জ্বলদর্চি

বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা-চরিত্রের গতিধারা /প্রসূন কাঞ্জিলাল

বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা-চরিত্রের গতিধারা

প্রসূন কাঞ্জিলাল



[ গোড়ার কথা : -----
সাহিত্যের অন্যান্য ধারার মাঝে গোয়েন্দা কাহিনীর গল্প-উপন্যাসগুলোও শুরু থেকেই এক স্বতন্ত্র মহিমায় উজ্জ্বল --- সব বয়সী পাঠক-পাঠিকা তথা দর্শক ( চিত্রায়িত কাহিনীর ক্ষেত্রে ) -দের কাছে এর ব্যপক জনপ্রিয়তাই তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এই রচনাতে চেষ্টা করেছি, একদম শুরুরও শুরু থেকে,  আমজনতার মনে অনুভূত জীবন্ত রক্ত-মাংসের চরিত্র হয়ে ওঠা বাংলাভাষী গোয়েন্দা চরিত্রগুলোকে কালানুক্রমে  কর্মকাণ্ডের এক সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তৈরী করতে। আর তাই, পৌরাণিক উপাখ্যান বাদ দিলে, আধুনিক কালের গোয়েন্দা কাহিনীর উৎপত্তি ও ভিত্তি খুঁজতে গিয়ে শুরুতে ফিরে চাইতে হয়েছে এই বিষয়ে পাশ্চাত্য সাহিত্যের দিকে।  চেষ্টা করেছি এই রচনাকে যতটা সম্ভব তথ্যনির্ভর করে তোলার। রচনায় প্রধানত স্থান পেয়েছে সেই সব চরিত্রগুলোই, যাদেরকে বাঙালি সাহিত্য প্রেমীরা এক ডাকে চেনে ; যদিও সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্য যথেষ্ট দক্ষতার সাথে জন্ম দিয়ে চলেছে আরও নতুন নতুন গোয়েন্দাদের। ]

 
গোয়েন্দা গল্প বা ডিটেকটিভ গল্পের প্রাণ হল বুদ্ধির খেলা। শাণিতবুদ্ধি অপরাধীর দুষ্কর্মে থাকে চাতুর্য। তারচেয়ে বেশি বুদ্ধি ধরেন গোয়েন্দা। তার বলেই তিনি কার্যকারণ, পরিস্থিতি আর ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষণ করে শনাক্ত করেন অপরাধীকে। গোয়েন্দা গল্প ভালো লাগে না এমন মানুষ খুব কম। রহস্য - যা সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না তার দিকে দেশ-জাতি নির্বিশেষে মানুষের স্বাভাবিক টান। রোমাঞ্চ—তথা শিহরন জাগানো ভয় সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। এ দুয়ের মিশেলে গোয়েন্দা গল্প হয়ে ওঠে আকর্ষনীয় । তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ব্যক্তিগত বা সামাজিক ক্ষতির দিকটিও। ব্যক্তি-নিরাপত্তা আর সামাজিক সুস্থিতি নষ্ট করে অপরাধী। তাকে ধরা এবং শাস্তির সম্ভাবনায় পূরণ হয় এসব ক্ষতি। এর সঙ্গে তৃপ্ত হয় মানবমনের অতলনিহিত ন্যায়বোধ। এমন করেই গোয়েন্দা গল্প হয়ে ওঠে বিশিষ্ট এক সাহিত্য।
🍂
অপরাধের রকমফের থাকে চুরি-ডাকাতি-জালিয়াতি থেকে খুন-জখম --- বুদ্ধিদীপ্ত বঞ্চনা থেকে পেশিশক্তির আস্ফালন --- সব ধরনের দুষ্কর্মই হতে পারে গোয়েন্দা গল্পের বিষয়। তবে অপরাধটি সবসময়েই হবে রহস্যে ঢাকা। অপরাধী কে --- বোঝা যাবে না সহজে। গোয়েন্দার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, যুক্তিসম্মত অনুমানশক্তি আর বিশ্লেষণ-নিপুণতায় চিহ্নিত হবে অপরাধী। এ ধরনের গল্পের মূল চরিত্র দুটি–অপরাধী আর তদন্তকারী গোয়েন্দা। পার্শ্বচরিত্র এক বা একাধিক অপরাধের বলি ব্যক্তি, পরিবার বা সংস্থা। এরাই সাধারণত নিয়োগ করে গোয়েন্দা। 
ফারসি 'গোইন্দদহ' থেকে উদ্ভূত শব্দটির অভিধান গত অর্থ গোপনে সন্ধানকারী। সে অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়। পুলিশের ভূমিকা এসব গল্পে সাধারণত লঘু। অবশ্য দুষ্কৃতীকে পাকড়াও করে আইন মোতাবেক শাস্তি দেওয়ার জন্য পুলিশের শরণ নিতেই হয়। দুষ্কর্মকারীকে চিনিয়ে দেওয়ার পরই সচরাচর সমাপ্ত হয় গোয়েন্দা গল্প।
দল বেঁধে বাস করার সময় থেকেই দলীয় বিধিভঙ্গকারীকে শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে মানুষ। রাষ্ট্র গঠনের পর ব্যাপারটি আরও বিস্তৃত হয়েছে। অর্থাৎ সভ্যতার শুরু থেকে এ দুটি জিনিস চলে আসছে। একইসঙ্গে তা নিয়ে গল্পও গড়ে উঠেছে। দেশ নির্বিশেষে চোর আর চোর ধরার লোককথা তারই প্রমাণ। 
ঠিকঠাক গোয়েন্দা গল্প রচনার শুরু হয় পৃথক পুলিশ বিভাগ চালু হওয়ার পরে।
এবার আসছি পাশ্চাত্যের  কথায়। উনিশ শতকের প্রথমে ফ্রান্স পরে ইংল্যান্ডে পুলিশি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংল্যান্ড-উপনিবেশ ভারতেও গড়ে ওঠে পুলিশবাহিনী। এরপরই ফ্রান্স-ইংল্যান্ডে দেখা দেয় গোয়েন্দা গল্পের প্রাথমিক রূপ। ফরাসি পুলিশবাহিনীর স্রষ্টা ফ্রাঁসোয়া ইউজিন ভিদক লিখেছিলেন, কয়েকটি অপরাধ আখ্যান। টানটান রহস্য আর বিশ্লেষণ-তীক্ষ্ণতার অভাব সেগুলিকে সেই অর্থে গোয়েন্দা গল্প হয়ে উঠতে দেয়নি। আবার মেধাদীপ্ত বিশ্লেষণ ছিল ভলত্যেয়ার রচিত ‘জাদিগ’ আখ্যানে। কিন্তু পুলিশি ব্যবস্থা স্থাপনের আগের যুগের এই কাহিনিগুলি রোমাঞ্চ-শিহরনের অভাবে সঠিক অর্থে গোয়েন্দা গল্প হয়ে ওঠেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম রচিত হল এমন গল্প যাতে ছিল টান টান রহস্য আর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ। একইসঙ্গে ছিল গোয়েন্দার উপস্থিতি। গল্পটির নাম 'দ্য মার্ডার ইন দ্য রু মর্গ'। লেখক এডগার অ্যালান পো (১৮০৯-১৯৫৯)।
গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল 'গ্রাহামস ম্যাগাজিন'র ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল সংখ্যায়। মাসিকপত্রটি মুদ্রিত হত ফিলাডেলফিয়া থেকে। পো’-র ডিটেকটিভের নাম মঁসিয়ে অগুস্ত দ্যু প্যা। সাহিত্যের গোয়েন্দা গল্পের আবশ্যিক গুণ হল পাঠকমনকে আবিষ্ট করা। এই গুণ প্রথম দেখা গিয়েছিল এই গল্পটিতে। বাস্তব গোয়েন্দার চেয়ে গল্পের গোয়েন্দা কাছের মানুষ, চেনা মানুষ। পুলিশ আর তার গোয়েন্দা শাখাটিকে সাধারণ মানুষ দেখে ভয়ের চোখে। আর সত্যিকারের গোয়েন্দা যে সবসময় সফল এমন নয়। কিন্তু গল্পের গোয়েন্দা কখনও বিফল হয় না। শাসকসংযোগ তথা প্রত্যক্ষ শাস্তির সঙ্গে যোগ থাকে না তার। এজন্যই এই গোয়েন্দা হতে পারে কাছের মানুষ, প্রিয় মানুষ। গল্প-গোয়েন্দার জনপ্রিয়তা কতদূর যেতে পারে তার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত শার্লক হোমস। স্যার আর্থার কোনান ডয়েলকে ছাপিয়ে গিয়েছিল তাঁরএই সৃষ্টি। ১৮৯৩-এ 'দ্য ফাইনাল প্রবলেম'-এ হোমসকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন ---ইচ্ছে অন্য লেখায় মন দেবেন। কিন্তু পাঠকদের চাপে তাঁকে আবার লিখতে হল হোমস-কাহিনি। ১৮৯৫-এ 'দ্য রিটার্ন অব শার্লক হোমস' গল্পে গোয়েন্দাকে ফিরিয়ে আনতে হল তাকে। হোমস প্রীতির জন্যই লন্ডনে ২২১বি, বেকার স্ট্রিট --- এই কল্পিত রাস্তার বাস্তব অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে। এখানে হোমসের নামে গড়ে উঠেছে পাবলিক হাউস। সেটি ডয়েল বর্ণিত আসবাবে সাজানো। বছর বছর অগণ্য মানুষ ভিড় করে সেখানে।
তবে উনিশ শতকে পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে লেখা হয়েছিল বেশ কিছু গোয়েন্দা গল্প। লেখকদের মধ্যে যেমন ছিলেন পুরুষ তেমনই ছিলেন মহিলা। কিন্তু নারী গোয়েন্দার দেখা মেলে না কারও লেখায়। মেয়েরা খুনোখুনির সামনে দাঁড়াতে ভয় পায়। তাদের কোমল স্বভাব আর দৈহিক দুর্বলতা হিংস্র দুষ্কৃতীর মুখোমুখি হওয়ার উপযোগী নয় --- দীর্ঘলালিত এ ধারণাই এর কারণ। তবু কিন্তু মেয়ে গোয়েন্দা এল। এল স্বভাবত রক্ষণশীল ব্রিটিশ লেখকের কলমেই। ইংরেজ সাহিত্যিক উইলকি কলিনস (১৮২৪-১৮৮৯) তার 'দ্য ল অ্যান্ড দ্য লেডি' উপন্যাসে আনলেন মহিলা ডিটেকটিভ – ‘ভ্যালেরিয়া ব্রিন্টন’-কে। 
আমেরিকান লেখিকা অ্যানা ক্যাথরিন গ্রিন (১৮৪৬-১৯৩৫) তৈরি করলেন একজোড়া মেয়ে গোয়েন্দা --- এমিলিয়া বাটার ওয়ার্থ আর ভায়োলেট স্ট্রেঞ্জ। হাঙ্গেরির অভিজাত কন্যা এসমা ম্যাডগালেনা রোজালিয়া জোসেফা অভি সংক্ষেপে ব্যারনেস অকজি (১৮৬৫-১৯৪৭)  গোয়েন্দা-সহায়ক হিসেবে এনেছিলেন মিস পলি বার্টনকে। পরে তাকে তিনি  করে তুললেন পুরো গোয়েন্দা। মার্কিন মহিলা মিসেস মেরি রবার্টস রাইন হার্ট (১৮৭৫-১৯৫৮) সৃষ্টি করলেন গোয়েন্দা-দম্পতি। আর্ল স্ট্যানলি গার্ডনার-এর (১৮৮৯-১৯৭০) সৃষ্ট গোয়েন্দা সহকারী ডেলা স্ট্রিট। সে গোয়েন্দা পেরি মেসন'র ক্লার্ক। বরাবর তার একই ভূমিকা। 
প্রতীচ্যের সেরা মহিলা গোয়েন্দা মিস মার্পল। আগাথা ক্রিস্টি'-র (১৮৯০-১৯৭৬) এই মহিলা গোয়েন্দাটি বিয়ে করেননি। থাকেন ইংল্যান্ডের শহরতলিতে। প্রৌঢ়া এই মহিলার নেশা উল বোনা। বোনার ফাঁস যত জটিল হয় ততই তাঁর মাথায় খুলে যায় রহস্যের জট। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর সাংসারিক অভিজ্ঞতা তার রহস্য উন্মোচনের চাবি। টমি-টুপেন্স --- আগাথা ক্রিস্টির এই যুগল গোয়েন্দার মধ্যে টুপেন্স'র বুদ্ধি আর সাহস দুটোই বেশি। স্বামী টমি অনেকটাই যেন স্ত্রীর সহকারী। দেখা যাচ্ছে যে সময় যত এগিয়েছে ততই বেড়েছে মেয়ে গোয়েন্দার সংখ্যা। মেয়েদের সামাজিক অবস্থা আর অবস্থানের উন্নতিই এর কারণ।
গোয়েন্দা নিয়ে আলোচনায় জনপ্রিয়তার বেশ উপরের দিকে থাকবে 'ফেমাস ফাইভ' গোয়েন্দা সিরিজের গল্পগুলি। ‘ফাইভ অন এ ট্রেজার আইল্যান্ড’, বিখ্যাত ফাইভ সিরিজের মূল বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪২ সালে। এনিড ব্লাইটন এই সিরিজে আরও বিশটি উপন্যাস লিখেছিলেন ; ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর একটি প্রকাশিত হয়। চার কিশোর - কিশোরী জুলিয়ান, ডিক, অ্যান, জর্জ এবং তাদের পোষ্য সারমেয় টিমিকে নিয়ে আটটি ছোট গল্প লিখেছেন।

এইবার তাকানো যাক বাংলাসাহিত্যের এই শাখাটির দিকে। ফরাসি এবং ইংরেজি সাহিত্যের পরই বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের সূচনা। বিদেশি প্রভাব অবশ্যই কাজ করেছে। ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের (১৮৪২-১৯১৯) অপরাধ-আখ্যানের বেশিরভাগই অনুবাদ। 'আশ্চর্য নারী ডিটেকটিভ’ আখ্যানটিও মৌলিক রচনা নয়। নতুবা এটিই হতে পারত বাংলায় প্রথম মেয়ে গোয়েন্দার গল্প। বাংলাতেও প্রথম দিকের গোয়েন্দা গল্পে পুরুষই ছিল প্রধান। তা-ও আবার যে-সে পুরুষ
নয় --- খোদ পুলিশকর্মীই সে সব আখ্যানের গোয়েন্দা। 'বাঁকাউল্লার দপ্তর' (১৮৫৫) অবশ্য প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ রচনা নয়। কিন্তু কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় (১৮৬৩-১৯১৯) নিজের লেখা বইটির আখ্যানগুলি দারোগা বাঁকাউল্লার অভিজ্ঞতা হিসেবেই উপস্থাপিত করেছেন। পরের দুটি বই সোজাসুজি পুলিশকর্মীর তদন্তের বিবরণ।
প্রথমটির নাম 'সেকালের দারোগার কাহিনী'। লেখক গিরিশচন্দ্র বসুর জন্ম ১৮২৪-এ; মৃত্যু ১৮৯৮-এ। বইটি মুদ্রিত হয় ১৮৯৫-এ। তার আগেই অবশ্য অক্ষয়চন্দ্র সরকার স্থাপিত মাসিকপত্র 'অবজীবন'-এ ধারাবাহিক হিসেবে এই কাহিনি প্রকাশিত হয়, ১৮৯৩-৯৪ --- এই এক বছর ধরে। 
‘দারোগার দপ্তর' দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের নিজের করা বিভিন্ন তদন্তের বিবরণ। উনিশ শতকের মধ্যভাগে ১৮৫৫-তে তাঁর জন্ম; মৃত্যু ১৯১৭-তে অর্থাৎ বিশ শতকের প্রথমে। পাঠকদের কাছে গোয়েন্দা গল্প তথা অপরাধ আখ্যানের চাহিদার দিকটি বুঝেছিলেন তিনি। তাই এ ধরনের একটি করে কাহিনি নিয়ে মাসিক পত্রের মতো বের করেছিলেন 'দারোগার দপ্তর'। শুরু বাংলা সন ১২৯৯-এ; চলেছিল বারো বছর। মোট দুশো ছটি আখ্যান বের হয় এই সময়পর্বে। দারোগার
দপ্তর’-এর জনপ্রিয়তা প্রিয়নাথকে দিয়েছিল 'তেত্রিশ বৎসরের পুলিশ কাহিনী' বা 'প্রিয়নাথ জীবনী' রচনার প্রেরণা। এটি বের হয় অবশ্য তাঁর মৃত্যুর পরে। ‘গোয়েন্দা কাহিনী’ শীর্ষনামে ১৮৯৪-এ একটি কাহিনীমালা প্রকাশিত হয়েছিল। 'দারোগার দপ্তর'-এর মতো না হলেও এটিও যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিল। সম্ভবত বাংলায় প্রথম 'গোয়েন্দা' শব্দ ব্যবহৃত হলো এই আখ্যানমালাতেই। সাহিত্যিকের কল্পনায় সৃষ্ট গোয়েন্দা গল্প আর অপরাধ-আখ্যান দেখা দিল এর পরেই। 
প্রথম লিখলেন নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত । ১৮৬১ -তে জন্ম, মারা যান ১৯৪০-এ। উনিশ-বিশ শতকের সন্ধিক্ষণে সক্রিয় ছিল তাঁর লেখনী। রহস্য গল্পের দিকে ছিল স্বাভাবিক টান। তবে অপরাধভিত্তিক কাহিনী বেশি লেখেননি। তাঁর এ ধরনের প্রথম গল্প 'চুরি না বাহাদুরি'। মুদ্রিত হয় ১২৯৪ বঙ্গাব্দের (১৯০১) বৈশাখ সংখ্যা 'ভারতী'তে। কয়েক বছর পরে কুন্তলীন পুরস্কার পায় কয়েকটি ডিটেকটিভ কাহিনী। 
সময় ১৩০৬ বঙ্গাব্দ। হেমেন্দ্রমোহন ঘোষ নিজের তৈরি বিলাসদ্রব্য ‘কুন্তলীন’ চুলের তেল, দেলখোস এসেন্স আর পানের মশলা তাম্বুলীনের বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রবর্তন করেন এই পুরস্কার। পুরস্কৃত গল্পগুলি পৃথক পুস্তক হিসেবে ছাপা হত। ১৩০৬ বঙ্গাব্দে পুরস্কৃত গল্পগুলির মধ্যে ছিল চারটি গোয়েন্দা গল্প। লেখক যথাক্রমে রজনীচন্দ্র দত্ত (প্রথম পুরস্কার), দীনেন্দ্রকুমার রায় (দ্বিতীয় পুরস্কার) জগদানন্দ রায় (সপ্তম পুরস্কার) ও সরলাবালা দাসী। এঁদের মধ্যে দীনেন্দ্রকুমার পরে বহু ধরনের গোয়েন্দা গল্প রচনায় মন দিয়েছিলেন। তবে এসব গল্পে নির্দিষ্ট কোনও গোয়েন্দা ছিল না। মেয়ে গোয়েন্দার কথাও কেউ-ই ভাবেননি। এবার দেখা দিল 'নন্দনকানন সিরিজ'। প্রকাশক উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। সাপ্তাহিক দৈনিক 'বসুমতী' পত্রিকা আর 'বসুমতী সাহিত্য মন্দির প্রতিষ্ঠা তাঁর বিশিষ্ট কীর্তি। এই সিরিজ বাঙালির সমাদরলাভ করেছিল।
বিশিষ্ট গোয়েন্দা—যিনি নানা আখ্যানে ফিরে ফিরে আসেন --- এমন গোয়েন্দা সৃষ্টি করলেন পাঁচকড়ি দে (১৮৭৩-১৯৪৫)। এক নয় তাঁর এ ধরনের গোয়েন্দার সংখ্যা দুই ---দেবেন্দ্রবিজয় আর অরিন্দম। দ্বিতীয় জন প্রথম জনের উপদেষ্টা। ‘মায়াবী' (আনুমানিক প্রকাশকাল ১৯০৫) আর‘মায়াবিনী’ (সঠিক প্রকাশকাল জানা যায়নি) এই উপন্যাস দুটিতে পাঁচকড়ি দে এনেছেন নারী-অপরাধী, জুমেলিয়াকে। কিন্তু মেয়ে গোয়েন্দার আভাসমাত্র নেই তাঁর রচনায়। এই বিষয়ে উল্লেখ্য, পাঁচকড়ি দে তার গোয়েন্দা উপন্যাস ‘মনোরমা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেছিলেন।
এদেশের সাহিত্যে কিন্তু মহিলা গোয়েন্দার কথা অনেক আগেই পাওয়া যায়। অন্তত দুটি আখ্যানে পাওয়া যায় মেয়েদের রহস্য সন্ধানের বিবরণ। প্রথমটি আছে ঋগ্বেদ সংহিতার (সময় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ শতক) দশম মণ্ডলের একশো আটতম সূক্তে। দেবতাদের হারানো গোসম্পদের সন্ধান এনে দিয়েছিল কুকুরদের আদি মাতা সরমা। অপহারক পণিদের অন্তরঙ্গ হয়ে ক্রমে সে পেয়েছিল গোরুর দলের খোঁজ। সরমা সংবাদ দিতে পেরেছিল বলেই দেবগণ সহজেই উদ্ধার করেছিল হৃত গোধন। 
এরপরে মেয়ে গোয়েন্দা বলা যায় ‘জাতক' আখ্যানমালার (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতক–এই পর্বে ‘জাতক' সংকলিত হয়) ‘পদকুশল মানব' কাহিনির অশ্বমুখী যক্ষীকে। ‘জাতক' বুদ্ধদেবের পূর্বের বিভিন্ন জন্মের আখ্যান। তখন তিনি বোধিসত্ত্ব—বুদ্ধ নন। উক্ত যক্ষিণী খাবার হিসেবে ধরে এনেও বিয়ে করেছিল যুবক বিপ্লকে। বোধিসত্ত্ব জন্ম নিলেন তাদের সন্তান হিসেবে। বড় হয়ে বাবার মুখে মায়ের পরিচয় জানলেন তিনি এবং দুজনে পালালেন। যক্ষিণী ছুটে এল। কিন্তু তাদের ফেরানো যাবে না বুঝে ছেলেকে শিখিয়ে দিল ‘চিন্তামণি’ মন্ত্র । মন্ত্রবলে বারো বছরের পুরনো পায়ের ছাপ দেখা যাবে। যক্ষী মারা যায় শোকে। বোধিসত্ত্ব পান দৈনিক সহস্র মুদ্রা বেতনের রাজার চাকরি। রাজপুরোহিতের মন্ত্রণায় রাজা আপন সম্পদ হরণ করে বোধিসত্ত্বের বিদ্যাবল পরীক্ষা করতে গিয়ে মারা পড়েন জনরোষে। বোধিসত্ত্ব তস্করকে চিহ্নিত করেছিলেন মাতৃদত্ত মন্ত্রের শক্তিতে পায়ের ছাপ দেখেই। এ বিদ্যার উৎস কিন্তু নারী ---হয়বদন যক্ষী।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রসিদ্ধ আখ্যান সিরিজ ‘সহস্র এক আরব্য রজনী'র (আলিফ লায়লা ও লায়লা ) মর্জিনাও নারী গোয়েন্দার সম্মান পেতে পারে। 'আলিবাবা আর চল্লিশ চোর' গল্পে ক্রীতদাসী মর্জিনা প্রভু আলিবাবাকে শত্রুমুক্ত করেছে কুশলী গোয়েন্দার মতোই। অবশ্য অপরাধ করার আগেই সে দস্যুদল আর তাদের নেতাকে চিনে নিয়েছিল এবং তাদের হত্যা করেছিল। তারপর দীর্ঘ দিন মেয়ে গোয়েন্দার খোঁজ মেলে না।
সুকুমার সেন (১৯০৫-১৯৭২) তার ‘ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি' (১৯৮৮) গ্রন্থে  জানিয়েছেন, বাংলায় মেয়ে গোয়েন্দাদের এনেছিলেন প্রভাবতী দেবী একদিক দিয়ে তাঁর মন্তব্য গ্রহনযোগ্য। কারণ প্রভাবতী লিখে ছিলেন গোয়েন্দা মেয়ের সিরিজ। কিন্তু যথার্থভাবে প্রথম মহিলা গোয়েন্দা বাংলায় এসে গিয়েছিল আগেই। এনেছিলেন দীনেন্দ্রকুমার রায়।
দীনেন্দ্রকুমার রায় বাংলা সাহিত্য ইতিহাসে ঈষৎ অবজ্ঞেয়। পাঠক তাঁকে জানে মিস্টার ব্লেক আর স্মিথ'-এর কাহিনিকার হিসেবে। মনস্কপাঠকের মনে আসতেও পারে ‘পল্লীচিত্র' (১৯০৪),‘পল্লীবৈচিত্র্য’ (১৯০৫), ‘পল্লীকথা' (১৯১৭) --- তাঁর এই বই তিনটির কথা। ১৮৬৯-এর ২৫ আগস্ট নদীয়ার মেহেরপুরে ব্রজনাথ রায়ের এই পুত্রটির জন্ম। মারা যান ১৯৪৩-এর ২৭ জুন। ব্রজনাথ রায় কাজ করতেন জমিদারি সেরেস্তায়। কিন্তু সাহিত্য ছিল তাঁর প্রাণ। ‘কুসুম-কাহিনী' নামে একটি কবিতা সংকলনও ছিল তাঁর। পিতার সাহিত্যপ্রীতি পুত্রের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠল। তাই প্রবেশিকা পাশের (১৮৮৮) পরই কার্যত দাঁড়ি পড়ল তাঁর প্রথাগত শিক্ষায়। যদিও ভর্তি হয়েছিলেন কৃষ্ণনগর কলেজ আর কলকাতার জেনারেল এসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনে। দুই স্থানে ব্যর্থতার পর তিনি চাকরি করতে আরম্ভ করলেন। প্রথমে নিযুক্ত হলেন মহিষাদল রাজ এন্ট্রান্স স্কুলের তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে । এ সময় জলধর সেনের (১৮৬০-১৯৩৯) সঙ্গে তাঁর পরিচয়। মুখ্যত তাঁর উৎসাহেই জলধর সেনের সাহিত্যজীবনের সূচনা এবং বিকাশ। 
বস্তুত বাংলার তৎকালীন সাহিত্যভূবনের রথীমহারথীদের সঙ্গে দীনেন্দ্রকুমারের ছিল নিবিড় যোগ। রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০), রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১), সরলা দেবী চৌধুরাণী (১৮৭২-১৯৪৫), সুরেশচন্দ্র সমাজপতি (১৮৭০-১৯৩০) অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় (১৮৬১-১৯৩০), শ্রী অরবিন্দ (১৮৭২-১৯৫০) --- কে নেই সেই তালিকায়? বিচিত্র ছিল তাঁর কর্মজীবন। শিক্ষকতার পর রাজশাহির জেলা জজ দপ্তরে বেশ কিছুদিন কাজ করেন। ১৮৯৮ তিনি যান বরোদায় শ্রী অরবিন্দকে বাংলা শেখানোর দায়িত্ব নিয়ে। দু-বছর পর ফিরে এসে সম্পাদনার কাজ করেন। বস্তুত পত্রিকা সম্পাদনায় ছিল তাঁর অনুরাগ আর দক্ষতা। রাজশাহি ধর্মসভার মুখপত্র ‘হিন্দুরঞ্জিকা’ আর ‘তিলি পত্রিকা' তাঁর আগের সম্পাদিত দুটি পত্রিকা। সে সব ছিল তাঁর শখের কাজ এবার তা হল বৃত্তি। 'সাপ্তাহিক বসুমতী'র সহ-সম্পাদক পদে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। পরে হন সম্পাদক। পূর্বে যেটির নাম করা হয়েছে সেই 'নন্দনকানন' মাসিকটি তাঁরই সম্পাদনায় মুদ্রিত হত। 'রহস্যলহরী' শীর্ষক গোয়েন্দা গল্পমালা প্রকাশ তাঁর শেষ জীবিকা। মোট দুশো সতেরোটি অনুবাদ উপন্যাস বের হয়েছিল এই সিরিজে। সবই প্রায় গোয়েন্দাগল্প। গোয়েন্দা মিস্টার ব্লেক; সহকারী স্মিথ। দীনেন্দ্রকুমার ছিলেন এক সার্থক ভাষাশিল্পী। প্রথম মুদ্রিত রচনা ‘একটি কুসুমের মর্মকথা’। প্রকাশিত হয়েছিল ১২৯৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যা ‘ভারতী ও বালক’-এ। ‘ভারতী, ‘সাধনা, ‘দাসী, ‘প্রদীপ, ‘সাহিত্য, ‘ভারতবর্ষ’ আর ‘মাসিক বসুমতী -তে নিয়মিত লিখতেন তিনি। গল্প, উপন্যাস ভিন্ন নানা বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধও মনোরম হয়ে উঠত তাঁর স্বচ্ছ, চিত্রময় সজীব গদ্য লিখনভঙ্গিতে। দীনেন্দ্রকুমারের বহু প্রবন্ধ এখনও গ্রন্থবদ্ধ হয়নি। তাঁর পল্লীকথাগুলি বই হয়ে বের হয়েছিল এবং অর্জন করেছিল রবীন্দ্র-প্রশংসা। ‘পল্লীচিত্র’ অবশ্য তিনি রবীন্দ্রনাথকেই উৎসর্গ করেছিলেন। উপন্যাস, গল্প সংকলন, নিবন্ধ সংকলন, কিশোর গল্প সঞ্চয়ন, স্মৃতিকথা, জীবনী—সব মিলিয়ে তাঁর উল্লেখ্য ভালো গ্রন্থের সংখ্যা আঠারো।‘রহস্যলহরী'র শতাধিক গ্রন্থ তো আছেই। ‘পট’ (১৯০১) দীনেন্দ্রকুমারের গোয়েন্দা গল্পের আদি সংকলন। ছয়টি গল্প আছে এ সংকলনে। দীনেন্দ্রকুমারের আশ্চর্য একটি গোয়েন্দা গল্প ‘হত্যারহস্য'। প্রকাশিত হয়েছিল 'ভারতী' পত্রিকার ১৩০১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ-ভাদ্র সংখ্যায়। এই গল্পটিতে আমরা পেলাম বাঙালি মেয়ে গোয়েন্দা কুসুমকে। নিতান্তই ঘরের মেয়ে, আটপৌরে বাঙালি বউ। চালাতে জানে না রিভলভার --- জানে না আট-দশটা ভাষা ; কেবল জানে ভালোবাসতে। সেই তার একমাত্র শক্তি। নিতান্ত নিরক্ষর নয়। মোটামুটি পড়াশোনা জানা আছে তার। বাপ-মা হারা মেয়ে কুসুম স্বামী হিসেবে পেয়েছিল ভালবাসার মানুষ নগেন্দ্রনাথকেই। কাজের সূত্রে কাশী গিয়েছিল কুসুমের স্বামী। সেখানে খুন হয় এক ধনী বয়স্কা বিধবা; চুরিও হয়। অপরাধী হিসেবে সবার সন্দেহ গিয়ে পড়ে নগেন্দ্রনাথের উপর। এবার কুসুম নজিরবিহীন সাহসের পরিচয় দেয়। স্বামীকে কলঙ্কমুক্ত করার জন্য দাসী হিসেবে কাশী চলে যায় সে। নিহতের পুত্রবধূ অবশ্য তার পরিচয় জানতেন এবং তাকে যথাসাধ্য সাহায্যের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। তবে দোষীকে চিহ্নিত করা আর তাকে ধরার কাজটি করে কুসুমই। সে খুনি হিসেবে সন্দেহ করে বাড়ির দাসী বামাকে। বামাকে অনুসরণ করে আসল ব্যাপারটি বুঝেও যায় সে। তারপর চলে যায় থানায়। নিয়ে আসে পুলিশ। বামা তাকে হত্যার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বিষ খায়। তবে মৃত্যুর আগে জানিয়ে যায় তার অপরাধের মূলেও ছিল প্রেম। প্রেমিক গোপালের সঙ্গে সুখে থাকার স্বপ্ন দেখত সে। আর সে জন্যই এই খুন। রহস্য ঘেরা হত্যাকাণ্ড, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ, অনুমান আর সিদ্ধান্তগ্রহণ ---গোয়েন্দা গল্পের এই মূল শর্তগুলি অনেকটাই রক্ষিত হয়েছে এই গল্পে। তাই কুসুমকে বাংলা গল্পের অন্যতম মেয়ে গোয়েন্দা বলাই যায়।
বাংলাগল্পে মেয়ে গোয়েন্দার উজ্জ্বল উপস্থিতির জন্য আরও কিছু কাল লাগল। বিশ শতকের চারের দশক। দেব সাহিত্য কুটির প্রকাশন সংস্থাটি কিশোরদের জন্য বিভিন্ন স্বাদের বইয়ের সঙ্গে গোয়েন্দা গল্পের প্রকাশ শুরু করল ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ আর ‘প্রহেলিকা' নামে দুটি সিরিজে। দুই সিরিজেই সে সময়ের বহু বিখ্যাত সাহিত্যিক লিখেছিলেন।
‘কাঞ্চনজঙ্ঘা' সিরিজের নবম গ্রন্থ ‘গুপ্তঘাতক'। রচনাকার প্রভাবতী দেবী সরস্বতী। বইটিতে বাঙালি পেল কিশোরী গোয়েন্দা কৃষ্ণাকে। বাবা রেঙ্গুনের পুলিশ কর্মচারী সত্যেন চৌধুরী মেয়েকে বড় করেছেন অন্যভাবে। কৃষ্ণা-কথা এতই পাঠকপ্রিয় হয় যে প্রভাবতী কৃষ্ণাকে নিয়ে সাতটি বইয়ের একটি সিরিজই লিখে ফেলেছিলেন। তাঁর অন্য মেয়ে গোয়েন্দার নাম অগ্নিশিখা রায় বা শিখা। তবে পাঠকের মন কৃষ্ণার মতো অতটা টানেনি। কলেজে পড়া পিতৃহীন সাহসী বুদ্ধিমতী, ব্যায়ামবলিষ্ঠ তার দেহ ; জানে পাঁচ-সাতটি ভাষা। চালাতে পারে মোটর। ঘোড়ায় চড়া, রিভলভার ছোঁড়া তার কাছে জলভাত। ছদ্মবেশ ধারণেও সে দক্ষ। অর্থাৎ একেবারে আদর্শ গোয়েন্দা। মাতা-পিতার হত্যার প্রতিশোধের জন্য তার গোয়েন্দা হওয়া। গুপ্তঘাতক’-এর পরের বই ‘হত্যার প্রতিশোধ’। ‘প্রহেলিকা’ সিরিজেও আছে দুটি কৃষ্ণা-কাহিনী ---‘কলঙ্কী চাঁদ’ আর ‘গ্রহের ফের’।  
বিশ শতকের শেষের দিকে বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে এল অনেক মেয়ে গোয়েন্দা। নলিনী দাশ (১৯১৬-১৯৯৩) গড়ে তুললেন চার কিশোরী গোয়েন্দার দল। নাম তাদের কালু-মালু, বুলু-টুলু। বন্ধুদের ভাষায় গন্ডালু। পুরনো বাংলা গোনার রীতিতে চারটিতে হত এক গন্ডা। তাই এ নাম। অ্যাডভেঞ্চার ভালবাসে তারা। প্রায়ই জড়িয়ে পড়ে নানা রহস্যজালে। খুঁটিয়ে দেখা আর যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে বেরিয়েও আসে তা থেকে। গন্ডালুর ‘গোয়েন্দা গন্ডালু’ হতে দেরি হয়না। স্কুল-হস্টেলের চারটি মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী কালু। সে-ই সবসময় থাকে সবার আগে। এদের গল্পে স্কুলস্টোরির সঙ্গে মিশে গেছে গোয়েন্দা গল্পের শিহরন।
তবে গোয়েন্দাকাহিনীর দিক থেকে সর্বপ্রথম সাফল্যের চূড়ায় ওঠে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ব্যোমকেশ’। তারপর একে একে সত্যজিৎ রায়ের 'ফেলুদা', নীহাররঞ্জন গুপ্তের 'কিরীটী', সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'কাকাবাবু' বাঙালি পাঠকের মন জয় করে নেয়। সেই চার বিখ্যাত বাঙালি গোয়েন্দা ব্যোমকেশ, ফেলুদা, কিরীটী আর কাকাবাবুর কিছু জানা অজানা কথাও ভাগ করে নেওয়া যাক । 
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট জনপ্রিয় চরিত্র ব্যোমকেশ। ব্যোমকেশ বক্সীর প্রথম আবির্ভাব 'সত্যান্বেষী' গল্পের মধ্য দিয়ে। শোনা যায়, একসময় শরদিন্দু এবং জীবনানন্দ দাশ হ্যারিসন রোডের একই মেস বাড়িতে থাকতেন। সেই মেসবাড়ির প্রেক্ষাপটেই জন্ম নেয় ব্যোমকেশ চরিত্রটি। আর ব্যোমকেশই একমাত্র গোয়েন্দা চরিত্র যার লাভ-স্টোরি আছে। ব্যোমকেশের স্ত্রীর নাম সত্যবতী। ব্যোমকেশ বক্সীর বন্ধু অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্যিক। তাঁর কলমে ব্যোমকেশের অভিযানগুলোর বর্ণনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যোমকেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ব্যোমকেশকে নিয়ে গোয়েন্দা গল্পের সিরিজ লেখা শুরু করেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। শরদিন্দু লিখতেন খুব সহজ সরল এবং সাবলীল ভাষায়। বেশ কয়েক বছর ধরে ১০ টি গল্প লেখার পর পাঠকদের হয়ত আর
ভাল লাগছে না এই ভেবে দীর্ঘ ১৫ বছর ব্যোমকেশকে নিয়ে তিনি গল্প লেখা বন্ধ করে দেন। দীর্ঘদিন পর পাঠক আর প্রকাশকদের অনুরোধে ‘চিত্রচোর’ গল্পটি দিয়ে ব্যোমকেশ সিরিজ আবার শুরু করেন। তিনি ব্যোমকেশ সিরিজের মোট তেত্রিশটি গল্প লিখেছিলেন। এর মাঝে 'শিশুপাল বধ' গল্পটি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক সিনেমা। যার মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের নির্দেশিত 'চিড়িয়াখানা' সিনেমায় ব্যোমকেশের চরিত্রে অভিনয় করেন স্বয়ং উত্তম কুমার।
সত্যজিৎ রায়ের নিজ হাতে গড়া চরিত্র ফেলুদা ওরফে ফেলু মিত্তির। ফেলুদার পুরো নাম প্রদোষচন্দ্র মিত্র। ফেলুদার ঠিকানা ২১, রজনী সেন রোড। ফেলুদার প্রধান সহকারী খুড়তুতো ভাই তোপসে এবং লেখক লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ু। এই জটায়ুও আবার গোয়েন্দা কাহিনি লেখেন, তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্রটির নাম 'প্রখর রুদ্র'। ফেলুদা শার্লক হোমসের বড় ফ্যান ছিলেন যা সত্যজিত রায়ের লেখায় বারবার উঠে এসেছে। ফেলুদার প্রধান সহকারী তপেশরঞ্জন মিত্র বা তোপশে চরিত্রটিও শার্লক হোমসের রচয়িতা স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের জন ওয়াটসন চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত। শুধু তাই নয়, ফেলুদা গল্পে যে সিধু জ্যাঠাকে দেখা যায় যার পরামর্শ নিতে যান ফেলুদা, এই সিধু জ্যাঠা চরিত্রটিতে শার্লক হোমসের দাদা মাইক্রফট হোমসের ছায়া লক্ষ্য করা যায়।  ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে 'সন্দেশ' পত্রিকায় ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ প্রথম প্রকাশিত হলে চারদিকে সাড়া পড়ে যায়। ফেলুদার সব মিলিয়ে ৩৫টি সম্পূর্ণ এবং ৪টি অসম্পূর্ণ গল্প এবং উপন্যাস প্রকাশিত হয়। ফেলুদা রহস্যের সমাধান করতে গিয়ে সাধারণত শারীরিক শক্তি বা, অস্ত্র ব্যবহার করেন না। ব্যবহার করেন "মগজাস্ত্র"। ফেলুদার পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা অসাধারণ। ফেলুদা সিরিজের গল্প এবং উপন্যাস ইংরেজি ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে। ফেলুদাকে নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের নিজে তৈরী করা দুখানি সিনেমা - 'জয় বাবা ফেলুনাথ' এবং 'সোনার কেল্লা'। ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
নীহাররঞ্জন গুপ্ত বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র 'কিরীটী'-র স্রষ্টা। নীহারবাবু পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি রহস্য গল্প লেখিকা আগাথা ক্রিস্টির সাথে দেখা করেন। আগাথা ক্রিস্টির কাছ থেকে গোয়েন্দা গল্প লেখার অনুপ্রেরণা পান। ভারতে ফিরে নীহাররঞ্জন লেখেন তাঁর প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস 'কালো ভ্রমর '। বাঙালি পেল আরেক নতুন গোয়েন্দা ‘কিরীটী’-কে ।
এক জমিদারবাড়ির সত্যিকারের ঘটনা থেকেই জন্ম নিয়েছিল নীহাররঞ্জনের প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাসের প্লট। জমিদারবাড়িতে এক দুপুরে খুন হয়ে যান বাড়ির বউমা। অন্তঃস্বত্ত্বা বিধবা সেই রমণীকে গুলি করে খুন করে তার সুপুরুষ দেওর। সে আবার যক্ষ্মায় আক্রান্ত। বউদিকে খুন করে নিজেকেও রেওয়াত করেনি। ওই বন্দুকেরই গুলিতে শেষ করে দেয় নিজেকেও। এক সময় ঘটে যাওয়া এই ঘটনা দাগ কাটে নীহারের মনে। সেখান থেকেই জন্ম নেয় কিরীটী। কিরীটী চরিত্রে মুগ্ধ ছিলেন উত্তমকুমার। একদিন নীহারবাবুর বাড়িতে এসে কিরীটী চরিত্রে অভিনয় করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু নীহারবাবু উত্তমকুমারকে স্পষ্টত জানিয়ে দেন যে, ‘কিরীটী’চরিত্রে তাঁকে কিছুতেই মানাবে না। নীহারবাবু মনে করতেন কিরীটী চরিত্রের জন্য পারফেক্ট নাট্যকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়!
বিখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক অনবদ্য গোয়েন্দা চরিত্র কাকাবাবু। কাকাবাবুর আসল নাম রাজা রায়চৌধুরী। তিনি ভারত সরকারের প্রত্নতত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা। কাকাবাবু একবার আফগানিস্তানে গাড়ি চালানোর সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। সেখানে কাকাবাবুর একটি পা ভেঙে যায়। তারপর থেকে তিনি হাঁটেন ক্র্যাচে ভর দিয়ে। কাকাবাবু বাংলায় প্রথম কোনো গোয়েন্দা চরিত্র যিনি দৈহিক ভাবে সামান্য অক্ষম হলেও মনের দিক থেকে, সাহসের দিক থেকে সব সময় এগিয়ে। কাকাবাবু কিছুদিন সিবিআই এর উপদেষ্টাও ছিলেন। বিয়ে করেননি। কাকাবাবু অসম্ভব সাহসী। তিনি তাঁর ভাইপো সন্তু আর সন্তুর বন্ধু জোজোকে নিয়ে অনেক রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চার করেছেন। কাকাবাবু শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও বুদ্ধির জোরে বিভিন্ন জটিল সব সমস্যার সমাধান করেন।  কাকাবাবুকে নিয়ে প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালে, 'আনন্দমেলা' পত্রিকায়। গল্পের নাম ছিল “ভয়ঙ্কর সুন্দর”। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মোট ৩৬টি কাকাবাবুর কাহিনী লিখেছেন। কাকাবাবুকে নিয়েও হয়েছে একাধিক সিনেমা।
এরপর বাংলা ছবি নির্মাতাদের একটুও ভুল হয়নি বাঙালি দর্শকদের স্নায়ু বুঝে নিতে। রক্তমাংসের ছাপোষা বাঙালি গোয়েন্দারা রীতিমতো হয়ে উঠলেন প্রায় সুপারহিরো। ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কাকাবাবুদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। কারণ নম্বর যারা দেবেন তার একটা বড়ো অংশই তো ক্ষুদে দর্শক; তাদের খুশি করা তো মুখের কথা নয়! সঙ্গে বাজারে ভিড় জমালেন আরও সব গোয়েন্দারা। একেন বাবু, সোনাদা, শবর, শান্তিলাল, কিরিটি, গোগোল, পান্ডব গোয়েন্দা, গোয়েন্দা জুনিয়রেরা, গোরা এবং আরও অনেকে । বাবার রেখে যাওয়া ফেলুদার সঙ্গেই তো একরকম ঘর বেঁধে ফেললেন সন্দীপ রায়।
আশার বিষয়, নারীকেন্দ্রিক গোয়েন্দা ছবির কথা আমাদের ছবি নির্মাতারা যে একেবারেই ভাবেননি তা নয়। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে আসে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘শুভ মহরৎ’ (২০০৩) ছবির কথা। আগাথা ক্রিস্টির ‘মিস মার্পেল’ (১৯৬২) উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত এই ছবিতে বাংলা ছায়াছবির প্রথম মহিলা গোয়েন্দা ‘রাঙা পিসিমা’-কে ( রাখী গুলজার অভিনীত চরিত্র ) হয়তো অনেকেরই মনে থাকবে।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহিলা গোয়েন্দা মিতিন মাসির কথাও কি ভোলা যায়? লেখিকা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাসের এই নারী গোয়েন্দাকে পর্দায় নিয়ে আসেন পরিচালক অরিন্দম শীল। মিতিন মাসির চরিত্রে কোয়েল মল্লিকের অভিনয় দর্শকদের নজর কেড়েছে।  এ প্রসঙ্গে যে জনপ্রিয় ধারাবাহিকটির কথা না বললেই নয়, তা হল ইন্দ্রাণী হালদার অভিনীত ‘গোয়েন্দা গিন্নি’।
বাংলা সাহিত্যে অনেকটা যেন ফেমাস ফাইভের ধাঁচেই পাণ্ডব গোয়েন্দাদের নিয়ে এলেন ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়। বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু, আর ওদের কুকুর কানা পঞ্চুর প্রথম দেখা ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে, শুকতারার পাতায়। 
ওঁরই সৃষ্ট আরেকটি কিশোর গোয়েন্দা চরিত্র গোয়েন্দা তাতার। ১৯৮৯-এর মে মাসের আনন্দমেলায় তার প্রথম অভিযানের খবর মেলে। সম্ভবত তাকে নিয়ে সর্বমোট চারটি অভিযানের গল্প লিখেছিলেন ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়। শঙ্কু আর দেবু হল তার দুই বন্ধু।
এদের সঙ্গেই যার নাম মনে আসে, সে আমাদের অত্যন্ত প্রিয় সমরেশ বসুর সৃষ্টি, গোগোল। বাবা সমিরেশ চ্যাটার্জী রাশিয়ান লেখক নিকোলাই গোগোলের একজন ফ্যান, তাই ছেলের নাম রেখেছিলেন গোগোল। গোগোলের বেশ কিছু গল্পে প্রাইভেট ডিটেকটিভ নৈহাটির অশোক ঠাকুর খুব বড়ো বিপদের হাত থেকে গোগোলকে উদ্ধার করেছেন। ওর বহু গল্পের মধ্যে উল্লেখ্য, ‘ইঁদুরের খুট খুট’, ‘জোনাকি ভূতের বাড়ি’, ‘সোনালি পাড়ের রহস্য’ , ‘শিমুলগড়ের খুনে ভূত’, ‘পশ্চিমের ব্যালকনি থেকে’, ‘গোগোল চিক্কুস নাগাল্যান্ডে’, ‘ভুল বাড়িতে ঢুকে’ ইত্যাদি।
এঁদের সাথেই যার নাম মনে আসে, সেই আরেক কিশোর গোয়েন্দা আনন্দ বাগচির সুধন্য। ওর বাবার বন্ধু কমলেশ পুলিশের বড়কর্তা। আশির দশকের আনন্দমেলায় আবির্ভাব হয়েছিল এই গোয়েন্দার। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প-উপন্যাস – ‘মৃত্যুর টিকিট, ‘নিখোঁজের খোঁজে, ‘যেখানে বাঘের ভয়, ‘রহস্যের আলোছায়া, ‘আয়না, ‘একটি প্যাঁচালো রহস্য’ ইত্যাদি।
আমরা সাহিত্যে দেখি, বহু গোয়েন্দারই সিরিজ লেখা হচ্ছে কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাঁর বয়স বাড়ছে না। এক্ষেত্রে অন্যতম ব্যতিক্রম প্রতিভা বসুর গোয়েন্দা অন্তু। ছোট্ট অন্তু বেশ কয়েকটি রহস্যভেদ করেছিল। তারপর অন্তু বড়ো হয়ে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসাবে আরও কিছু রহস্য দক্ষতার সঙ্গে ভেদ করে। অন্তুর সহকারী ছিলেন তাঁর দিদা হৈমন্তী দেবী। তাঁর ভালো নাম অতীন্দ্রিয় মিত্র। তাঁর একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় গল্প ‘মাত্র কয়েক ঘণ্টা’।
আশাপূর্ণা দেবীর কলমে আমরা পেয়েছিলাম দুই অশিক্ষিত বেকার যুবক ট্যাপা আর মদনাকে, যারা প্রথম জীবনে ছিল চোর, এক মহৎ ব্যক্তিত্ব শ্রী জগবন্ধু বোসের হাত ধরে তাঁরা জীবনের মূল স্রোতে ফিরে এসেছিল। পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় প্রকাশিত ‘ছুটিতে ছোটাছুটি’ গল্পতে রাঁচি বেড়াতে গিয়ে জড়িয়ে গেল পাগলের ডাক্তার তালুকদারের অপরাধমূলক কার্যকলাপের সঙ্গে। কেয়ারটেকারের কাজ করতে গিয়ে ধরে ফেলল এক বিরাট স্মাগলার চক্রকে ‘কপাল খুলে গেল নাকি’উপন্যাসে। 
বাংলা গোয়েন্দার জগত কিছুদিনের জন্য আলো করেছিল সুদীপ্ত মুখার্জ্জীর গোয়েন্দা সুধন্য, বিল্টু, আর তাদের ছোটকা। তাঁদের একটি উল্লেখযোগ্য গল্প ‘ধোবিপাট’। ব্যোমকেশ বক্সির মতো তিনি নিজেকে বলতেন ‘ছিদ্রান্বেষী সুধন্য’– অর্থাৎ অপরাধীর রেখে যাওয়া ভুলের ছিদ্র দিয়ে তিনি ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোন। এর সঙ্গেই উল্লেখ করা যায় রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা অভ্রদীপ, ‘সোনার আংটি উধাও’ উপন্যাসে তাঁর বুদ্ধিমত্তার কথা সবার নিশ্চয়ই মনে আছে। 
সিদ্ধার্থ ঘোষের গোয়েন্দা হলডেন সায়েন্স ক্লাবের সেনাপতি মিহির ঘটক ও সৌমেনের বেশ কয়েকটি উপন্যাস ও গল্প বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, যার মধ্যে কয়েকটি ‘একটি জলবৎ রহস্য, ‘ভেরেশাগিনের ছবি’ ইত্যাদি। কলকাতা মিউজিয়ামের জব চার্নক মেমোরিয়াল হল থেকে চুরি যায় উনিশ শতকের রুশ শিল্পী ভেরেশাগিনের সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমিতে আঁকা এক দুর্লভ পেইন্টিং। তাই নিয়েই উপন্যাস ‘ভেরেশাগিনের ছবি’। 
হিমানিশ গোস্বামীর কলমে উঠে এলেন আরেক গোয়েন্দা, কিট্টু লাহিড়ী। প্রকৃতি, বাঘাকাকাকে নিয়ে তাঁর আবির্ভাব ‘কিট্টুর গুরুলাভ’ উপন্যাসে। 
সমরেশ মজুমদারের পাকা হাতে আমরা পেলাম গোয়েন্দা অমল সোম আর তৃতীয় পাণ্ডব -- অর্জুনকে। ‘খুন খারাপি’ উপন্যাসে আবির্ভাবেই জয় করে নিয়েছিল পাঠকের মন। পরবর্তীকালে অমল সোম নিজেকে গুটিয়ে নিলে অর্জুন একাই বহু রহস্যের জট ছাড়িয়েছেন। তাঁর উপন্যাসে কমিক রিলিফ হয়ে এসেছেন মেজর। ‘সীতাহরণ রহস্য, ‘লাইটার, ‘জুতোয় রক্তের দাগ, ‘বিশ বাঁও জল’ ইত্যাদি গল্পের হাত ধরে জলপাইগুড়ি থেকে অর্জুন পাড়ি জমিয়েছেন ইউরোপ, অ্যামেরিকায়।
বিমল করের হাতে রিটায়ার্ড ম্যাজিশিয়ান কিকিরা বা কিঙ্কর কিশোর রায় হয়ে উঠেছেন একজন বিশিষ্ট রহস্যভেদী ; যদিও তাঁকে গোয়েন্দা বলতে বিমল করের ছিল যথেষ্ট আপত্তি। চন্দন আর তারাপদকে সঙ্গে নিয়ে একে একে বহু রহস্যের সমাধান করেছেন তিনি। তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ‘যাদুকরের রহস্যময় মৃত্যু’, ‘রাজবাড়ির ছোরা’, ‘কাপালিকরা এখনও আছে’, ‘শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধ ও কিকিরা ইত্যাদি।
কিকিরার পাশাপাশি আরেক রহস্যভেদী চরিত্রের আমদানি করেছিলেন বিমল কর। তাঁর নাম ভিক্টর ঘোষ। ‘হারানো ডায়েরির খোঁজে’, ঢাল পাহাড়ির পাহাড়-জঙ্গলে প্রকৃতির কোলে এক নতুন ধরনের রহস্যের আবহ তৈরি হয়েছে। 
মিস মার্পেলের মতোই বাংলা সাহিত্যেও আমরা পেয়েছিলাম প্রতুলচন্দ্র গুপ্তের সদু-ঠাকুমাকে। তাঁর বিচক্ষণতায় সমাধান হয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রহস্যের।
অদ্রীশ বর্ধনের গোয়েন্দা ইন্দ্রনাথ ও মৃগাঙ্ক যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। রাধারমণ রায়ের গোয়েন্দা গণেশ হালদারের বেশ কিছু গল্প শুকতারার পাতায় কিশোর পাঠকের মন ভরিয়েছিল। ‘গণেশ হালদারের হেঁয়ালি’ তার মধ্যে অন্যতম। আনন্দমেলার পাতায় বেশ কিছু ডিটেকটিভের আবির্ভাব হয়েছিল। যাঁদের সামান্য কয়েকটি গল্প পড়ারই সৌভাগ্য হয়েছে তাঁদের মধ্যে মীরা বালসুব্রামনিয়মের পুল্লা রেড্ডি ( নন্দীবাড়ির নেকলেস গল্পে ), প্রবীর ঘোষের আনন্দবাবু ( নিরালম্ববাবা ও আনন্দবাবু গল্পে ) -- এদের কথাও বিশেষ উল্লেখ্য।
এখানে বলে রাখা ভালো, হাস্যরসের লেখক শিবরাম চক্রবর্তীও কিন্তু গোয়েন্দা গল্প লিখেছেন, অবশ্য মজা করে। তার চরিত্রের নাম ছিল কল্কে আর কাশি। এরা দুজন রহস্য যতটা না ভেদ করতেন, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ ছিল তাদের পাঠকদের মনোরঞ্জনের দিকে। সেই অর্থে শিবরামের এ রচনাটিকে ‘ডিটেকটিভস অফ হিউমার’ বলা যায়। অর্থাৎ হাস্যকর বা হাস্যরসের গোয়েন্দা। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও কিন্তু গোয়েন্দা গল্পের প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল। তিনি ‘ডিটেকটিভ’ শিরোনামে একটি গল্পও লিখেছিলেন। শিবরামের কল্পে-কাশির দেখাদেখি হুকোকাশিকে নিয়ে গোয়েন্দা গল্প লেখেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য।
পরিশেষে আরেকটি কথা বলি। সাহিত্যের মূল বৃক্ষটি কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে নবরসের শিকড়ের আধারে। সফল সাহিত্যের আসরে স্থান পাকা করে নিতে গেলে যাতে রসিকজন মুখ না ফিরিয়ে নেন তার জন্য এই রসের সম্ভার সঠিক প্রয়োগে আনতে হবে গোয়েন্দা গল্পের মধ্যেও। উপরোক্ত লেখকদের প্রায় প্রত্যেকের লেখা গোয়েন্দা গল্পই হয়ত সে কারণে হয়ে উঠেছে রসোত্তীর্ন। এক সাক্ষাৎকারে শরদিন্দুবাবুকে প্রশ্ন করা হয় "গোয়েন্দা গল্প প্রকৃত সাহিত্য কি না?" তিনি বলেন, “রহস্য রোমাঞ্চ গল্প নিশ্চয়ই সাহিত্যে স্থান পেতে পারে। কারণ এখানেও মনুষ্যচরিত্র এবং মানবীয় ধর্ম নিয়ে রচনা। শুধু একটু রহস্য থাকে বলেই কেন নিম্নশ্রেণীর হবে? নোবেল পুরস্কার পাওয়া কোন কোন লেখকও এই জাতের লেখা লিখেছেন।......ভাষা হচ্ছে গল্পের বাহন। সেই বাহন যদি ভাল না হয় তাহলে গল্পও ভাল ভাবে বলা যায় না। হোক না গোয়েন্দা গল্প, তবু সেটা গল্প তো! সুতরাং মনোজ্ঞ করে বলা চাই।”
    একটি সমাজে কোনো বিশেষ সময়ে গোয়েন্দার আবির্ভাবের আর্থ-সামাজিক কারণ যাই থাক না কেন, বাঙালির গোয়েন্দা-রহস্য প্রীতির উত্তর খুঁজতে লাইব্রেরি তো বটেই সঙ্গে বাঙালির বৈঠকখানা বা চায়ের ঠেকও উপযুক্ত ঠিকানা হয়ে ওঠে। একটি অপরাধ সংঘটিত হলে নানা মুনির নানান তত্ত্ব ও সমাধান সূত্র বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকেও বোধহয় ঘোল খাইয়ে দিতে পারে। কল্পনা ও জল্পনা-প্রিয় বাঙালির জটিল মাথা যে রহস্য ও তার সমাধানের ন্যারেটিভেই সর্বাধিক আকৃষ্ট হবে, তাতে আর বিরোধ কোথায়? তাই একই ধরনের গোয়েন্দা  গল্প পড়তে বা ছবি দেখতে দেখতেও বাঙালির একঘেয়েমি আসে না।

তথ্য সূত্র :

১) ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি - সুকুমার সেন।
২) রহস্যগল্পের নায়কেরা - প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত।
৩) গোয়েন্দাচরিত - প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত।
৪) বিভিন্ন লেখকের লেখা গোয়েন্দা গল্প সমগ্র।
৫) ইন্টারনেট ও অন্যান্য।
৬) বিশেষ কৃতজ্ঞতা : শ্রীমতি সুবর্ণা নাগ এবং শ্রী শুভজিৎ মুখার্জী।

Post a Comment

0 Comments