জ্বলদর্চি

ড. সুহৃদ কুমার ভৌমিক, ডি লিট (অধ্যাপক, গবেষক, ভাষাবিদ) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ২৬
ড. সুহৃদ কুমার ভৌমিক, ডি লিট (অধ্যাপক, গবেষক, ভাষাবিদ)

ভাস্করব্রত পতি


"তুমি সম্প্রতি সাঁওতালি ভাষার চর্চায় নিবিষ্ট হয়েছ, এটা বিশেষ আনন্দের কথা। বাঙালির জীবন ও কর্মক্ষেত্র এখনো বড়ো সংকীর্ণ। তুমি একটি নতুন পথ বেছে নিলে, এতে যেন বহুদূর অগ্রসর হতে পারো, এই প্রার্থনা করি" -- এভাবেই ড. সুহৃদকুমার ভৌমিকের সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু। বাংলা ছন্দ সাহিত্যের আসরে আজ সুহৃদবাবু নতুন আলো দেখাচ্ছেন। বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত পংক্তির স্বরূপ নিরুপণ এবং সেই শক্তির দ্বারা চালিত হয়ে বাংলা ছন্দ যে বিচিত্র ধারায় পরিণতি লাভ করেছে তা অনুসরণে প্রয়াসী হয়েছেন তিনি।

সাঁওতালি ভাষা বাংলা ভাষার ব্যাকরণে প্রভাব বিস্তার করেছে। সেই বাংলা ভাষার গভীরতা আলোচনার জন্য প্রয়োজন সাঁওতালি ভাষার জ্ঞান। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরাসী ভাষা সহ 'কমপারেটিভ লিটারেচার' নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর ফের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন তিনি। বাংলা ছন্দের বিবর্তন বিষয়ে গবেষণা করে পি এইচ ডি পেয়েছেন অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে। আর এই বাংলা ছন্দের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে ঢুঁ মেরেছেন আদিবাসীদের রুদ্ধ দুয়ারে। আচার্য প্রবোধ চন্দ্র সেন লিখেছেন, "শ্রীমান সুহৃদ কুমার ভৌমিক বাঙলা ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তির স্বরূপ নিরূপন এবং সেই শক্তির দ্বারা চালিত হয়ে বাঙলা ছন্দ যে বিচিত্র ধারায় পরিণতি লাভ করেছে তা অনুসরণে প্রয়াসী হয়েছেন। বাঙলা ছন্দ সাহিত্যের আসরে সানন্দ চিত্তে জানাচ্ছি স্বাগতম"। তেমনি জাতীয় অধ্যাপক আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন। · His activities in this department are sane and sound and based on knowledge"

১৯৪০ সালে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৬৩ থেকে শুরু করেন 'হারিয়াড় সাকাম' পত্রিকার (সবুজ পাতা) প্রকাশ। ২০০৩ পর্যন্ত টানা ৪০ বছর এক নাগাড়ে প্রকাশিত হয় তা। সাঁওতালি ভাষার প্রচারে এবং প্রসারে এই পত্রিকা ছিল যুগান্তকারী। মেছেদাতে শুরু করেন নিজস্ব প্রকাশনা 'মারাংবুরু প্রেস'। এই প্রেস সম্পর্কে তিনি জানিয়েছেন, "মারাংবুরু প্রেস মূলতঃ উপজাতি ভাষায় পুস্তক ও পত্রিকা প্রকাশ করে"। মেচেদাতে সেই প্রেস থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন লেখকের প্রায় ২৫০-এর বেশি বই। যা আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতির অন্যতম দলিল। এখান থেকেই প্রকাশিত হয়েছে 'শাল পাতার ডাইনী ', 'সংসার ফেন্দ', 'ঞিদাপেড়া', 'ডাহার', 'ধরম আয়ো বাবা', 'ইসরড়', 'বাঙলা সাঁওতাল অভিধান 'বা 'রণড়মালা', 'সারদামঙ্গল ও দ্বারিকাপালা' ইত্যাদি।

তিনি প্রকাশ করেছেন আটখানা আদিবাসী ভাষার ব্যাকরণ বই। কোল(হো), সাদরি, ধিমাল ইত্যাদি জনজাতির ভাষার ব্যাকরণ বই তাঁরই তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত। আচার্য সুকুমার সেন লিখেছেন, "পণ্ডিতেরা মনে করেন, সাঁওতালি ভাষা বাংলা ভাষার ব্যাকরণে প্রভাব বিস্তার করেছে। তবে বাঙলা ভাষার গভীর আলোচনার জন্য সাঁওতালির জ্ঞান অপরিহার্য। সেই পথে কিছুটা এগোতে আমাদের সাহায্য করলেন, শ্রী সুহৃদ ভৌমিক সাঁওতালি ভাষার অভিধানের প্রথম খণ্ড প্রকাশ করে"।
উলুবেড়িয়া কলেজে অধ্যাপনা করতেন। অবসরের পর বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অলচিকি ভাষা বিভাগের অতিধি অধ্যাপক। তাঁর লেখা 'বাংলা ছন্দের বিবর্তন', 'ঝাড়খণ্ডে মহাপ্রভু', 'আদিবাসীদের ভাষা ও বাংলা', 'সাঁওতালি গান ও কবিতা সংকলন', 'আর্য রহস্য', 'বাংলা ভাষার গঠন', 'বাংলা দেশ ও ডেভিড ম্যাকাচ্চন', 'সাহিত্যের মুক্তি', 'বঙ্গ সংস্কৃতিতে আদিবাসী ঐতিহ্য', 'বাঙালির জাতিতত্ত্ব ও কৃষিজীবী সম্প্রদায়', 'আরণ্যক দর্শন ও সাঁওতালী ঈশোপনিষদ', 'TUSHU SONGS', 'মহাভারতে বর্ণিত জনজাতি' গবেষকদের কাছে অতি মূল্যবান গ্রন্থ। এছাড়াও তিনি লিখেছেন অজস্র প্রবন্ধ। বাংলা, ইংরাজী ও সাঁওতালি ভাষায় সেইসব প্রবন্ধগুলিতে তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন বাঙালির উচ্চারণ, ছন্দ এবং ভাব। চর্যাপদে বাঙলা ছন্দের পদক্ষেপ ঘটলেও তা প্রাচীন কলাবৃত্ত পাদাকুলক ছন্দের অনুকরণে আমাদের ভাষায় এক কৃত্রিম ছন্দের পদযাত্রা মাত্র। বাঙলা ছন্দের মুক্তি ঘটে বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যে -- মিশ্রবৃত্ত ছন্দের আবির্ভাবে -- যা আজ বাঙলা কবিতার জনপ্রিয় ও ভার বহনকারী ছন্দ। 

কবিগুরুর গীতাঞ্জলি ও গল্পগুচ্ছের সাঁওতালি অনুবাদ 'সেরেঞ সেপেঞ' ও 'গাম গাহলে' লিখে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। তাঁর লেখা 'সাঁওতালি বাংলা অভিধান' তথা 'রণড়মালা' দেখে আচার্য সুকুমার সেন চমতকৃত হয়েছিলেন। বিভিন্ন সময়ে পেয়েছেন রেভারেণ্ড ফাদার আতোয়ান, নরেশ গুহ, ডেভিড ম্যাকাচ্চিয়ান, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, রেভারেণ্ড ফাদার ফালো, কবি বুদ্ধদেব বসু, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তদের স্নেহ সান্নিধ্য।

তাঁর কাজের নিরিখেই তিনি গিয়েছেন বাংলা বিহার ওড়িশার প্রত্যন্ত আদিবাসী অঞ্চলে। কোল, হো, মুণ্ডা, জুয়াং, সাঁওতাল, ধিমাল, লেপচা ইত্যাদি জনজাতির মানুষের উচ্চারণ জানতে দিনের পর দিন থেকেছেন তাঁদের সাথে। ভূমিজ, শোরা, বীরহড়, করকো, গদব প্রমুখ উপজাতিদের সঙ্গে বাঙ্গালী প্রভৃতি আর্য্য ভাষী জনগণের ভাষা ও সংস্কৃতির সংযোগ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করেছেন তিনি। তাঁর মতে, সাঁওতাল মুণ্ডা হো অসুর প্রভৃতি উপজাতির রক্তই আমাদের মধ্যে সর্বাধিক। তিনি তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন কিভাবে ওড়িশার জুয়াং ও ভুঁইয়ারা এক বিচিত্র কৃষিজীবী সম্প্রদায়ে মিলিয়ে গেছে। রাজস্থানের শোলাঙ্কি সহ নেপালী বা গোর্খারাই এ দেশের বহু বিখ্যাত পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর মতে, "আমরা রক্তের দিক থেকে বিশুদ্ধ, স্বতন্ত্র ও অন্যের চেয়ে মহান -- একথা অহঙ্কারের সঙ্গে বলার অধিকার আর আমাদের দেশের কোনো জাতেরই নেই"। একসময়ের Class Struggle পরবর্তীতে হয়েছে Caste Struggle এ। তিনি তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন নিম্নমানের উৎপাদক সম্প্রদায়ের উচ্চতর জাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার কথা। আর এক্ষেত্রে উন্নত প্রতিষ্ঠিত জাতগুলির প্রবল বাধাদান।

কারান্তরালেও কাটাতে হয়েছে তাঁকে। আপোষ করেননি কোনওদিন। তাঁর সিলেবাসে 'ফাঁকি' শব্দটির বড়ই অভাব। কাজ পাগল এই মানুষটি বারংবার তুলে ধরতে চেয়েছেন বাঙালি ও আদিবাসীদের সম্পর্কটি ঠিক কোথায় এবং বাংলা ভাষার ভিত্তিভূমি কোথায়, নিরূপিত তা। বাংলা ভাষা গঠনে দ্রাবিড় ও অষ্ট্রিক গোষ্ঠীর কি বিরাট অবদান আমাদের জানা দরকার। ড. সুহৃদ ভৌমিক লিখেছেন, "মেদিনীপুরের ভাষায় প্রত্যক্ষ দ্রাবিড় শব্দের প্রধান কারণ হইল -- ইহা বাঙলার দক্ষিণ অংশ এবং স্থলপথে দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড় দের ইহাই প্রবেশদ্বার। ফলে মেদিনীপুরেই দ্রাবিড় উপজাতিদের আনাগোনা বেশি। ১৯৬১ সালের সেনসস রেপোর্ট অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে উপজাতিদের ১৫.১৬% ভাগ দ্রাবিড়, যাহার মোটা অংশ মেদিনীপুরে"।

কাজের সুবাদে তিনি পেয়েছিলেন ভারততত্ত্ববিদ ড. ডেভিড ম্যাকাচ্চিয়ানের সঙ্গ। দুজনে মিলে বিভিন্ন এলাকা থেকে তুলে এনেছেন অসংখ্য মণিমুক্তা। তাঁদের লেখা 'Patuas and Patua Art in Bengal' বইটি পটচিত্রের ইতিহাসে এক মাইলস্টোন। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অলচিকি বিভাগের মিউজিয়ামে তিনি দান করেছেন তাঁর সংগ্রহে থাকা কয়েক লক্ষ টাকার বহু পুরোনো পটচিত্র। একসময় উলুবেড়িয়া কলেজে অধ্যাপনা করতেন। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াতেন মেদিনীপুরের এই 'রতন' মানুষটি। তাঁর কাজের পরিধির ব্যাপ্তি পরিমাপ করা অসম্ভব। সাহিত্য এবং ভাষা নিয়ে তাঁর কাজ আজ নতুন পথের সন্ধান দিচ্ছে।

পুরুলিয়ার সিধু কানু বিশ্ববিদ্যালয় এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সাম্মানিক ডি লিট সম্মান। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে দিয়েছে 'বঙ্গবিভূষণ' সম্মান। পেয়েছেন 'সহজিয়া সম্মান'। কিন্তু প্রচারবিমুখ এই মানুষটি নীরবে কাজ করে চলেছেন নিজের তাগিদেই। সমাজের অন্তজ্য শ্রেণীর ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর কাজ প্রণিধানযোগ্য। কোনো রাজনীতির আবর্তে বাঁধা পড়েননি তিনি। নিরহংকারী এই মানুষটি অতি সহজে 'বন্ধু স্যার' হয়ে আপন করে নেন সকলকে। ভাষার বুনোটে তিনি তুলে ধরেন প্রাচীন ভারতের অধিবাসী ও বর্তমান বাঙালির ভাষা সাহিত্য ও চিন্তার সম্পর্কগুলো।
 
ক্লিক করে পড়ুন। কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের স্মৃতিগদ্য। 👇

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments