায় দু’দিন ওপর থেকে নামলেনই না। এক ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি উনি ঘরে এসেছেন। আমার হাতে কয়েকটা পাথর দিয়ে বললেন, উনি নাকি দু’দিন বাড়িতেই ছিলেন না। অথচ কেউ তো তাঁকে কোথাও যেতে দেখেননি। ফিরেই বা এলেন কীভাবে? যেখানে গিয়েছিলেন পাথরগুলো সেখানকারই। খুব সাবধানে রাখি যেন। কারো হাতে যেন না পড়ে। উনি নিজেই ওই শোকেসে ঢুকিয়ে রাখেন। এর কিছুদিন পরেই উনি চলে গেলেন’।  
বিপ্লববাবু যা আশঙ্কা করেছিলেন সেটাই ঘটেছে। অধীরবাবু চলে যাওয়ার পেছনে কিছু একটা ভয়ঙ্কর কারণ আছে। মিকির ঠাকুরমা একটু শান্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন ।    
‘মিকি যেদিন হল, নার্সিংহোমে ওর  বেবিকটে দেখলাম ওর হাতে দু’টো ছোট হুবহু পাথর ধরা আছে। আমি  খুব ভয় পেয়ে যাই। পাথরগুলো সকলের অলক্ষ্যে সরিয়ে এনে ওই শোকেসেই রেখে দিই। দিন দু’য়েক পরে, আমার রেডিওটা হঠাৎ আপনাআপনি বেজে ওঠে। অনেক দূর থেকে কেউ যেন কিছু বলার চেষ্টা করছে’।   
মিকির মা মিকিকে কোলের ভেতর চেপে ধরে আছে। বিপ্লববাবুর পা কাঁপছে। 
‘তারপর?’ 
‘তোর বাবার গলা। বললেন উনি এখন একটি উপগ্রহে আছেন। ছাদের ঘরে একটা ডাইরির কথা বললেন। তারপর রেডিওটা থেমে গেল।’ 
‘কী ছিল ডাইরিটায়?’ 
বিপ্লববাবু উত্তেজিত হয়ে আছেন। 
‘ওই উপগ্রহের এলিয়নরা তোর বাবাকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সঙ্কেত পাঠিয়েছিল। তোর বাবাকে ওরা ওখানে নিয়ে যেতে চায় কারণ তোর বাবার মস্তিষ্ক নাকি বিরল যা ওদের গবেষণায় প্রয়োজন। দু’দিনের জন্য যখন নিয়ে গিয়েছিল তখন ওরা এই পাথরগুলো দেয়, পাথরগুলো ছুঁলে জাগতিক যেকোন রঙের সঙ্গে সরাসরি যোগস্থাপন ঘটবে। পাথর স্পর্শ করা প্রাণীটি ইচ্ছেমত যেকোন রঙ শিশি বা বোতলে সংরক্ষণ করতে পারবে। ফিরে আসার পর তোর বাবা যেতে চাননি আর। সেই শাস্তিই পেয়েছেন উনি’।      
মিকির ঠাকুরমা চোখে জল ধরে রাখতে পারছেন না। 
‘আমিও পারি মিকির মতো যেকোন কিছু থেকে রঙ নির্যাস করতে। পাথর দু’টো আমিও ধরেছিলাম যে। মিকির হাতে পাথরগুলো দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম তোর বাবাকে নিয়ে যাওয়ার মূল্য ওরা দিয়ে গেছে মিকির হাতে। পাথরগুলো দেখলে আমার ভীষণ ভয় হয় আবার মনে হয় তোর বাবা ওই পাথরের দেশেই কোথাও অন্য আকার ধারণ করে বেঁচে আছেন’।  
বিপ্লববাবু সোজা হয়ে বসলেন। মিকির ছোট্ট হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলেন মিকির দাদুকে। বর্ণচোরা মিকিকে জনগণের সামনে নিয়ে আসবেন নাকি বাবার মতো ওও নিজে একদিন গবেষণা করে খুঁজে দিতে পারবে আরও কিছু তথ্য। ভীষণ দোলাচলে বিপ্লববাবু ।   
মিকি ছাদের ঘরে ক্যানভাসে সাদা পাতায় আঁচড় কাটছে। দেওয়ালে টাঙানো দাদুর ছবিটা দেখে আঁকছে দাদুকে। দাদুর গায়ের রঙটা তার ভীষণ প্রয়োজন। এলিয়নরা কি ওর বন্ধু হবে? একবার কি দাদুকে নিয়ে আসবে ওর কাছে? ছুঁয়ে দেখবে একবার দাদুকে মিকি।   
ঘর জুড়ে একটা ঠান্ডা হাওয়ার চাদর উড়ছে। মিকির রঙের শিশিগুলোতে হাল্কা কম্পনের শব্দ। চওড়া একটা ছায়া নেমে আসছে। দূরের আকাছে মেঘ কেটে রাস্তা বানাচ্ছে যেন কারা।

পূজা এলো পূজা গেলো
পীযূষ প্রতিহার

পূজা এলো পূজা এলো
লক্ষ্মী এলো, দুর্গা এলো,
সরস্বতী, গনেশ এলো
কার্তিক ভাই সঙ্গে এলো।

শিবঠাকুরও লুকিয়ে এলো
পূজা হলো, মজা হলো,
ঢাক-ঢোল-কাঁসর গুলো 
নানা বাদ্যে মাতিয়ে দিলো।

পূজা এলো পূজা গেলো
পূজার আমেজ ফুরিয়ে গেলো,
আসাও হলো, যাওয়াও হলো
শুরুও হলো, শেষও হলো।


রাজার বাড়ি
জয়ন্তী মন্ডল

 
বাবার মুখে কত গল্প শোনে টুপুর।রাজার বাড়ি, রাণী সায়র, গোলাপ বাগ! যেন রূপকথার গল্প! বাবা বলেন, তখন রাজা রানি গোলাপ বাগে বিকেলে হওয়া খেতে যেতেন। তাও নাকি পানসি চেপে। 
বাপরে! শুনলেই কেমন অবাক লাগে টুপুরের! টুপুর আবদারের সুরে বলে, বাবা এবার কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে রাজার বাড়ি দেখতে যাব। বাবা বলেন, রাজার বাড়িটাই তো এখন  কলেজ। তুমি যখন বড় হয়ে  কলেজে পড়বে তখন তুমি একাই রাজার বাড়ি যেতে পারবে।
বারান্দার জানালার কাছে গালে হাত দিয়ে আনমনে বসে বসে এসব কথা ভাবছিল টুপুর। কবে যে ও বড় হবে! এখন তো সবে ক্লাস ফাইভ।
চিঠি….!
বিশু কাকার ডাকে টুপুরের চমক ভাঙলো। পিওন বিশু কাকার হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে টুপুর দৌড় দিল দোরের দিকে। ঠাকুমা সুধাময়ী বললেন, কার চিঠি এসেছে টুপুর?
টুপুর মাথার দুদিকে বিনুনি দুলিয়ে বলল, বাবার। ঠাকুমা কাছে এসে বসে বললেন, কি লিখেছে পড়ে শোনাও তো দিদি। টুপুর দাওয়ায় চেয়ারটাই বসে পুরো চিঠিখানা পড়ে শেষের বাক্যটা একটু বেশি  জোরে পড়ল, 'মা আগামী মাসে আমি ছুটি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। গিয়ে মাঠে ধান কাটার ব্যবস্থা করব।  চিন্তা করো না। আর টুপুরের জন্য একটা লেডিস সাইকেল কিনেছি। ওটাও সঙ্গে নিয়ে যাবো।' চিঠিটা পড়া শেষ করেই টুপুর লাফাতে লাগল।
সুধাময়ী বললেন, শশী তোমার জন্য সাইকেল এনেই ছাড়ল তবে।
এক মাস পর শশীকান্তকে নতুন সাইকেল নিয়ে বাড়ি আসতে দেখে টুপুরের মা সরযূর মাথায় হাত! সত্যি সত্যি উনি সাইকেল আনলেন! এমনিতে সারাদিনে মেয়ের টিকি পাওয়া যায় না।
তারপর  জুটল সাইকেল!
অনুযোগের সুরে বললেন, উনি তো বাসে ওঠা মাত্র টুপুর পড়াশোনা সব শিকেয় তুলে সাইকেল নিয়ে উড়ে বেড়াবে এ পাড়া ও পাড়া।টুপুর অবশ্য মায়ের  কথায় তেমন গা করে না। মা বক বক করল তো ভারী বয়েই গেল। মা দুটো কথা শুরু করল কি টুপুর টুক করে সাইকেল খানা নিয়ে চুপি চুপি সেই যে বেরিয়ে যায়। টুপুরকে খুঁজতে গিয়ে চণ্ডীটাও হয় বেপাত্তা।
ব্যস। হাটে যাওয়া, মাঠে মজুরদের খাবার নিয়ে যাওয়া একপ্রকার লাটেই ওঠে সেদিন। চন্ডীকে খুঁজতে গিয়ে সমুর সকালের পড়ার দফারফা। সরযু রাগ করে বলে, চণ্ডীটাকে এ বছর ছাড়িয়েই দেবো ভাবছি। শশীকান্ত থানার বড়বাবু। মেয়ের জন্য শখ করে একটা না হয় সাইকেল কিনে দিয়েছে। সুধাময়ী এতে  ছেলের দোষের কিছু দেখতে পায় না।
সরযুর শাশুড়িমার ওপর কথা বলার নিয়ম নেই। তাই নিজের মনেই বলেন, এবার আসুক টুপুরের বাবা। তারপর এর একটা বিহীত না করে ছাড়ছি না। এক মাস পর শশীকান্তর চিঠি এলো।
চিঠিতে লিখেছেন, ' মা এ মাসে আমি  বাড়ি যেতে পারবো না। থানার কাজে একটু বাইরে যেতে হচ্ছে।'

বাবার চিঠিখানা পড়তে পড়তে মুচকি হেসে টুপুর নিজের মনে নিজেকেই বলল, চমৎকার! 
চিঠি পড়তে পড়তে টুপুরের হাসি  হাসি মুখখানা দেখে সুধাময়ী  বললেন, হাসির কী হলো টুপুর।
টুপুর আবার এক গাল হেসে বলল কিচ্ছু না।


                             ২

সক্কাল বেলায় সরযূ রান্নাঘরে উনুনে চায়ের জল চাপিয়ে ডাকল, টুপুর! এত বেলা পর্যন্ত ঘুমুলে চলবে। মাস্টার মশায়ের পড়াটা কে করবে শুনি।
টুপুর এর কোনো সাড়া নেই।
মেয়ের কোনো রা নেই দেখে সরযূ সরজমিনে দেখতে এল মেয়েকে।
কোথায় টুপুর!
টুপুর তো তখন সরকার পুকুর, ক্যানেল পোল, খুশিগঞ্জের মোড় পেরিয়ে কাঁকুরে পথ ধরেছে। 
সাইকেল ছুটছে না ঘোড়া ছুটছে বোঝা ভার।
শ্যামপুরের মোড়ে টুপুর কে সাইকেল নিয়ে যেতে দেখে জনা কয়েক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এতটুকু মেয়ে! কোথায় চললে একা একা?
টুপুর মুখে কুলুপ। নাম ধাম বলে বিপদে পড়ুক আর কি!
মায়ের কানে খবর গেলে চন্ডী কাকু কান ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে যাবে।
তারপর মায়ের হাতে দমাদম পিটুনি। মাটি হয়ে যাবে রাজার বাড়ি দেখাটা।
কাজেই টুপুর চুপ।
উ! আবার কে ডাকে? 
সাইকেল থেকে নেমে ঘুরে দাঁড়াল টুপুর। দ্যাখে এক বুড়ি মানুষ টুপুরকে ডাকছে।
কাছে গিয়ে টুপুর বলল, আমার হাতে সময় নেই ঠাকুমা। কি বলার তাড়াতাড়ি বলে ফেলো।
বুড়ি বলল, হাটে যাচ্ছ খুকি?
খুকি! শুনেই ভ্রূ কচকালো টুপুর। তারপর বলল, আমি খুকি নই। এখন কী বলবে  বলো।
বুড়ি বলল আমার জন্যে ক'টা বাতাসা এনে দেবে? গোপালকে জল বাতাসা দেবো।
টুপুর হ্যাঁ বলতেই বুড়ি হাত বাড়িয়ে টুপুর এর হাতে পঞ্চাশ পয়সা দিল।
 টুপুর কাঁধে ঝোলা ব্যাগে পয়সাটা রেখে সাইকেলটায় উঠে বসল।
টুপুরের সাইকেল  তো নয় যেন পঙ্খীরাজ ঘোড়া। শো শো করে টুপুর করে পেরিয়ে গেল বুড়ো শিবের মন্দির, বেড়াচাঁপার দরগা।
হাটতলায় পৌছে টুপুর খই মুড়ির দোকানের কাছে সাইকেল থেকে নেমে পঞ্চাশ পয়সার বাতাসা কিনল। বাতাসার ঠোঙ্গাটা কাধেঁর ব্যাগে পুরে আবার চলল সাইকেলে। হাটতলা পেরিয়ে বড় রাস্তায় পড়তেই টুপুর দেখে একটা ভ্যান গাড়ি। তাতে চেপে আছে অনেকগুলো স্কুলের ছেলেমেয়ে।
ছেলেমেয়ে গুলো কল কল করে কথা বলছে। টুপুর কে দেখে তারা সব চুপ করে গেল।
টুপুর বুঝতে পারল ওকেই সকলে দেখছে।
ভ্যানওলা টুপুরকে বলল, কোথায় যাবে খুকি?
টুপুর বলল,শহরে।
তুমি একাই যাবে?
টুপুর গম্ভীর হয়ে বলল হ্যাঁ।
টুপুর ভ্যানের ভেতরে ছেলেমেয়ে  গুলোকে আড়চোখে দেখে  ভ্যানওলা কে ছাড়িয়ে এগিয়ে চলল।
শহরের কাছাকাছি আসতেই লোকের আনাগোনা, মোটর সাইকেলের হর্ন শুনে টুপুর বুঝল কাছেই শহর। এবার টুপুর ওর সাইকেলের গতি কমিয়ে সাইকেল থেকে নেমে পথ চলতি একটা লোককে জিজ্ঞেস করল রাজার বাড়িটা কতদূর বলতে পারো?
লোকটা বলল, সোজা রাস্তা ধরে গিয়ে যেখানে ডাইনে বাঁক পাবে সেখান থেকে কিছুটা গেলেই রাজার বাড়ি। 

টুপুর যখন রাজার বাড়ি এসে পৌঁছল সূর্য তখন মাথার উপর।
অবাক হয়ে দেখছিল টুপুর। হুঁশ ফিরলো একটা দিদির ডাকে।
কাকে খুঁজছো খুকি?
-কাউকে না।
-তবে এখানে দাঁড়িয়ে যে?
-রাজার বাড়ি দেখছি।
দিদিটা বলল, আগে এখানে  রাজা, রানী তাদের  লোক লস্কর সব থাকতো। এখন এটা কলেজ।
টুপুর বলল আর গোলাপবাগ?
দিদিটা বলল, তোমার সঙ্গে তো দেখছি একটা পুঁচকে সাইকেল আছে। অসুবিধে হবে না। 
রানী সায়রের পাড় ধরে সোজা চলে যাও। গোলাপ বাগ দেখতে পাবে। গোলাপ ফুলের বাগান।
টুপুর গোলাপ বাগে পৌঁছে দেখে বড় বড় দাদা দিদিরা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে একটা বড় লোহার গেট পেরিয়ে ভেতরে চলেছে।
কেউ কেউ টুপুর কে একবার করে দেখছে। টুপুর ওদের তাকানো কে তেমন গুরুত্ব দিল না। এগিয়ে বড় লোহার গেটখানা পেরিয়ে টুপুর হতবাক! দেখল একটা ছোট্ট টিলা। সেই টিলার গা বেয়ে  কত গোলাপ গাছ। তাতে কত রঙের যে গোলাপ ফুল ফুটে আছে!
দু'পা বাড়িয়েছে। ওমা!
সামনে একটা পরিখা।
পার হব কি করে?
পরিখা পার হবার কোনো সাঁকো বা রাস্তা টুপুর এর চোখে পড়ল না।
শুধু জলে ভাসছে একটা পানসি। তাতে কোন লোক নেই।
পরিখা আর গোলাপ বাগানের দিকে তাকিয়ে কতক্ষণ যে টুপুরের কেটে গেল খেয়াল নেই। বড় বড় দাদা দিদিরা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। হুঁশ ফিরল টুপুরের। 
ওকেও বাড়ি ফিরতে হবে। ব্যাগটা সাইকেলের হ্যান্ডেল থেকে কাঁধে নিয়ে সাইকেলটাই চেপে
আর কোথাও দাঁড়াল না। 
শুধু একবার হাটতলা পেরিয়ে পথের ধারে বুড়ি ঠাকুমাকে বাতাসা গুলো দিয়ে বাড়ির পথ ধরল।
টুপুর যখন গাঁয়ে পৌঁছল তখন গোটা গাঁ ভেঙ্গে পড়েছে টুপুরকে দেখতে। টুপুরই মাথায়, মুখে জল দিয়ে মা সরযূর জ্ঞান ফেরালো।
পরদিন সকালবেলা  ঠাকুমা সুধাময়ী সমুকে দিয়ে চিঠি লিখলেন, ' বাবা শশীকান্ত। খুব শীঘ্র বাড়ি এসো।  টুপুর এর জন্য আনা নতুন সাইকেল খানা দোকানে ফিরিয়ে নিয়ে যেও। সাইকেল আসা অবধি আমাদের বড়ই কাজ বেড়েছে সেই সঙ্গে চিন্তাও। নইলে টুপুর কে তোমার কাছে বর্ধমানে নিয়ে গিয়ে রেখো। তোমার সঙ্গে গিয়ে প্রতিদিন রাজার বাড়ি আর রাজার বাগান দেখতে পাবে।'

শরৎকাল
---সন্দীপন রায়

এইযে তোমার শিউলি ভোর আর মাঠের সাদা কাশ।
মন ভোলানো পদ্মফুলের পুকুর ভরা চাষ।
তুমিই শরৎকাল।

এইযে তোমার নীল আকাশে সাদা ছেঁড়া মেঘ।
মন ছুটে যায় এদিক ওদিক বাঁধন ছেঁড়া বেগ।
তুমিই শরৎকাল।

এইযে তুমি অন্যরকম দিলখোলা বোলচাল।
ভাদ্র আর আশ্বিনে তাই তুমিই শরৎকাল।


মাছেদের সিঁড়ি 

মলয় সরকার 

'গল্পের গরু গাছে ওঠে' এ কথাটা আমি তো ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি।তোমরাও নিশ্চয়ই এতদিনে অবশ্যই শুনেছ।তবে কি দিয়ে ওঠে, কেমন করে ওঠে, সে তথ্যটা স্বচক্ষে তো দেখা হয়ই নি, বই ঘেঁটেও কোথাও পাই নি। তোমাদের কারোর জানা থাকলে আমাকে অবশ্যই জানিও।

তবে বলি, গরুর ব্যাপারটা সঠিক না জানলেও আর একটা ব্যাপার কিন্তু আমি জানি, দেখেওছি নিজের চোখেই।আর নিজের চোখে দেখা জিনিসকে তো আর আজগুবি বা গালগল্প বলে অবিশ্বাস করতে পারি না। যাই হোক, কি দেখেছি বলছি। তোমরা যদি চাও তো, তোমাদেরও হদিশ দিতে পারি কোথায় গেলে তোমরাও নিজের চোখে দেখে আসতে পারবে সেই আজব জিনিস।

যে আজব জিনিসের কথা বলছি, তা হল, গরু না উঠুক মাছ যে সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে উঠছে, এমন দেখেছ বা শুনেছ কখনও?অবশ্য গ্রামের লোকেরা অনেকে কইমাছকে কানকো দিয়ে হেঁটে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বা ছোট গাছের গোড়ায় উঠতে হয়ত  দেখেছেন।সেটা অবশ্য অন্য ব্যাপার। তবে যারা অনেক পড়াশোনা কর, বা ঘুরে বেড়াও দেশ বিদেশ, তারা হয়ত দেখে বা শুনে থাকলেও থাকতে পার।আমি বলতে বসেছি তাদের জন্য, যারা শোনেনি বা দেখেনি এসব।

সেবারে বেড়াতে গিয়েছি, আমেরিকার ওয়াশিংটন প্রদেশের সিয়াটেল শহরে। সেখানে এক জায়গায় গিয়েছি, যার নাম ব্যালার্ড লক বা Ballard lock যার আসল নাম Hiram M. Chittenden locks।  এটি সেইখানে, যেখানে এসে মিশছে ওয়াশিংটন লেক ও স্যামন উপসাগর। স্যামন উপসাগরে আছে নোনা জল আর ওয়াশিংটন লেকে আছে মিষ্টি জল। দুটো এসে মিশেছে ঠিক এই জায়গায়। 

এখানে দুটি অদ্ভুত জিনিস দেখা যায়। ফলে দর্শক বা পর্যটকের ভিড়ও এখানে যথেষ্টই হয়।

প্রথমটা হল, যাঁরা পানামা খাল দেখেন নি, তাঁরা এখানে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে নিতে পারেন।পানামাতে প্রশান্ত মহাসাগরের আর আটলাণ্টিক মহাসাগরকে মেশানো হয়েছে কৃত্রিম ভাবে।কিন্তু সেখানে দুই মহাসাগরের জলের উচ্চতার তফাত প্রায় ২৬ মিটার।সেটাকে বিশেষ ব্যবস্থা করে লক গেট দিয়ে জলের উচ্চতা সমান করে তবে জাহাজকে একদিক থেকে আর এক দিকে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
এখানেও অর্থাৎ ব্যালার্ড লকেও দু দিকে জলের উচ্চতার তফাত আছে এবং সে উচ্চতার তফাত প্রায় ২.৭ মি. বা ৮.৮ ফুট। এখানেও ছোট আকারে এই লক গেট ব্যবস্থা করে লঞ্চ, স্পীড বোট বা ছোট ছোট জাহাজকে জলের উচ্চতা সমান করে তবে একদিক থেকে আর এক দিকে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। দেখার মত জিনিস।

আর দ্বিতীয়টি হল, মাছেদের সিঁড়ি, হ্যাঁ যেটির কথা বলতে বসেছি।

মাছেদের ভিতর কয়েক ধরণের মাছ আছে যাদের জীবনচর্যা বড় অদ্ভুত ধরণের।অবশ্য পৃথিবীতে বহু আশ্চর্য প্রাণী আছে,  যাদের ধরণ ধারণ জীবনযাত্রা ভীষণই অদ্ভুত।সে যাক গে, এই যে ধরণের মাছেদের কথা বলতে বসেছি, তার মধ্যে প্রধানতঃ দুটি ভাগ ,একটিকে বলে ক্যাটাড্রোমাস (Catadromous) এবং অপরটি এনাড্রোমাস(Anadromous)।

প্রথমটি হল তারা, যারা সাগরে জন্মায় কিন্তু থাকে মিষ্টি জলে, আবার ডিম দেওয়ার সময় ফেরত যায় সাগরের নোনা জলে।এই দলে আছে ঈল মাছ ইত্যাদি।
আর দ্বিতীয়রা হল ঠিক উলটো।তারা মিষ্টি জলে জন্মায়, সারা জীবন সাগরে থাকে কিন্তু ডিম দিতে আসে মিষ্টি জলে।এই দলে আছে স্যামন, ব্যাস ইত্যাদিরা।আমাদের চেনা মাছ ইলিশও এই দলে পড়ে।
আমি আপাততঃ এই দ্বিতীয় দলের কথা বলব।মাছেদের ডিম দেওয়ার সময়, নিয়ম সব আলাদা আলাদা। তার মধ্যে আটলাণ্টিক স্যামনরা, প্রায় ৯০ শতাংশই, একবার ডিম দিয়েই মরে যায়।যদি কেউ বাঁচে তাহলে দুই বা তিনবার দিতেও পারে। এছাড়াও আরও অনেক ধরণের স্যামন আছে , যেমন কোহো স্যামন, সকাই স্যামন ইত্যাদি।

এবার আসল কথায় আসি।দেখা গেছে প্রায় এই স্যামনগুলো জন্মায় খুব অগভীর ঝরণা বা ছোট খাট নদীর উৎসমুখে।সেখানে একটা মা স্যামন এসে ডিম দিল এবং ওখানেই মরে গেল।সেই ডিম থেকে যে স্যামন বাচ্চারা বের হল, তারা চলে যেতে থাকল নদীর প্রবাহ ধরে সমুদ্রে।সারা জীবন সে কাটাল বহুদূরের সমুদ্রের নোনা জলে।এই দূরত্ব ৬০-১০০ মাইলও হতে পারে। সেই বাচ্চারা বড় হয়ে যখন ডিম দেওয়ার উপযুক্ত হয়, সে চলতে থাকে উলটো মুখে, তার জন্মস্থান যে অগভীর জলে, ঝরণার মুখে, সেখানে।এই রাস্তা সে কি করে খুঁজে পায়, বা সে সঠিক জায়গায় কি করে ফিরে আসে বিজ্ঞানীরা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন নি। পরিযায়ী পাখীদের গল্পও অনেকটা একই রকম।

এই ফিরে আসার পথে তাকে চলতে হয় নদীর প্রবাহের গতিমুখের বিপরীতে। এবার ধর, নামার সময় ঝরণা অনেক সময়ই পাহাড় থেকে দুরন্ত গতিতে নামে, হয়ত ২৫-৩০ কি মি বেগে।মাছকেও তখন তার বিপরীতে এগিয়ে চলতে তার থেকেও বেশি শক্তিতে এগোতে হয়।তাহলে কত শক্তি তাকে দিতে হয় ভাব।

এবার মনে কর, নামার সময় ঝরণা বড় বড় পাথরে পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে নেমেছে।তাহলে মাছকে সেই উলটোপথে পাথর টপকে যেতে গেলে, লাফিয়ে সেই পাথরের উপর দিয়ে যেতে হবে উপরের ধাপে। এর জন্য সে যে লাফ দেয়, অনেক সময় সেই এক লাফে পেরোতে পারে না।ফলে, যতক্ষণ না সে পাথরটা পেরোতে পারবে, লাফ দিতেই থাকে বার বার।একসময় হয়ত সফলও হয়।তবে এটা সম্ভব হয় না যদি সেই বাধার উচ্চতা অনেক বেশি হয়, যা সে কখনই পেরোতে পারবে না।আবার প্রকৃতির নিয়মে অনেক সময় বুদ্ধিমান ভালুক বা কোন শিকারী ওৎ পেতে বসে থাকে এই সব জায়গায়।মাছ লাফালেই খপ করে ধরে খেয়ে ফেলে।সে বেচারী আর জন্মস্থানে পৌঁছাতে পারে না।তার জায়গায় সে পৌঁছে যায় শিকারীর পেটে।মানুষও জাল ফেলে অনেক সময়ই এই মাছ ধরে ফেলে।যেমন, আমরা যে ডিমভরা ইলিশ বাজার থেকে কিনি, সে বেচারীও ডিম পাড়তেই মিষ্টি জলে যাচ্ছিল।কিন্তু দুর্ভাগ্য, জেলের জালে ধরা পড়ে আমাদের পেটে চলে এল। এখন, দুর্ভাগ্যটা ওর না আমাদের, সেটা ভাবতে হবে।কারণ, একটা ইলিশ মাছের পেটে কত ডিম থাকে! তার থেকে, সব না হলেও অনেক মাছ হতে পারত।কিন্তু আমরা তাকে আগেই মেরে ফেলে ভবিষ্যত মাছের বংশবৃদ্ধি নষ্ট করে দিলাম।ক্ষতি আসলে আমাদেরই হল।

যাক, এই রকম ভাবেই প্রকৃতিতেও সব মাছই সঠিক জায়গায় পৌঁছায় না।তার মধ্যে যারা শেষপর্যন্ত পৌঁছায়, তারাই ডিম দিতে পারে, সেই জন্মস্থানে পৌঁছে।সাগরের অত গভীর নোনা জলে যার বাস, সে দৈহিক কি রকম পরিবর্তন করে ফেলে যাতে এত অগভীর এবং মিষ্টি জলে সে বেঁচে থাকতে পারে, বিজ্ঞানীদের কাছে এটা আশ্চর্য ব্যাপার।

এই ভাবে কিছু জায়গা, মানুষ নিজে খুঁজে পেয়ে চিহ্নিত করেছে প্রকৃতির বুকে, যেখানে মাছ নিজেরা লাফিয়ে লাফিয়ে পাথর ডিঙোচ্ছে, পরিষ্কার দেখা যায়। যেমনটি রয়েছে আমেরিকার গ্রানাইট ফলসে বা অলিম্পিক ন্যাশনাল পার্কের কিছু জায়গায়। এছাড়া মানুষ এই সময়ে মাছের যাতায়াতের পথ লক্ষ্য করে বিভিন্ন জায়গায় সুন্দর ভাবে বানিয়েছে মাছেদের জন্য উপযুক্ত  সিঁড়ি।এদের বলা হয় Fish ladder। এই সিঁড়ি তৈরীর কতকগুলি বিশেষত্ব আছে।সেখানে জলের গতি এত বেশী হওয়া চলবে না যে, মাছকেই তা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আবার একেবারে না হলেও চলবে না।
ওদিকে আবার বাধাটি এত উঁচু না হয় যাতে মাছ লাফিয়ে যেতে পারবে না। এই সমস্ত নানাবিধ ব্যাপার মাথায় রেখে সারা পৃথিবীতেই বিভিন্ন ড্যাম বা জলপ্রবাহের উপর এই মাছেদের জন্য সিঁড়ি তৈরী হয়েছে। যেমন ওরেগনে কলম্বিয়া নদীর উপর Bonneville Damএ, কিংবা জার্মানীতে  Elbe নদীর উপর, আর  আমি যেখানকার কথা বলছি, সেই সিয়াটেল এর ব্যালার্ড লক এ।এছাড়া আরও অনেকই আছে।যেখানে যেখানে এই Fish ladder আছে, সেখানে এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখার জন্য প্রায়ই অজস্র মানুষ ভিড় করেন। আবার দেখার সুবিধার জন্য বা উপভোগের জন্য রাস্তাটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বড় করা হয়।মাছের এই ফিরতি যাত্রাপথও  অনেক ক্ষেত্রেই ৯০-১০০ কি মি ও হতে পারে।

এই মাছেদের লাফিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আবার সব সময় হয় না। যখন যে মাছেদের ডিম দেওয়ার সময় হয়, তাদের এই পিছন দিকে যাত্রাপথে গমনের সময়েই কেবল তা দেখা যায়।সাধারণতঃ স্যামন মাছের ক্ষেত্রে (স্যামন আবার, যেহেতু অনেক রকম আছে, তাদের ডিম দেওয়ার সময়ও অল্পবিস্তর আলাদা।) তবে মোটামুটি আগষ্ট - অক্টোবর কি নভেম্বর মাসের সময়ে ভালই দেখা যায়।

এবার ফিরে আসি,  সিয়াটেলে ব্যালার্ড লকএ কি দেখেছি।এখানে লক গেট এর একপাশ দিয়ে যাতায়াত করছে বিশেষ ব্যবস্থায়, লঞ্চ জাহাজ,  স্পীড বোটেরা।পাশেই রয়েছে সব জল আটকে বিরাট স্লুইস গেট। স্লুইস গেটের একপাশে জল অনেক উঁচুতে, আর এক পাশে অনেক নীচুতে।সেই নীচু জলে ঘোরা ফেরা করছে বেশ কিছু সী লায়ন, যাদের কাজই হল ওই স্যামন মাছ খাওয়া। স্যামনরা ছুটে আসে নীচু নোনা জলের থেকে মিষ্টি জলের দিকে।আর সেইখানে ওত পেতে বসে আছে ওই সী লায়নরা। তাদের হাত ফসকে স্যামনরা যেতে চেষ্টা করে উঁচু মিষ্টি জলের দিকে।সে জন্য একটি পথ করা আছে।তাতে অনেক ধাপের সিঁড়ি আছে।আর সেই সিঁড়ি বেয়ে জল নামছে নীচের দিকে। কাজেই স্যামনরাও যেতে চেষ্টা করছে উপর দিকে।ফলে তাকে উঠতে হচ্ছে ওই সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে।

এখানে আর একটি মজার ব্যাপার করা আছে।তা হল, ওই যে মাছেদের রাস্তা, তার একটা দেওয়াল পুরু কাঁচের। ফলে তার পাশ থেকে পরিষ্কার দেখা যায়, বিশাল বিশাল স্যামনরা ঝাঁকে ঝাঁকে চলেছে, একেবারে ঠিক জীবন্ত একোয়ারিয়ামের মত।সেটি দেখার জন্য একটি গ্যালারী ওয়ালা ঘরও আছে।আরাম করে বসে যতক্ষণ খুশী মাছেদের সাথে সময় কাটানো যায়।

আমি একটি জায়গায় গিয়েছিলাম, অলিম্পিক ন্যাশনাল পার্কে।সেখানে একটু ছোট ঝরণাকে চিহ্নিত করা আছে, স্যামনের জন্মস্থান বলে।কাছে গিয়ে দেখি, ঝরণার জল বয়ে চলেছে, যার গভীরতা কয়েক ইঞ্চির মত, সির সির করে ধীর গতিতে।আর সেই ঝরণার মুখে গাদা গাদা বড় ছোট স্যামন।কেউ মরে গেছে, কেউ খাবি খাচ্ছে, আর কেউ আরও জল ঠেলে এগোনোর চেষ্টা করছে।দেখে আশ্চর্য লাগল।এই সেই স্যামন, যে ঘুরে বেড়াত কোন মহাসাগরে প্রশান্ত কি আটলান্টিকে, সে আজ আমার চোখের সামনে এতটুকু জলে, যেখানে তার পিঠও ডোবে না, সেখানেই চলে এসেছে শেষ যাত্রায়, শেষবারের মত জন্মস্থান দেখে যেতে।আজ ওর শক্তি নেই, গতি নেই, জীবনের সবটুকু দিয়ে  বংশধারাকে বাঁচিয়ে রাখার মহান কর্তব্য করতে ছুটে এসেছে।চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে অজস্র শিশু স্যামন। যারা আর অল্প সময়ের পরেই যাত্রা করবে বংশাবলীর ধারা বজায় রাখতে সেই মহাসাগরের পথে।

প্রকৃতির কি বিচিত্র ব্যবস্থা।


          লক গেটে পেরোচ্ছে স্যামন মাছেরা


 
পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments