জ্বলদর্চি

প্লিজ,একটু শুনবেন? /সন্দীপ দত্ত

গল্প
প্লিজ,একটু শুনবেন?
সন্দীপ দত্ত 


"কাদাজলে নেমে আপনাকে কিছুটা পথ হাঁটতে হতে পারে দাদা। পারবেন তো?" বলে আনন্দ প্লাস'য়ের পাতায় আলো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ধনগ্ন সুন্দরী অভিনেত্রীর চিকন ঊরুর দিকে লালসায় ভেজা দৃষ্টি নিয়ে পলকহীন তাকাল তারক।
"কতটা পথ?" জিজ্ঞেস করলেন কৃষ্ণকিশোর। পার্টিঅফিসের এসিটা ঘন্টাখানেক আগে বিকল হয়ে গেছে। মিস্ত্রীকে খবর দেওয়া হয়েছে তক্ষুণি। এখনও আসেনি। তবে এসে যাবে। এলে একবার চোখ রাঙাবে তারক। মন্ত্রীমশাইয়ের ঘামের দাম ওরা জানে? খেসারত দিতে পারবে কৃষ্ণকিশোর কামিল‍্যার ক্লান্তির? ফোনটা ওর বউ ধরেছিল। বলল,"অংশু ল‍্যাট্রিনে। স্টুল করছে।" পার্টিঅফিসের এটা ওটা সারাই করে বলে বউটার খুব অহংকার। কথায় কথায় ইংরেজি বলতে চেষ্টা করে। আসুক আজ অংশু,একটা না দাবড়ালে ও সোজা হবে না। কী খেয়েছিল কাল? হাতি? পায়খানা করতে এতক্ষণ লাগে? একঘন্টা?
         পকেট থেকে রুমাল বের করলেন কৃষ্ণকিশোর। কপালের ঘাম মুছে বললেন,"কতটা পথ?"
"তা ধরুন,প্রায় দু'কিলোমিটার।"তারক বলে।
"সেকি! এতটা পথ? আমি পারব?"
"ওইজন‍্যই তো বলছি দাদা,যাওয়ার দরকার নেই। কী দরকার বলুন তো শুকনো বিপদ বাড়ানোর? অমন রাস্তায় হেঁটে শেষে এই বয়েসে পা'টা ভাঙুক আর কী! যা খানাখন্দ! আপনি ভার্চুয়াল সভা করুন। কোভিডের সময় যেমন করেছিলেন।"
"নারে,সবসময় ভার্চুয়ালে হয় না। মানুষের কাছাকাছি পৌঁছতে হয়। এতে বিশ্বাস অটুট থাকে। আমাদের তো বিশ্বাসের ওপরই সব। মানুষগুলো যত বিশ্বাস করবে,তত ওদের বোকা বানানো সুবিধে। ও আমি ঠিক সামলে নেব তারক,তোরা অত ভাবিস না। আমার সাথে দেহরক্ষী থাকবে,তোরা সব থাকবি। পা একটু টলমল করলে ধরে নিতে পারবি না?"
"সে তো আমরা আপনার সঙ্গে সঙ্গেই থাকব। তবু......."
"ওখানে আমাদের নির্বাচনীসভাটা কবে যেন?" জিজ্ঞেস করলেন কৃষ্ণকিশোর।
"আগামী পরশু। বিকেল তিনটেয়। মানে আপনি বিকেল তিনটের সময় মঞ্চে উঠবেন। মিনিট কুড়ি পঁচিশ ভাষণ দিলেই হবে। তারপর আপনি আবার গাড়িতে উঠে যাবেন।"তারক বলে।
"ভাল কথা বলেছিস তারক। আমি তো খেয়ালই করিনি,আমার গাড়ি থাকবে। খানাখন্দে ভরা কাদাজলের ওই পথটা আমি যদি গাড়িতে যাই,তাহলেই তো সব সমস‍্যা মিটে যায়,তাই না?"
"সে যায়,তবে পাবলিককে বুঝতেই পারছেন। একবার ক্ষেপে গেলে......."
"ওসব ছাড়। অমন অলক্ষুণে কথা মুখে আনছিস কেন? যা হয় হবে। মানুষের কাছে পৌঁছনোটা এখন খুব জরুরি। প্রার্থী তো হোসনি। হলে বুঝতে পারতিস,একটা ভোটের কী মূল‍্য! গত ইলেকশনে গোবিন্দলালের পোষা ছাগলটা কী করল দেখলি না? কতগুলো ব‍্যালট পেপার পাতার মতো চিবিয়ে খেয়ে নিল বল্ তো? শালা,হজমও করে ফেলল তারপর। আশ্চর্য! আগের জন্মে ছাগল ছিল কিনা কে জানে!"
তারক হাসে। "ওটা ছাগল নয় দাদা। ও মানুষ। ওর নাম লাট্টু। গোবিন্দলালের ডান হাতের তর্জনী। আগে আইসক্রীম ফেরি করত ঘন্টা বাজিয়ে। গোবিন্দলালের সঙ্গে থেকে থেকে এখন আইসক্রীম ফ‍্যাক্টরির মালিক। শুধু তাই নয়,পেল্লাই বাড়ি তুলেছে একেবারে মেন রাস্তার ধারে। তিনতলা। কী তার ডিজাইন! যেন বলিউডের অভিনেতার বাংলো। আমি দেখিনি। কানে এসেছে।"
"ওই ছাগলটা কোথাকার যেন?"
আবার হাসে তারক। "কে? লাট্টু? ও তো কামারহাটিতে থাকে।"
"লাট্টু নয় তো,যেন লাটসাহেব! ছাগল একটা! অত তো করলি,পারলি জিততে? একেবারে ল‍্যাজেগোবরে গোহারা হেরে বড় বড় বাতেলা! ও ছাগলের শিং এবার ভেঙে দেব আমি। আর ওই গোবিন্দলালটাকেও দেখব,কত ওর হিম্মত হয়েছে! শালার এবার নাকটাই কেটে নেব আমি। দেখব,কেমন করে নিঃশ্বাস ফেলে!" রাগে ফোঁস ফোঁস করলেন কৃষ্ণকিশোর।
"অমন করে বলবেন না দাদা। গোবিন্দলালের দলটাই এখন দেশ চালাচ্ছে। আমরা সেই দেশটাতেই থাকি।" মিনমিন করে তারক।
🍂

"তো? হ‍্যাঁরে তারক,তোর মাথার স্ক্রুগুলো কি সব ঢিলে হয়ে গেছে? জন্মের মতো দেব টাইট করে? ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস নাকি? খবরদার! বুঝতে পারলে একেবারে সুট করে দেব! মাথামোটা কোথাকার! তুই কার চামচে রে তারক? গরু,থুড়ি আমার না ছাগলের? গোবিন্দলাল দেশ চালাতে পারে কিন্তু রাজ‍্য তো আমরা চালাই,সেটা খেয়াল কর্!" রেগেমেগে বললেন কৃষ্ণকিশোর।
"সে তো ঠিকই।" তারক বলে।
"তাহলে? একটু ভেবেচিন্তে কথা বল্! আমরা না থাকলে কোথায় থাকতিস তোরা? এই যে বসে বসে পেপারে মেয়েটার বুক দেখছিস আর জিভ চাটছিস,তোর ওই স্বপ্ন আমি সত‍্যি করিনি? আমাদের ভক্তি না করলে তোরা প্রসাদ পাবি কী করে?" কৃষ্ণকিশোর আড়চোখে মেয়েটার ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন।
         ঠিক তখনই ভেজানো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে কেউ যেন বলল,"প্লিজ,একটু শুনবেন?"
"কে রে শালা?" কৃষ্ণকিশোরের ধমক খেয়ে আবার রীতিমতো পুষ্ট হয়ে গেছে তারক। রগ ফুলিয়ে ও-ই জিজ্ঞেস করল।
"আমি অংশু। এসির মেকানিক।"
"ও চাঁদু তুমি? এসো। দেখি তোমার চাঁদবদন মুখখানা।" তারক বলে।
       দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে অংশু। ঢুকেই কৃষ্ণকিশোরের দিকে মুখ করে ভয়ে ভয়ে বলল,"সকাল থেকে প্রচুর আম পড়ছে স‍্যার। তাই একটু দেরি হল। হাত পা,কোমড়ে ব‍্যথা ধরে গেছে স‍্যার। তুলতে পারছি না। তাই দেরি হয়ে গেল।"
"আম পড়ছে! কোথায়? এটা তো আমের মরশুম নয়! এখন তো তালের মরশুম। তোদের কি বারোমেসে গাছ? তা অসময়ের আম,খেতে বোধহয় খুব মিষ্টি রে! আমার জন‍্য কিলোদুয়েক আনতে পারতিস।"
"না স‍্যার,ওই আমের কথা বলছি না। আজ আমার পেট থেকে আম পড়ছে। ল‍্যাট্রিন গিয়ে গিয়ে আর পারছি না। সকাল থেকে সাতবার হয়ে গেছে। তাই আসতে দেরি হল।" অংশু বলে। বলে তারকের দিকে তাকায়। "বেশিক্ষণ টাইম লাগবে না। এক্ষুণি সারিয়ে দিচ্ছি।" বলে যন্ত্রপাতি বের করে হাত চালিয়ে।
"মুখটা বন্ধ রেখে তাই করো বিশ্বকর্মা! নইলে এমন দেব,এখানেই আম পড়বে। শালা! জানিস,ঘেমেনেয়ে দাদা একেবারে চটি হয়ে যাচ্ছেন!"
সেকেন্ড কয়েক পর কৃষ্ণকিশোর তারকের কাছে জানতে চাইলেন,"চটি মানে কী রে,তারক?
তারক বলল,"চড়ুই। খুব ছোট্ট একটা পাখি। বর্ষার জলে হোক কিংবা গ্রীষ্মের ঘামে,ভিজে গেলে একেবারে এইটুকুনি হয়ে যায়।"

তারকের আশঙ্কাটাই সত‍্যি হল। দু'দিন পর নির্বাচনী প্রচারে ভাষণ রাখতে গিয়ে মঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছতেই পারলেন না কৃষ্ণকিশোর। রাস্তাতেই উন্মত্ত জনতা আটকে দিল গাড়ি। প্রায় দু'কিলোমিটার খানাখন্দে ভরা কাদাজলের পথে নামতে হল তাঁকে। পাবলিক তখন রাগে ফুঁসছে। জ‍্যান্ত,ছোট কয়েকটা মাছ সেই জলে ছেড়ে দিয়ে তারা চিৎকার করে বলছে,"ইচ্ছে করছে আপনার ঘাড় ধরে একবার চুবিয়ে দিই। এটা রাস্তা? মানুষ যাতায়াত করতে পারে এটা দিয়ে? ভোটের সময় ভিখারি সেজে ভোটটা তো নিয়ে নেন,প্রতিশ্রুতিগুলো রাখেন না কেন? আপনাদের জুতোপেটা করা উচিত। মাথা কামিয়ে ঘোল ঢেলে দেওয়া উচিত এমন নেতাদের। গরিবের টাকা নয়ছয় করতে খুব ওস্তাদ একেবারে,না?"
          জনতার ওই ভিড়ের মধ‍্যে থেকেই কেউ যেন বলল,"প্লিজ,একটু শুনবেন?"
           কৃষ্ণকিশোরকে ঘাড় ঘোরাতে দিল না তারক। ফিসফিস করে কানের কাছে বলল,"একদম নয়। সোজা এগিয়ে চলুন। গত ইলেকশনে প্রচারে এসে আপনি যার বাড়িতে বসে বিউলির ডাল আর আলুপোস্ত দিয়ে ভাত খেতে খেতে আন্তরিকতার অভিনয় করে বলেছিলেন,ঘরে বসে থাকা শিক্ষিত বেকার ছেলেটার নিশ্চিত করে দেবেন ভোটের ফলটা বেরোলেই।"
"কবেকার ঘটনা ওটা?" একেবারে গলা নামিয়ে বললেন কৃষ্ণকিশোর।
তারক বলে,"ওই যে বললাম,গত ইলেকশনে! পাঁচবছর হয়ে গেল দাদা।"

Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousJuly 24, 2023

    গল্পটা খুব ভালো লাগলো, বাস্তব প্রেক্ষাপটের উপর বেশ মজাদার।

    ReplyDelete