জ্বলদর্চি

জুনিয়ার পি সি সরকার-এর সাক্ষাৎকার, জ্বলদর্চির পক্ষে মৌসুমী ঘোষ

‘ম্যাজিক সম্বন্ধে আমাদের সমাজের ধারণা অন্যরকম। কিন্তু পৃথিবীর সবটাই ম্যাজিক।’

জুনিয়ার পি সি সরকার-এর সাক্ষাৎকার 
নিয়েছেন
জ্বলদর্চির পক্ষে মৌসুমী ঘোষ 


মৌসুমী: আপনার জুনিয়ার পি সি সরকার হওয়ার গল্প আপনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারগুলিতে বলেছেন। আজ আমরা আপনার কাছে শুনতে চাই জাদুকর পি সি সরকার থেকে লেখক পি সি সরকার হওয়ার গল্প। ব্যস্ত জীবনে কখন লেখার সময় বার করে নেন? 

পি সি সরকার: আমি যদি নিশ্বাস নিতে সময় পাই, আমি যদি খেতে সময় পাই, আমি যদি কথা বলতে সময় পাই, আমি যদি চলতে সময় পাই, আমি যদি ম্যাজিক দেখাতে সময় পাই, আমি যদি আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় পাই তবে আমি কেন লিখতে সময় পাব না?  

মৌসুমী: ‘প্রদীপের পাঁচালি’, ‘আমার জীবন আমার ম্যাজিক’, ‘এসো ম্যাজিক শিখি’… — আপনার ম্যাজিক সংক্রান্ত এই বইগুলি ছাড়া আপনি আর কি কি নিয়ে লিখেছেন বা লিখতে চান?  

পি সি সরকার: আমি তো, ম্যাজিক বা গল্প বা এই জীবন, তারমধ্যে কোনো তফাৎ খুঁজে পাই না। সেটাই হয়ে গেছে আমাদের সমাজের খামতি। আমার চোখের সামনে এই যে জানালা রয়েছে সেই জানলা দিয়ে আমি কত মানুষ, যানবাহন দেখতে পাচ্ছি এর থেকে বড় প্রোগ্রাম আর কী আছে? ম্যাজিক সম্বন্ধে আমাদের সমাজের ধারণা অন্যরকম। কিন্তু পৃথিবীর সবটাই  ম্যাজিক।

মৌসুমী: আপনার বাবার লেখা বইগুলো আপনার জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে? বিশেষত ম্যাজিক দেখাতে সেগুলো আপনাকে কতটা সাহায্য করেছিল? 

পি সি সরকার: নিশ্চয়ই প্রভাব আছে। সবকিছুই সবকিছুর ওপর প্রভাব ফেলে। আমাদের ইভোলিউশান তাই বলছে। আমার বাবা বা অন্য কারো ভাল লেখা বই, সবই প্রভাব ফেলে। আর বইতে যদি লেখা নাও থাকে। আগে যেমন বেদ, বেদান্ত উপনিষদ যা ছিল সব শ্রুতি। গুরু যা বলেছেন শিষ্যরা তা শুনেছেন, গান হিসেবে মুখস্থ করে মনে রেখেছেন। আর মানে বোঝানোর জন্য গুরু বিশেষ কতকগুলি শব্দ বলেছেন, এগুলো মন্ত্রগুপ্তি। আমাদের সমাজে স্কুলের শিক্ষায় এই মন্ত্রগুপ্তি আমরা পাই না। ইমপ্লিমেন্টেশন বা প্রয়োগ করা — যাকে বলে কাজে লাগানোটাই বড় কথা। শিক্ষামন্ত্রীকে যদি অর্থমন্ত্রী করা হয় তবে কি তিনি রাতারাতি অর্থমন্ত্রী হয়ে যাবেন? — মোটেই না। আমাদের ব্যাপারটা ঠিক তাই চলছে। আমি রসিকতা করে বলছি, আমাদের শিক্ষা মন্ত্রী যদি অশিক্ষিত হন, তাহলে শিক্ষার যা অবস্থা হবে! ইমপ্লিমেনটেশানটাই বড়ো কথা। যে কারণে সাঁতার শেখার, ঘোড়ায় চড়ার কোনো বই হয় না। এগুলোকে প্র্যাক্টিক্যালি করতে হয়। সেটাই শিক্ষা। আমাদের গুরুমুখী যে বিদ্যা ছিল। আমরা আশ্রমে যে শিক্ষা লাভ করতাম, সেটা আর আমাদের স্কুলের কোর্সে ক্ষুদিরামের ছবির পাশে বিশেষ কিছু ব্যক্তির ছবি দিয়ে তাদেরও মহৎ ব্যক্তি বানিয়ে দেওয়া হল। সেটাতো আমরা পড়তে চাই না। জোর করে পড়াবোও না, পড়বও না, বিদ্রোহ করব। সেজন্য মহর্ষি কারলাইল, একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, যেটা বি এ ক্লাসে এখন পাঠ্য, ফ্রম দ্য চয়েস অফ বুকস, কোন বই পড়ব / কোন বই পড়ব না। সেটার মধ্যেই আসল বিদ্যা রয়ে গেছে। বিদ্যা অর্জন করে সেটা যদি প্রয়োগ করতে না পারলাম, সে বিদ্যা তো অবিদ্যা।    

পরীক্ষার খাতায় আমার গৃহশিক্ষকের পড়ানো যদি বমি করে দিয়ে আসি, তবে সেটা আর শিক্ষা রইল না। ওটা দুর্গন্ধময় বমন করা হয়। দাগ কেটে রেখে যেতে বলেন মহাপুরুষরা। আমাদের দুর্ভাগ্য যে লিখে রেখে যেতে হয়। যে কারণে মহাপুরুষরা সবাই দুঃখ করেছেন, আমাদের ইতিহাস লেখার মতো লোক বা মানসিকতা নেই। একসময় রাজারা ইতিহাস লেখাতেন নিজের স্তাবকদের দিয়ে। অর্থাৎ স্তুতি করাতেন। সুতরাং সত্যি কথা লিখতে গেলে যে বুকের পাটা দরকার সেটার অভাব আছে বা ছিল। তাই পুরোনো পড়ার লাভ কী? এখন বিদ্বজ্জন বলতে জোকার, মানে বিদূষক, এরা সমাজবিরোধী, এরা পদলেহনকারী। তারা যদি বিদ্বজ্জনের তকমা নিয়ে ক্যা ক্যা , ম্যা ম্যা, ফ্যা ফ্যা লিখে শেখাতে চান, সেটা আমি আমার সন্তানকে শেখাতে চাই না। তাই আমি যে শিক্ষা অর্জন করেছি, সেটা পারফর্ম করব বলেই আমি মানুষকে কাছে আসতে বলি। উপনিষদ কথাটার মানেই হচ্ছে সামনে কাছে এসে বোসো।  আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের কথা হচ্ছে, রেডিওয় টেলিভিশনে বা মাঠে বসে আমার কথা শোনো। মাঠে কাঁই কাঁই করে চেঁচিয়ে অসত্য ভাষণ কোনো জীবনের সাহিত্য নয়। সেটা হয়তো যা চলছে তার প্রতিফলন, তাও লেখা হচ্ছে। আমি তাই লিখছি ততটুকু, যতটুকু আমি বুঝতে পেরেছি পৃথিবীটাকে। 
পৃথিবীটাতো ম্যাজিকময়। এই ম্যাজিকময় কথাটা যদি আমরা বুঝতে না পারি তাহলে ম্যাজিক নিয়ে আলোচনা করার কোনো মানে হয় না। একজন লেখক বা গায়ক বা তবলিয়া চাইছেন ভাল লিখতে বা গাইতে বা তবলা বাজাতে। যদি উনি অসাধারণ লেখেন বা গান বা বাজান, তখন আমরা বলি ওনার হাতে জাদু আছে। জাদুকর কথাটাই একটা খেতাব বিশেষ। সেটা শিল্প ছাড়িয়ে অন্যমাত্রায় চলে যাওয়া, যেমন হকির জাদুকর, ফুটবলের জাদুকর — সর্বক্ষেত্রের জাদুকর হতে পারে। আমি যে জাদুকর, কবিগুরুর ভাষায় ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’, অর্থাৎ সত্যের সীমানাটাকে শিল্পী শিল্পের মাধ্যমে বাড়িয়ে দেন। ম্যাজিশিয়ানের রাজ্যে পাঁচ-সাত পঁয়ত্রিশে কোনো মজা নেই। নিয়ম ছাড়া আমরা কি কট্টর বাস্তবে যাবার চেষ্টা করব না? নাকি রকেটে উঠব না? গাছের ডালে বেশ সুন্দর বসবাস করছি। তাহলে তো প্রগতি আসবে না। বাস্তবে থেকে আমরা কল্পনার রাজ্যে যদি না ঝাঁপ দিই তবে প্রগতি আসবে না। প্রগতি আনায় যারা সফল হয়ে গেছেন, তার ওপর আমরা যদি মন্ত্রমিদং করি সেটাকেই বলে ‘জাদুবিদ্যা’। 


মৌসুমী: আবরা-কা-ডাবরা বা গিলি-গিলি-গে বা হিং-টিং-ছট — ম্যাজিকের এই কথাগুলো কি যেকোন কিছু শুরুর আগে যেমন বলা হয় ১-২-৩ স্টার্ট তেমন কিছু, নাকি এর পিছনে ম্যাজিক ইতিহাসের কোন গল্প আছে? 

পি সি সরকার: এগুলো জাদু বিদ্যার মধ্যে অলংকরণ। এগুলো ছাড়াও জাদু হয়। আসলে মেলায় বা স্টেজে যে ম্যাজিকগুলো হয় আপনি সেইখানে আটকে আছেন। আমি স্টেজে একবারও বলিনা আবরা-কা-ডাবরা বা অন্যগুলো। যারা এগুলো বলেন তাদের জিজ্ঞাসা করবেন। তবে আমার ধারণা যিনি এগুলো বলেন তিনি একটা অলীক অবাস্তব জগতকে টেনে আনছেন বাস্তব জগতে এবং যথেষ্ট সংস্কার ছড়াচ্ছেন। আমি এটা করি না।  

  একজন জাদুকরের পোশাক কী হবে তা নিয়ে কেউই ভাবেন না। অনেক এক্সপেরিমেন্ট করে কবিগুরু পোশাকটা বানিয়েছিলেন। এগুলো নিয়ে কেউ আলোচনা করেন না। প্রতিটা খেলায় আলাদা পোশাক মানে কিন্তু সেজে নতুন পোশাক পরলাম তা কিন্তু নয়। মঞ্চে আমি আলেকজান্ডারের পাঠ করছি, আর পোশাক পরেছি ধুতি পাঞ্জাবি, তা কী হবে? আমাদের শিক্ষিত লোকেরাও প্রচুর এরকম ভুল করে বসে থাকেন। ইতিহাসে আলেকজান্ডার আর পুরুর যখন দেখা হল, তখন আলেকজান্ডার জিজ্ঞাসা করছেন, বন্দী তুমি আমার কাছে কী ব্যবহার প্রত্যাশা কর? পুরু তখন কী ভাষায় বলেছিলেন, রাজার কাছে রাজার ব্যবহার, কথাটা? পুরু তো পাঞ্জাবী, তিনি কি পাঞ্জাবী ভাষায় বলেছিলেন? নাকি পুরু গ্রীক ভাষা জানতেন? সুতরাং আমাদের ভুল শেখান হয় প্রচুর। 

মৌসুমী: আজকালকার বাচ্চারা হ্যারী পটারের খুব ফ্যান। হ্যারি পটারের মতো আপনার কি ম্যাজিক স্কুল স্থাপন করার ইচ্ছা আছে অথবা এমন স্কুল আদৌ স্থাপন করা সম্ভব কি?

পি সি সরকার: হ্যারী পটার সাহিত্য। সাহিত্যকে বাস্তবে টেনে আনতে হবে এটা আমি মানব না। কান দিয়ে যদি সত্যি সত্যি দেখা যেত, চিন্তাভাবনা দেখা যেত, ব্যাপারটা সেরকম। ম্যাজিক কিন্তু কেউ কানে শোনে না, ম্যাজিক দেখানোর জিনিস। ম্যাজিকে স্টেজে মোহময়তা সৃষ্টি করাটাই আসল। কান একটা উপাঙ্গ। এটা তো আমাদের গুরুর আশ্রমটাকে দেখিয়েছে। ম্যাজিক অবাস্তবের মঞ্চরূপ। আমরা তো বাস্তবটাকে নিয়েই সামলাতে পারছি না। আগে বাস্তবটাতে রপ্ত হই। বাস্তবে আমাদের কোভিড হয়েছে। বাস্তবে আমরা সকলে পলিটিক্যালি ডিফারেন্ট। বাঙালিদের মধ্যে বিভাজন হয়ে গেছে। আগে ছিল ঘটি-বাঙাল। এখন হয়ে গেছে এই পন্থী - ওই পন্থী। সুতরাং মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ এটি বরাবরই আমাদের কাছে অভিশাপ। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র, বৈশ্য – এই যে বিভেদগুলো। এখনো তথাকথিত শিক্ষিত মহল বলছেন, আদিবাসী রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। আমরা কিন্তু বিদেশী। আদিবাসী কথাটাই আমার সাংঘাতিক প্রটেস্ট আছে। ম্যাকলে সাহেব এসে সিডিউল কাস্ট কথাটা উস্কে দিয়েছেন। সাহেবদের মধ্যেও জুতো পালিশের লোক আছে, জমাদার আছে। কিন্তু সাহেবদের মধ্যে কাস্ট সিস্টেম নেই। ভারতবর্ষ সাঁওতাল ও দ্রাবিড়দের দেশ। সেখানে বাইরে থেকে এসে আমরা লুটেপুটে খাচ্ছি। আসলে আমরাই ঋণী।

    সাঁওতালদের মুখ্য দেবতা ‘বোংগা’। বোংগা পাহাড় তাদের রক্ষক দেবতা বলে তাঁরা মানেন। বোংগা কথাটা থেকে বঙ্গভূমি কথাটা এসেছে। 

মৌসুমী: করোনা কালে অনলাইন ক্লাসের জন্য ছোটোরা প্রায় সকলেই ফোন জ্বরে ভুগছে। তাদের ফোনের এই আকর্ষণ থেকে সরিয়ে আনতে আপনার দাওয়াই কি? 

পি সি সরকার: আপনি তো আপনার প্রশ্নের মধ্যে উত্তর দিয়েই দিয়েছেন। আমি বলব, সবথেকে সহজ বুদ্ধি ওরা রাজনীতি করুক, লেখাপড়া বন্ধ করে দিক। 

মৌসুমী: বাস্তবের কোনও কঠিন অবস্থাকে আপনার ম্যাজিক করে পাল্টে দিতে ইচ্ছে করে?

পি. সি.সরকার : আমি বাচ্চাদের খুব ভালোবাসি, মানুষকে খুব ভালোবাসি। (হাসি) নতুন যারা আসছে তাদের বলি, ভালো থাকো সুখে থাকো।


ক্লিক করে পড়ুন। কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের স্মৃতিগদ্য। 👇

Post a Comment

0 Comments