জ্বলদর্চি

নিজের ছবি /সমরেশ মজুমদার

নিজের ছবি

সমরেশ মজুমদার 


এরকম কথা ছিল না। জল ওপর থেকে ঝরলে তা নিচে নেমে যাবে, সেটাই তো নিয়ম। জন্মালেই প্রতিটি দিন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে হবে, এর অন্যথা তো হয় না, তেমনি, এই আমি, আমার পাঁচ বছর বয়সে যে পৃথিবীকে চিনতাম সেটাই তো আমার নিজস্ব ছিল। পরপর গোটা আটেক টিনের চালওয়ালা বাড়ি, সামনে বিশাল খেলার মাঠ, মাঠের মাঝখানে একটা বিশাল লম্বা গাছ, যাতে কখনই ফুল ফুটতো না কিন্তু প্রচুর ছায়া দিত। মাঠের ওপাশে তারের বেড়া ডিঙোলেই সরু পিচের রাস্তা। সেই রাস্তায় গোটা দিনে বড় জোর গোটা পনের গাড়ি ছোটাছুটি করত। বাসের সংখ্যা চারের বেশি নয়। আর সেই পিচের রাস্তার দুপাশে প্রায় হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকত শাল, সেগুন অথবা ইউক্যালিপটাস গাছগুলো। সকাল সন্ধেতে গাছগুলোয় রাজ্যের পাখিরা এসে দখল নেওয়ার চেষ্টা করত। রাতের জায়গা দখল নেওয়ার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত।

আমাদের সেই টিনের চালওয়ালা বাড়িগুলোয় আটটি পরিবার থাকতাম। এবং কি আশ্চর্য, আটটি পরিবারেই আটজন প্রায় সমবয়সের বন্ধু থাকতাম। আমরা আটজন রোজ সকালে অর্ধমাইল পথ হেঁটে হাট পেরিয়ে পাঠশালায় যেতাম। দুপুরে খাওয়ার আগে ফিরে আসতাম খিদে পেত বলে। তারপর বিকেল অবধি মায়ের শাসনে ঘুম। ঘুম ভাঙলেই বাতাবি লেবু নিয়ে ফুটবল খেলা। আমাদের সেই খেলার মাঠ যা পাখিদের দখলে চলে যেত ভোরে ও সন্ধ্যায়। কতরকমের পাখি এবং তাদের বিচিত্র ডাক এত প্রবল হয়ে যেত যে কান ঝালাপালা হয়ে যেত।

বাড়ির পিছনে খানিকটা জঙ্গল মত জায়গা পার হলেই ছিল এক স্বপ্নের নদী। চওড়ায় খুব বেশি হলে চল্লিশ কি পঁয়তাল্লিশ ফুট। সবচেয়ে বেশি গভীরতা সাড়ে তিনফুটের বেশি নয়। স্রোত এত তীব্র যে সাড়ে তিনফুট জল পার হয়ে যেতে হিমসিম খেতে হয়। দূরের চা-বাগানের মাটি ফুঁড়ে যে জল উঠে আসছে তা অন্য ঝরণাদের সঙ্গে মিশে এই জলের ধারা তৈরি করেছে। এই জল দুপাশের চায়ের কারখানায় মেশিনে বিদ্যুৎ তৈরি করে আলোকিত করছে ওই চত্বর।

আমরা আটজন পাঁচ বয়সী সবে বালক হওয়া ছেলে ওই নদীর খুব ভাল বন্ধু ছিলাম। নদীর গায়ে কাপড় কাচার জন্য যে পাথরের চাঁই ছিল সেটা কোনোমতে সরালেই কাঁকড়া আর চিংড়িদের দেখা পেতাম। আচমকা মাথার ওপর থেকে আড়াল সরে গেলে তারা হকচকিয়ে যেত। আমরা খপ করে তাদের জল থেকে তুলে নিয়ে এসে চটের ঝোলায় ভরতাম। স্রোতে সাঁতার কাটা মাছগুলোকে ধরা আমাদের সাধ্যের বাইরে ছিল।

কিন্তু বছরে একটা দিন আসত যেদিন আমরা জেনে যেতাম আজ বিকালে ওই নদী বন্ধ করা হবে। আগামী সকাল পর্যন্ত নদী থাকবে শুকনো। তারপর আবার জল ছাড়া হলে কিছুক্ষণ পরে নদী জলে টলমল করবে।

বিকেল হতেই আমরা চলে যেতাম নদীর পাড়ে। চোখের সামনে ধীরে ধীরে আলো নেভার মত নদীর জল কমে আসত, নীচের বালি দেখা যেত। আমরা নেমে পড়তাম, শুধু আমরা নয়, ওপাশের শ্রমিক বাড়ির থেকে ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ জল-চলে-যাওয়া নদীর বুকে লাফানো মাছ, যে যেমন পারে ধরতে নেমে পড়তাম। সন্ধে নামলেই নদীর বুকে শত শত লণ্ঠন, মোমবাতি জ্বলে উঠত। নুড়ি পাথরের ওপরে লাফানো মাছেদের ধরা হয়ে গেলে পাথর বালির নিচে লুকিয়ে থাকা জলের প্রাণীদের খোঁজা শুরু হয়ে যেত।

বাড়ি থেকে ডাক আসতো আমাদের। খুব মন খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু আমরা নদী থেকে উঠে আসতে বাধ্য হতাম। যে যার বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখতাম আমাদের এক একজন কাজের লোক বালতি নিয়ে শুকনো নদীর দিকে যাচ্ছে বালির নীচ থেকে মাছ ধরে আনতে। তখন আমাদের যাওয়ার অনুমতি থাকতো না। পরের দিন সকালে আমরা জমা হতাম জল-হীন নদীর পাড়ে। যতটা দেখা যায়, তাতে বুঝতে অসুবিধা হোত না যে গতরাতে লোকজন বালি-নুড়ি তছনছ করে মাছ কাঁকড়া খুঁজেছে। যে নদীর বুককে সারা বছর জলের আড়ালে দেখে আসতে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম, তার এমন বিশ্রী চেহারা আমাদের মোটেই ভাল লাগত না। আমরা ফিরে এসেছিলাম বাড়ির সামনের মাঠে। আমাদের প্রত্যেকেরই মনখারাপ হয়ে গিয়েছে। যেভাবে নদীর সব চিংড়ি, কাঁকড়া, পুঁটিমাছ তুলে নেওয়া হল, তাতে আর নতুন করে ওদের নদীর জলে দেখা যাবে তো? খোকন সান্ত্বনার সুরে বলল, বাবা মাকে বলছিল, ' সারা বছর নদীতে যত আবর্জনা জমেছিল তা জল বন্ধ করে পরিষ্কার করা হয়। পরিষ্কার জলে ফ্যাক্টরির বিদ্যুৎ উৎপাদনে সুবিধা হবে।'
কথাগুলো যতই সত্য হোক, আমাদের ভাল লাগল না।

বিকেল হতে না হতেই খোকনের চিৎকার কানে এল, 'তাড়াতাড়ি আয়, নদীতে জল আসছে।' চোঁ চোঁ দৌড়ে আমরা আটজন পৌঁছে গেলাম নদীর পাড়ে। অবাক হয়ে দেখলাম, ওপাশ থেকে শুকনো নুড়ি-বালির ওপর দিয়ে গড়াতে গড়াতে জলের ঢেউ যখন নিচের দিকে চলে গেল তখন নদীর এপাড়-ওপাড় জলে টলমল করছে। খানিক বাদে জলের রঙ বদলাতে শুরু করল। ধীরে ধীরে  জলের ঢেউ বাড়তে লাগল। ঘোলাভাবটা কাটতে লাগল।


আমাদের আটজনের একজন বন্ধু ছিল হ্যাফপ্যান্ট আর ছেঁড়া গেঞ্জি পরে সে লাঠি হাতে দূরের কুলি লাইন থেকে বেরিয়ে রাস্তার একটা ধার দিয়ে হেঁটে আমাদের খেলার মাঠ ছাড়িয়ে বাজারের দিকে চলে যেত। ওর নাম ছিল মাংরা। দুটো চোখেই কোনো দৃষ্টিশক্তি ছিল না। অথচ হাঁটতে হাঁটতে খেলার মাঠের পাশের রাস্তায় পৌঁছেই সে দাঁড়িয়ে যেত। মুখ ঘুরিয়ে শব্দ শোনার চেষ্টা করত। আমাদের কেউ ওকে দেখে এগিয়ে গেলে হলদে দাঁত বের করে হাসতো। আমরা ওকে ঘিরে ধরতাম, কথা বলতাম আমরাই, প্রশ্নের পর প্রশ্ন, সে হাসতো, কথা বলতো না। অথবা জানি ও যাচ্ছে বাজারের মিষ্টির দোকানে। সেখানে আধঘন্টা বসে অপেক্ষা পর দোকানদার যদি একটা মিষ্টি খেতে দেয়, তাই খেয়ে লাঠি দিয়ে পথ মেপে ফিরে আসতো। ওকে আমরা লজেন্স দিতাম। কোনো কোনোদিন ও পকেট থেকে পেয়ারা বের করে আমাদের সামনে তুলে ধরত। যেহেতু দৃষ্টিহীন, রোজগার করার কোনো ক্ষমতা থাকার কথা নয়, ভাইদের দয়ায় সে বেঁচে আছে কিন্তু হাসিতে আমরা তার কোনো প্রভাব দেখতাম না। মিনিট খানেক আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে ও লাঠি আর পা দিয়ে রাস্তা মাপতে মাপতে চলে যেত বাজারের দিকে। খোকন একবার বলেছিল, 'মাংরার মনে খুব জোর। এতটা রাস্তা হেঁটে রোজ মিষ্টি খেতে যায়। আমি অন্ধ হলে বাড়ির বাইরে যেতে সাহসই পেতাম না।' আশ্চর্য ব্যাপার, আমাদের আটজনের কথা মাংরা জানতো। প্রত্যেকের কণ্ঠস্বর ওর চেনা ছিল। কোনোদিন আমাদের কেউ না এলে কথা শুনতে শুনতে ওর কপালে ভাঁজ পড়ত, ঠোঁট ছুঁচালো হোত। এবং শেষ পর্যন্ত যার গলা শুনতে পাচ্ছে না তার নাম ধরে বলতো, 'বিশু, বিশু আজ আসেনি? কি হয়েছে বিশুর?'

শুনে আমাদের খুব ভাল লাগতো। কিন্তু একটা ব্যাপার আমাদের খুব অবাক করত। আমাদের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও সে হাইওয়ের পাশ থেকে নেমে খেলার মাঠ তো দূরের কথা বাড়ির বারান্দায় আসতে চাইতো না।


এলো পনেরই আগষ্ট। পাঠশালার মাঠে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জমায়েত হবে সকাল আটটায়। কদিন ধরে মাস্টারমশাই আমাদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দুটো গান গাইতে শিখিয়েছেন। যার প্রথমটা খুব বড় হলেও আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। 'ধনধান্যপুষ্পভরা', দ্বিতীয়টি, 'জনগণমন অধিনায়ক'। ওই ছোট্ট জনপদে তখন কি উত্তেজনা। ভারতবর্ষ স্বাধীন হচ্ছে, ইংরেজরা ভারত ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে, আমরা এখন স্বাধীন।


এখনও দৃশ্যটা উত্তেজনা তৈরি  করে। আমরা আটজন বালক যার যার কোয়াটার্সে সারারাত উত্তেজনায় ভালো ভাবে ঘুমাতে পারিনি। আলো ফোটার আগেই সাদা শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরে যে যার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। গতকাল স্কুল থেকে যে জাতীয় পতাকা আমাদের দেওয়া হয়েছিল তা মাথার উপর তুলে ধরে দৌড়াতে লাগলাম। মুখে 'বন্দেমাতরম' ধ্বনি। রাস্তার দুপাশের গাছে গাছে সবে ঘুম থেকে ওঠা পাখিরা চেঁচামেচি শুরু করে দিল সেই ধ্বনি শুনে। আমরা নির্জন পিচের রাস্তা ধরে ছুটে যাচ্ছি স্লোগান দিতে দিতে। পাঠশালার মাঠে আজ অনেক ভিড়। শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, অভিভাবকরাও চলে এসেছেন।জাতীয় পতাকা একটা লম্বা খুঁটিতে বেঁধে দড়িতে ঝুলিয়ে নামিয়ে রাখা আছে। কেউ একজন গান ধরল, 'ধনধান্যপুষ্পভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা' সঙ্গে সঙ্গে গলায় গলায় ছড়িয়ে গেল সেই গান। তখন সবে সূর্য উঠবে উঠবে করছে।


মনের গায়ে গেঁথে থাকা ওই দৃশ্যগুলো চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই। আমার সেই সাতবন্ধু আজ কে কোথায় জানি না, আছে কিনা তাও জানি না; কিন্তু ভাবলেই ওরা চলে আসে। চলে আসে মাংরা, চলে আসে সাড়ে তিনফুট গভীর সেই জলের ধারা।

আমার বেঁচে থাকার সম্পদ।

ক্লিক করে পড়ুন। পি সি সরকার জুনিয়রের সাক্ষাৎকার। 👇

Post a Comment

1 Comments