জ্বলদর্চি

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী/পঞ্চদশ পর্ব/ দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী               
পঞ্চদশ পর্ব         
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী


তানসেনের অচৈতন্য দগ্ধ শরীর ও অচৈতন্য সরস্বতীকে বাঁদীরা শিবিকায় তুলে হাভেলিতে নিয়ে চলে গেলে সম্রাটের নির্দেশে অনতিবিলম্বে হেকিম এসে তানসেনের শরীরের অগ্নিদগ্ধ স্থানগুলি নরম কাপড়ের সাহায্যে পরিষ্কার করে জড়িবুটি ও আরক মিশ্রিত মলম পুরো করে লাগিয়ে দিয়ে খাবার জন্য দাওয়াই দিয়ে গেলেন। আর সরস্বতীকে দেখে বললেন "অগ্নির উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে এবং তার পিতাকে অগ্নিদগ্ধ দেখে ভয় পেয়ে সে অচৈতন্য হয়ে গিয়েছিল। এরজন্য কোন চিন্তা করার কারণ নেই"। কিছুক্ষণ পরে তার চোখে মুখে ক্রমাগত জলের ঝাপটা দিতে সে চেতনা ফিরে পেল।                           

তানসেনের এই দিনের অনুষ্ঠান দেখে সমগ্র দিল্লিবাসীরা যেমন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে তাদের মনে একরাশ উৎকণ্ঠাও বাসা বেঁধেছে কারণ তাদের প্রিয় সংগীতসম্রাট যে অগ্নিদগ্ধ হয়ে গেছেন। "তিনি বাঁচবেন তো?" এই প্রশ্ন সকলের মুখে। মুসলমানেরা মসজিদে যেয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া মাগছেন আর হিন্দুরা মন্দিরে যেয়ে প্রার্থনা জানাচ্ছেন যেন তাদের প্রিয় সঙ্গীতসাধক দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন।    

প্রায় প্রতিদিনই একবার করে বীরবল, বাজবাহাদুর, আবুল ফজল এসে তানসেনকে দেখে যাচ্ছেন। দিন সাতেক পরে যখন তানসেন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন তখন তারা জানালেন মিঞা খোদাবক্স ও তার সঙ্গীদের সম্রাট সভা গায়কের পদ থেকে অপসারিত করেছেন এবং তাদেরকে দেওয়া জায়গীর কেড়ে নিয়েছেন। সম্রাটের নির্দেশে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে পরোক্ষভাবে হত্যার দায়ে কোতোয়াল তাদের সকলকেই কয়েদখানায় অন্তরীন করে রেখেছেন।                                         

রুদ্রবীণার ঝঙ্কার 
ইতিমধ্যে তানসেনের কাছে দরবারের প্রধান আধিকারিক সংবাদ পাঠিয়েছেন যে আগামীকাল দরবারে আসার পূর্বে সম্রাট আপনাকে দেখতে যাবেন। সম্রাটের আগমন হেতু কক্ষের পুরাতন গালিচা পরিবর্তন করে নতুন গালিচা পাতা হয়েছে। চন্দন কাঠের তৈরী দুটি সুদৃশ্য নতুন কুর্শিতে মখমলের গদি লাগিয়ে কক্ষের অভ্যন্তরে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বীণাযন্ত্রগুলি পুনরায় পরিষ্কার করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু বীণাযন্ত্রগুলির দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলেন রুদ্রবীণাটি সেখানে নেই। তিনি মনে মনে ভাবলেন হয়তো সেই দিনের অনুষ্ঠানের পরে সেটি নষ্ট হয়ে গেছে অথবা হারিয়ে গেছে। যাইহোক পরে সেটি খুঁজে রাখার কথা বলবেন বা সেটি কি হয়েছে জানার চেষ্টা করবেন। কক্ষের অভ্যন্তরভাগ গোলাপ ও কেওড়ার নির্যাসে ভরপুর, সুগন্ধে আমোদিত। ইতিমধ্যে বাজনার আওয়াজে তানসেন বুঝতে পারলেন সম্রাট তাঁর হাভেলীর দিকে আসছেন। তিনি শয়নকক্ষ থেকে ধীর পদক্ষেপে সংগীত কক্ষের দ্বারে এসে দাঁড়ালেন সম্রাটকে স্বাগত জানাতে। কন্যা সরস্বতী সম্রাটকে হাভেলির প্রধানদ্বার থেকে সঙ্গীতকক্ষে নিয়ে এলো। সম্রাটকে দেখে তানসেন দুর্বল শরীরে তাকে কুর্ণিশ করে ভেতরে নিয়ে গিয়ে মখমল আচ্ছাদিত চন্দন কাঠের কুরশিতে বসার অনুরোধ জানালেন। সম্রাট বসার পরে তাঁর পাশের কুরশিতে তানসেনকে বসার ইঙ্গিত করলেন। তানসেন কুরশিতে বসার পরে বললেন "আজ আমার কি সৌভাগ্য যে ভারত সম্রাট তাঁর অধীনস্থ সামান্য এক দীনের কুটিরে পদার্পণ করেছেন"। তাঁর কথা শুনে সম্রাট বললেন "আপনি সামান্য তো নন, অসামান্য বললেও ভুল হবে। আপনি খোদাতালার এক অনন্য সৃষ্টি। আমার সৌভাগ্য যে আপনার মত একজন গুনীমানুষকে পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। সংগীতের মাধ্যমে খোদাতালার সৃষ্টি প্রকৃতিতেও যে পরিবর্তন সম্ভব সেদিন আপনার কন্ঠে দীপক রাগ শুনে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পেরেছি। আপনি খোদাতালার উপরেও খোদকারি করেছেন। আপনাকে কি বলে যে আমি ধন্যবাদ জানাবো ভেবে পাচ্ছি না"। এই বলে তিনি আসন ছেড়ে উঠে তানসেনের আসনের কাছে এসে তাঁর গলা থেকে গজমতির মালা খুলে তানসেনের কন্ঠে পরিয়ে দিয়ে বললেন "আমার তরফ থেকে আপনার জন্য সামান্য এই উপহার। আপনার জন্য যদি কিছু করতে পারি তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করব"। সম্রাটের কথা শুনে তানসেন কৃতজ্ঞচিত্তে বললেন "জাহাঁপনা আমার নিজের কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই। গুরু হরিদাস স্বামী ও ঘাউস মহম্মদের শিক্ষায় আমার এই সঙ্গীতবিদ্যা। তাঁদের আদর্শে আমার জীবনের পথ চলা। আপনার কাছে আমার একটি মাত্র আরজি আছে যদি অভয় দেন তাহলে বলি"। সম্রাট বললেন "আপনি নির্ভয়ে বলুন আপনার কি আরজি। আমি নিশ্চয়ই তা পূরণ করব"।   

সম্রাটের অভয় বাণী পেয়ে তানসেন বললেন "জাহাঁপনা, সেদিনের অনুষ্ঠান শেষে যে মেয়েটি আমাদের সকলের জীবন বাঁচিয়েছিল সেই রূপোয়াতী আমার হাভেলীতে থাকে। হরিদাস স্বামীর আশ্রমে আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন এই নিরাশ্রয়া যুবতীর নিরাপত্তার জন্য হরিদাস স্বামী আমাদের সাথে একে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং আমাকে অনুরোধ করেছিলেন মেয়েটিকে নিরাপদে আশ্রয় দিতে। সঙ্গীতের প্রতি মেয়েটির অপূর্ব নিষ্ঠা ও একাগ্রতা। সরস্বতীকে আমি যে যে রাগের তালিম দিয়েছি সেগুলি শুনে সে সেই সমস্ত রাগে ব্যুৎপত্তি লাভ করেছে। সরস্বতীকে আমি মেঘমল্লার রাগের যে তালিম দিয়েছিলাম সেই রাগ শুনে আয়ত্ত করে সেদিন আমাদের জীবন রক্ষা করেছে। এক্ষনে সংবাদ পেয়েছি চিতোরের পদচ্যুত রানা প্রতাপ সিংহ সম্পর্কে তার মাতুল। মেয়েটিকে যদি কোনভাবে ঝালোয়ার দুর্গে রানা প্রতাপের হাতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতে পারেন তাহলে আমি হরিদাস স্বামীর কাছে ঋণ থেকে মুক্ত হব এবং আপনার কাছেও চির কৃতজ্ঞ থাকবো"। 

তানসেনের এই কথা শুনে সম্রাটের মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠলো। কিন্তু তানসেনকে দেওয়া তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করে তিনি বললেন "রানা প্রতাপ আমার ঘোরতর শত্রু। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে আমি ঝালোয়ার দুর্গ আক্রমণ করব। কিন্তু তার পূর্বে আমি আপনার আশ্রিতা রূপোয়াতীকে রানা প্রতাপের হাতে নিরাপদে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করব"। এই কথা বলে তানসেনের সত্বর আরোগ্য লাভের কামনা করে তিনি কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। 
                                                                   ক্রমশঃ


পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments