জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ /পর্ব -২৯ /বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা অ্যাভিনিউ
পর্ব -২৯

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


বাংলাদেশের সাতের দশকের অন্যতম সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কবি ও অধ্যাপক মাহমুদ কামাল। তাঁর কবিতার সঙ্গে পরিচয় সেই কবে থেকে। শুধু কবিতা নয় তাঁর মননশীল প্রবন্ধও সমৃদ্ধ করেছে বাংলা সাহিত্যের প্রবাহকে।তিনি স্রোতের কবি নন। গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে কাব্যচিন্তার নিজস্ব প্রকরণ তৈরি করেছেন রচনা করেছেন আলাদা এক নির্মাণবিশ্ব।গ্রামবাংলার প্রতিদিনের চেনা দৃশ্য যা আমাদের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত তারই অন্তর্ভেদী জীবনঘনিষ্ঠ রূপ এবং গ্রামীণ নিসর্গের বিস্তার দেখা যায় তাঁর কবিতার রেখাচিত্রে।নিভৃতমনস্ক কবি তাঁর সাহিত্যজীবনের সূচনালগ্নেই রাজধানীর চিৎকার ও সাড়ম্বর প্রদর্শনী থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। এমনকি প্রতিষ্ঠিত কবি হিসেবে দেশে বিদেশে সম্মানিত হওয়ার পরও কেন্দ্রের প্রতি বিন্দুমাত্র মোহ তাঁকে আচ্ছন্ন করেনি। বরং  নিজের দৃষ্টিকে আরও গভীরভাবে নিবদ্ধ করেছেন বাঙলার নদী মাঠ দিগন্তের দিকে এবং অনুভব করেছেন ‘মানুষই তো প্রকৃত উদ্ভিদ’। ফলে জীবন প্রদায়িনী সেই শেকড়ের কাছে, মাটির কাছে, প্রেম ও প্রকৃতির কাছে নিবেদন করেছেন নিজের সম্পুর্ণ সত্তাকে।     

১৯৫৭ সালের ২৩ অক্টোবর কবির জন্ম বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার আকুরটাকুর এলাকায়। মাহমুদ কামালের বর্ণময় জীবন এবং সাহিত্যের বহুমুখী দিগন্ত  তাঁকে গ্রহণীয় করে তুলেছে অগণন পাঠকের কাছে।বিচিত্র বিষয় এবং জীবনের নানাবিধ পরিসরের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে সৃজনশীলতার ক্ষেত্রকে ব্যপ্ত ও প্রসারিত করেছেন।   

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
বাংলাদেশে ছয়ের দশকের উত্তাল অস্থির পরিস্থিতি।এই অগ্নিবর্ণ সময়ের উপর দিয়ে হেঁটে এসেছে তাঁর শৈশব-কৈশোরের দিনগুলি।চেতনে অবচেতনে ইতিহাসের এই বাঁক তাঁকে কবিতার এমন এক পথে নিয়ে এসেছে তাঁর অন্তরে বুনে দিয়েছে এমনই এক চিন্তাবীজ  যা সত্তরের দশকে মুক্তির মন্ত্রে কবির জীবন ও ভাবনাকে নিয়ে গেছে ভিন্ন এক পথে।বাস্তবের শ্বাসরোধী জীবন এবং স্বপ্নের উদ্দীপনা কবিতাকে দিয়েছে নতুন মোড়। তবু তাঁর কবিতায় তা সোচ্চার ভাবে ঘোষিত হয়নি। শিল্পময় আবেষ্টনীর ভেতর সেই নিরুচ্চারিত স্বরের স্পর্ধা আমাদের স্তব্ধ ও নির্বাক করে দেয়। 

"একটি শিশির বিন্দু উপুড় হওয়া নদীটাকে প্রশ্ন করে

হে নদীমাতৃক দেশে জননী আমার               

তুমি কি কাঁদছো?

এই প্রশ্নে নদীর কান্নার ধ্বনি

দ্রুত বেড়ে ওঠে

না- কোনও স্রোতধ্বনি নয়, প্রবহমানতা নয়

আনন্দ শীৎকার নয়

নদীটি কাঁদছে খুব পড়ন্ত বিকেলে

তার বুকে জল নেই কেন?’ (উপুড় হওয়া নদী, নির্বাচিত কবিতা )

সমকালীন সমাজ ও প্রেক্ষিত থেকে চিরায়ত দৃশ্যের ভেতর এভাবেই জন্ম নেয় সার্থক কবিতা। টাঙ্গাইলের নদ- নদী,মাটি ও উদ্ভিদ পরিচিত দৃশ্য নিয়ে হাজির হয়।কবিতার অন্তকরণে বেজে ওঠে অন্য এক সুর। বাংলার চিরন্তন নিসর্গ এবং প্রকৃতির চিত্রভাস্কর্যে লেপ্টে থাকে কবির দেশচেতনার গভীরতা।বাংলাদেশের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অবিভাজ্য অংশ ছাড়া একে আর কোন অভিধায় চিহ্নিত করা যেতে পারে! মাহমুদ কামালের কবিতায় নৈসর্গিক প্রাচুর্য, জীবনের সাথে নিসর্গের মেলবন্ধন এবং নদীমাতৃক বাংলার মাতৃত্বের রূপ রঙ গন্ধ চিত্রিত হয়েছে নান্দনিক ভাব সম্ভারে। 

একদিকে নিসর্গ অন্যদিকে সমাজের নানা ঘাত-প্রতিঘাত,সময় ও জীবনের সহবাস বহুমাত্রিক উপাদাসমূহে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপতিত, শিল্পের প্রেক্ষাপটে এক শাশ্বত বৈচিত্র্যে সংস্থিতি পেয়েছে। যে-কারণে তাঁর প্রকৃতির কবিতা আমাদের কাছে অভিনব জীবন জাগৃতির কবিতা। 

"অনতিক্রান্ত বৃত্তের ঘুরপাকে

মেধা ও মনন পাশ ফিরে শুয়ে থাকে

সময়ের কাছে নতজানু যত মেধা

পরিপূরকের বিপরীতে হয় নীল

একজীবনের হালখাতা খুলে দেখে দ্বৈরথে শুধু চিৎকার-চেঁচামেচি।"

( সময়ের কাছে নতজানু যত মেধা )

১৯৮৫ সালে আটাশ বছর বয়সে পরকীয়া কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে কবির আত্মপ্রকাশ। যাব না তবু যাই ( ২০২০)  তাঁর সাম্প্রতিক প্রকাশিত কবিতার বই। এই ৩৫ বছরের পথ সমৃদ্ধ হয়ে আছে তাঁর সৃষ্টির উজ্জ্বল দিকচিহ্নে। কবিতার মতো কিছু কথা(১৯৮৭), শব্দেরা কখনো মানতে চায় না ছন্দাছন্দ ( ১৯৯০) স্বপ্নের রাজকন্যা ( ১৯৯৮), বিরামচিহ্ন (১৯৯৯), দ্বিতীয় জীবন ( ২০০১) , বিকেলের সকল চড়ুই ( ২০০৩)  বালক বয়সে (২০০৪), মেঘেরা কোথায় যায় ( ২০০৫) , মুহূর্তের কবিতা( ২০০৬),কাব্যসমগ্র ( ২০০৮), বাকি টুকু অদ্ভুত আধার(  ২০১০,  মুখোশের ভেতরে মুখোশ ( ২০১২), বদলে যায় পথের প্রকৃতি ( ২০১৪) নির্বাচিত কবিতা(২০১৫), আসে যায় মাঝখানে সামান্য সময়( ২০১৭) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি গল্প এবং উপন্যাসেও তিনি সমানভাবে মেলে দিয়েছেন নিজেকে। গৃহপরিচারিকার গৃহভৃত্য (১৯৯১),এলাচিপুরের সেই লোক (২০১৪) , নির্বাচিত গল্প( ২০১৯) গল্পগ্রন্থের মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন কথাভূবন।একমাত্র উপন্যাস স্বপ্নবৃত্তান্ত অথবা জীবনের লক্ষ্য ( ২০০৭) ।প্রবন্ধে চলমান রাজনীতির কথা যেমন এসেছে এসেছে মুক্ত চিন্তার কথা যেমন এসেছে তার সমান্তরালভাবে এসেছে কবিতার নানা বিভঙ্গ ও গদ্যের নানাবিধ স্তর। সম্পাদনা করেছেন অজস্র মূল্যবান গ্রন্থসম্ভার যা বাংলা সাহিত্যের দুনিয়াকে নতুনভাবে চিনতে সাহায্য করেছে।গদ্য ও পদ্যের সম্পন্ন পৃথিবীতে তিনি আপাদমস্তক একজন মগ্ন কবি। রোম্যান্টিক মহার্ঘ মানসিকতার কবি। সৌন্দর্যময়তা বহুকৌণিক বিচ্ছুরণসহ সুসংহত উপলব্ধিতে প্রতিবিম্বিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। চির রহস্যময় প্রেম  আশ্চর্য মহিমা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে শিল্পের প্রচ্ছায়ায়। কখনও  শরীরের ত্রিমাত্রিক অবস্থানের সুগভীর আবহে আবার কখনও বহুমাত্রিক বিস্তারে প্রেম ছড়িয়ে পড়েছে অসীম আধারের দিকে। প্রেমের রহস্য, যন্ত্রণা, আকুলতা, এবং শরীরের  আধারে তার শিল্পময় শিহরণ জীবন্ত রূপ পেয়েছে মাহমুদ কামালের কবিতায়। যৌনতা বাদ দিয়ে প্রেমের অলীক কল্পনায় গা ভাসিয়ে দেননি কবি। প্রেম তাঁর কাছে এসেছে রক্তমাংসের চেহারা নিয়ে, রূপমুগ্ধ দৈহিক সম্মোহন নিয়ে, শারীরিক আশ্লেষের মাধুর্য নিয়ে।  শিল্পোত্তীর্ণ যৌনতা কবির নন্দিত উচ্চারণে এবং হৃদয়ের উষ্ণতায় জারিত হয়ে নিখুঁত রঙ ও রেখায় প্রতিভাত হয়েছে।    


নারী তুমি পাঠ্য হয়ে প্রশংসিত গ্রন্থের মতোই

চলে এলে ঋজু দেহে নিস্তরঙ্গ এই সংসারে

সংসারে এসেই নারী অঞ্চল প্রভাবে তুমি কুসুম ভাঙার গান

গেয়ে উঠে কুমারীর ঘ্রাণটুকু ছড়াতে ছড়াতে

প্রথম পাঠ্যেই প্রিয় অপাঠ্য অদ্রাব্য হলে অকাল কুসুম ( অকাল কুসুম)


শরীরের আড়াল থেকে উঁকি দেয় শশীকলা ,চাঁদ

এটা কোন ভান নয় প্রাকৃতিক শরীর সংবাদ

দুই হাত উঁচু করে যখন মুকুর

সবুজাভ নারী সহ চমকে ওঠে যুবতী পুকুর ( যুবতী পুকুর)


শাণিত বৃশ্চিক তুমি বৃতি ভেঙে কতদূর নেবে

বহিরাবরণ খুলে নিতে চাও তাই হোক তবে

বিপরীত বসুমতী দিনরাত করুক বর্ষণ

এইবার সবকিছু ভুলে গিয়ে বিরোধী বোতাম

খুলে দেবো সুগঠিত ফিটফাট বনানী বদ্বীপ

বিষুবরেখায় যদি বাড়ি ঘর জীবন সংসার

সুচারু ব্যজন তাই বয়ে যাক পাতাল প্রদোষে

দলিত মথিত করো ফেনায়িত সকল সন্তাপ ( পরকীয়া)


লুকিয়ে রেখেছো মেয়ে সৌন্দর্যের দ্যুতিময় বৃতি

অপরোক্ষ ফ্রেমের ভেতর জীবনের নানা সোনাদানা

সৌন্দর্য প্রেমিক খুশি উঁকি দেয়া চাঁদের প্রচ্ছদে ( মুহুর্তের কবিতা)


আমি ফিরে পেতে চাই স্বর্ণগ্রাম, কাঁখের কলস

ফিরে পেতে চাই আজ উপর্যুক্ত সকল অতীত

পাখির কাকলিসহ সবুজাভ ফিরে পেতে চাই ( বিকেলের সকল চড়ুই)


আঁধারে ধাঁধার মাঝে

শিখা টলোমলো

ফুরিয়ে যেও না মোম

 আরোও কিছু জ্বলো ( মোম/ দ্বিতীয় জীবন)


ছাদের রেলিঙে শাড়ি শুয়ে আছে

রেলিঙ কি গর্ভবতী হল ? ( কবিতার মতো কিছু কথা)


যুবতী নদীর টানে বিকেলও হয়ে ওঠে রোদ্দুর যুবক ( কবিতার মতো কিছু কথা )


 গোপনে সারিয়ে ফেলি ক্ষত

আমি তাই প্রকাশ্যে অক্ষত!

 মুখোশের আড়ালে লোকটির মুখ

সাবধান ভূষণের মাঝে পাড়ি দিচ্ছে  পেছন-সম্মুখ

পরিস্ফুটনে ঐ লোকটিই আমি

প্রকাশিত আপোষকামী

দ্রুতবেগে ধরে ফেলি সুতো

যদি হয় প্রচল প্রসূত

এটা কোন গল্প নয় সত্যিও নয়

মুখোশের ভেতরে নির্ণয়

খেলা করে আনন্দ শীৎকার

আসলে চিৎকার

 

শরীরে ময়লা জমে দাগ গোপনীয়

প্লাবিত জ্যোৎস্নার কথা তাদের শুনিয়ো

গোপনে সারিয়ে ফেলি যাবতীয় ক্ষত

আমি তাই  প্রতিদিন প্রকাশ্যে অক্ষত! (প্রকাশ্যে অক্ষত)  ( চলবে)

Post a Comment

0 Comments