জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৪৮/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৪৮

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

কাশীপুর উদ্যানবাটীতে ঠাকুরের সেবার কাজে নিয়োজিত হলেন গোপাল-দা সহ অন্যান্য ত্যাগী ভক্তেরা। অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি ছিলেন বলে গোপালদা-র সুশৃঙ্খল সেবাকার্য ঠাকুরের খুব পছন্দ ছিল। এটা জানা যায় যে ঠাকুরকে ওষুধ খাওয়াবার দায়িত্ব ছিল গোপালদা'র উপর। এছাড়া আরও অন্যান্য কাজ ছিল। ফলে একনাগাড়ে পরিশ্রম হত তখন। একদিন ওষুধ দেওয়ার সময় পেরিয়ে গিয়েছে দেখে শ্রীশ্রীঠাকুর খোঁজ করলেন তাঁর --“সেই বুড়ো লোকটা কোথায়?” গোপালদা ঘুমোচ্ছেন শুনে ঠাকুর বেশ আনন্দসহকারে অপর একজনকে বললেন,“আহা, কত রাত জেগেছে! একটু ঘুমুক -- তাকে আর জাগিও না। তুমি বরং ওষুধটা ঢেলে দাও।” ঠাকুর জানতেন গোপালদা-র এই অনুপস্থিতির কারণ। শ্রীশ্রীমা গোপালদা’র সঙ্গে নিঃসঙ্কোচে কথা বলতেন। ফলে পথ্য প্রস্তুতের পদ্ধতি শিখে নিয়ে তিনি আবার সেটি শ্রীশ্রীমা'কে শিখিয়ে দিতেন। নিমজল দিয়ে নিত্য ঠাকুরের গলার ক্ষত পরিষ্কার করতে হত। সযত্নে এবং অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গ এই কাজটি করতেন গোপালদা। একদিন ক্ষত পরিষ্কার করবার সময় ঠাকুর ব্যথা পেয়ে উঃ! উঃ! করে ওঠেন। স্বভাবতই গোপালদা বিচলিত হয়ে পড়েন, ঠাকুরের ব্যথা পাওয়া তাঁর পক্ষে সহ্য করা সম্ভব ছিল না। তিনি বললেন, “থাক, আর ধোয়াব না।” ঠাকুর তখন বললেন, “না, না, তুমি ধুইয়ে দাও। এই দেখ আমার আর কোন কষ্ট হচ্ছে না।” এই বলে নিজের মন দেহ থেকে তুলে নিলেন। এরপর মুখ থেকে কোনও শব্দও আর বের হল না, কিংবা মুখবিকৃতির  ঘটনাও ঘটল না। অবতার লীলায় সবই সম্ভব! 
 শ্রীরামকৃষ্ণ এক অদ্ভুত নির্মাতা ছিলেন। মার্কিন সাহিত্যিক ক্রিস্টোফার ইশারউড যথার্থই লিখছেন --‘ Ramakrishna movement is unique because its founder was unique.’ তাঁর প্রতিটি সন্ন্যাসী সন্তানের জীবন ও ভাবনার মৌলিকত্বও বিশেষভাবে লক্ষ্য করার। এবারের লীলায় ভগবানের সপার্ষদ আগমন ও এই ধরাধামে বিচরণ এক অভাবনীয় ঘটনা। পবিত্র অধ্যাত্মভূমি ভারতবর্ষের মহিমা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সমগ্র জগতকে তা কম্বুকণ্ঠে জানালেন তাঁর সুযোগ্য ও প্রধান সন্ন্যাসী সন্তান নরেন্দ্রনাথ তথা স্বামী বিবেকানন্দ। এই নরেন্দ্রনাথকে নিয়েই এক কাণ্ড ঘটল কাশীপুরে। এখানে তিনি একবার নির্বিকল্প সমাধিতে ডুবে গেলেন, তাঁর দেহে মৃতের লক্ষণ প্রকাশ পেল। এমন অবস্থা পরিদর্শনে দিশেহারা হয়ে গোপালদা ঠাকুরের কাছে ছুটে গিয়ে জানালেন যে নরেন মরে গেছে। বিস্তারিত শুনে ঠাকুর বলেছিলেন, “বেশ হয়েছে। এখন ঐভাবে কিছুক্ষণ থাক। আমায় সমাধির জন্য বড় জ্বালিয়েছিল।” ( শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা, স্বামী গম্ভীরানন্দ ) সমাধির শেষে বাহ্যজ্ঞান ফিরলেও নরেন্দ্রনাথের দেহজ্ঞান ফিরতে বিশেষ বিলম্ব হয়েছিল। পাশের জনদের উদ্দেশ্যে উচ্চৈঃস্বরে বলেছিলেন যে তাঁর দেহ কোথায়, কারণ দেহ খুঁজে পাচ্ছিলেন না!
 কাশীপুর উদ্যানবাটীর দিনগুলি প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীলাটু মহারাজ এক জায়গায় বলছেন -- “ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে হামাদের কাশীপুর যেতে হলো। (শ্রীশ্রী )মা'ও গেলেন। সেখানে লোরেনভাই, রাখালভাই, শরোটভাই, শশীভাই, (বুড়ো ) গোপালদাদা, ছোট গোপাল, নিরঞ্জনভাই, কালীভাই, বাবুরামভাই -- এরা সব বাড়ী ছেড়ে রয়ে গেলো। আর রামবাবু, সুরেন্দর বাবু, মাষ্টারমশায়, বলরাম বাবু, গিরিশ বাবু, কালী বাবু -- এনারা সব খরচ খরচা করতে লাগলেন। সুরিন্দর বাবু বাড়ীভাড়া দিতেন, বলরামবাবু ঠাকুরের পথ্য দিতেন, রামবাবু হামাদের সব খরচখরচা দিতেন। একদিন টাকাপয়সার হিসেব রাখা নিয়ে কথা উঠলো। লোরেন ভাই বললে, ‘এত হিসেব রাখারাখি কেন? এখানে কেউ ত চুরি করতে আসে নি?’ বাকী হামনে বললুম, ‘তবু একটা হিসেব রাখা ভালো।’ হামার কথা রাখাল ভাই মেনে নিলো। গোপাল দাদার ওপোর হিসেব রাখার ভার পড়লো।” (শ্রীশ্রীলাটু মহারাজের স্মৃতিকথা, চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায় )
 ঠাকুরের ভক্ত বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল কথিত কাশীপুরের দিনগুলির প্রসঙ্গটি এইরকম -- “সন্ধ্যাবেলা ভাতের পায়েস আনা হলে তিনি আমায় বললেন --‘আমায় বসিয়ে দাও; বসে বসে আমার খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।’ ঠাকুরের ইচ্ছামত আমরা কয়জনে মিলিয়া তাঁহাকে বসাইয়া দিলাম। আমাদের মধ্যে লাটু ও বুড়োগোপাল দাদা ছিল। নরেন্দ্রনাথকে ঠাকুর ইঙ্গিতে জানাইলেন --‘ওদের বিছানাটা ঝেড়ে দিতে বল।’ তাহা শুনিয়া নরেন্দ্রনাথ একটা কি বললেন; তাহাতে ঠাকুর জানাইলেন -- ‘ভাত যে রে!’ নরেন্দ্রনাথ তাহা শুনিয়া বলেন, ‘আপনি ত বিধিনিষেধের পার।’ ঠাকুর তখন নরেন্দ্রনাথকে ইঙ্গিতে বুঝাইলেন -- ‘ওরে, ব্রাহ্মণশরীর যে রে! এটার ব্রাহ্মণ-সংস্কার যাবার নয়।’ ইতোমধ্যে লাটু ও বুড়োগোপাল দাদা ঠাকুরের বিছানা ঝাড়িয়া দিয়াছিল। ঠাকুর তখন আঙ্গুলে করিয়া একটু পায়েস মুখে দিলেন। তারপর বললেন --‘ভিতরে এত ক্ষিধে যে হাঁড়ি হাঁড়ি ডাল ভাত খেতে আমার ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু মহামায়া কিছুই খেতে দিচ্ছেন না’।”  ( শ্রীশ্রী লাটু মহারাজের স্মৃতিকথা, চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায় )
 বস্তুতপক্ষে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে প্রবল সেবার মাধ্যমে এই ধরাধামে ঠাকুরের প্রত্যক্ষ অস্তিত্ব বজায় রাখবার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন শ্রীশ্রীমা এবং তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গ ত্যাগী ও গৃহী ভক্তেরা। বুড়ো গোপাল দাদার ভূমিকা যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাশীপুরে ঘটা আরেকটি ঘটনা বিষয়ে বলেছিলেন শ্রীশ্রীমা। এই বিষয়ে স্বামী বিমলাত্মানন্দজী লিখছেন --“জয়রামবাটিতে পুরাতনবাড়ি। শ্রীশ্রীমা ওখানে আছেন। দুটি ভক্ত সুরেন্দ্রনাথ ভৌমিক ও ডাঃ দুর্গাপদ ঘোষ এসেছেন শ্রীশ্রীমায়ের দর্শনে। তাঁরা শ্রীশ্রীমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন, আর উত্তর দিচ্ছেন শ্রীশ্রীমা। এক সময় সুরেনবাবু তাঁকে বললেন -- ’মা, ধ্যান-ট্যান তো হয় না।’ এর জবাবে শ্রীশ্রীমা কাশীপুর বাগানের প্রসঙ্গ টেনে আনলেনঃ ‘তা নাই বা হলো। ঠাকুরের ছবি দেখলেই হবে।’ ঠাকুরের তখন অসুখ, কাশীপুরে। ছেলেরা পালা করে থাকত। তখন গোপাল রয়েছে ( বুড়ো গোপালদা )। ঠাকুরকে ফেলে সে গিয়ে ধ্যান করতে বসেছে। অনেকক্ষণ ধ্যান করছে। গিরিশবাবু এসে শুনে  বললেন,' চোখ বুজে যার ধ্যান করছে তিনি  এখানে রোগশয্যায় পড়ে কষ্ট পাচ্ছেন, আর ও কি না ধ্যান করতে গেল!’ গোপালকে ডেকে পাঠালেন। ঠাকুর তাকে পা টিপে দিতে বললেন। বললেন, ‘পায়ে ব্যথা হয়েছে বলে টিপতে বলছি কি? তা নয়, তোর অনেক করা ছিল ( জন্মান্তরে ), তাই।’
 এরপর শ্রীশ্রীমা বললেন সুরেনবাবুকে --‘ওঁকে দেখবে, তাহলেই হবে’।” ( শ্রীশ্রীমায়ের কাশীপুরলীলা, স্বামী বিমলাত্মানন্দ, শারদীয়া সমাজশিক্ষা )
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments