জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—উত্তর আমেরিকা (কানাডা)পেঁচাদের চোখমুখ /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প—উত্তর আমেরিকা (কানাডা)
পেঁচাদের চোখমুখ 

চিন্ময় দাশ


উপর উপর দেখলে মনে হবে খরগোশ আর নেকড়ে—দুজনের মধ্যে ভারি ভাব। আসলে কিন্তু তা নয়। বরং একেবারে উলটো। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। দুজনেই দুজনকে চালাকিবাজ বলে সন্দেহ করে। সত্যি বলতে কী, খরগোশ খুবই চালাক। কারও সাথে চালাকি করতে পারলে, ভারি আমোদ হয় তার। বিশেষ করে, নেকড়েকে বোকা বানাতে তার সবচেয়ে বেশি আনন্দ। 
ঘটনা হোল, বনের বেশ গভীরে দুজনের বাস। মোটামুটি কাছাকাছিই থাকে দুজনে। এদিকে হয়েছে কী, দুজনের বাড়ি থেকে প্রায় সমান দূরত্বে এক গরীব বুড়ির বাড়ি। একটি মেয়ে আছে বুড়ির। দেখতে ভারি সুন্দর। দাঁড়কাকের ডানার পালকের মত ঘন কালো রঙ মেয়েটির মাথার চুলের। চোখ দুটোতে নীল সাগরের গভীরতা। খরগোশ আর নেকড়ে দুজনের ভারি পছন্দ বুড়ির সেই মেয়েকে। দুজনেই তাকে বিয়ে করতে চায়।
খরগোশ মাঝে মঝেই চলে যায় বুড়ির বাড়িতে। নরম বাদামী ফারের জামা গায়ে দেয়। গলায় ঝকঝকে হার, পায়ে নূপুর। খরগোশের তো কাটা-ঠোঁট। তার পাতলা গোঁফে সেটা ঢাকা পড়ে না। সেটা আড়াল করবার জন্য, একটা বাঁশের বাশি চেপে রাখে মুখে। পোষাক আর বাঁশির সুরে, মেয়েটিকে ভোলাতে চায় খরগোশ। তবে, তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। মেয়েটির তাকে আদৌ পছন্দ নয়। বরং তেজিয়ান, ক্ষিপ্র আর নম্র নেকড়েকেই ভালো লাগে তার।
তখন বসন্তকাল। বুড়ির বাড়ি এসেছে খরগোশ। শুনতে পেলো, দাওয়ায় বসে মা–মেয়েতে কথাবার্তা হচ্ছে। বুড়ি বলছে—খরগোশকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তারচেয়ে, নেকড়েকেই বিয়ে কর তুই। ভালো শিকারি। কোনদিন পেটের চিন্তা করতে হবে না আমাদের। 
শুনে যেমন ভারি কষ্ট হোল, রাগও হোল খরগোশের। এটা কোন মতেই হতে দেওয়া যায় না। যেভাবেই হোক, এ বিয়ে আটকাতে হবে। সেদনই রাত্রে চুপিচুপি বুড়ির বাড়ি গিয়ে হাজির খরগোশ। নেকড়ে সম্পর্কে উপহাস করে বলতে লাগল—নেকড়েটা একটা শিকারি নাকি? রাজ্যের আলসে, আর ভীতুর ডিম। কিচ্ছুটি পারে না। নেহাত না খেয়ে মরবে, আমিই তো শিকার করে খাও্ইয়াই হতভাগাটাকে। বলতে গেল, অকম্মার ধাড়ি একেবারে। দূরের পথ কোথাও যেতে হলে, নেকড়টার পিঠে চড়েই তো যাই আমি। 
শুনে বুড়ি তো হতবাক। এমন অকর্মার হাতে মেয়ে দেওয়া যায় নাকি? কিন্তু এও যে ঠিক বলছে, সেটা জানা যাবে কী করে? খরগোশ যে মিথ্যা বলায় ওস্তাদ, তাও শুনেছে বুড়ি। অতব ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 
বুড়ি ব্যাপারটা যাচাই করে নিতে চাইল-- তুমি যদি সত্যিই নেকড়ের পিঠে চেপে আসতে পারো আমার এখানে, তবেই বুঝব তোমার কথা ঠিক। নেকড়ে বাতিল, তোমার সাথেই বিয়ে হবে আমার মেয়ের। 
কৌশলটা ঠিকঠাক কাজে লেগেছে। খুশি হয়ে বাড়ি ফিরে গেল খরগোশ।
পরদিন। মাথায় একটা ফন্দি এঁটে নিয়ে, সোজা নেকড়ের ডেরায় হাজির হোল খরগোশ। গলা মিষ্টি করে বলল—এক কাজ করলে হয় না? চলো না বন্ধু, একবার বুড়ির বাড়ি যাই। 
শুনে, নেকড়ে তো লাফিয়ে উঠল। মনে ভারি ফুর্তি। আবার একটু কিন্তু ভাবও হোল। বিমর্ষ গলায় বলল—সে তো ভালই হয়। কিন্তু আমার সাথে কি আর দেখা করবে ওরা? 
--আরে ভায়া, আমি আছি কী করতে? সে ভার তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। তুমি যাবে কি না, সেইটা শুধু বলো। বাকিটা আমি দেখে নেব। 
নেকড়ে তো এক পায়ে খাড়া। দুজনের মনেই ফূর্তি। এক সাথে রওণা হয়ে গেল দুটিতে।  
খানিকটা গিয়েছে, অমনি একটু জোরে জোরে ককাতে লাগল খরগোশ। নেকড়ে বলল—হোলটা কী তোমার? অমন করছ কেন, বন্ধু?
--আর বোল না গো। ভারি মোচড় দিচ্ছে পেটে। একটা পাও আর ফেলতে পারছি না আমি। মরে যাব মনে হচ্ছে। তুমি একাই চলে যাও।
নেকড়ে আঁতকে উঠল—তাই কখনো হয় নাকি? তোমাকে ছাড়া আমি যাবোই না। 
--কী করে যাই বলো তো আমি? একটা পা ফেলবারও ক্ষমতা নাই আমার। 
--তাহলে এখন উপায়? কথা তো নয়, আর্তনাদ করে উঠল নেকড়ে। বড় আশা নিয়ে বেরিয়েছে বেচারা! 
--একটা মাত্র উপায় আছে। কিন্তু সেটা তোমাকে বলি কী করে? খরগোশের কথা শেষ হতে না দিয়ে, নেকড়ে বলল—তাহলে, বলে ফেলো, উপায়টা কী? দেরি কেন? 
খরগোশ বলল—তুমি যদি বাকি রাস্তাটা আমাকে পিঠে চাপিয়ে নিয়ে যাও, তাহলে তো আর কোন ভাবনাই থাকে না।
নেকড়ে ভারি খুশি এ কথা শুনে—এ আর এমন কী কথা? একটা ঢেলার মত ওজনও নয় তোমার। আমার কোন অসুবিধাই হবে না। নিশ্চিন্তে চেপে পড়ো। মনের খুশি মনে চেপে রেখে, নেকড়ের পিঠে চেপে বসল খরগোশ।
খানিক দূর না যেতেই তার আবার বায়না খরগোশের—দাঁড়াও, বন্ধু। এ ভাবে আমি তো যেতেই পারছি না।
নেকড়ে বলল—কেন গো, আবার কী হোল? 
--আর বোল না ভাই। জিন ছাড়া যাওয়া যায় না কি? খরগোশ কাতর গলায় বলল—তোমার শিরদাঁড়ার ঘষা লেগে, ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে আমার। 
এক কাঠুরের বাড়ি থেকে একটা জিন ধার করা হোল। নেকড়ের পিঠে চাপানো হোল জিনটা। খরগোশ চেপে বসল জিনের ওপর। 
খানিক দূর না যেতেই, আবার থামিয়ে দিল নেকড়েকে। নেকড়ে বলল—আবার কী হোল? 
খরগোশ উতসাহের সাথে বলল— তুমি বুঝতে পারছো, এভাবে যেতে কী দারুণ দেখাচ্ছে আমাদের দুজনকে? যেন এক তেজিয়ান ঘোড়া চলেছে দূর দেশে। তবে একটু খামতি থেকে যাচ্ছে। 
--কিসের খামতি? বলো শুনি। 
খরগোশ বলল—এই জিনের সাথে, একটা লাগাম, একজোড়া বুটজুতো আর ছোট্ট একটা চাবুক—এগুলো যদি থাকতো, সোনায় সোহাগা হোত একেবারে। চোখ কপালে উঠে যেত মা –মেয়ের। কথা সরত না মুখ থেকে।
নেকড়ে এবার জিনিষগুলো এক শিকারির বাড়ি থেকে জোগাড় করে আনল। এবার সম্পূর্ণ হোল ছবিটা। নেকড়ের পিঠে জিনের ওপর বসেছে খরগোশ। দু’পায়ে বুটজুতো। বাম হাতে লাগাম। ডান হাতে একটা চাবুক।
খোশমেজাজে গল্প করতে করতে চলেছে দুটিতে। দুজনের মনেই ফূর্তি। বুড়ির বাড়ির কাছাকাছি হতেই, খরগোশ চেঁচিয়ে উঠল—হোয়া, হোয়া। দাঁড়িয়ে যা এবার। আর ছুটতে হবে না তোকে। পৌঁছে গেছি। বলেই, দু’পায়ের জুতো দিয়ে নেকড়ের পেটে দুই খোঁচা। আর চাবুকের এক বাড়ি।
ঘা খেয়ে, নেকড়ে একটু ককিয়ে উঠল বটে, মুখে কিছু বলল না। খরগোশ চাবুকটা একবার বাতাসে ঘুরিয়ে নিয়ে, নেকড়ের পিঠ থেকে নামল আয়েস করে।  হাতের লাগাম একটা গাছের ডালে জড়িয়ে, বেঁধে দিল নেকড়েকে। আস্তে করে বলল—এইখানে দাঁড়িয়ে থাকো চুপটি করে। আমি মা-মেয়েকে ডেকে আনছি।
ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে সবই দেখছিল মা আর মেয়ে দুজনেই। তাদের তো চক্ষু চড়কগাছ। সত্যিই তো, খরগোশ তো মিথ্যে বলেনি। নেকড়েটা দেখছি একেবারে বেকুব একটা।
ভাবতে ভাবতেই খরগোশ স্বয়ং এসে হাজির হয়েছে—কীগো, বলেছিলাম কি না? এই হোল ব্যাটার আসল চেহারা। নিজেদের চোখেই দেখে নাও। 
বুড়ির দরদ একেবারে মরে যায়নি তাই বলে। সে বলল—হ্যাঁ, দেখছি তো। যাকগে, পরিশ্রম করে এসেছে। একটু খাবার দিই ওকে। 
খরগোশ তাড়াতাড়ি বলল—তুমি আবার কষ্ট করবে কেন? আমাকে দাও। আমি দিয়ে আসছি।
বুড়ি খানিকটা মাংস দিয়েছে। মাংস পেয়ে নেকড়ে তো ভারি খুশি। চাবুকের ঘা, পেটে জুতোর খোঁচা কিছুই মনে রইল না তার। বরং ভাবল, এতো সহজে মাংস পেয়ে যাওয়ার এই খেলাটা তো মন্দ নয়।
বুড়ির সাথে অনেক গল্পগাছা হোল খরগোশের। ফেরার সময়, বাড়িটার খিড়কির পথ ধরে সরে পড়ল চুপিসারে। নেকড়ে যাতে টের না পায়। থাক ব্যাটা গাছে বাঁধা হয়ে। 
এদিকে দেখতে দেখতে বিকেল হোল, সন্ধ্যাও নেমে গেল এক সময়। তখন আবার খিদে লেগেছে নেকড়ের। সেই কোন সকালে খানিকটা মাংস খেয়েছে। বিরক্ত হয়ে উঠল মনে মনে। অনেক টানা-হেঁচড়া করেও, লাগামটা ছেঁড়া গেল না। অগত্যা দাঁত দিয়ে কেটেই ফেলল সেটাকে।
রাতটুকু বুড়ির ঘরেই কাটিয়ে দেওয়া যাক। তাছাড়া, মেয়েটকে তো এখনও একবার দেখা হোল না। কত আশা করে আসা—এই সব ভেবে, বুড়ির ঘরে এসে হাজির হোল নেকড়ে। 
ঘরে তো ঢুকতেই দিল না বুড়ি, দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল তাকে। উলটে আরও কতো কথা শুনিয়ে দিল—তোমার এলেম আমাদের বোঝা হয়ে গেছে। একটা পুঁচকে খরগোশ তোমাকে লাগাম পরিয়ে চড়িয়ে বেড়ায়। খবরদার, তোমাকে যেন আর এই এলাকায় না দেখি। শেষবারের মতো বলে দিলাম। দূর হয়ে যাও এখান থেকে। 
নেকড়ের মাথায় আগুন জ্বলছে। হতভাগা খরগোশ বোকা বানিয়েছে তাকে। ওটাকে নিকেশ না করে শান্তি নাই। ঘরের পথে ফিরে চলল হতাশ মনে।
পরের দিনই খরগোশ বুড়ির কাছে শুনল, বুড়ি দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে নেকড়েকে। একটা কথাও বলতে দেয়নি। শুনেই খরগোশের বুক ছাঁত করে উঠেছে। তার মানে হোল, সব বুঝে গেছে নেকড়ে। এবার আর রক্ষা নাই। 
ক’দিন ঘর থেকে বেরই হোল না খরগোশ। কিন্তু না খেয়ে ক’দিন আর থাকা যায়? যে দিন  বেরুল, একটু দূরের দিকেই চলে গেল। বলা যায় না, নেকড়েটার সামনে পড়ে যায় যদি। 
ঘুরতে ঘুরতে একটা বাঁধাকপির খেত চোখে পড়ে গেল খরগোশের। আহা, কী আনন্দ, কী আনন্দ! বাঁধাকপি চিবোতে লেগে গেল মনের সুখে।  এদিকে খেতের মালিক যে আড়ালে বসে পাহারা দিচ্ছে, সে জানবে কেমন করে? ধরা পড়ে গেল বেচারা।
একটা দড়িতে গাছের সাথে খরগোশকে বেঁধে, লোকটা বলল—দিন দিন চুরি করে কপি খেয়ে যাস আমার। উচিত শিক্ষা দেব আজ তোকে। একটু গরম জল নিয়ে আসি বাড়ি থেকে। তারপর মজা বোঝাব তোকে।
এদিকে অন্ধকার নেমে গেছে। এক বিপদের উপর নতুন বিপদ উদয় হোল খানিক বাদে। নেকড়াটাই এসে পৌঁছেছে সেখানে। চোখে পড়া মাত্রই খরগোশ চিতকার জুড়ে দিল—তাড়াতাড়ি এসো, বন্ধু। দয়া করে বাঁচাও আমাকে।
খরগোশটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। বাঁচাও বাঁচাও করছে। কারণ কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার। অবাক হয়ে নেকড়ে বলল—হয়েছে কী তোমার? এই দশা কেন? হোল কী করে? 
--আর বোল না, বন্ধু!। কী উটকো বিপদেই যে পড়েছি।  খানিক আগে এখানে পৌঁছেছি। এই খেতের চাষির সাথে দেখা। তার না কি বাড়িতে কী পূজাআচ্চা ছিল। আস্ত একটা ভেড়া উতসর্গ করেছে খেতের দেবতাকে। এখন আমাকে ধরেছে, সেটা আমাকে খেতে হবে।
--বলো কী হে, ভেড়া খেতে হবে তোমাকে?
--তাহলে আর বলছিটা কী তোমাকে? কেন যে মরতে এদিকে এলাম। পালিয়ে না যাই, তাই আমাকে বেঁধে রেখে, বাড়ি গেল  ভেড়া আনতে।
এসব কথায় আর নেকড়ের কান নাই, মন নাই। ভেড়ার নাম শুনেই, ঠোঁট চাটতে লেগেছে সে। ভেড়া ভারি উপাদেয় খাদ্য। খরগোশ আড়চোখে চেয়ে দেখল, ফন্দিটা তার কাজে লেগে গেছে। সে বলল—এক কাজ করলে হয় না? তাতে আমি রেহাই পাই, তোমারও পেট ভরে। 
নেকড়ে তো এটাই চাইছে মনে মনে। সে না বোঝার ভাণ করে বলল—কী কাজ বলো। আমার আপত্তি নাই। 
--আমার জায়গায় তুমি এসে দাঁড়াও। ভেড়াটা তোমাকেই দিয়ে দেবে চাষি। 
খরগোশের কথায় সাথেসাথেই নেকড়ে রাজি। বলল—সে তো ভালো কথাই। আমার আপত্তি নাই।
খরগোশ বলল—তাহলে আর কী। চটপট আমার দড়ি খুলে দাও। আমি তোমাকে আটকে দিচ্ছি। 
বন্দী দশা থেকে ছাড়া পেয়ে গেল খরগোশ। নেকড়েকে শক্ত করে বেঁধে, মনে ভারি আনন্দ। আবার বোকা বানানো গেছে শয়তানটাকে। মুখে বলল—আমি কাছাকাছিই থাকছি। তোমার ভোজ হয়ে গেলে, একসাথে ফেরা যাবে।
খানিক বাদেই নেকড়ে দেখল লোকটা ফিরে আসছে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। কিন্তু গাছের তলায় অন্ধকার। আলো আবছা। এক হাঁড়ি গরম জল এনেছে লোকটা। খরগোশ না নেকড়ে-- সে অত খেয়াল করল না। হড়হড় করে পুরো জল নেকড়ের গায়েই দিল ঢেলে। আচমকা এই কাণ্ডে নেকড়ে তো পরিত্রাহি ডাক ছাড়তে লেগেছে। লোকটা বলল—বাব্বা, গরম জলে তোর গলা তো বেশ খোলতাই হয়েছে দেখছি। তা হবে না? বসন্তের জোছনা রাত। বাঁধাকপি ভর্তি পরের বাগান। চুরি করে খাওয়ার মজা কত! বোঝ এবার ঠেলা। হয়েছেটা কী? মজা আরও বাকি আছে।
বলেই হাতের লাঠি দিয়ে সপাং সপাং মারতে লাগল নেকড়েকে। ভয়ানক চিতকার করছে বেচারা। পিঠের চামড়া ফেটে যাচ্ছে। মাথাটাও ফেটে যাওয়ার জোগাড়। প্রাণটাও যাওয়ার অবস্থা এবার। 
গাছের আড়ালে বসে, সবই কানে যাচ্ছে খরগোশের। হাসির দাপটে পেট ফেটে যেতে বসেছে তারও। 
এদিকে ছটফট হাঁচোড়-পাঁচোড় করতে করতে বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। অমনি পড়ি কি মরি করে লম্বা ছুট নেকড়ের। বনের ভেতর কোন দিকে যাচ্ছে, সে খেয়াল করবার ফুরসতও নাই তার। 
সেদিন থেকে দুজনেই চোখ কান খোলা রেখেছে। নেকড়ে তক্কে তক্কে থাকে। দু’-দুবার ঠকিয়েছে বদমাসটা। এবার চোখে পড়লে, কোন কথা বলবার আগেই কব্জা করে ফেলতে হবে। মুণ্ডু চিবিয়ে খাবো, তারপর অন্য কথা। খরগোশও বুঝে গেছে, বিপদ এবার বড় মাপেই নামবে। হুঁশিয়ার না থাকলে, চিতপটাং।
দিন সাত আট কেটে গেল। কেউ কারও চোখে পড়ল না। একদিন রাত্রি নেমেছে। গোল আর ইয়াব্বড় একখানা চাঁদ উঠেছে আকাশে। তার আলোয় ঘর থেকে বেরিয়েছে খরগোশ। কিছু পেটে দেওয়া দরকার। 
একটা তামাকের খেতে ঢুকে, মনের সুখে পাতা চিবোচ্ছে খরগোশ, নেকড়েটা দেখতে পেয়ে গেল তাকে। তবে রে—বলে এগিয়ে আসছে, খরগোশও দেখল, সামনে সাক্ষাত যম। অমনি এক ছুট। নেকড়েও ছুটছে পেছনে। ছোট ছোট পায়ে নেকড়ের সাথে পাল্লা দেওয়া যায় কখনো? একবার এদিক একবার ওদিক ঘোরপ্যাঁচ লাগিয়ে দৌড়চ্ছে। তাতেও যখন পেরে ওঠা যাচ্ছে না, একটা পুরণো গাছের গায়ে গর্ত চোখে পড়ে গেল খরগোশের। যাক বাবা বাঁচা গেল। এই ভেবে, সুড়ুত করে ঢুকে পড়ল খোঁদলটাতে। 
নেকড়েও তাকে  ঢুকে পড়তে দেখেছে। গাছটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল সে। –এইবার কব্জায় পেয়েছি ব্যাটাকে। এবার পালাবে কোথায়? আগে গাছ কাটব। তারপর হতচ্ছাড়াটাকে কচুকাটা করব টেনে বের করে। সবার আগে কুড়ুলটা আনতে হবে বাড়ি থেকে।
হঠাতই চিড়িক দিয়ে উঠল মাথায়। অরেব্বাস, কুড়ুল আনতে যাবো কী করে? আমি গেলেই তো কেটে  পড়বে ও। কী করা যায়, কী করা যায়? এদিক ওদিক চেয়ে দেখতে গিয়ে, একটা পেঁচাকে চোখে পড়ে গেল নেকড়ের। সামনেই একটা গাছের ডালে বসেছিল পেঁচাটা।
নেকড়ে পেঁচাকে বলল—এতদিনে কব্জায় পেয়েছি এটাকে। ওর মুণ্ডু কাটবো আজ। তার আগে বাড়ি গিয়ে কুড়ুল আনতে হবে আমাকে। ততক্ষণ তুমি একটু নজর রাখবে? পাহারা দেবে এই খোঁদলের মুখটায়, খরগোশটা বেরিয়ে না পালায়।
গাছ থেকে নেমে গর্তটার সামনে বসে পাহারা দিতে লাগল পেঁচা। বলল—ঠিক আছে। তুমি নিশ্চিন্তে যেতে পারো। আমি একে আটকে রাখছি। 
ভিতরে কোটরে বসে, সব কানে যাচ্ছে খরগোশের। সে ভালোই জানে, আজ পর্যন্ত না কেউ তাকে কব্জায় পেয়েছে, না কেউ আটকে রাখতে পারবে। কৌশল এখনো বাকি আছে তার। 
নেকড়ে চলে যেতেই, খরগোশ মুখ বার করে পেঁচাকে বলল—বসে বসে করছোটা কী ওখানে। তুমি তো এই এলাকাতেই থাকো। অত সুন্দর একটা বাসা আছে এখানে ভিতরে, সে খবর জানো তুমি? 
--সুন্দর বাসা আছে ভেতরে? সত্যি বলছো তুমি? পেঁচা বেশ খুশি।
খরগোশ জবাব দিল—আমার বলা না বলায় কী যায় আসে? নিজের চোখে দেখে নাও এসে। 
পেঁচা বলল—দূর, খুব অন্ধকার। কিছুই দেখতে পাবো না আমি। 
--পাবে না মানে? আলবাত পাবে। খরগোশ বলল—আলো আছে আমার কাছে। জ্বেলে দেব। তুমি শুধু চোখ দুটো যতটা পারো বড়ো করে, মুখটা গর্তের কাছে নিয়ে এসো। পরিষ্কার দেখতে পাবে। 
পেঁচাদের চিরকালই খুব কৌতুহল। খরগোশের কথা মতো, চোখ দুটো একেবারে বড় করে, গর্তের ভেতরটা দেখতে গেল সে। তামাক পাতার রস ভর্তি ছিল খরগোশের মুখে। সাথেসাথেই দিল ছিটিয়ে পেঁচার চোখে মুখে। 
আর যায় কোথায়? ভয়ানক যন্ত্রনায় চিতকার করে উঠল পেঁচা, চোখ দুটো জ্বলে যাচ্ছে তার। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। বন্ধও করা যাচ্ছে না চোখগুলো। চোখ রগড়াচ্ছে আর চেঁচাতে চেঁচাতে, এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াতে লাগল বেচার। আহা, কী সুন্দর সুযোগ, খরগোশ বেরিয়ে একেবারে হাওয়া হয়ে গেল। পেঁচা সেখবর জানতেও পারল না।
কুড়ুল নিয়ে ফিরেই, গাছটা কাটতে লেগে গেল নেকড়ে। কাটা শেষ হলে, এবার টুকরো করতে লাগল গুঁড়িটাকে। কিন্তু কোথায়? খরগোশের টিকিটাও নাই কোটরে। 
এটা নিশ্চয়ই পেঁচার কাজ। এ ব্যাটাই পালাতে দিয়েছে শয়তানটাকে। মাথা গরম হয়ে গেল নেকড়ের। কুড়ুলের বাঁট দিয়ে পেঁচার মুখে দিল কয়েক ঘা বসিয়ে। সে বেচারা মরছিল চোখের জ্বালায়। ইয়াব্বড় হয়ে গেছল চোখ দুটো। বন্ধও করতে পারছিল না। এবার মুখটাও গেল থেঁতলে। পাখিদের মুখ ছুঁচালো। এখন সেই মুখ হয়ে গিয়েছে চ্যাপ্টা। আর, মাথাটা আকারে এই বড়টি। সে এক বিকট অবস্থা দাঁড়িয়েছে পেঁচার। 
নেকড়ের সেদিকে তাকাবারও সময় নাই। পেঁচা কাতরাচ্ছে। রাগে গরগর করতে করতে, খরগোশের খোঁজে চলে গেল নেকড়ে।
সেদিন থেকে খরগোশ আর নেকড়ের বন্ধুত্ব তো বহু দূরের কথা, ভাব-সাবও নাই দুজনের। নেকড়ে আজও তক্কে তক্কে থাকে খরগোশের। একবার বাগে পেলে, চালাকি ঘুচিয়ে দেবে চিরদিনের মত। খরগোশও ভালই জানে সেই মতলব। নেকড়ের ছায়াও মাড়ায় না কোন দিন।
আর পেঁচা? সে বেচারার কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো। বেঢপ একখানা মাথা হয়েছে পেঁচার। এরকম মাথা সারা পৃথিবীর কোন দেশে কোন পাখিরই নাই। আর চোখ দুটোর কথা না বলাই ভালো। বড় বড় ড্যাবডেবে দুটো চোখ। বন্ধ করতে পারে না কোন দিন। চোখে তামাক-রসের যন্ত্রনা আজও মেটেনি প্যাঁচাদের। দিনের আলোটুকুও সইতে পারে না তাদের চোখ। রাতের অন্ধকারেই যতটুকু যা দেখতে পায় তারা। বলতে কী, সেজন্যই দিনের বেলায় বাইরে বেরোনোও ছেড়ে দিয়েছে পেঁচারা।

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments